অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-১৪+১৫

0
920

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১৪ 🌹🌿অপ্রত্যাশিত সম্পর্ক🌿🌹

রাতের ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাশ। তারসাথে চারপাশের অসংখ্য গোলাপের সুগন্ধ পরিবেশটাকে একেবারে মাতিয়ে রেখেছে। সাদিদ এমনিতেই নীলাতে মত্ত। আর আজ পরিবেশটা যেন তাকে আরও মাতাল করে তুলছে। সাদিদ নীলার গলায় কামড় দেওয়া যায়গাটাতে এবার ছোট্ট ছোট্ট চুমু খেতে লাগল। সাদিদের কামড়ে গলাটা হালকা জ্বলছিল। এখন সাদিদের ভেজা ঠোঁটের আলতো ছোঁয়ায় নীলার বড্ড আরাম লাগছে। নীলা আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলেছে। তারা দুইজন-ই একে অপরের সান্নিধ্যে এতটা মত্ত যে আশেপাশের কোনো কিছুতে আপাতত তাদের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। তারা কেবল ভালোবাসা পাওয়া এবং দেওয়াতে ব্যস্ত।
আচমকা অনেকগুলো টর্চ লাইটের আলোতে তাদের চোখ ঝলসে উঠল। তাই সাদিদ নীলাকে ছেড়ে দিয়ে চোখের উপর হাত ধরল। আলোগুলো সব চোখে এসে লাগছে।

— ‘ দেখছেন মেম্বারসাব, আমি আপনেরে কইছিলাম না দুইডা পুলা-মাইয়া বাগানের মধ্যে ফষ্টিনষ্টি করতাছে। ‘
— ‘ হুম জামাল। তাইতো দেখতাছি। ঢাকার থাইক্কা নোংরা মাইয়া-পোলা আইয়া অহন আমাদের গোলাপ গ্রামটাও নোংরা করতে লাগছে। ‘
— ‘ মেম্বারসাব, এইগুলোরে এহন-ই মাটির নিচে পুঁতে ফেলেন। তাইলে আর ভবিষ্যতে এমন দুঃসাহস কারও হইব না। ‘
— ‘ আরে মিয়ারা আস্তে। দেখি না আগে রসের নাগররে। তারপর না হয় মারামারির কথা আইব। ‘

নীলা সাদিদের শার্ট ভয়ে শক্ত করে খামচে ধরেছে। সাদিদও নীলাকে একহাতে শক্ত করে জড়িয়ে রয়েছে। সামনের লোকজনের কুৎসিত কথাগুলো শুনে তার আর বুঝার বাকি নেই যে, তারা মস্ত বড় একটা ঝামেলায় ফেঁসে গিয়েছে। কিন্তু এখন নোংরা কথা শুনে মাথা গরম করলে চলবে না। পরিস্থিতি সামলাতে ধীরে সুস্থে পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা তারা গ্রামের মানুষ, খুনাখুনিতে যেতে তাদের সময় লাগবে না।
সাদিদ এবার নীলাকে ছেড়ে এগিয়ে আসতে চায়ল। কিন্তু নীলা ভয়ে মাথা ডানে-বামে করছে। ভয়ে তার চোখজোড়াতে অশ্রুকণারা এসে ভিড় জমিয়েছে। নিজের প্রাণপাখির অসহায়-ভয়ার্ত মুখটা দেখে সাদিদের বুকটা চিনচিন ব্যাথা করছে। দোষটা তার-ই, নীলাকে নিয়ে এতরাতে এমন একটা গ্রাম্য পরিবেশে আসা তার মোটেই ঠিক হয়নি। সেও তো এমনটা চায়নি। কিন্তু সব মিলিয়ে এতটা রাত হয়ে গেল। এখন এসব ভেবে খারাপ বৈকি লাভ হবে না। তাই সে নীলাকে নিয়েই সামনে এগিয়ে গেল।

— ‘ আসসালামু আলাইকুম। আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি এই এলাকার একজন সম্মানিত লোক। আপনাদের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে আপনারা বিষয়টা খুব খারাপভাবে নিচ্ছেন। প্লিজ দয়া করে এমনটা চিন্তা করবেন না৷ আমরা ভালো ফ্যামিলির ছেলেমেয়ে। কারণবশত এখানে এত রাত হয়ে গিয়েছে। ‘

মোর্শেদ তালুকদার সাদিদের কথায় তার পাশের লোকদের দিকে তাকালেন। তারা নিজেদের মধ্যে ফোঁসুর ফোঁসুর করছে। সাদিদের কথায় তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাচ্ছে। আর তাদের দেখে ভদ্র পরিবারের মেয়ে-ছেলেও মনে হচ্ছে। তাই তারা এবার খানিকটা ধমল। কিন্তু পাশ থেকে চৌকিদার জামাল বলে উঠল,

— ‘ মেম্বারসাব, আপনি ওমন চুপ কইরা আছেন ক্যান? এই পুলা কি কইল আর না কইল তাতে আপনারা ধইম্মা যাইতেছেন ক্যান মিয়া ভাইরা। এগুলারে শাস্তি দেওন লাগবে। নতুবা আমাগো গেরামের বদনাম হইব। ‘
— ‘ প্লিজ আপনি এমন করে বলবেন না। একটু বুঝার চেষ্টা করুন। আমরা কোনো খারাপ কাজ করছিলাম না। ‘
— ‘ অত্ত বড় মিছা কথা! আমি নিজের চোক্ষে দেখছি তুই এই মাইয়ার পরনের শাড়ি খোইলা বুকের উপর দলাই-মলাই, চুমাচুমি… ছিঃ ছিঃ আমার মুখ দিয়ে এসব কথা বাহির হইব না। ‘
— ‘ নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ। ‘

উপস্থিত সবাই এবার থুথু ছিটিয়ে তাদের ঘৃণা প্রকাশ করছে।
সাদিদ অসহায় চোখে চৌকিদার জামালের দিকে তাকালো। হালকা আলোতে তার পান খেয়ে বিদঘুটে হলুদ দাঁতগুলো আরও বেশি বিদঘুটে লাগছে। আর সে সেই বিদঘুটে দাঁত ক্রমাগত কিড়মিড় করছে। আজকাল মানুষ কারও ভালো না করতে পারুক, কিন্তু মন্দ করতে পিছুপা হবে না। চৌকিদার জামাল নিঃসন্দেহে সেই লোকগুলোর অন্তর্ভুক্ত।

— ‘ এই, তোরা কে কোথায়? এগুলারে বাইন্ধা নিয়ে আয়। ‘
— ‘ প্লিজ এমনটা করবেন না। আপনারা একটু ওয়েট করুন, আমি এখনই পাশের থানার অফিসারের সাথে যোগাযোগ করছি। ‘
— ‘ মেম্বারসাব, খবরদার এই পুলার কথা হুনবেন না। হে বহুত চালু আছে। ‘

সাদিদের ইচ্ছে করছে জামালকে তুলে একটা আছাড় দিতে। শুধু পরিস্থিতির চাপে তাকে চুপচাপ এসব বাজে কথা সয়ে যেতে হচ্ছে।

— ‘ না, কোনো অসি-টসি ডাকা লাগব না। আমি গ্রামের মেম্বার, তাই আমি-ই এর বিচার করুম। এই নিয়ে আয় তাদের। ‘

সাদিদ নীলার দিকে তাকিয়ে একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। নীলা সাথে আছে বিধায় মারামারি বা হাতাহাতি কোনোটাই সাদিদ এখন করতে পাড়ছে না। কেননা সে কোনোভাবেই নীলাকে নিয়ে রিক্স নিতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের সাথে যেতে হচ্ছে।

.

একটা বড় উঠুনের মাঝখানে নীলা-সাদিদকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মনে হচ্ছে তারা কোনো ফাঁসির আসামি। আশেপাশের পরিস্থিতি ঠিক এমনটাই নির্দেশ করছে। রাত অনেক হলেও ছেলে, বুড়ো, মহিলা মানুষের অভাব নেই। গ্রামে মোটামোটি অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের ঘটনা ছড়িয়ে পরেছে। সাদিদ শিউর না কিন্তু তার সিক্স সেন্স বলছে, এখানে অবশ্যই চৌকিদার জামালের হাত রয়েছে। উৎসুক জনতা ইতিমধ্যে অপরাধীদের শাস্তি পর্যন্ত নির্ধারণ করে ফেলেছে।

— ‘ আপনারা এটা ঠিক করছেন না। আপনারা যদি আইনগত কোনো শাস্তি দিতে চান তাহলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমাকে একটা কল করার সুযোগ দিন। তারপর না হয় আপনারা কোনো পদক্ষেপ নিবেন। ‘
— ‘ শুনো শহুরে ছেলে, এটা আমাদের গ্রাম। তাই এখানে তোমার কথা চলবে না। ‘
— ‘ কিন্তু আমাকে একটা…
— ‘ এই মিয়া থাম। মাইয়া নিয়া আমাদের বাগানে ফষ্টিনষ্টি কইয়া আইছস কথা কইতে! ‘
— ‘ আপনি চুপ করেন। সেই কখন থেকে আজেবাজে কথা বলছেন। ও আমার হবু স্ত্রী। দুইজনে একটু ভালো সময় কাটানের জন্য এখানে এসেছিলাম। বিশ্বাস না হলে বাগানের লোকের সাথে কথা বলেন। উনারা টাকা নেওয়ার সময় তো এমন কিছু বলেনি। নতুবা আমরা কখনও আসতাম না। ‘
— ‘ হেরে ছমির, তোর বাগানেই তো এইসব। তুই কিছু-ক। ‘
— ‘ তালুকদার সাহেব, এহানে আমার কোনো দোষ নাই। এই ভাই আমাদের টাকা দিয়া সব ব্যবস্থা করছে। কিন্তু তারা যে এই আকাম করব আমাগো এমন কিছু কয় নাই। ‘
— ‘ আপনারা বারবার এমন বাজে শব্দ ব্যবহার করছেন কেন? আমিতো বললাম সে আমার হবু স্ত্রী। খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করব। তাই প্লিজ এমনভাবে বলবেন না। ‘

সাদিদের কথা শুনে এবার মোর্শেদ তালুকদার কপালে আঙ্গুল ঘষে কিছু চিন্তা করতে লাগলেন। মিনিটখানেক পর গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,

— ‘ তা তোমরা সত্যিই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইতে যাইতাছ? ‘
— ‘ জ্বি, ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই। ‘
— ‘ তাইলে মিয়া তোমাগো মাফ করন যাইব। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। ‘
— ‘ অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি বলুন আমি আপনার শর্ত পূরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। ‘
— ‘ তোমরা বিয়া করো আর যাই করো, কিন্তু তোমাদের লাইগ্গা আমাগো গ্রামের সম্মান নষ্ট হইছে। এহন যদি আমরা তোমাদের এমনি এমনি ছাইরা দেই, তো আমাদের গ্রাম লোকসমাজের কাছে ছোট হইয়া যাইব। কেউ আমাদের গোলাপ গ্রামরে নিরাপদ মনে করব না। ‘

এইটুকু বলে মোর্শেদ তালুকদার থামলেন। সাদিদ-নীলার দিকে একপলক তাকিয়ে বললেন,

— ‘ তাই তোমাদের এই মুহূর্তে বিয়ে করতে হইব। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক এই মাইয়ারে তোমার এহন বিয়ে করা লাগব। আমাদের সবার সামনেই এই বিয়া সম্পূর্ণ হইব। নতুবা আমরা তোমাদের যাইতে দিমু না। ‘

তালুকদারের কথা শেষ হতেই উপস্থিত আম-জনতা বাহ্বা দিতে লাগল। সবাই তার বিচারে মারাত্মক খুশি। তালুকদার সাহেবও হাত নাড়িয়ে সবার বাহ্বা সাধরে গ্রহণ করছেন।
সাদিদ একপলক পাশে দাঁড়ানো নীলার দিকে তাকালো। তার গাল বেয়ে টুপটুপ করে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। সবার এমন কথা শুনে সে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। সাদিদ লম্বা করে একটা শ্বাস টানল। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে উঠল,

— ‘ দেখুন আমরা এমন কিছু করব না। বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা নয়। আমরা বিয়ে অবশ্যই করব। কিন্তু সেটা আমাদের পরিবারের সব সদস্যদের উপস্থিতিতে, তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে। এভাবে তাদেরকে ব্যতিত আমাদের পক্ষে বিয়ের মতো জীবনের একটা গুরত্বপূর্ণ কাজ করা সম্ভব নয়। ‘
— ‘ এটা কইলে তো হইব না মিয়া। তোমাগো লাইগা আমাদের সম্মানিত মেম্বারসাবের কথা ফেলনা যাইব ক্যান? ইতা আমরা হইতে দিমু না। কি গো মিয়ারা তোমরা কিছু কও। ‘
— ‘ হুম হুম। ইতা আমরা হইতে দিমু না। ‘

উৎসুক জনতার চেঁচামেচি বেড়ে গেল। অপরদিকে চৌকিদার জামালের মুখে তৃপ্তির হাসি। সাদিদ নিজের রাগকে আর সংবরণ করতে পারল না৷ এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে চৌকিদারকে এক থাপ্পড় মেরে বসল।

— ‘ তোকে এইটা আরও বহুত আগেই দেওয়া দরকার ছিল। ভদ্রতা বজায় রেখে এতক্ষণ শান্ত ছিলাম। ‘

চৌকিদার মার খেয়ে সাপের মতো ফুঁসে উঠল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল,

— ‘ এই জমিলার মা এইদিকে আয়। আর মিয়ারা তোমরাও আহো। এখনই এই হারাম* আর তার প্রেমিকারে মাটির নিচে পুঁতে দিমু। হেতের কতবড় সাহস হে আমার গায়ে হাত দেয়। ‘

সবাই মোটামোটি তেড়ে আসতে নিলেই সাদিদ একহাতে নীলাকে বুকে টেনে নিলো। নীলা এমন পরিস্থিতিতে পড়ে থরথর করে কাঁপছে। সাদিদ তাকে বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে আঙ্গুল উচিয়ে শাসিয়ে বলল,

— ‘ খবরদার যদি কেউ একপা এগিয়েছ তো। ওর গায়ে একটা আঁচড় লাগলে তোমাদের একটাকেও আমি ছাড়ব না। সবকটাকে খুন করে ফেলব। ‘

সাদিদের রাগী স্বরের এমন হুঁশিয়ারতে সবাই পিছিয়ে গেলেও চৌকিদার পিছিয়ে আসলো না। বড় লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসতে গেলেই সাদিদ তার বুক বরাবর সজোরে একটা লাথি দিয়ে বসল। চৌকিদার মাটিতে ছিটকে পড়ে আর্তনাদ করে উঠল। সে বুকে হাত চেপে ব্যাথাজনক শব্দ করতে লাগল।
সাদিদের চোখ-মুখ রাগে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তার এমন অবস্থা দেখে সবাই আর আগানোর সাহস পেল না। তালুকদার সাহেব এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। সাদিদের সামনে গিয়ে রাগ মিশ্রিত গম্ভীরস্বরে বলে উঠলেন,

— ‘ এইটাতো ঠিক না মিয়া। তোমরা নিজেরা অন্যায় কইরা এহন আমাদের গ্রামের লোকজনের সাথে মারামারি করতাছ! ‘
— ‘ আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি এমনটা মোটেও করতে চাইনি। কিন্তু এই লোাকটার বাড়াবাড়ি আর সহ্য করতে পারিনি। ‘
— ‘ মেম্বারসাব, আপনারে আমার এই বুকের বেতনার কসম, এই পুলারে আপনি ছাড়বেন না। হালা খায় কি? অত জোরে লাথি দিচ্ছে মনে হইতাছে ছাতনার কয়েকটা হাড্ডি ভাঙা গেছে। ‘

সাদিদ আবারও চোখ গরম করে চৌকিদারের দিকে তাকালো। সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বুক ঠলতে শুরু করল।

— ‘ এই করিম যা তো, মোল্লারে ডাইক্কা আন। বিয়ে এহন-ই হইব। ‘
— ‘ আমি আগেও বলেছি আমরা কখনও এই বিয়েতে সম্মতি দিব না। ‘
— ‘ বিয়া করবা না? খুব ভালা কথা। তালুকদার সাহেব তাইলে আপনি অনুমতি দেন, আমি এই মাইয়া-পুলার ভিডিও করি।
” বাগানে ফষ্টিনষ্টি করতে গিয়া হাতেনাতে ধরা। ” এমন একটা শিরোনাম দিয়া ফেইসবুকে ছাইরা দিলেই কেল্লাফতে। মিনিটেই ভাইরাল হইয়া যাইব। ‘
— ‘ প্লিজ এমন করো না। তুমি বয়সে আমার ছোট ভাইয়ের মতো। এসব করলে আমাদের ফ্যামিলির বদনাম ছড়িয়ে পড়বে। ‘
— ‘ তো আর কিতা করতাম? আপনেরা বিয়া করতে রাজি না হইলে আমাগো এমনটাই করা লাগব। তালুকদার সাহেব ভিডিও করুম? ‘
— ‘হ্যাঁ কর। ‘

কলেজে পড়ুয়া ছেলেটা ফোন হাতে নিতেই সাদিদ নীলার মুখের দিকে তাকালো। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। সাদিদের নিজের উপর-ই বারবার রাগ হচ্ছে। রাত করে নীলাকে এই জায়গায় আনাটাই তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। যে ভুলের খেসারত এখন তাদের দুইজনকেই সমানতালে দিতে হবে।

— ‘ থাম। আমরা বিয়েতে রাজি। ‘

সাদিদের এমন কথায় নীলা চমকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। সাদিদ মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে নীলার গালে হাত রাখল। খুবই স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

— ‘ পাখি, আর কাঁদে না। আমি বাসায় গিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে বলব। তারা অবশ্যই আমাদের সিচুয়েশন বুঝতে পারবে। ‘

নীলা কান্নারুদ্ধ কন্ঠে মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে না করল। সাদিদ আবারও হেসে তার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,

— ‘ বিয়ে তো আমরা আজ না হয় কাল করতাম-ই। পরিস্থিতিতে না হয় এখনই করছি। তুমি প্লিজ ভয় পেও না। আমি আছিতো, সবকিছু সামলিয়ে নিব। ‘

.

অবশেষে কাজিকে তালুকদার বাড়িতে ডাকা হলো। নগদ বিশহাজার একটাকায় মোহরানা ধার্য করে কাজিসাহেব সাদিদকে কবুল বলতে বললেন।
সাদিদ নীলার হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠল,

— ‘ কবুল, কবুল, কবুল। ‘

কাজিসাহেব এবার নীলার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ‘ মা এইবার তোমার পালা। বলো কবুল। ‘

নীলা সাদিদের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাতেই সাদিদ ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করল। নীলাও বুঝতে পারছে এইমুহূর্তে বিয়ে ছাড়া এখান থেকে তাদের মুক্তি পাবার আর কোনো রাস্তা নেই। চোখ বন্ধ করে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে সে বলে উঠল,

— ‘ কবুল, কবুল, কবুল। ‘

বিয়ে সম্পূর্ণ হতেই কাজি সাহেবসহ বেশ কয়েকজন বলে উঠল,

— ‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘

নীলা সবার সামনেই এবার সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে কান্না করে উঠল। সাদিদ নিজেও এই পরিস্থিতির স্বীকার, তাই নীলার বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে তার একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। সে আলতো হাতে নীলার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। এখানের ঝামেলা তো মিটমাট হলো। এখন শুধু দুই পরিবারের বাকি সদস্যদের সবটা বুঝাতে পারলেই হলো।

__________________

সাদিদ একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ডাইভ করছে। ঘড়ির কাটা আনুমানিক একটার উপরে। নিঃশব্দে এতক্ষণ গাড়ি গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। কারও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ হচ্ছে না। বিয়ের মতো এমন একটা খুশির বিষয়েও দুইজনের কেউ খুশি হতে পাড়ছে না। বিষন্নতায় দুইজনের মনসহ পরিবেশটাও ছেয়ে গিয়েছে।
সাদিদ-ই নীরবতা ভেঙে ডেকে উঠল,

— ‘ পাখি? ‘

নীলা উত্তর দিলো না। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে থাকল। সাদিদ একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ডাইভিং-এ মননিবেশ করল। কি সুন্দরভাবে রাতটা শুরু হয়েছিল। অথচ শেষ হলো এতটা কুৎসিতভাবে। যেখানে আজ তারা জীবনের সুখি দিনগুলোর স্বপ্ন সাজাতো। ভবিষ্যতের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো ভেবে পুলকিত হতো, সেখানে আজ দুইজনই বিষন্ন-হতাশ মনে বসে রয়েছে। হাসির বদলে মুখে এসে ভিড় জমিয়েছে অবাধ্য অশ্রুকণা।
সাদিদ নীলাকে নিয়ে পদ্মলয়া থেকে সামান্য একটু দূরে এসে গাড়ি থামাল। গাড়ি থামাতেই নীলা চোখ খোলে তাকালো। কিন্তু সামনে পদ্মলয়ার এড়িয়া দেখে সে অবাক দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকালো।

— ‘ আমি এই মুহূর্তে আর কোনো হড্ডগোল চাচ্ছি না। সকালে ঠান্ডা মাথায় সবাইকে সবকিছু জানাব। কিন্তু এখন তোমাকে কেউ এইরকম বেশভূষা দেখলে অন্য কিছু ভাবতে পারে। তাই এখানে নিয়ে আসলাম। তুমি একটু বসো আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাসা থেকে ফিরে আসছি। ‘

নীলা হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না। সাদিদও আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাসার ভিতর চলে গেল।
কিছু সময় পর সাদিদ হাতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।

— ‘ পাখি শাড়িটা চেইঞ্জ করে এটা পরে নাও। ‘
— ‘ কি এটা? ‘
— ‘ তোমার জন্যই কিনেছিলাম। সিম্পল একটা রেডিমেড সুট। তুমি পিছনে গিয়ে চেইঞ্জ করে নাও। আমি ততক্ষণ বাহিরে দাঁড়াচ্ছি। ‘

সাদিদ নীলার উত্তর না শুনেই বাহিরে চলে গেল। নীলাও চুপচাপ সাদিদের দেওয়া ড্রেসটা নিয়ে পিছনে বসল।
প্রায় অনেকক্ষণ পরে নীলা জানালার কাচটা অল্প একটু নামিয়ে ভিতর থেকে আওয়াজ দিলো,

— ‘ এই যে শুনছেন? ‘
— ‘ হ্যাঁ বলো পাখি, হয়েছে তোমার? ‘
— ‘ না। একটু সমস্যা হচ্ছে। ‘
— ‘ কি, আমাকে বলো। ‘
— ‘ আসলে… না মানে… আসলে…
— ‘ এতো ইতস্ততবোধ করছ কেন? কি সমস্যা বলে ফেল। ‘
— ‘ না মানে সেফটিপিন ব্লাউজের সাথে আটকে গিয়েছে। কোনোভাবেই খোলতে পাড়ছি না। একটু যদি হেল্প, না মানে…

সাদিদের আর নীলার এতক্ষণের আসলে নকলের অর্থ বুঝার বাকি নেই।
সাদিদ বিনাবাক্য গাড়িতে উঠে গাড়ির ভিতরের লাইটটা জ্বালিয়ে নীলার পাশে এসে বসল। নীলা এখনও সেফটিপিন খোলার চেষ্টায় রয়েছে।

— ‘ পাশ ফিরে বসো। আমি খোলতে সাহায্য করছি। ‘

নীলা পাশ ফিরতেই সাদিদ তার ঘাড়ের চুলগুলো সামনে এনে দিলো। সেফটিপিনটা আঁকাবাঁকা হয়ে গিয়েছে। তাই নীলা বের করতে পাড়ছে না। সাদিদও কিছুক্ষণ চেষ্টা করল। হচ্ছে না বিধায় নীলার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ পাখি হচ্ছে না। এটা কেটে ফেলি? ‘
— ‘ না। ‘

নীলা প্রায় আতংকে বলে উঠল। এত দামি শাড়িটা সাদিদ তাকে উপহার দিয়েছে। কেবল আজকেই এটা পড়ল। আর এখন নাকি কেটে ফেলবে!

— ‘ তাহলে আর কি করব? এটা ছাড়াতে পাড়ছি না। ‘
— ‘ আপনাকে করতে হবে না। আমাকে দিন, আমি দেখছি। ‘
— ‘ তুমি বোধহয় আমার থেকে বেশি পাড়বে! চুপচাপ বসো। আমি-ই করব। ‘

সাদিদের বাচ্চামো দেখে নীলা এতক্ষণে মৃদু হাসল। নতুবা হাসির রেখার যেন মুখে প্রায় বিলুপ্তি ঘটেছিল। সাদিদ পুরো দমে এবার সেফটিপিনির সাথে যুদ্ধ লাগল। টানাটানি করতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ব্লাউজটা কাঁধের নিচে এসে নামল। এবং নীলার থার্ড পেপার সাদিদের সামনে উঁকি দিলো। লজ্জায় নীলার প্রায় মাটির নিচে যাবার অবস্থা।
নীলা দ্রুত ব্লাউজ টেনে কাঁধ আড়াল করল। সাদিদ কয়েক মুহূর্তের জন্য ভেবাচেকা খেলেও পরমুহূর্তেই তার মাথায় দুষ্টুমি চাপল। সে নীলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘মেয়েদের নাকি এসব ক্ষেত্রে পিংক পছন্দ। কিন্তু তোমার সাদা কেন? আমাকে স্মরণ করে নাকি? ‘

নীলা লাজুক হেসে কনুই দিয়ে সাদিদকে মৃদু ধাক্কা দিলো। সাদিদও হাসল। কিন্তু সেটা নীলার অগোচরে। নীলা কাঁধে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে সে আবারও দুষ্টুমিস্বরে বলে উঠল,

— ‘ সাইজ কত? ‘

নীলা এবার পারে না গাড়ি থেকে দৌড়ে চলে যেতে। এই ছেলেটা কত নম্বরের নির্লজ্জ সেটা নীলার আন্দাজেও বাহিরে। নীলা নিচুস্বরে বলল,

— ‘ অসভ্য লোক। ‘
— ‘ সত্যি কথা বললেই অসভ্য! আর তুমি না বললে কি? আমিতো জানি। ‘

নীলার চমকিত দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে সাদিদের দিকে তাকাতেই সে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল। নীলার একেবারে কাছাকাছি মুখ নিয়ে এসে বলল,

— ‘ তখন আন্দাজে তোমার ব্লাউজ আনলাম না? সাইজ তো ঠিক-ই মনে হচ্ছে। ‘

নীলা দ্রুত মুখ ফিরাল। এই ছেলের সাথে যত কথা বলবে তত লজ্জা দিবে। কিন্তু সাদিদ যে দুষ্টুর শিরোমণি। নীলাকে আরও লজ্জায় ফেলতে বলে উঠল,

— ‘ আমার কাছে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? এখন থেকে তো তোমার প্রয়োজনীয় এসব আমি-ই নিয়ে আসব। তাই সবকিছুর সাইজ জানা আমার জন্য অতিবজরুরি। ‘

নীলা লজ্জায় পিছন থেকে কোশন নিয়ে সাদিদের উপর ছুঁড়ে মারল। আর সাদিদ মৃদু হেসে গাড়ির বাহিরে চলে আসলো। নীলা ড্রেস চেইঞ্জ করে সামনে আসতেই সেও এসে ডাইভিং সিটে বসল। কিছুসময় পর সাদিদ হঠাৎ-ই ডেকে উঠল,

— ‘ বউ? ‘

নীলার বুকটা ধক করে উঠল। সে তো সত্যি-ই এখন এই শব্দটার উপযোগী। সে কারও বিয়ে করা বউ। কিন্তু আকষ্মিকতায় এই শব্দটার সাথে নীলা নিজেকে খাপ খাওয়াতে পাড়ছে না। তাই ইতস্ততবোধ কন্ঠে বলল,

— ‘ প্লিজ এই নামে ডাকবেন না। কেমন যেন লাগছে। ‘
— ‘ কেমন লাগছে আবার? বউকে বউ বলে ডাকব না! ‘
— ‘ না, ডাকার দরকার নেই। ‘
— ‘ তাহলে পাখিবউ ডাকব? ‘

নীলা জানালার বাহিরে তাকিয়ে লাজুক হাসল। এই ছেলে মারাত্মক। নিজেরটা ষোলো আনা কিভাবে আদায় করতে হয় সেটা তার ভালো-ই জানা। বাসার সামনে আসতেই নীলা আচমকা বলে উঠল,

— ‘ আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। ‘
— ‘ হ্যাঁ, কি কথা বলো। ‘
— ‘ আপাতত বিয়ের বিষয়টা পরিবারকে জানাতে চাইছি না। ‘
— ‘ কেন? এতবড় বিষয় না জানিয়ে কিভাবে রাখব? ‘
— ‘ সেইটাই, এতবড় বিষয়। তাই জানাতে চাইছি না। সবাই এইমুহূর্তে জানলে খুব কষ্ট পাবে। ‘
— ‘ আরে পাখি কোনো কষ্ট পাবে না। দেখ তারা খুব খুশি হবে। ‘
— ‘ প্লিজ, আমার এই কথাটা রাখুন। আপনি তো শীঘ্রই আমাকে বিয়ে করবেন। তাই তাদের এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিয়ের কথাটা জানানোর প্রয়োজন নেই। ‘

নীলার ইতস্ততবোধ দেখে সাদিদ এবার দমে গেল। সত্যিই সে শীঘ্রই নীলাকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে চায়। তাই আপাতত তাদের না জানলেও খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তাই মুচকি হেসে বলল,

— ‘ আচ্ছা যাও জানাবো না। ‘

নীলাও এবার মৃদু হাসল। কিন্তু দুষ্টু সাদিদ পরমুহূর্তেই বলে উঠল,

— ‘ তার মানে তোমার জন্য আমাকে বিবাহিত হয়েও ব্যাচেলর থাকতে হবে! খুব দুঃখের বিষয় পাখিবউ। ‘

নীলা লজ্জা পেয়ে গাড়ির দরজাতে হাত দিতেই সাদিদ তার হাতটা টেনে ধরল। মুচকি হেসে সে নিচে নেমে নীলার পাশের দরজাটা খোলে দিয়ে তাকে নামালো। তারপর নীলার গালে হাত দিয়ে কপালে দীর্ঘ চুমু খেল। চোখে চোখ রেখে বলল,

— ‘ আমার বউকে তোমার হেফাজতে দিয়ে গেলাম। কোনো অযত্ন করলে তোমার খবর আছে। ‘
— ‘ এখন শুধু বউ? আমি কিছু নই! ‘
— ‘ তুমিতো আমার প্রাণপাখি, এখন আবার বউপাখি। আবার অল্প কিছুদিন পর হয়ে যাবে আমার বাচ্চাদের মা-পাখি। ‘

নীলা সাদিদকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরাল। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,

— ‘ খারাপ লোক একটা। সবসময় আজেবাজে কথা। ‘

নীলার ফিসফিসিয়ে কথা শুনে সাদিদ মুখে ভীষণ অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে বলে উঠল,

— ‘ আর মনে মনে গালমন্দ করো না পাখি। এমনিতেই বড্ড জ্বালায় আছি। বিয়ে করলাম অথচ বউ সাথে নেই। বিয়ের প্রথম রাত নিয়ে সবার কত আশা থাকে। অথচ আমি কিনা বউয়ের পাশেই থাকতে পাড়ছি না৷ বউয়ের আদর তো দূরের কথা নাগাল পাওয়া-ই দুঃসাধ্য। এত কষ্ট সহ্য করা যায়? ‘

নীলা সাদিদকে পিছনে ফেলে দৌড় দিলো। এখন এই ছেলের সামনে থাকলে তাকে আরও লজ্জাজনক কথা বলে পুরো মিইয়ে দিবে। কারণ সে প্রকৃত অর্থেই একজন ঠোঁটকাটা। নির্লজ্জের কারখানা।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১৫

স্নিগ্ধ সূর্যের আলো সাদিদের মুখে লাগতেই সে পাশ ফিরল। জীবনের খুব মধুর একটা মুহূর্তের সুখ কল্পনায় সে এখন ব্যস্ত। বন্ধ আখিঁদ্বয়ের মধ্যেও তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। পাশের কোলবালিশটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে গেলেই সাদিদ দ্রুত চোখ খোলে তাকালো। মুহূর্তেই তার চক্ষু বিস্ফোরিত হলো। উপরের হালকা চাদরটা সরিয়ে সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রাগীস্বরে বলে উঠল,

— ‘ তুই এখানে কি করিস? ‘
— ‘ ঘুমাতে আসছি। ‘

তানহার নিলিপ্ত বাক্যে সাদিদের রাগটা তরতর করে বেড়ে গেল। মুহূর্তেই ফর্সা কপালের রগটা ফোলে উঠল। নিজেকে সে শান্ত রাখতে পাড়ছে না। তারপরও যথেষ্ট চেষ্টা করে বলল,

— ‘ ঘুমাবি ভালো কথা। কিন্তু আমার রুমে কেন? আর তুই ভিতরে আসলি কিভাবে? আমিতো দরজা ভিতর থেকে লক করে ঘুমিয়েছি। ‘
— ‘ ফাস্ট অফ অল তোর রুমে আমার ঘুমটা চাপে বেশি। আর ভিতরে কিভাবে আসলাম? এইতো চাবি। ‘

বলেই তানহা হাতের মুঠোতে চাবিটা উপরে ঢিল মেরে ক্যাচ করল। মুখে তার দুষ্টু হাসি। যেন সে খুব ভালো একটা কাজ করেছে।

— ‘ তুই এতটা নির্লজ্জ কিভাবে হতে পাড়িস! আমি ঘুমিয়েছিলাম। এমতাবস্থায় লক খোলে ভিতরে এসে আমার-ই বিছানায় আমার পাশে শুয়ে থাকতে তোর বিবেকে একটুও বাঁধল না? ‘

সাদিদের মুখে রাগের পাশাপাশি ঘৃণার আভাস। প্রিয়তির মুখটা এবার মলিন হলো। সে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে এসে সাদিদের বুকে ঝাপটে পড়ল। বিষয়টা এতটাই দ্রুত ঘটেছে যে সাদিদ আঁচ পর্যন্ত করতে পারেনি। সে এবার ঝাটকা মেরে তানহাকে দৌড়ে সরাল৷ চোখ গরম করে আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসাল,

— ‘ খবরদার তানহা। তোকে আমি আগেও সাবধান করেছি। একদম আমার গা ঘেঁষার চেষ্টা করবি না। নতুবা তোর কুকীর্তির কথা সবাইকে জানাতে আমি বাধ্য হব। ‘
— ‘ কেন? কেন সাদি, বল আমাকে? এত কেন বিতৃষ্ণা তোর! আমার মধ্যে কিসের অভাব? কতটা বছর ধরে তোর পিছনে পড়ে রয়েছি অথচ তুই একবার ফিরেও তাকাস না। কেন রে? কি কমতি আছে আমার মধ্যে? তোর জন্য নিজেকে কোনো দিক দিয়ে কম রাখিনি। তারপরও কেন আমাদের মধ্যে এই দুরত্ব? ‘

সাদিদের এবার খারাপ লাগছে। সাদিদতো জানে এই মেয়েটা তাকে কতটা পছন্দ করে। তার জন্য কত ভয়ংকর কাজও করে ফেলতে পারে। কিন্তু সাদিদও যে নিরুপায়। ভালোবাসা যদি জোর করে আদায় করা যেত তাহলে এই জিনিসটার মূল্য এতটা হতো না। সাদিদ ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে এককদম এগিয়ে এলো। নরমস্বরে বলল,

— ‘ দেখ তানহা, আমি তোকে আগেও বলেছি। তোকে আমি বোন আর ফ্রেন্ড ব্যতিত অন্যকিছু আগেও ভাবিনি। আর এখনও ভাবছি না। প্লিজ আমার পিছনে পড়ে না থেকে ফুফা-ফুপির পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে ফেল। আমি শুনেছি ছেলেটা তোর জন্য পাগল। ‘
— ‘ কিন্তু আমিতো নই। আমি যে তোর জন্য পাগল। প্লিজ সাদি একটু চেষ্টা কর। একটু ভালোবাস। কথা দিচ্ছি তোর জীবনটা সুখে ভরিয়ে দিব। ‘
— ‘ তানহা, আবার তোর পাগলামি শুরু! প্লিজ এমন করে বলিস না। নিজের কাছেই শুনতে খারাপ লাগে। ‘

তানহা এবার এগিয়ে এসে সাদিদের গালে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরল। সাদিদ পিছিয়ে গিয়ে সরিয়ে নিতেই আবারও এসে তানহা তাকে ঝাপটে ধরল। সে অস্থির হয়ে বলতে লাগল,

— ‘ প্লিজ এমন করিস না। আমি তোকে ভালোবাসি ইয়ার। তোর জন্য সব কিছু করতে পারব। প্লিজ আমাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিস না। ‘
— ‘ তানহা ছাড় বলছি। আমি কিন্তু রাগে কিছু একটা করে বসব। ‘
— ‘ প্লিজ কর। একটাবার কাছে টেনে নে। দেখবি এত সুখ আর কোথাও পাবি না। ‘

তানহা এবার পাগলামি করে টপসের বোতাম খোলা শুরু করতেই সাদিদ তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরাল। কিন্তু তানহা তাতেও থেমে থাকল না। টপসটা একটা টানে শরীর থেকে খোলে নিলো। সাদিদ দ্রুত চোখ বন্ধ করে পিছনে ফিরে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে ধরতেই তানহা এসে বাধা দিলো। সাদিদকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

— ‘ তানহা, আমি তোকে খুন করব। লজ্জাহীন মেয়ে, ছাড় আমাকে। তোকে এই অবস্থায় দেখে আমার গা ঘুলাচ্ছে। ‘
— ‘ এখন-ই ঠিক হয়ে যাবি। দেখবি তুই এরপর সুখে পাগল হয়ে যাবি। ‘

তানহা সাদিদের পরনের ট্রি-শার্ট খোলার চেষ্টা করতেই সাদিদের রাগটা সহ্যের বাহিরে চলে গেল। তানহাকে ছাড়িয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসাল।

— ‘ বোন হিসেবে আজ পর্যন্ত তোর এসব সহ্য করছিলাম। কিন্তু তুইতো…
এতদিন তোকে শুধু ভালোবাসতাম না। আজ থেকে তার সাথে আরেকটা জিনিস যোগ হলো। আমি তোকে ঘৃণা করি তানহা। তোর মনমানসিকতায় আমি থুথু ফেলি। বুঝিছিস তুই? ‘

সাদিদ দরজাটা ধারাম করে খোলে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। রাগটা তার এখন সাত আসমানে। এই রাগ দ্রুত কমাতে না পাড়লে তার মাথা ফেটে যাবে।
অপরদিকে তানহা গালে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে সাদিদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে বোধহয় এতটা ভালো এই জীবনে আর কাউকে বাসেনি। কিন্তু ভালোবেসে লাভ হলো না। শুধুমাত্র প্রাপ্য হিসেবে পেয়েছে সীমাহীন কষ্ট। কষ্টের গন্ডি এখনও পূর্ণ হয়নি। তাইতো সাদিদ আজও তার ভালোবাসা পায়ের নিচে পিষে চলে যাচ্ছে।

_________________

রাতে দেরী করে ঘুমিয়েছে বিধায় নীলাও এখন বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। নার্গিস খাতুন ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার উঠে তাকে নাস্তা করতে বলে গিয়েছেন। কিন্তু নীলা হুম হুম করতে করতে এতবেলা করে ফেলেছে।
ফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে নীলা চোখ বন্ধ রেখেই হাতড়ে বিছানার পাশ থেকে ফোনটা নিলো। কোনোমতে রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে সাদিদের গম্ভীরকণ্ঠ শুনা গেল,

— ‘ এখন-ই নিচে আস। ‘

নীলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সাদিদ কথাটা বলে উঠল। নীলা পিটপিট করে চোখ খোলল। এতসকালে এমন একটা কথার অর্থ নীলার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। তাই ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

— ‘ জ্বি? ‘
— ‘ আই সেইড গেট ডাউন এট দ্য মোমেন্ট। আদার ওয়াইজ আ’ম কামিং আপস্টাইরাস। ‘

ফোনের অপরপাশে সাদিদের এমন রাগী কন্ঠস্বর শুনে নীলা কেঁপে উঠল। কোনোমতে বলে উঠল,

— ‘ আ..সছি। ‘

নীলা এলেমেলো অবস্থায়-ই শরীরে ভালোকরে চাদর পেঁচিয়ে রুম থেকে বের হলো। নার্গিস খাতুন তাকে দেখেই বলল,

— ‘ বস নাস্তা দিচ্ছি। সবতো ঠান্ডা হয়ে গেল। ‘
— ‘ না মা, এখন না। একটু নিচে যাব। ‘
— ‘ নিচে কি কাজ? ‘
— ‘ না মানে… আসলে একটু হাঁটাহাটি করব। ‘
— ‘ সেটা ভালো কথা। কিন্তু এতবেলা কে মর্নিংওয়াকে বের হয়? ‘
— ‘ সমস্যা নেই মা, আমি যাচ্ছি। ‘

নীলা নার্গিস খাতুনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে গেল। গেইট পেড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সাদিদকে খোঁজতে লাগল। রাস্তার ওপাশে সাদিদের গাড়িটা দাঁড়ানো দেখে নীলা সেদিকে এগিয়ে গেল।
সাদিদ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। গায়ে রাতের পাতলা ট্রি-শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার। চুল এলেমেলো হয়ে কপালে পড়ে রয়েছে। নীলা একপলক সাদিদকে দেখে জানালায় টুকা দিলো। সাদিদ নীলার উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ বন্ধ রেখেই বলল,

— ‘ গাড়িতে উঠ। ‘

সাদিদের এমন থমথমে গলায় নীলার শ্বাস আঁটকে যাবার অবস্থা। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতেও পাড়ছে না। সাদিদ যে ভীষণ রেগে আছে সেটা নীলার বুঝতে আর বাকি নেই। কিন্তু রাগটা কিসের এইটাই সে বুঝে উঠতে পাড়ছে না। নীলা আর কিছু চিন্তা না করে দরজা খোলে গাড়িতে বসল। নীলা বসতেই সাদিদ গাড়ি স্টার্ট করল। নিঃশব্দে ডাইভ করে কিছুটা দূর একটু নিরিবিলি জায়গায় এসে সে গাড়ি ব্রেক করল। বিনাবাক্য নিচে নেমে নীলার পাশে গিয়ে দরজাটা খোলল। গম্ভীর কণ্ঠেই বলল,

— ‘ আস। ‘

নীলার নিজেকে বাধ্য পুতুল মনে হচ্ছে। যে তার মালিকের কথায় উঠে-বসে। সাদিদ-ই নীলাকে স্থির বসে থাকতে দেখে হাত ধরে নিচে নামাল। পিছনের দরজাটা খোলে দিয়ে নীলাকে বসিয়ে দিলো। নীলা সাহস করে কিছু জিজ্ঞাসা করবে ভেবেছিল। কিন্তু তার আগেই সাদিদ ভয়ংকর একটা কাজ করে বসল।
সে সোজা গিয়ে নীলার কোলে মাথা রাখল। সে বেশ লম্বা বিধায় পা গুটিয়ে রাখতে হচ্ছে। নীলা এই মুহূর্তে পুরোপুরি অনুভূতিহীন হয়ে গিয়েছে। শরীর অসার হয়ে পাথরে রূপ নিয়েছে। নিরবতা ভেঙে সাদিদ-ই বলল,

— ‘ মাথা ব্যাথা করছে। চুলগুলো টেনে দাও। ‘
— ‘ প্লিজ এখান থে..কে মাথা সরান…

নীলা শুধু আটকে যাওয়া গলায় বলতে নিয়েছিল, কোল থেকে মাথাটা সরাতে। কিন্তু সাদিদকে চোখজোড়া খোলে এমন লাল লাল করে তাকাতে দেখে, নীলা আর বাক্য সম্পূর্ণ করতে পাড়ল না। চুপচাপ কাঁপা হাতটা সাদিদের মাথায় রাখল। শরীর মনে হচ্ছে অসার হয়ে গিয়েছে। হাতও চলছে না। হঠাৎ সাদিদ রাগী স্বরে ধমকে উঠল,

— ‘ খাওনা নাকি? জোরে টান দাও। ‘

নীলা আচমকা সাদিদের এমন ধমকে মৃদু কেঁপে উঠল। বুক ধুকপুক করছে। চোখজোড়াও মুহূর্তেই ম্লান হলো। সাদিদ তাকে কথাটা সুন্দর করে বললেই পারত। এমনভাবে ধমকে বলার কিছু ছিল না। নীলা কান্না চেপে মুখ ঘুরিয়ে জোরে জোরে চুল টানতে লাগল। এত জোরে টানার চেষ্টা করছে বোধহয় আজ সাদিককে পুরো টাকলু বানিয়েই দম নিবে।
সাদিদ এতক্ষণ রেগে থাকলেও নীলার এমন বাচ্চামি দেখে তার এখন দম ফাটানো হাসি আসছে। সাদিদ চোখজোড়া খোলে উপরে তাকালো। নীলাকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে দেখেই সে ঠোঁট টিপে নিঃশব্দে হাসল। প্রাণপাখির রাগ ভাঙাতে নরম স্বরে ডাকল,

— ‘ বউ? ‘

নীলা উত্তর দিলো না, এমনকি একবার ফিরেও তাকালো না। সাদিদ এবার শব্দ করেই হেসে ফেলল। নীলা অপরদিকে মুখ ফিরানো অবস্থায় সাদিদের হাসির শব্দ শুনে তার ভ্রুজোড়া তির্যক হলো। নীলার চেহারায় এতক্ষণ অভিমানের রেশ দেখা গেলেও এবার রাগের আভাসও পাওয়া গেল। সাদিদও হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে সুর টেনে ডাকতেই লাগল,

— ‘ বউ, এই বউউউ। ও পাখিবউ। ‘

নীলাকে এখনও ফিরে তাকাতে না দেখে সাদিদ এবার ঠোঁট কামড়ে হাসল। দুষ্টুমিস্বরে ডেকে উঠল,

— ‘ ও আমার বাচ্চাদের মা-পাখি? বাচ্চাদের বাবাই ডাকে তো৷ ‘

নীলার সব রাগ ভানের জলে ভেসে গেল। সাদিদের মুখে আবারও এমন লজ্জাজনক কথা শুনে, তার মুখে ঈষৎ লালাভ আভা দেখা গেল। সাদিদ কোলে শুয়ে থেকে নীলার অর্ধ লালাভ চেহারাটা দেখে নিঃশব্দে হাসল। আরেকটু লজ্জা দিতে কাত হয়ে শুয়ে নীলার পেটে মুখ গুঁজলো। সাদিদের তপ্ত নিঃশ্বাস জামার উপর দিয়ে পেটে লাগতেই নীলা ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠে সাদিদের চুল খামচে ধরল। সাদিদ নীলার শরীরে বহমান কম্পন অনুভব করতে পাড়ছে। আর এই কম্পনের অর্থও তার কাছে অজানা নয়। সাদিদ নীলার কোমড় জড়িয়ে ধরে পেটে মুখে গুঁজে উষ্ণ ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগল। নীলা চোখ বন্ধ করে আটকে যাওয়া গলায় বলল,

— ‘ কি কর..ছেন? ‘
— ‘ কি করছি? ‘

সাদিদের নির্লিপ্ত উত্তরে নীলার মুখটা এবার অসহায়ে পরিণত হলো। তারপরও যে সাদিদকে এখান থেকে সরাতেই হবে। নতুবা নীলা এখানেই বোধহয় জ্ঞান হারাবে।

— ‘ প্লিজ উ..ঠুন। সহ্য কর..তে পাড়ছি না। ‘

সাদিদ নীলার জামার উপর দিয়ে আরেকটা চুমু দিয়ে বলল,

— ‘ কি সহ্য করতে পাড়ছ না? ‘

নীলা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগানো গেলেও ঘুমের অভিনয় করা ব্যক্তিকে জাগানো অসম্ভব। সাদিদও এখন নীলার কাছে তেমন-ই একজন ব্যক্তি। নীলা হালকা রেগে সাদিদের চুলে টান দিয়ে বলল,

— ‘ সরুন। আপনার খোঁচা দাড়িতে আমার শরীর শিরশির করছে। ‘

সাদিদ এবার মাথা তুলে নীলার দিকে তাকালো। নীলার মুখ থেকে এইরকম কথা বের করতে পেরে সে হাসল। কিন্তু পরমুহূর্তেই শয়তানি মাথায় চেপে সে নীলার পেটে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। নীলার এসব একেবারে সহ্য হয় না। তাই অনবরত হাসতে হাসতে সাদিদকে সরাতে চাইছে। কিন্তু সাদিদ তো ছাড়ার পাত্র নয়। উঠে বসে নীলাকে ক্রমাগত সুড়সুড়ি দিতে লাগল। নীলা হাসতে হাসতে সিটে হেলে পরতেই সাদিদ থামল। নীলা ক্রমাগত বড়বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ঠোঁটের কোণে এখনও তার মৃদু হাসির রেখা। সাদিদ একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নীলার এলোমলো শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার চোখে ক্রমশ ঘোর লাগতে লাগল। সবসময়ের মতো এবারও মুখ ঘুরিয়ে নিতেই সাদিদ থেমে গেল। আবারও সে নীলার দিকে ফিরে তাকালো। সে তো এখন সাদিদের বিয়ে করা বউ। যেভাবেই হোক বিয়ে তো হয়েছে। নগদ মোহরানা দিয়ে সাদিদ তাকে বিয়ে করেছে। নীলার আর তার মধ্যে এখন স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক বিদ্যামান। নীলার সর্বাগ্রে তার পুরোপুরি হক আছে। তাই এবার সাদিদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল না। নীলাকে সে চায়। একজন স্ত্রীর ন্যায় নীলাকে তার চায়। নীলা এখনও পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস টানছে। সাদিদের চোখে যে নেশা লেগে যাচ্ছে এদিকে তার খেয়াল নেই। সাদিদ একপলক নীলাকে আবারও দেখে নিয়ে, নেশাক্ত চাহনি নিয়ে সে নিচু হলো।
ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাসের উপস্থিতি টের পেয়ে নীলা দ্রুত চোখ খোলে তাকালো। সাদিদকে নিজের এতটা কাছে দেখে চমকিত দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু পরমুহূর্তেই সাদিদের এমন ঘোলাটে চোখ দেখে তার বুকে টিপটিপ করে আওয়াজ হতে লাগল। ক্রমশ আওয়াজের পরিমাণটা বাড়তে লাগলেই নীলা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কাঁপা গলায় বলল,

— ‘ এখন যে..তে হবে। নতু..বা আম্মু বকা দিবে। ‘
— ‘ কোথাও যেতে হবে না। ‘

সাদিদের এমন নেশাক্ত কন্ঠ শুনে নীলা মৃদু কাঁপতে লাগল। নীলা আবারও সাহস করে সাদিদের দিকে তাকাতেই তার ঘোলাটে দৃষ্টির সম্মুখীন হলো। সে দ্রুত চোখ ফিরাল। এই দৃষ্টির দিকে তাকানো যায় না। এই চোখে নীলা তার সর্বনাশ দেখে। সাদিদ নীলার ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলে উঠল,

— ‘ বউপাখি! তুমি-কি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হওয়া আমাদের এই বিয়েটাকে মানতে পারনি? ‘

নীলা অবাক চোখে তাকালো। সাদিদ এমন করে বলছে কেন? নীলা এমনটা কখন বলল? হয়তো সে নিজেকে প্রস্তুত করার সময় পায়নি বা এসবের জন্য সে এখন-ই তৈরি ছিল না।
কিন্তু বিয়ে তো বিয়ে। ধর্মমতে তাদের বিয়ে হয়েছে। এখানে মানা না মানার প্রশ্ন আসছে কেন?
সাদিদ বোধহয় নীলার অব্যক্ত উত্তর খোঁজে নিতে পাড়ল। তাই ঘাড়ে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে বলল,

— ‘ তাহলে তো কাছে আসতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। আমরা কি…
— ‘ প্লিজ বাসা..য় যেতে দিন। অনেক স..ময় হয়েছে। ‘

নীলা সাদিদকে থামিয়ে অতিদ্রুত কথাটা বলল। শেষের কথাটা বলতে তার কন্ঠনালী বারবার আটকে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনোমতে বাক্যটা সমাপ্ত করল। নীলার এতকষ্টের পরিশ্রমেও সাদিদ জল ঢালল। একপ্রকার না শুনার ভান ধরে নেশালো কন্ঠ বলে উঠল,

— ‘ সবসময় তো তোমার কথা শুনলে চলবে না। তুমি বলেছ আপাতত পরিবারের কাউকে জানাতে পারব না। তাই আমিও তোমার কথায় রাজি হয়েছি। কিন্তু বউ হয়েও আমার থেকে এমন দূরত্ব বজায় রাখবে এটাতো হতে দেওয়া যায় না। আমি সেটা মানতে পারব না। ‘

সাদিদের এমন কথা শুনে নীলার শ্বাস আঁটকে যাচ্ছে। জোর খাটিয়ে উঠতে চাইলেই সাদিদ তাকে নিজের সাথে চেপে ধরল। গালে গাল ঘষতে ঘষতে বলল,

— ‘ মধুচন্দ্রিমা। ‘

সাদিদের খোঁচা দাড়ির আঘাতে এমনি-ই নীলার অবস্থা খারাপ। তারউপর এই শব্দটা শুনে নীলার তো মরে যাবার অবস্থা। সাদিদ এমন করছে কেন? সে কি বুঝে না নীলার এসব সহ্য হয় না?
সাদিদ একপলক নীলার দিকে তাকালো। তার অস্থিরতা সাদিদ বুঝতে পাড়ছে। সবকিছু এত দ্রুত হয়েছে যে নতুন সম্পর্কের জন্য এক্সট্রা কোনো সময় পাওয়া যায়নি।
কিন্তু বিয়েটা যেহেতু হয়ে গিয়েছে এখন অযথা দূরত্ব বজায় রেখে কষ্ট পাওয়ার মানে কি? তাই সাদিদ গাল থেকে নিজের মুখটা সরিয়ে নীলার চোখের দিকে তাকালো। গালে হাত বুলাতেই নীলা আবারও মৃদু কেঁপে উঠল। সাদিদ নীলার অপরগালে ভিজে ঠোঁট স্পর্শ করে আদর দিলো। নীলার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে মিহি স্বরে বলল,

— ‘ বিয়ে হলো অথচ বাসর হলো না। এখন আবার মধুচন্দ্রিমাও কি বাদ যাবে নাকি? আমি অতটা দয়ালু নয় পাখি। আমি আমাদের মধুচন্দ্রিমা চাই। এটাতেও যদি তোমার আপত্তি থাকে, তাহলে আমি ফ্যামিলিকে জানাতে বাধ্য হব। তারা অন্ততপক্ষে বিয়ের পরও স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা রেখে পাপ করতে চাইবে না। কিন্তু যে করেই হোক তোমাকে আমার চাই। আর এই দূরত্ব সহ্য হবার নয়। এতটা বছর খুব জ্বালিয়েছ। আর তোমাকে জ্বালাতে দিতে পারব না। এখন আমার সময়, তাই তোমাকে খুব করে জ্বালাব। ‘

নীলা চোখ বন্ধ করে রয়েছে। সাদিদ তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে! না এদিকে গেলে বাঁচা যায় না ঐদিকে গেলে। এককথায় সব জায়গাতেই নীলার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে। একপাশে তৃষার্ত প্রেমিকের অতিরিক্ত ল ভালোবাসার বিপদ। আর অপরদিকে পরিবারের সদস্যরা কষ্ট পাবে এই বিপদ। এই কোন মহাবিপদে পড়ল সে?

#চলবে…