অনান পর্ব-০৬

0
287

#অনান
#পর্ব-৬

“ডাইনী, আমাকে বিধবা বানিয়ে তোর শান্তি হয়নি? কি চাস তুই? বাপটা মরলো আজ চারদিনও হয়নি এর মধ্যেই তুই নিজের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে গেছিস?”
মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে বিছানা ছাড়লো নীরা।ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে চিৎকার করছে ওদের মা। সামনেই মিরা আর রাতুল বসে আছে। ওর মায়ের পাশে দেখলো মোর্শেদকে। মায়ের হাত ধরে বারবার বলছে-
“বড়মা, চুপ করোনা। এভাবে চিৎকার করলে তোমার শরীর খারাপ হবে।”
“এই মেয়ে আমাদের মেরে ফেলার জন্যই এসেছে। দেখনা কেমন বেহায়ার মতো টাকা চাইছে?”
“কি অন্যায় বলেছি মা? এই বাড়িঘর সম্পদ এসবে আমার ভাগ আছে না? নিজের অংশ চাওয়া কি দোষের? নীরা তুইই বল, তোকে বাবা ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে না? তবে আমি চাইলে দোষ হবে কেন? আমাকে কি তারা জন্ম দেয়নি?”
মিরার কথা শুনে নীরা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। এসব কি বলছে মিরা? তাহলে কি এই কারনে বাড়িতে ফেরত এসেছে মিরা?
“মিরাপা, তুমি কিভাবে জানলে বড় আব্বু ঢাকায় বাড়ি কিনে দিয়েছে নীরাকে?”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মোর্শেদ। মিরার সাথে তো কারোরই যোগাযোগ নেই তবে এ খবর মিরার কানে গেলো কি করে?
“কে আবার বলবে? নীরার সাথে দেখা হয়েছিলো ঢাকায় তখন ওই তো বললো?”
মোর্শেদ আর নীরার মা দু’জনেই বিস্মিত হয়ে নীরার দিকে তাকালো। নীরা তখন ভয়ে কাঁপছে। মিরার সাথে দেখা হওয়ার কথা ও এতোদিন কাউকে বলেনি। মা উঠে নীরার সামনে দাঁড়ালো-
“তোদের দুবোন কে জন্ম দিয়ে কি পাপ করেছিলাম বলতো? একজন তোর বাপকে আধমরা করে রেখে গেছিলো আর এবার তুই তোর বাপকে পুরো মেরে ফেললি? তোকে কি মানা করা হয়নি যে, মিরার সাথে কোনো কথা বা যোগাযোগ রাখবি না? বোন তোর কাছে এতো প্রিয় হয়ে গেছিলো যে বাবার নিষেধ ও শুনিসনি? নিজের ঘরের কথা বোনকে বলেছিস? তোরা দু’জন মিলে আমাকে বৈধব্যের জীবন উপহার দিলি। তোদের জন্ম দেওয়ার বেশ ভালো ঋন শোধ করলি।”
“মা! বিশ্বাস করো আমি কিছুই জানি না। কিছুই করিনি আমি।”
মা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো নীরাকে।
“আজ থেকে জানবো আমার আর কোনো মেয়ে নেই। তুই চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে। ”
বলে মা নিজেই নিজের ঘরে যেয়ে খিল দিলেন। নীরা অসহায় চোখে একবার মিরাকে আর একবার মোর্শেদকে দেখলো। রাতুল উঠে গেলো নিজের রুমে। মোর্শেদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মিরাকে বললো-
“মিরাপা, খুব খারাপ একটা কাজ করেছো তুমি। বড় আব্বু ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছে ঠিকই কিন্তু সেটা কারো নামে নয়। সবার উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাট কিনেছে যাতে পরিবারের সবাই সেখানে যেয়ে থাকতে পারে। যদিও এতোসব কৈফিয়ত তোমাকে দেওয়াটা আমার জন্য ঠিক না তবুও বললাম। আর তুমি তো জানোই, এ বাড়ির সম্পদ মেয়েদের দেওয়ার নিয়ম নেই। আর তোমার জন্য তো এ বাড়িই হারাম তবুও তুমি কোন সাহসে এ বাড়িতে এলে সেটাই বুঝতে পারছি না। প্লিজ আর কোনো ঝামেলা না করে ফিরে যাও। আমি চাইনা এ বাড়িতে তুমি আর কোনো ঝামেলা করো। ব্যাপারটা বাবা চাচা অব্দি গেলে তোমার জন্য ভালো হবে না। ”
“ভয় দেখাবি না মোর্শেদ, আমি কিছুতেই নিজের হক না নিয়ে ফিরবো না।”
“হক! কিসের হক? তুমি কে এ বাড়ির? যেদিন বাড়ি ছেড়েছিলে সেদিন মনে ছিলো না এসব কথা? ভালোয় ভালোয় বলছি চলে যাও। তা না হলে কিন্তু…”
মোর্শেদ কথা শেষ করার আগেই নীরা মুখ খোলে-
“বলছিলাম কি কিছু না হয়….”
“চুপ কর বেয়াদব মেয়ে। একটা কথাও বলবি না তুই? তোর কারনে শুধু তোর বোকামির কারনে বড় আব্বু আজ আমাদের মাঝে নেই সেটা কি বুঝতে পারছিস তুই? আর একটা কথাও না। বেশি আদর দিয়ে তোকে মাথায় তুলেছি দেখছি।”
মোর্শেদের হুঙ্কার শুনে কেঁপে উঠলো নীরা। জীবনে প্রথমবারের মতো বকা শুনে কেঁদে দিলো সে। দৌড়ে নিজের রুমে যেয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। সমানে হেঁচকি তুলে কেঁদে যাচ্ছে। তার কি দোষ? সে তো কেবল অনেকদিন পর বোনকে দেখে আবেগ তাড়িত হয়ে গল্প করেছে। বোনটা যে তার সেসব গল্প শুনে এরকম করবে তা কি সে জানতো?

★★★

সারাদিন খাওয়া দাওয়া হয়নি নীরার। কেউ তাকে খেতে ডাকেওনি। খিদেয় পেট চো চো করছে। নীরাও অভিমান করে রুম থেকে বেড়োয় নি।
“যথেষ্ট হয়েছে রাগ দেখানো এবার উঠে খেয়ে নে।”
নীরা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো মোর্শেদ খাবার এনেছে। মোর্শেদকে দেখেই নীরার অভিমান যেন ফুলে ফেঁপে উঠলো।
“খাবো না।”
“সত্যি খাবি না? আমি কিন্তু সব খাবার নিয়ে যাবো?”
“যা না, একদম ভয় দেখাবি না।”
“বেশ। তোরা বোন দুটো আসলেও খুব স্বার্থপর।”
“হুম, আমরা স্বার্থপর আর তুই খুব ভালো। আমরা মেয়ে বলে আমাদের দোষ সহজেই চোখে পড়ে। তুই ছেলে বলে সব দোষ মাফ।”
“আমি আবার কি করলাম?”
মোর্শেদ আকাশ থেকে পড়ে।
“তোর কারণে মিরা আপু পালিয়ে গেছিলো তা কি আর সবাই জানে? বাবার কাছে তো তুই ঠিকই ভালো মানুষ সেজে ছিলি। উল্টো সব দোষ হলো মিরা আপার।”
“নীরা! কি সব বলছিস মাথা ঠিক আছে তোর?”
“ঠিকই বলেছি। তুই বাবার কাছে মিরা আপার নামে মিথ্যে নালিশ দিসনি? বল?”
“ব্যাস যথেষ্ট হয়েছে, না জেনে এসব বলতে একটুও গলা কাঁপছে না তোর? তোর বোন সম্পর্কে কতটুকু জানতিস তুই যে আমায় মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছিস? আর আমি যদি মিথ্যেই বলতাম তবে বড় আব্বু আমায় কবেই ত্যাজ্য করতেন, এটুকুই বুঝিস নি? ছিহ, এতো বড় মিথ্যে আমার নামে বললি তুই?”
মোর্শেদের কথায় একটু দমে যায় নীরা। মিনমিন করে বলে-
“তুই না বললে তো বাবা জানতোই না। মিরা আপাকে না মারলে কি সে বাড়ি থেকে পালাতো?”
“এইজন্যই বলে অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী। তোর মিরা আপা এলাকার বকাটে রুহুলের সাথে প্রেম করতো, পালিয়ে বিয়ে করে রুহুলকে নিয়ে এবাড়িতে আসার প্ল্যান করছিলো আর সব জেনে আমি চুপচাপ থাকতাম, এটাই বলতে চাইছিস তুই? আমি চেয়েছিলাম মিরা আপাকে ওই বকাটের হাত থেকে বাঁচাতে। তাই বড় আব্বুকে কথাগুলো জানিয়েছিলাম। এটা কি আমার অন্যায় হয়েছে? যদিও মিরা আপা কোনো বাঁধাই মানেনি। বংশের মুখে চুনকালি মেখে ওই রুহুলকে বিয়ে করেছে। আর তুই কি করেছিস? সেই বোনকে বিশ্বাস করে মনের ঝাঁপি খুলে দিয়েছিস? মিরা আপার সাথে যে তোর দেখা হয়েছে তা তো আমাকে একবারও বলিসনি? বললে হয়তো তোকে সব বলতে পারতাম, বড় আব্বু হয়তো আমাদের মাঝে থাকতেন। কি করেছিস তুই?”
মোর্শেদ একদমে কথা বলে যায়। নীরার ভীষণ খারাপ লাগছে। ও তো ভেবেছিলো, মোর্শেদই শয়তানি করেছে যে কারনে মিরা পালিয়ে গেছিলো।
“মিরা আপা বড় আব্বুকে কতটা হার্ট করে কথা বলেছে কে জানে? তুই তো জানিস, বড় আব্বু কোনো অন্যায় কথা মেনে নিতে পারে না। এমনিতেই মিরা আপার কারনে হীনমন্যতায় ভুগতো বড় আব্বু। বড়ভাই হওয়া সত্বেও পরিবার, সমাজের কাছে মাথা নিচু করে থাকতে হতো। তারউপর সেই মেয়েই যখন তার সামনে দাড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে তাকে অন্যায়কারী বলেছে, সেটা তার মনে কতটা আঘাত হেনেছে ভাবতে পারিস? কিভাবে ভাববি? তুই তো পারিস শুধু রাগ দেখাতে। বড় আব্বু তোকে জোর করে আমার সাথে বিয়ে দিলো সেজন্যও তোর রাগ ছিলো তার উপর। অথচ একটাবার ভেবে দেখলি না সে কেন এই কাজটা করলো?”
“আমি আমি… আমি তো আগে বুঝিনি… ”
“তুই না মেয়ে? মেয়েরা নাকি বাবাকে খুব বোঝে?অথচ তুই… হুহহ। আজ বুঝলাম, বিয়ের এতোগুলা দিন বাদেও তুই কেন আমার সাথে এমন ব্যবহার করিস? আমিই পাগল, তোকে সবসময় আগলে রাখতে চেয়েছি। অথচ তোর তো আমার আগলে রাখার কোনো প্রয়োজনই নেই? যে মেয়ে নিজের বাবার ভালোবাসা বোঝেনি সে আমায় কি বুঝবে?”
“আমি সত্যিই এতোকিছু জানতাম না। তুই তো অন্তত বিশ্বাস কর আমায়?”
“বিশ্বাস! তোকে? কতো কথা লুকিয়েছিস আমার কাছে। সেদিন কতো করে জিজ্ঞেস করলাম, তোর কি হয়েছে? বলেছিসি কিছু? আজ থেকে নিজের মতো থাকবি। বড় আব্বু তো নেই, আমিও তোকে স্বাধীনতা দিলাম। যা খুশি কর কেউ কিছু বলবে না আর।”
নীরা দিশাহারা হয়ে বসে পড়লো। এ কি করেছে সে? নিজের অজান্তেই এতো বড় ক্ষতি করে ফেললো নিজের? বাবা নেই, মাও ভুল বুঝে দূরে সরে গেলো। আর মোর্শেদকে যে নিজের ভুলে হারিয়ে ফেলছে? এখন কি করবে নীরা?

চলবে—–
©Farhana_Yesmin।