অনেক সাধনার পরে পর্ব-১০+১১

0
298

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[১০]

মৌনতার সঙ্গে হাটছিলো মিতালী। দৃষ্টি ছিলো তার সামনে। অংকুরের কথা কর্নপাত হতেই চোখ তুলে অংকুরের দিকে তাকালো। ভেলপুরির কথা শুনে রাস্তার অপর পাশে তাকিয়ে দেখলো। ভেলপুরি তার ভীষণ রকমের পছন্দ। বলতে গেলে ফুচকার চেয়েও বেশি। একইসঙ্গে বেশ কয়েকটা শেষ করে দিতে পারে অনায়াসে। আজও খেতে ইচ্ছে করলো তার মন। কিন্তু! অংকুরের পাশে বেশ অস্বস্তি লাগলো তার। তাই পছন্দের জিনিসটা কাছে পেয়েও নাঃকোচ করলো। বললো , ‘না খাবো না।’

বারণ শুনলো না অংকুর। বরঞ্চ মিতালীর এক হাত বিনা সংকোচে ধরে রাস্তার অপর পাশে যেতে লাগলো। বললো, ‘ মেয়েদের ফুচকা-ভেলপুরি খেতে বললে না করতে নেই। নাহলে তাদের কিউটনেস থাকে না।’

অংকুর দ্বিধা ছাড়াই অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে মিতালীর হাত ধরে রাস্তা পাড় হতে লাগলো। বিস্মিত হয়ে আছে মিতালী। একবার অংকুরের হাতের দিকে তাকিয়ে আবারো অংকুরের দিকে তাকালো। লোকটার স্বভাব এতো অদ্ভুত কেন? অনুমতি ছাড়াই কিভাবে অধিকার ফলেছে দেখো। হতবাক হয়ে গেলো মিতালী। বাধা দিলো না কেন সে নিজেও জানে না।

অংকুর ভেলপুরির দোকানের কাছে এসেই বললো, ‘গপাগপ সবচেয়ে ভালো করে কয়েকটা ভেলপুরি বানান তো।’ তারপর মিলির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি ঝাল খেতে পারো?’

মিতালী মাথা উপর নিচ করে দুলালো অর্থাৎ সে ঝাল খেতে পারে। অংকুরের যেন পছন্দ হলো ব্যাপারটা। সে দোকানী কে বললো, ‘মামা ঝাল ঝাল কয়েকটা ভেলপুরি চাই।’

বৃদ্ধ ভেলপুরি ওয়ালা তার বিদঘুটে পান খাওয়া দাঁত বের করে হেসে সম্মতি দিলো। অংকুর এখনো মিতালীর হাত ধরে আছে। ভাব এমন যেন তারা কতো পূর্ব-পরিচিত। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ঘাটতে লাগলো। কিন্তু মিতালীর হাত ভুলেও ছাড়লো না।

দোকানদারের সামনে অংকুরের হাত ধরার ব্যাপার টা নিয়ে বেশ লজ্জা লাগছে মিতালীর। নিজেই নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না। অংকুর হাত ছাড়ার পরিবর্তে আরো শক্ত করে ধরলো। ধাতস্থ হলো মিতালী। আরো কয়েকবার নিরবে বৃথা চেষ্টা করলো হাত ছাড়াবার জন্য। কিন্তু প্রতিবারই অংকুর নিরবে হাত শক্ত করে ধরেছে। আর সহ্য করতে পারলো না মিতালী। কণ্ঠস্বর নিচু করে বললো, ‘হাত ছাড়ুন আমার।’

মোবাইলের থেকে দৃষ্টি তুলে মিতালীর দিকে তাকালো অংকুর। মৃদু কন্ঠে বললো, ‘ছাড়বো না।’

কিছুটা বিব্রতভাবে তাকালো মিতালী। চোখে চোখ পরলো দুজনের। অংকুরের চাহনী প্রগাঢ়। চোখ ফিরিয়ে নিলো মিতালী। এই চোখে তাকিয়ে থাকার সাধ্য তার নেই। স্মিতি হাসলো অংকুর। মিতালীর দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললো, ‘আমি থমকে যাই তোমার চোখে, বিদ্রোহ আর বিরহ একত্রে জন্মায় যেখানে।’

চুপ রইলো মিতালী। অংকুরের চোখ থেকে নিজের চোখ সরালো না। বিনা সংকোচে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। প্রতিত্তুরে অংকুর মুচকি হাসলো। এক হাতে মিতালীর উড়ন্ত কিছু চুল কানের পিছে গুঁজে দিলো। মৃদু গলায় বললো,

‘হাত ছেড়ে দিলে আস্থা ছেড়ে যাবে ৷ যার হাত ধরাতে পৃথিবী সুন্দর লাগে তার হাত ধরে যদি পৃথিবীর শেষ আলোকরশ্মি পর্যন্ত পাড়ি জামাতে চাই সে ছেড়ে গেলে হেরে যাবে।’

বাক্যহারা হয়ে পরেছে মিতালী। মৌনতার সঙ্গে অংকুরের চোখে তাকালো। বুঝার চেষ্টা করলো প্রতিটা কথার গভীরত্ব। হাত ছেঁড়ে দিলে হারিয়ে যাবে? অসাড় হলো সে। অংকুরের চোখের চাহনীতে যেন অন্য কিছু খোঁজে পাচ্ছে মিতালী। এই চাহনী কিসের? ভালোবাসার? নাকি শুধু মাত্র মোহ? চোখ ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। এই গভীর চোখের ভাষা বুঝার ক্ষমতা তার নেই। থাকলেও সে বুঝতে চায় না। আজ হয়তো ভালোবাসার কথা বলে কাছে টানবে। কিন্তু ঠিকই কিছুদিন পর তার খুঁত বের করে দূরে ছুঁড়ে মারবে। এটাই ছেলেদের স্বভাব। শুকনো ঢুক গিললো মিতালী। ভাবলো না আর।

ভেলপুরি মামার ডাক শুনে দুইজনই ভাবনার জগত থেকে বেড়িয়ে এলো। অংকুর হাত বাড়িয়ে ভেলপুরির প্লেট হাতে নিয়ে একটা মিতালীর হাতে দিয়ে আরেকটা নিজের কাছে রাখলো। ঝাল দিয়েছে প্রচুর। ভেলপুরি গুলো লাল চকচকে হয়ে আছে। বিলম্ব করলো না মিতালী। একটা ভেলপুরি হাতে উঠিয়ে গপাগপ একখান কামড় বসিয়ে দিলো। আস্তে আস্তে খেতে খেতে পরপর কয়েকটা খেয়ে নিলো মিতালী। চোখ তুলে অংকুরের দিকে তাকিয়ে দেখে সে একটাই হাতে নিয়ে বসে আছে। চোখ দুটো তার লাল হয়ে পানি জমে গেছে। ভ্রুঁ উঁচু করলো মিতালী। প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে?’.

অসহায় মুখে ঠোঁট উল্টে তাকালো অংকুর। বললো, ‘আমি ঝাল খেতে পারি না।’

‘তাহলে ঝাল দিতে বলেছেন কেন?’

‘মানুষের কাছে শুনেছিলাম। প্রেমিকা পাশে থাকলে নাকি টকও মিষ্টি লাগে। তাই ভেবেছি হয়তো ঝাল ভেলপুরিও মিষ্টি হয়ে যাবে। কিন্তু কথাটা যে সম্পূর্ণ বায়োনাট কথা এখন বুঝলাম।’

অংকুরের কথা শুনে হুহা করে উচ্চস্বরে হাসিতে মেতে উঠলো মিতালী। হাসিতে চোখ মুখ খিঁচে আছে তার। গালে ছোট ছোট দুইটা টুল পরলো। এই প্রথম মিতালীর হাসি দেখেছে অংকুর। তাই তো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। ঝালের কথা একদম বেমালুম ভুলে গেছে সে। এখন তার কাছে পৃথিবীর একমাত্র কাজ হচ্ছে মিতালীর হাসি দেখা। তার হাসি দেখে নিজের ঠোঁটেও হাসি টানলো অংকুর। মিতালীএ দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভেলপুরি হাতে নিয়ে কামড় বসালো। পরপর কয়েকটা কামড় দিয়ে সম্পূর্ণ ভেলপুরি খেয়ে নিলো।

মিতালী কোনো রকমে হাসি থামালো। তারপরেও ঠোঁটে হাসি ঝুলে আছে তার। ব্যাগ থেকে ওয়াটার বোতল বের করে অংকুরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আপনি অনেক মজার মানুষ। পানি খেয়ে নিন তাহলে ঝাল কমবে।’

এতোক্ষণ এক দৃষ্টিতে মিতালীর দিকেই তাকিয়ে ছিলো অংকুর। তার কথা শুনেই ধ্যান ভাঙ্গলো। ঝালের কথা শুনে যেন ঝাল আরো বেড়ে গেলো। চটজলদি বোতল হাতে নিয়ে ঢকঢক করে অর্ধেক পানি শেষ করে নিয়েছে। ঝালের মাত্রা কিছুটা কমেছে তবে সম্পূর্ণ যায়নি। অংকুর বড় বড় শ্বাস ফেলে বললো, ‘বাপরে! মাইয়া মানুষ এতো ঝাল খায় কেমনে? ভাইরে ভাই আমার অবস্থা বাজে হয়ে গেছে। আইসিইউ তে ইমিডিয়েক্টলি ভর্তি হতে হবে।’

আবারো হাসলো মিতালী। নিরবে নিজের প্লেটের অবশিষ্ট অর্ধেক ভেলপুরি খেয়ে নিলো। তারপর হাত বাড়িয়ে অংকুরের প্লেটে থাকা বাকি দুইটা ভেলপুরি খেয়ে প্লেট খালি করলো। খাওয়ার মাঝে একবার অংকুরকে সেধেছে মিতালী। অংকুর কানে ধরেছে ঝাল ভেলপুরি এই জীবনে আর খাবে না।

অতঃপর ফুটপাত ধরে হাটছে দুজন। রাস্তার দুই পাশে বড়বড় উঁচু গাছ যারা আকাশ ছোঁয়ার বৃথা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। গাছের মরা নেত্রপল্লব মাটিতে লুটিয়ে আছে। যার উপর পদচারণ পরলে মচমচিয়ে ধ্বনি সৃষ্টি করে। মৃদু বাতাসে মিতালীর খোলা চুল গুলো উড়ছে। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অংকুর। নিশ্চুপ দুজন। তবুও কোথাও যেন মৌনতায় কথোপকথন চলছে। হাঁটার মাঝেই অংকুর গুনগুন করে গান ধরলো।

আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা,
আমি যে পথ চিনি না।
তোমারি উপর করিনু নির্ভর
তোমা বই করেও জানি না।
আজ হতে তুমি হৃদয়ের রাজা,
তোমারেই আমি করিব গো পূজা।
সন্দেহের কণা কিছু রাখিব না,
কারো কোথা আমি মানি না।

সম্পূর্ণ গান টা মনোযোগ দিয়ে শুনলো মিতালী। তার নিজের কাছেও প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠের এই গান ভালো লাগে। অংকুরের কন্ঠে নিজের প্রিয় গানটা শুনে আরো ভালোলাগা কাজ করলো মনে। আনমনে মুচকি হাসলো।

কোলাহলপূর্ণ মিতালীর ভার্সিটি। চারপাশ শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। ভার্সিটির বড় গেইটের সামনে আসার পর মিতালী দাঁড়িয়ে পরলো। ধাতস্থ হলো অংকুর। রাস্তাটা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে ভাবে নি সে। কিছুটা ক্ষুন্ন হলো মন। ভার্সিটিটা দেখে অংকুর প্রশ্ন করলো, ‘তুমি এখানেই পড়ো?’

মিতালী মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সম্মতি দিলো। তারপর উড়ন্ত এলোমেলো চুল গুলো দুই হাতে ঠিক করে নিলো। ভিতরে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ উদ্যোগশীল হলো। তখুনি অংকুর দাঁড়ালো তার সামনে। মিতালীর চোখের দিকে গভীর চোখে তাকালো। চোখে চোখ রেখেই মৃদু গলায় বললো, ‘পথটা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হলো কেন বলো তো? আরেকটু দীর্ঘ হতে পারতো না? কি হতো আরেকটু পথ তোমার যাথে হাটতে পারলে?’

প্রতিত্তুর করলো না মিতালী। নিশ্চুপ থেকে তাকিয়ে রইলো শুধু। অংকুর আলতো ভাবে হাসলো। মিতালীর সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল, ‘আবারো দেখা হবে প্রণয়িনী।’

মিতালী দ্রুত পা চালিয়ে ভার্সিটির ভিতরে এসে অংকুরের চোখের আড়াল হওয়ার প্রচেষ্টা করতে লাগলো। এতোক্ষণ নিজের ভিতর ভয়, জড়তা, অস্বস্তি ও ভালোলাগার রেশ ছিলো। এখন যেন সে হাফ ছেঁড়ে বাঁচলো। এই ছেলে সাংঘাতিক। তার কাছাকাছি কোনো ভাবেই থাকা সম্ভব না। নাহলে নিজের কথার প্রেমে ফাঁসিয়ে ফেলবে।

চলমান..

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[১১]

সূর্যের তীব্র আলোকরশ্মির কারনে উত্তাপ হয়ে আছে চারপাশ। অসয্য ভ্যাঁপসা গরম বিদ্যমান। সকালের রোদ ছিল কোমল। কিন্তু এখন মাত্রারিক্ত গরম। মাথার ঠিক মাঝ বরাবর উল্কাপিণ্ড। এক হাত চোখে-মুখের সামনে এনে রোদের তাপ থেকে বাঁচার বৃথা চেষ্টা করছে শেফালী। দ্রুততার সাথে পা চালিয়ে রাস্তার অপর পাশে এক প্রকার দৌড়ে আসলো। দোকানের সামনে ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আঙ্কেল একটা কোকাকোলা দেন তো।’

‘আমাকেও একটা দিয়েন।’ পাশে দাঁড়ানো লোকটার কথা শুনে ঘাড় ঘুড়ালো শেফালী। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি দেখেই চোখ তার ছানাবড়া হয়ে গেলো মুহূর্তেই। ঘূর্নাক্ষরেও ভাবেনি আবার দেখা হবে। চোখ এখনো তার কোটর বেড়িয়ে আসার উপক্রম। হতবাক হয়ে গেলো সে।

বাঁকা হেসে তাকালো রাকিব। পূর্ণাঙ্গ চোখে দেখলো শেফালী কে। কলেজ ড্রেস পড়ুয়া মেয়েটিকে রাস্তার অপর পাশ থেকে আসতে দেখেই দাঁড়িয়ে পরেছিলো সে। ক্লাইন্ডদের সাথে সকালের মিটিং একটু আগে শেষ হয়েছে। তাছাড়া এখন অফিসের ব্রেক টাইম তাই হাতেও সময় আছে প্রচুর। তাড়া নেই একদম। আর এই সময়টা নাহয় এই মেয়েকে একটু জ্বলিয়ে উপভোগ করা যাক। দোকানদার দুইটা কোকাকোলার বোতল দিলো। রাকিব একটা নিজে রেখে আরেকটা শেফালীর হাতে ধরিয়ে দিলো। কোকাকোলার বোতল খুলেই লম্বা চুমুক বসালো। তারপর দোকানদারের উদ্দেশ্যে বললো, ‘ টাকা ওর থেকে নিয়েন।’

এতোক্ষণ মৌনতার সঙ্গে রাকিবের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিলো শেফালী। রাকিবের কথা কর্নপাত হতেই তাৎক্ষনাৎ মৃদু চেঁচিয়ে উঠলো, ‘কেন কেন? আমি টাকা দিবো কেন? কোক খেয়েছেন আপনি তাহলে আমি কেন টাকা দিবো? নিজের টাকায় খেতে পারেন না?’

রাকিব কন্ঠস্বর ত্যাঁছড়া করে বললো, ‘এমনিতেও তোমার থেকে আটশো টাকা পাই আমি। কোকের টাকাটা সেখান থেকে কাটিয়ে নিলাম।’

উষ্ঠধয়ের মাঝে কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হয়ে এলো আপনা-আপনি। আহাম্মক হয়ে গেলো শেফালী। হা হয়ে তাকিয়ে রইলো রাকিবের দিকে। বিস্মিত হয়ে বললো, ‘আটশো কিভাবে?’

বিদ্রোপ মাখা হাসি দিলো রাকিব। কোকের বোতল দিয়ে শেফালীর মাথায় হাল্কা চাপড় দিয়ে বললো, ‘তখন দাও নি তাই এখন আটশো। চটজলদি বাকি টাকা দিয়ে দাও। নাহলে আরো বেড়ে যাবে।’

‘এ্যাঁ মগের মুল্লুক। বললেই হলো আটশো। কান খুলে শুনে রাখুন। আমি আপনাকে একটাও দিচ্ছি না। এখন যে কোক খেয়েছেন সেটার টাকাও না।’ ঝাঁঝালো গলায় প্রতিত্তুর করলো শেফালী। রাগে ফুঁশছে সে। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে শুধু নিজের কোকের টাকাটা দোকানদারকে দিলো। তীক্ষ্ণ চোখে রাকিবের দিকে তাকিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাঁড়ালো। রাকিবও তড়িঘড়ি করে তার টাকা মিটিয়ে দৌড়ে এসে শেফালীর পাশে হাটতে লাগলো।

দুপুরের মধ্যভাগ হওয়ায় রাস্তা-ঘাট একদম খালি। হাতে গুনা দুই একটা মানুষ দেখা যাচ্ছে কেবল। একটা বড় কড়ুই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে শেফালী। একটাও রিকশা মিলছে না বাসায় যাবার জন্য। যাও দুই একটা পাচ্ছে কিন্তু তারা অন্য গলিতে যাবে। বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শেফালী। তার পাশেই রাকিব দাঁড়িয়ে আছে। সে থেমে থেমে কোকের বোতলে চুমুক বসাচ্ছে। বোতলে শেষ চুমুকে দিয়ে তা নিচে ফেললো। তারপর সেটাতে পা দিয়ে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। অন্য মেয়ে হলে মুগ্ধ হয়ে হা করে তাকিয়ে থাকতো। কিন্তু শেফালী রাগান্বিত হলো। ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলো, ‘আপনার এখানে কি? দেখে তো মনে হচ্ছে অফিসে কাজ করেন। তাহলে রাস্তায় কি করছেন? যান এখান থেকে।’

‘আশ্চর্য রাস্তাটা কি তোমার বাপের টাকায় বানানো? আমি যেখানে খুশি সেখানে থাকবো তাতে তোমার কি? ইচ্ছে হলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পানি পানি ডান্স দিবো। সমস্যা?’

রাকিবের প্রতিত্তুর শুনে রাগ শরিরে তিরতির করে বেড়ে গেলো শেফালীর। হাতে থাকা কোকের বোতলটা শক্ত করে ধরলো। মনে মনে বোতলটাকে রাকিব ভেবে মুচড়াতে লাগলো। এতেও যেন রাগ বিন্দুমাত্র কমছে না তার।

রাকিব মৃদু হাসলো। মন ভরে দেখলো শেফালীকে। কলেজ ড্রেস পরুয়া ফর্শা মেয়েটির মুখশ্রী লাল হয়ে আছে। চুল গুলো বেনী করে এক পাশে রাখা। কপালে থাকা ছোট ছোট চুল গুলো চোখে মুখের উপর এসে পরে আছে। অতিরিক্ত গরমের কারনে নাকটা ঘেমে আছে তার। সূর্যের প্রচন্ড তাপে ফর্শা ফর্শা গাল দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে একদম। কপালে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা গুলো চিকচিক করছে। রাগের কারনে নাক ফোলে আছে। শেফালীর অগোচরে মৃদু হাসলো রাকিব। প্রশ্ন করলো, ‘তোমার বাবার নাম কি?’

‘কেন? বাবার নাম দিয়ে কি রান্না করে খাবেন?’ শেফালীর ত্যাঁছড়া প্রতিত্তুর শুনে ভ্রুঁ কুঁচকালো রাকিব। এই মেয়ে ভালো করে কথা বলতে পারে নাকি? সব সময় ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলবে। সম্মান দিয়ে কথা বলতে পারে না একদম। রাগ হলো একটু। তাই বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলে উঠলো , ‘এই মেয়ে। আমি তোমার বয়সে যথেষ্ট বড়। রেসপেক্ট দিয়ে কথা বলতে পারো না? বড় দের সাথে কেমন আচরন করতে হয় তা বাবা মা কখনো শেখায় নি?’

থমথমে হয়ে এলো শেফালী। অপমানিত বোধ করলো সে। মুখ কালো হয়ে গেলো তার। এরূপ উগ্র আচরন একদম ঠিক হয়নি। বড়দের সাথে এমন ব্যবহার উচিত না। তাছাড়া নির্জন রাস্তায় এই লোক ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। যেকোনো মুহূর্তে খারাপ কিছু করে ফেলতে পারে। তার চেয়ে ভালো পাগলের সাথে সাথে নিজেও লাফানো। তাই তো সে ছোট করে উত্তর দিলো, ‘জুলফিকার মাহমুদ।’

‘ওয়েট! কি বললে তুমি? জুলফিকার? সিরিয়াসলি? তোমাদের বাসা কোথায়? আর তোমার বাবা কি করে?’

রাকিবের প্রশ্ন শুনে কপাল কুঁচকালো শেফালী। এতো কিছু জানতে চাইছে কেন লোকটা? এতো আগ্রহ দেখাচ্ছে কেন? বাবাকে চিনে নাকি? ভদ্র মেয়ের মতো প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিলো সে। রাকিবের যা যা জানার দরকার তা প্রশ্ন করলো। শেফালীও উত্তর দিলো।

মৃদু হেসে উঠলো রাকিব। মাথায় তার দুষ্টু বুদ্ধি আটলো। শেফালীকে এই ফাঁকে একটু হ্যানস্তা করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। একটু ভাব আর ঢং মিশিয়ে বলে উঠলো, ‘আরেহ তুমি জুলফিকার আঙ্কেলের মেয়ে? বাহ ভালোই বড় হয়ে গেছো দেখছি।’

‘মানে? আপনি বাবাকে চিনেন? কি হয় আপনার?’

‘আরে আমি তোমার বাবার বন্ধুর ছেলে। আমার আব্বু আর তোমার আব্বুর মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিছুদিন আগেও তোমার আব্বুর সাথে দেখা হয়েছে আমার। উনি যথেষ্ট ভালো আর সাবলীল।’

আপনা আপনি ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো শেফালী। তার জানা মনে, তার বাবার বন্ধুর ছেলেপেলে কচি খোকা একদম। তার বাবার অনেক পরে বন্ধুরা বিয়ে করেছে। সেই সুবাধে বাচ্চা কাচ্চা সব শেফালীর ছোট। কিন্তু হঠাৎ এমন দামড়া পোলা বাবার বন্ধুর ছেলে রূপে বেরুলো কবে? বিশ্বাস করতে চাইলো না শেফালীর মন। তখুনি মনে পরলো আরেকটা কথা। কিছুদিন আগে তার বাবা বলেছিলো সে তার বন্ধুর ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। তার মানে সত্যি সত্যি তারা পরিচিত? চোখ বড়বড় হয়ে গেলো শেফালীর। কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করলো তার। এখন যদি এই লোক বাবাকে বলে দেয়? যদি বলে দেয় শেফালী রাস্তা ঘাটে বাজে আচরন করেছে তার সাথে? বাবা অর্থাৎ জুলফিকার প্রচন্ড রাগি একজন মানুষ। এই অপরাধে তার মাথা মচকে ফেলবে একদম। ভয়ে ভয়ে ঠোঁট প্রসারিত করে মেকি হাসি দিলো একটা।

শেফালীর প্রতিক্রিয়া দেখে চোখে হাসলো রাকিব। যাক মেয়েটা বিশ্বাস করেছে। কতো ভালো নাটক পারে সে। ওয়াও! চাইলেই নিশো, অপূর্বের পাশাপাশি সে নিজেও ভালো নায়ক হতে পারবে। ভাবতেই গলা ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু হাসলো না। বরঞ্চ উপরে সিরিয়াস রইলো। জিভ দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে নিলো সে। হাতে থাকা সিলভারের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে প্রশ্ন করলো, ‘তোমার কলেজ তো এখনো শেষ হয়নি। তাহলে এখানে কি করছো তুমি?’

চোখ বড় হয়ে গেলো শেফালীর। সে কলেজ ব্যাঙ্ক করে এসেছে। এই অসয্য গরমে ক্লাস করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছিল না। তাই কলেজ ফাঁকি দিয়ে দেয়াল টপকে এসেছে। এবার কি হবে? উনি যদি আব্বুকে বলে দেয় তাহলে? ভয়ার্ত চোখে তাকালো শেফালী। বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো, ‘কলেজ ছুটি।’

‘মিথ্যে বলবে না। কলেজ ছুটি হলে রাস্তায় অন্য স্টুডেন্টস দেখা যেতো। তুমি পালিয়ে এসেছো রাইট? এই বয়সে কলেজ ফাঁকি দিচ্ছো তুমি? সামনে না এইসএসসি তোমাদের? দাঁড়াও আমি আঙ্কেলকে জানিয়ে দিচ্ছি। উনার নাম্বার আমার কাছে আছে। ওয়েট!’

পকেট থেকে মোবাইল বের করলো রাকিব। আত্মার পানি শুকিয়ে গেলো শেফালীর। অস্থির হয়ে উঠলো সে। চটজলদি বলতে লাগল, ‘প্লিজ ভাইয়া, আব্বুকে কিছু বললেন না। আব্বু জানতে পারলে গর্দান নিবে। প্লিজ ভাইয়া। আপনি যা বলবেন তাই হবে। প্লিজ!’

বাঁকা হাসলো রাকিব। মোবাইল দেখিয়ে বললো, ‘ওকে দিলাম না কল। কিন্তু তার আগে আমার আটশো টাকা ফেরত দাও।’

চোখ মুখ কালো করে তাকালো শেফালী। কণ্ঠস্বর নিচু করে বললো, ‘আম্মা শুধু ভাড়া আর টিফিনের টাকা দিয়েছে। এতো টাকা আমার কাছে নেই।’

‘ঠিক আছে। তাহলে নাম্বার টা দিয়ে যাও। যদি টাকা না দেওয়ার ধান্দায় থাকো তাহলে সোজা তোমার আব্বুর কানে সব চালান করবো। মনে থাকে যেন।’

রাকিবের হাল্কার উপর ঝাপসা মারা থ্রে’ট শুনে ধাতস্থ হলো শেফালী। অসহায় মুখে তাকালো। চুপচাপ নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে দিলো। ভাগ্যক্রমে তখুনি একটা রিকশা পেলো সে। রাকিব তাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে বললো, ‘সাবধানে যাও। আর হ্যাঁ কল দিলে রিসিভ করবে কিন্তু।’

ভদ্র মেয়ের মতো মাথা দুলালো শেফালী। রাকিব রিকশার হুট তুলে দিলে রিকশাচালক চালাতে শুরু করে। নিঃশব্দে হেসে ফেললো রাকিব। মেয়েটা এতো বোকা কেন? অতিরিক্ত চঞ্চল স্বভাবের। তবে মনটা অনেক নরম। মোবাইল বের করে নাম্বারটা সেভ করলো ‘ভয়ংকরী’ দিয়ে। শেফালীর রাগি রাগি চোখের চাহনীর কারনে সে তার কাছে ভয়ংকরী। তার রাজ্যের ভয়ংকরী।

শরিরে রাগ নিয়েই বাসায় আসলো শেফালী। ঘেমে আছে একদম। বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে রেখেছে। বাসায় ঢুকেই টি-টেবিলের উপর ব্যাগ রেখে সোফায় ধপাস করে শুয়ে পরলো। তার সামনের সোফায় জুলেখা বসে ছিলেন। শেফালীকে এমতাবস্থায় দেখেই বলে উঠলেন, ‘ওমা! ইস্কুল থেইকা আইছোস আগে গোসল আনা করবি। এনে বইছোস ক্যান? যা যা আগে গোসল কইরা আয়। তাইলে শরির ঠান্ডা হইবো নে।’

দাদীর কথা কানে তুললো না শেফালী। বরঞ্চ চেঁচিয়ে ডাকলো মাকে।

‘আম্মা! আম্মা! পানি দাও তো।’

রাগলেন জুলেখা বেগম। পানে যাবতীয় মশলাদি সাজাচ্ছিলেন তিনি। তখুনি শেফালীর দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললেন, ‘মাগোমা। ভালোই বেয়াদব হইছোস দেখতাছি। মারে কামের অর্ডার করছ মাইয়া। বলি উঠে গিয়া আনতে পারছ না? ওই তো টেবিলের উপরেই পানি আছে। গিয়া আন। না ম্যাডামে আম্মারে অর্ডার করতাছে। ইস্কুলে গিয়ে এইসব শিখেন আপনে?’

এবার মহা বিরক্ত হলো শেফালী। ‘উফফ’ বলে উঠে দাঁড়ালো। তখুনি আমেনা ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলেন। শেফালী চুপচাপ পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে ব্যাগ হাতে নিয়ে রুমে চলে গেলো। রাগ লাগছে তার। একটা অপরিচিত ছেলে কিনা তাকে ভয় দেখালো? এভাবে হ্যানস্তা করতে পারলো? এতোটাই সহজ শেফালীকে হারানো? ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। হাত দিয়ে টেনে টেনে বেনী খুলতে লাগলো। যেহেতু চুল গুলো হাল্কা কুঁকড়ানো সেহেতু খুলতে একটু সময় লাগছে। তাও টেনেটুনে খুলার চেষ্টা করছে। রাগ লাগছে তার। ভীষণ ভাবে রাগ লাগছে।

চলমান..