অনেক সাধনার পরে পর্ব-৮+৯

0
297

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[০৮]

গভীর চাহনীতে তাকালো অংকুর। উষ্ঠধয়ে ফুটালো মৃদু বাকা হাসি। মিতালীর দিকে এক কদম এগিয়ে কিছুটা ঝুকে দাঁড়ালো। পিছালো না মিতালী। বরঞ্চ উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অংকুর মিতালীর কাজল কালো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘যদি বলি ভালোবাসার জন্য?’

নিষ্প্রাণতা আসলো মিতালীর মাঝে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো অংকুরের দিকে। এমন প্রতিত্তুর তার কল্পনার বাহিরে ছিলো। কান দুটোতে এখনো অংকুরের বলা কথাটি কম্পিত হচ্ছে। ঈষৎ কেঁপে উঠলো মিতালীর হৃদয়। মৃদু হাসলো অংকুর। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমাকে খুব বাজে ভাবে ফাঁসিয়েছ তুমি। মামলা করা উচিত তোমার নামে।’

মিতালী বললো, ‘কিসব আবুল তাবুল বলছেন। মাথা ঠিক আছে আপনার?’

উচ্চস্বরে হেসে ফেললো অংকুর। ঠোঁটের বাম পাশের ছোট বাকা দাঁতটা ভেসে উঠলো স্পষ্ট। হাসির কারনে চোখের পাশে ছোট ছোট ভাজ পরেছে। পরিস্ফুট ভাবে দেখলো মিতালী। সে এখনো বাক্যহীন হয়ে আছে। মাত্র দুইদিনের পরিচয়ে ভালোবাসা? এতো টাই সহজ? সবটাই তার কাছে ধোঁয়াশা লাগছে। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে অংকুরের দিকে। তখুনি আগমন ঘটলো শেফালীর। সে এখানে এসে দুজনকে পাশাপাশি দেখে ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকালো। হতবাক হয়ে দুজনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো, ‘তোমরা একে ওপরকে চিনো? বুবু কে উনি?’

মিতালী নিশ্চুপ রইলো। প্রতিক্রিয়া করার মতো কিছু পেলো না। মনে মনে কিছু কথা আওড়ে নিলো কি বলবে তা নিয়ে। অতঃপর জিভ দিয়ে উষ্ঠধয় ভিজিয়ে নিলো। প্রতিত্তুর করার জন্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই অংকুর শেফালীকে বলে উঠলো, ‘হ্যালো সিস্টার, আই’ম ইউ’র ফিউচার ব্রাদার ইন ল। নাইস টু মিট ইউ।’

বিস্ময়ে তাৎক্ষনাৎ দুই ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে গেলো শেফালীর। ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে রইলো অংকুরের দিকে। মুখ ফাঁক রেখেই একবার মিতালীর তাকালো। তারপর অংকুরের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘সত্যি নি? নাকি আমি স্বপ্ন দেখতাছি? বুবু হাতে চিমটি কাটো তো। হায় আল্লাহ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কেন?’

উচ্চস্বরে হেসে ফেললো অংকুর। তার হাসি দেখে রাগ শরিরে তিরতির করে বেড়ে গেলো মিতালীর। রাগে কিড়মিড় করতে করতে শেফালীর মাথায় চাপড় বসালো। তারপর চোখ পাকিয়ে বললো, ‘মিথ্যে কথা। এই ফালতু লোকটাকে আমি একদম চিনি না। বাসায় চল এখুনি।’

শেফালীর হাত ধরে হাটতে নিলেই বাধা দিলো শেফালী। মিতালীর হাত ছাড়িয়ে অংকুরের দিকে উল্লাসিত কন্ঠে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘হ্যালো, আমি শেফালী। তোমার নাম কি?’

হাসলো অংকুর। নিজের হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে বললো, ‘অংকুর।’

‘আরেহ বাহ্। সুন্দর নাম। আমার কিন্তু তোমাকে দুলাভাই হিসেবে বেশ পছন্দ হয়েছে। এখন তোমাকে আমি জিমি বলে ডাকবো। আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম দুলাভাই কে জিমি ডাকবো।’

মিতালীর দিকে তাকিয়ে প্রাপ্তির হাসি দিলো অংকুর। অন্যদিকে মিতালী তাদের কথোপকথন শুনে রাগে ফেটে যাচ্ছে একদম। সহ্য করতে না না পেরে শেফালীর কান ধরলো। বললো, ‘ফাজিল মেয়ে। যাকে খুশি তাকেই দুলাভাই কেন ডাকবি তুই? আমি কি এই ছেলে কে বিয়ে করেছি? বেয়াদব মেয়ে কোথাকার।’

ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো শেফালী, ‘আহ্ বুবু কি করছো? ব্যাথা পাচ্ছি ছাড়ো প্লিজ।’

কান ছেড়ে দিলো মিতালী। শেফালী মুখ কালো করে কান কান ঢলতে লাগলো। মিতালী অংকুরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শেফালীর হাত ধরে অটো দাঁড় করিয়ে উঠে বসলো তাতে। অংকুর এখনো আগের জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে তার মৃদু হাসি। মিতালীদের অটো চোখের আড়াল হতেই দৃষ্টি সরালো রাস্তা থেকে। এক হাতে মাথা চুলকে মোবাইল বের করলো পকেট থেকে। মিতালীর নাম্বার টা সেভ করলো ‘তুলতুল’ দিয়ে।

অটোতে কাচুমুচু হয়ে বসে আছে শেফালী। আড় চোখে মিতালীর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে রাগে ফুঁশ ফুঁশ করে নিশ্বাস ছুঁড়ছে। ভয়ে শুকনো ঢুক গিললো। তখন নাহয় নাচতে নাচতে দুলাভাই ডেকে দিয়েছে। এখন তার কি হবে?আর ছেলেটার সাথে বুবুর সম্পর্ক আছে কি না, না জেনেই এমন করেছে সে। আজ তো তার কপালে শনি-দশা আছে নিশ্চিত।

মিতালী চুপচাপ ঘাড় কাত করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। চলন্ত গাড়ি থেকে রাস্তার পাশের গাছের দৃশ্য দেখতে মুগ্ধকর। একটু আগের ঘটনায় প্রথমে রাগ হলেও এখন তার হাসি পাচ্ছে। দুই দিনের পরিচয়ে কিনা ভালোবাসা? হাহ্ এতো টা সহজ না দুনিয়া। অন্তত্য তার মতো মোটা মেয়েদের জন্য তো না-ই। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। তখুনি মোবাইলে ম্যাসেজের নোটিফিকেশনের ধ্বনি কানে আসলো তার। মোবাইলের স্কিন অন করে তাকিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজ টা ওপেন করে দেখে অবাক হলো। বুঝতে বাকি নেই ম্যাসেজ টা কে পাঠিয়েছে। আপন মনে মৃদু হেসে ফেললো মিতালী।

‘অনাদিকাল এ পথে চলতে গিয়ে,
তোমার সাথে দেখা মিলে চেনা প্রান্তরে।
সুসৌরভে পুলকিত হয় ওঠে আমার মৌন,
বিমুগ্ধ অন্তরে স্বপনদুয়ার খুলে করে মধুপূর্ণ।’
.

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই শুয়ে পরেছে। জেগে আছে শুধু দুই বোন। শেফালী টেবিলের এক পাশে বসে পড়ছে। মিতালী এক পাশে বসে নতুন ক্যালিগ্রাফি আর্ট করছে। খুব মনোযোগীর সাথে ০০ সাইজের তুলি ক্যানভাসে চালাচ্ছে সে। কিছুসময় পর খেয়াল করলো শেফালী ঘুমে ঢুলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত্রীর মাত্র বারো টা ছয়। শেফালী সাধারনত অনেক তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে ভোরে উঠে। রাত দশটা কি এগারোটার পর তাকে ধরে বেধেও সজাগ রাখা যায় না। ইদানীং রাত জাগছে সে। কারন একটা-ই পড়া। এই পড়াশোনা না থাকলে বোধহয় তার জন্য হাজার গুন ভালো ছিল। সে সব কিছু ছাড়তে পারবে কিন্তু ঘুম নিয়ে নো কম্প্রোমাইজ! ঈষৎ হাসলো মিতালী। শেফালীর গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘ঘুমিয়ে পর গিয়ে। নাহলে ঘাড়ে ব্যাথা করবে পরে।’

পিটপিট চোখে তাকালো শেফালী। ঘুমে চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ঘুমুঘুমু চোখে তাকিয়ে ঘুমার্ত গলায় বললো, ‘বা*লের পড়া যদি না থাকতো তাহলে আমি আমার আড়ামের ঘুম হারাম করতাম না।’

দেড়ি করলো না আর। চটজলদি টেবিল ছেড়ে মিতালীর রুমেই শুয়ে পরলো উল্টো হয়ে। মুহূর্তেই চোখে হাজারটা রাজ্যের ঘুম এসে হানা দিলো। ঘুমিয়ে গেলো শেফালী। তার এই কান্ডে নিঃশব্দে হেসে উঠলো মিতালী। আবারো মনস্থির করলো ক্যানভাস তুলিতে। কিন্তু মনোনিবেশ করতে পারলো না। যখন পূর্ণ মৌন রঙতুলিতে তখুনি মোবাইলের কর্কষ রিংটোনের আওয়াজে ধ্যান ভাঙ্গে। কিঞ্চিৎ পরিমানের বিরক্ত হলো মিতালী। কপাল কুঁচকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। চিনে না তাই কল রিসিভ করেনি মিতালী। মোবাইলটা উল্টে টেবিলের এক পাশে রেখে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর কল টা আপনা আপনি কেটে গেছে। পাত্তা দিলো না সে। আবারো নিজের কাছে মনোযোগ দিলো। প্রায় দশ মিনিট পর সেই একই নাম্বারে কল আসলো। বিরক্ত হলো মিতালী। কটমট চোখে মোবাইলের দিকে তাকালো। একই নাম্বার থেকে আবারো কল। হয়তো জরুরি। তাই বিলম্ব না করে কল রিসিভ করলো সে। ‘হ্যালো’ বলার পর অপর পাশ থেকে ভেসে এলো একটা পুরুষনালীর কণ্ঠস্বর।

‘ব্যাপার কি মিস? প্রথম দিনেই আমাকে ইগনোর লিষ্টে ফেলে দিলেন?’

ভ্রুঁ জোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে এলো মিতালীর। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে স্কিনে নাম্বার টা ভালো করে দেখে নিলো একবার। না পরিচিত কেউ বলে মনে হচ্ছে না। মোবাইল কানে রেখে প্রশ্ন করলো, ‘কে আপনি?’

অপর পাশ থেকে অংকুরের অবাক কন্ঠ ভেসে উঠলো, ‘যাক বাবা! সন্ধ্যা রাতেই না তোমার মেমোরির প্রশংসা করলাম। এরই মাঝে ভুলে গেলে? সিরিয়াসলি?

‘আপনি? এতো রাতে কল দিলেন কেন?’

মধ্যরাতে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে বসে আছে অংকুর। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে রাকিব মোবাইলে গেমস খেলছে। মিতালীর কথা শুনে অংকুর হাত ঘড়ির দিকে চোখ বুলালো। তারপর বলল,

‘এতো রাত কোথায়? মাত্র সাড়ে বারোটা বাজে। ঘুমিয়ে গিয়েছিলে নাকি? ডিস্টার্ব করলাম?’

‘অবশ্যই ডিস্টার্ব করেছেন। মাঝ রাতে একটা মেয়েকে তার পারমিশন ছাড়া কল দেওয়া টা কি ডিস্টার্বড নয়?’ মিতালীর কাটকাট গলার উত্তর।

‘তোমার থেকে পারমিশন চাইলেও তুমি দিতে না। তাই নিজেকে থেকে কল দিয়ে দিলাম।’

‘আপনি তো জিজ্ঞেস করেন নি। আমি পারমিশন দিতেও পারতাম। তাহলে? জিজ্ঞেস করে কল দেওয়ার দরকার ছিল না?’

‘তারমানে আমাকে কল দেয়ার পারমিশন দিতে? ওকে ওয়েট!’

বলেই লাইন কেটে দিলো অংকুর। অবাক হলো মিতালী। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে টেবিলের কাছে রাখার আগেই আবারো কল আসলো অংকুরের। কপালে বিরক্তির ভাজ আসলো তার। কল রিসিভ করে কানে দিল। তারপর বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো,

‘সমস্যা কি? আবার কল দিলেন কেন?’

‘ওমা! তুমি না পারমিশন দিলে কল দেওয়ার জন্য? তাই আবারো কল দিলাম। এবার বলতে পারবে না পারমিশন নেই নি কেন। ‘

অংকুরের হাস্যউজ্জল কন্ঠ শুনে হতবাক হলো মিতালী। কখন পারমিশন দিলো সে?এই ছেলে এতো কথা বলতে পারে? আষ্টর্য! অংকুর আবারো বলতে লাগলো, ‘তোমার নাম তো মিতালী রাইট?’

ছোট করে উত্তর দিলো, ‘হুম!’

‘ওহ ইয়া! অংকুর নামের অর্থ সূচনা করা, সৃষ্টি করা। আর মিতালী নামের অর্থ বন্ধুত্ব। সুতরাং কি দাঁড়ালো? অংকুর মিতালী নামের অর্থ হয় বন্ধুত্বের সূচনা করা। তাহলে নামের সাথে মিল রেখে আমরা দুইজন এখন থেকে বন্ধু। পাক্কা?’

তার কথা শুনে নিরবে হাসলো মিতালী। ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলে রইলো তার। অংকুর আবারো বলতে লাগলো, ‘কি মিল আমাদের নামের। ওয়াও। এমন মিল কোনো কাপলের পাবে না বুঝেছো। অংকুর – মিতালী! ওয়াহ্ নাম দুটো একত্রে বললেই কেমন শান্তি শান্তি লাগে। ভালো লাগে না মিতালী?’

উত্তর দিলো না মিতালী। নিশ্চপ থেকে শুনতে লাগলো অংকুরের যতো কথা। তৃতীয় সাক্ষাতে একটা ছেলের এমন ব্যবহার করছে যেন তারা কত বছরের পূর্ব-পরিচিত। অংকুরের ব্যবহারে নিরবে হাসছে আর চুপচাপ শ্রবণ করছে সে।

অংকুর বললো, ‘তোমার নামটা অনেক বড়। স্যরি টু সে, এতো বড় নামে ডাকতে পারবো না আমি। একটু কেটে-ঝেটে ছোট করে নেই কেমন? তাহলে কি নামে ডাকবো?’

ভ্রুঁ কুঁচকালো মিতালী। অংকুরের সাথে তাল মিলিয়ে বললো, ‘হুম তাহলে কি নামে ডাকবেন?’

ভাবুক হলো অংকুর। ভাবতে ভাবতে বললো, ‘মিতালী? মিতা? তালী? নাহ। মাঝখানের তা টা বাদ। তাহলে মিলী। ওয়াও! এটাই ফাইনাল। আনকমন নাম। এখন থেকে মিলি বলে ডাকবো তোমাকে।’

এবার একটু আওয়াজ করেই হেসে ফেললো মিতালী। তার হাসির আওয়াজে অংকুর নিজেও মৃদু হাসলো। মুগ্ধ হলো তার মন। আনমনে কবিতা এঁকে বলে উঠলো, ‘

‘তোমার হাসিতে রজনীগন্ধা ফুটে
বিশাদ যেন এক নিমিশেই টুটে!’

ধাতস্থ হলো মিতালী। উষ্ঠধয়ে লেপ্টে থাকা হাসি মিলিয়ে গেলো। লজ্জাভূতি হলো সে। ঠোঁটে ঠোঁট চেঁপে ধরলো। গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে গেলো তার। কোনো রকমে ‘রাখছি’ বলে কল কেটে দিলো।

বিস্মিত হলো অংকুর। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে স্কিনের দিকে তাকালো। ‘তুলতুল’ নামটা দেখে হেসে উঠলো সে।

চলমান।

#অনেক_সাধনার_পরে
#মাইশাতুল_মিহির

[০৯]

স্নিগ্ধ ভোরের পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো মিতালীর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো মাত্র ছয়টা বাজে। পাশে তাকালে শেফালীর ঘুমন্ত মুখ-খানি নজরে আসলো তার। বাচ্চাদের মতো হাত পা ছড়িয়ে ঠোঁট দুটো উল্টে শুয়ে আছে। মুচকি হাসলো মিতালী। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিলো। পাওয়ার বাটনে ক্লিক করলে স্কিনে তার আর শেফালীর মুখ ভেসে উঠে। পাশাপাশি ম্যাসেজের ছোট একটা নোটিফিকেশন।

‘গুড মর্নিং মিলি।’

ম্যাসেজ টা দেখে হেসে ফেললো মিতালী। রিপ্লাই দিলো না। মোবাইলটা পাশে রেখে শুয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। ফ্রেশ হয়ে নিলো চটজলদি। চুল গুলো আজ বেনী করলো না। উঁচু করে খোঁপা বেধে নিলো। মুখের দুই পাশে ছোট ছোট চুল গুলো গুছিয়ে কানের পিছে গুঁজে দিলো। পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি মেলে দেখলো নিজেকে। ডান হাত উঠিয়ে গালে রাখলো। ফোলা ফোলা গাল দুটো। পেটটাও বড়। স্বাস্থ্য একটু বেশি। যার ধরন মোটা মোটা লাগে। সে তো প্রচুর খাওয়া কন্ট্রোল করে তাহলে স্লিম হচ্ছে না কেন? কি হতো স্বাস্থ্যটা আরেকটু কম হলে? সমাজে মানুষজন দের কটূকথা শুনতে হতো না। না এতো অপমান সয্য করতে হতো। তার কপালেই কেন এমন ছিলো? কেন? নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিতালী। ওড়না টা গায়ে আঁটসাঁট করে বেধে বের হলো রুম থেকে। রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলে দেখে তার মা সকালের নাস্তার আয়োজন করছে । চুপচাপ কোমড়ে ওড়না পেঁচিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়ালো সাহায্য করার জন্য।

‘উঠে গেছিস। শেফালী উঠছে?’

মিতালী রুটি বানানোর জন্য খুন্ততি হাতে নিলো। উত্তর দিলো, ‘এখনো উঠেনি। ঘুমাচ্ছে।’

মিতালী রুটি বানানোর প্রস্তুতি নিলেই বাধ সাধেন আমেনা। বলে উঠলেন, ‘আরেহ্ তুই কষ্ট করবি কেন। যা যা আমিই করে নিচ্ছি। তুই গিয়ে শুয়ে থাক যা।’

মা মেয়ের কথোপকথনের মাঝে ফোঁড়ন কাটে মিতালীর দাদী জুলেখা। তিনি রান্না ঘরে এসেছিলেন নিজের চা নিতে। তখুনি আমেনার বলা কথাটা কর্ণগোচর হলো তার। তাই তো মুখ বাঁকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘হ হ, মাইয়া রে ঘরে বসাইয়া খাওয়াও। একটু তো কাম করতে দেও। একলা একলা আর কত করবা শুনি? তোমারে একটু সাহায্য করলেও ত পারে। সারাদিন তো দুই মাইয়া এই খানে ওই খানে ঘুরাঘুরি করে। কাম করতে দে একটু। কাম করলে শরির পঁচে না।’

আমেনা চুপ হয়ে গেলো। নিরব থেকে মিতালীর হাতে খুন্তিটা দিয়ে চুলায় ভাতের পাতিল বসালো। তারপর অপর পাশের চুলায় চায়ের পাতিল বসালো গরম করতে।

দাদীর কথা শুনে মৃদু হাসলো মিতালী। রুটি বেলতে বেলতে উত্তর দিলো, ‘আমিও তাই বলি দাদী। কিন্তু আম্মু তো বুঝে না। সাহায্য করতেও দেয় না।’

জুলেখা বিদ্রোপ মাখা হাসি দিলেন। বললেন, ‘তোর মা সারাজীবন এমনই করছে। আমারেও তেমন কাম কাইজ ধরতে দেয় নাই। একলা একলা পুরা সংসারের কাম করছে। বুঝছোস মিতালী। এমন পুতের বউ হাজারে একটা পাওয়া যায়।’

শাশুড়ির কথা শুন্র আলতো করে হাসলেন আমেনা। তারপর কাপে চা ঢেলে শাশুড়ির হাতে দিয়ে বললেন, ‘হইছে হইছে। এই নেন আপনার চা। রুমে চলে যান এখানে গরম বেশি।’

প্রতিত্তুর করলো না জুলেখা। চুপচাপ চা’য়ের কাপ হাতে নিয়ে রুমে চলে গেলেন। মিতালী আর আমেনা; দুই মা মেয়ে মিলে সকালের সম্পূর্ণ নাস্তা একা হাতে তৈরি করে নিলো। টেবিলে সব কিছু দুই জনই মিলে-মিশে সাজিয়েছে। বেশ কিছু সময় পর উপস্থিত হলো শেফালী। তার চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। পরনে তার টপ শার্ট। টেবিলের কাছে এসে মিতালীর পাশের চেয়ারটা টেনেই ধপ করে বসে পরলো। মিতালী তার পাশের চেয়ারে বসে ছিলো। চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়েই বললো, ‘মহারানীর ঘুম ভাঙ্গছে?’

প্রতিত্তুর করলো না শেফালী। ঠোঁট উল্টে বোনের দিকে তাকালো। অর্থাৎ কোনো এক কারনে তার আড়ামের ঘুম হারাম হয়েছে যার জন্য সে অসন্তুষ্ট। বোনের চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারলো মিতালী। শেফালীর এই অবস্থা দেখে আলতো করে হেসে উঠলো সে।

শেফালীকে ডাইনিং টেবিলে দেখেই আমেনা আদেশ করে বললেন, ‘তোর বাবা কে ডাক দিয়ে আয় তো। গিয়ে বল নাস্তা রেডি। আর হ্যাঁ আসার সময় তোর দাদীকেও ডাক দিস।’

শেফালীর চোখে-মুখে এখনো কিছু ঘুম লেগে আছে। যার ধরন বিরক্ত লাগলো তার। মুখ ব্যঙ্গ্য করে বললো, ‘দাদীকে ডাকতে হবে না। খাবারের ঘ্রান পেয়েই উড়ে চলে আসবে।’

ঠোঁট চেপে হাসলো মিতালী। আমেনা শেফালীর কথায় তার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। বিরক্তিতে নাকমুখ কুঁচকালো শেফালী। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো বাবা দাদীকে ডাক দিতে।

খাবারের পর্ব শেষ করেই মিতালী তৈরি হয়ে নিলো ভার্সিটিতে যাবার জন্য। চুল গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে নিলো। আজ চুল খোলা রাখবে বলে ঠিক করেছে তার মন। কালো রঙের থ্রি-পিসের সঙ্গে কালো রেশমি চুরি পরে নিলো। দুই কানে বড়বড় ঝুমকা আটকে নিলো। ঠোঁটে দিল হাল্কা গোলাপি লিপজেল। আয়নায় নিজেকে একবার ভালো করে প্রখর করে দেখলো। ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হলো বাসা থেকে। আজ হাতে অনেক সময় আছে। তাই ঠিক করলো হেঁটে যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলো। কোনো এক কারনে রাস্তাটা আজ নির্জন। কোলাহলপূর্ণ হয়ে আছে একদম। নিস্তর এই জনমানবহীন রাস্তায় একা হাঁটছে মিতালী। দখিণা মুগ্ধ বাতাসে চুল গুলো উড়ছে। ছোট বড় পাখির কিচিরমিচির ডাকে মুখরিত পরিবেশ। রাস্তার পাশে একটা ছোট পুকুর আছে। মিতালী পুকুর পাড়ের কার্নিশে দাঁড়ালো। দমকা কিছু শীতল হাওয়া শরিরে এসে লাগলো তার। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল মিতালী। মনে ভালো লাগার হাওয়া বয়ে গেলো তার মাঝে। আপন মনে গান গাইতে লাগলো সে। নিজের সেই প্রানপ্রিয় রবীন্দ্র-সঙ্গিত – ‘তোমার খোলা হাওয়া!’

তোমার খোলা হাওয়া
লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি
আমি ডুবতে রাজি আছি।
সকাল আমার গেল মিছে,
বিকেল যে যায় তারি পিছে গো-
রেখো না আর, বেঁধো না আর কূলের কাছাকাছি।
মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা,
ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।
ঝড়কে আমি করব মিতে,
ডরব না তার ভ্রূকুটিতে-
দাও ছেড়ে দাও, ওগো,
আমি তুফান পেলে বাঁচি।

সম্পূর্ণ গানটা চোখ বন্ধ করে গেয়েছে মিতালী। গানের প্রতিটা লাইন হৃদয়স্পর্শ করেছে তার। গান গাওয়া শেষে চোখ মেলে তাকালো। ঠোঁটে ফুটে এলো তার মৃদু মুচকি হাসি। তখুনি খেয়াল করলো এক জোড়া চোখ তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। নিজের পাশে হঠাৎ অংকুরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো মিতালী। তাৎক্ষনাৎ দু-কদম পিছিয়ে গেলো সে। বুকে হাত রেখে জুড়ে নিশ্বাস ছুঁড়ে বললো, ‘আপনি? এভাবে কেউ দাঁড়ায়? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’

দাঁত কেলিয়ে হাসলো অংকুর। বললো, ‘তোমার গানের গলায় ভীষণ সুন্দর। নতুন করে আবারো প্রেমে পরতে বাধ্য হলাম।’

মিতালী নিশ্চুপ থেকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো অংকুরের দিকে। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ ফিরিয়ে নিলো। চারপাশ নিরব হওয়ায় পাখির ডাক, কুকুরের আর্তনাদ এবং গাড়ির হর্ণের আওয়াজ কানে আসছে শুধু। নিরব-নিস্তর রাস্তার এক পাশ ধরে হাঁটছে দুজন। মৌনতা যেন তাদের সঙ্গ নিয়েছে আজ। হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে মিতালীকে দেখছে অংকুর। এতো গুলুমুলু কেন মেয়েটা? দেখতে কি কিউট লাগে। ফর্শা গাল দুটো টেনে দিলে লাল হয়ে যাবে নিশ্চয়? নিজে নিজে এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন হেসে উঠলো অংকুর। একা একা তাকে হাসতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকালো মিতালী। সেও মৃদু হেসে প্রশ্ন করলো, ‘একা একা হাসছেন যে? পাগল হলেন নাকি?’

হাসির মাত্রা আরো বৃদ্ধি করলো অংকুর। এক হাতে উড়ন্ত এলোমেলো চুল গুলো পিছে ঠেলে দিয়ে ঠিক করলো। মিতালীর প্রশ্নের প্রতিত্তুর করলো, ‘পাশে যদি একটা গুলুমুলু কিউট পাখি থাকে তাহলে এমনিতেই ভালো লাগে। ভালো লাগা থেকে প্রশান্তির হাসি আসে। ইউ নো হুয়াট? খোলা চুলে আজকে তোমাকে অনেক অনেক সুন্দর লাগছে।’

ভ্যাবাচেকা খেলো মিতালী। থমথমে চেহারা হয়ে গেলো তার। অংকুরের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো তাৎক্ষনাৎ। ধাতস্থ হলো সে। কেননা এই প্রথম, এই প্রথম কোনো পুরুষ মানুষের পাশাপাশি হাঁটছে সে। আবার সেই পুরুষ মানুষের কাছ থেকে প্রশংসা মুখর হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে তার। পায়ের গতির মাত্রা দ্বিগুণ করে নিলো। তার সাথে তাল মিলিয়ে অংকুর নিজেও দ্রুত হাঁটতে লাগলো। বললো, ‘এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন বলো তো? একটু তো আস্তে হাঁটো। নাহলে পথটুকু শেষ হয়ে যাবে। প্লিজ একটু আস্তে হেঁটে একটু বেশি সময় দাও।’

নিথর হলো মিতালী। নিরবে আপনা আপনি পায়ের গতি কমিয়ে দিলো। হাতে থাকা কালো ফিতার ছোট যান্ত্রীক যন্ত্রটার দিকে চোখ বুলালো। যথেষ্ট সময় আছে। আস্তে আস্তে গেলেও সমস্যা নেই। হঠাৎ-ই নিজের মনে অদ্ভুত প্রশ্ন জাগলো। সে কেন অংকুরের কথায় সাড়া দিয়ে আস্তে হাটছে? কেন অংকুর কে সময় দিবে সে? অংকুরের প্রতি কি তার দুর্বলতা কাজ করছে? আসলেই? নিজের মাথায় আসা সকল প্রকার অদ্ভুত চিন্তা গুলো ঝামটা মেরে ফেলে দিলো। রাস্তার আশেপাশে তাকালো একবার। না! আজ বাংলাদেশে গাড়ির অভাব পরেছে? কি আষ্টর্য।

পকেটে হাত গুঁজে হাঁটছে অংকুর। হাঁটার সময় সামনে নয় বরং পাশে থাকা রূপসী কে দেখছে। সদ্য ফোটা নিষ্পাপ পদ্মফুল। কাজল কালো চোখের মায়াবিনী। মনের মাঝে কেমন প্রশান্তির ভেলা ভাসছে। মনের সুপ্ত কোনে জাগ্রত হচ্ছে অসীম সমান ভালোবাসা। উড়ন্ত চুলের জন্য মিতালীকে তার কাছে পরী লাগছে। আনমনে মুচকি হাসলো সে। রাস্তার পাশে ভেলপুরির দোকান দেখে মিতালীকে প্রশ্ন করলো, ‘ভেলপুরি খাবে মিলি?’

চলমান..