অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-১৬+১৭

0
970

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১৬ ✈🌎

চারজোড়া চোখ সাদিদ নীলার দিকে চমকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সাদিদের মুখ নিঃসৃত বাক্যগুলো তাদের কাছে নিতান্তই গল্পকথা মনে হচ্ছে। নতুবা এমনটাও কি সম্ভব? আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে তানবীর প্রায় ধমকিয়ে উঠল,

— ‘ একটা লাথি মারমু এমন ফাইজলামি করলে। ‘
— ‘ আচ্ছা মারিস। বাট আ’ম টেলিং দ্য ট্রোথ। ‘

সাদিদ এতটুকু বলে থামল। মাথা নিচু করে বসে থাকা নীলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একহাতে তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,

— ‘ উয়ি আর হাসবেন্ড ওয়াইফ। ‘
— ‘ সাদি, তুই সত্যিই মজা করছিস না? ‘
— ‘ এমন বিষয় নিয়ে মজা করব কেন? আমি এতক্ষণ তোদের সব সত্য কথা-ই বলেছি। যেভাবেই হোক না কেন বা যে পরিস্থিতি, ধর্মমতে নীলাঞ্জনা এখন আমার ওয়াইফ। পৃথিবীর কোনো কিছু এই পবিত্র সত্যকে মিথ্যা করতে পারবে না। ‘

এতক্ষণে বোধহয় উপস্থিত সবাই বিষয়টাকে আসলেই সত্য ভেবে নিচ্ছে। নতুবা হুট করে কেউ এসে বলবে সে আমার বিয়ে করা বউ, এমনটা কে বিশ্বাস করবে?
সবাই এখন একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এতক্ষণ পরিস্থিতি গম্ভীর থাকলে আচমকা সব পল্টন এসে একত সাদিদ নীলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাদিদ-নীলাকে প্রায় আলু বর্তা বানাতে তারা উঠে পড়ে লেগেছে। সাদিদ কোনোভাবে নীলাকে এর মধ্যে থেকে বের করার চেষ্টা করতে করতে বলল,

— ‘ এই তোরা আমার বউকে মেরে ফেলবি নাকি? ছাড় বলছি। ওর কষ্ট হচ্ছে। ‘

সাদিদের নিচুস্বরের ধমকে সবাই এবার একটু ধমলো। কিন্তু আলাদাভাবে নীলা-সাদিদকে বিয়ের শুভেচ্ছা জানাতে লাগল। তানবীর কোলাকুলি করতে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ খালি বিয়ে? নাকি সব কাজই শেষ করে তারপর জানাতে এসেছিস? ‘

সাদিদ ঠোঁট কামড়ে হাসল। সে ভালো-ই বুঝতে পাড়ছে তানবীর কোনদিকে ইন্ডিকেট করছে। সাদিদ তার পিঠে জোরে একটা চাপড় মেরে বলল,

— ‘ আমি কি তোদের মতো নাকি? বিয়েটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হয়েছিল বিধায় জানাতে পারিনি। তাই বলে এতটাও ফাস্টে যাচ্ছি না। ‘
— ‘ মিয়া তুমি আর কথা কইয়ো না। তোমারে আমি হারে হারে চিনবার পারি। হয়তো ঠিকঠাক সুবিধা করতে পারো নাই। নতুবা তৃতীয় ব্যক্তি নিয়া-ই তুমি হাজিরা দিতা। ‘

সাদিদ তার কথা শুনে হাসতে হাসতে তানবীরের পেটে মৃদু ঘুষি দিলো। তানবীরও দুষ্টু হাসছে। পাশ থেকে নীলা, শান্ত আর প্রিয়তী সন্দেহপ্রবল দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অর্ণব পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। প্রিয়তী তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠল,

— ‘ বাবু, তারা এভাবে হাসছে কেন? ‘

তানবীর হাসি ভুলে এবার তেতে উঠল। রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

— ‘ এই মাইয়া, এই? হে কি ফিডার খায়? না বাবুদের মতো প্যামপাস পরে? হেরে বাবু ডাকস কেন? ‘
— ‘ ছিঃ কি বিচ্ছিরি! তোমার মুখের ভাষা এমন জঘন্য কেন? ‘
— ‘ তোর মুখের এই জঘন্য শব্দগুলো শুনলে আমার ভাষা এমনিতেই জঘন্যের আস্তানা খোঁজে বেড়ায়। ‘
— ‘ দেখছ বাবু, ও কি বলে? ‘
— ‘ তোর পেঁচার মতো মুখে…
— ‘ চুপ আর একটা কথা নয়। এখানে তোদের একটা দরকারী কাজে ডেকেছি? না তোদের ঝগড়ার জন্য? ‘
— ‘ সব দোষ এই বাবু নামকরণের মহিলার। ‘
— ‘ তানবীর চুপ করতো এবার। নতুবা আমি চলে গেলাম। ‘
— ‘ আচ্ছা রাগিস না। বল কি কথা। ‘

সাদিদ নীলার দিকে তাকালো। নীলা অনবরত হাত-পায়ের নখ খুঁটে চলেছে। সাদিদ তাকে আগেই এই বিষয়ে বলেছে। এখন সবার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে এইটা নিয়েই তার ভয়।

— ‘ আমি একটু ঘুরতে যাবার প্ল্যান করছিলাম। ‘

অর্ণব, তানবীর তাদের ভ্রুজোড়া কুঁচকালো। বাকি সবাই স্বাভাবিকভাবে নিলেও তাদের একটু খটকা লাগছে। অর্ণব-ই বলল,

— ‘ সেটা ভালো কথা। কিন্তু কোথায় যাবার প্ল্যান করেছিস? ‘
— ‘ দার্জিলিং। ‘

সাদিদের এমন নির্লিপ্ত উত্তরে নীলার প্রায় চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। কি বলছে সাদিদ?
দার্জিলিং! নীলার তো নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না।
সাদিদের এক কথা ছিল, হয় মধুচন্দ্রিমা নতুবা পরিবারকে জানাব। নীলার লজ্জা লাগলেও শেষমেশ মধুচন্দ্রিমাতে এসে রাজি হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে দার্জিলিং?
এমনটাতো সাদিদ তাকে বলেনি। এমনকি নীলাও এমনটা ভাবতে পর্যন্ত পারেনি।

— ‘ দার্জিলিং প্ল্যান? ‘
— ‘ হুম। ‘

তানবীর আর অর্ণব এবার হাসছে। তাদের আর বুঝার বাকি নেই বিষয়টা প্রকৃত অর্থে কি? তাদের এমন দুষ্টু হাসি দেখে সাদিদও মাথা চুলকে হাসছে। তার বন্ধুগুলো বড্ড পাঁজি।

— ‘ যাবি ভালো কথা। কিন্তু কবে যেতে চাস? ‘
— ‘ যত দ্রুত সম্ভব। কিন্তু আমরা একা নয়। তোদের সবাইকেও আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। ‘
— ‘ মানে? ‘

সবকটা একসঙ্গে চিল্লিয়ে উঠল। সাদিদ কানে হাত চেপে ধরে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,

— ‘ আরে আস্তে। কানের পর্দা ফাটিয়ে দিবি তো। সবাই মিলে এমন চেচাচ্ছিস কেন? ‘
— ‘ না চেঁচিয়ে কি করব? তুই শালা হানি…

সাদিদ দ্রুত এসে তানবীরের মুখ চেপে ধরল। নীলাকে সে একান্তই ভালোবেসে লজ্জা দিতে চায়। লজ্জায় রাঙিয়ে তার লালাভ বর্ণের সৌন্দর্যমাখা মুখটা দেখতে, সাদিদের চোখজোড়া সবসময় ক্লান্ত হয়ে বসে থাকে। কিন্তু তাই বলে সে সবার সামনে এভাবে লজ্জা পাক এমনটা সাদিদ চায় না। তাই এই বাধা, আটকিয়ে ফেলার ব্যস্ততা।

— ‘ চুপ। তুই আর একটা কথাও বলবি না। ‘

তানবীরও এবার বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ালো। সাদিদ মুখ ছাড়তেই পাশ থেকে অর্ণব বলে উঠল,

— ‘ তোরা ঘুরতে যাচ্ছিস ভালো কথা। কিন্তু সেখানে আমাদের গিয়ে কি কাজ? ‘
— ‘ প্রথমত তোরা আমার ভাইয়ের থেকে কম নস। তাই আমাদের সাথে যেতেই পারিস। এভাবে আলাদাভাবে বলার কিছু নেই। আর নীলাঞ্জনাও হয়তো এমনটাই চায়।
আমাদের বিয়ের কথাটা পরিবারের কেউ এখনও জানে না। এমতাবস্থায় একা একা দু’জন এতটাদূরে ঘুরতে গেলে ওর হয়তো ভালো লাগবে না। সবসময় মাথায় এটা-সেটা আসতে থাকবে। সবার সাথে থাকলে জার্নিটা বেশি এনজয় করবে। তাই তোদেরকেও আমাদের সাথে আসতেই হবে। ‘
— ‘ ভাইয়া না মানে জিজু, উনাদেরটা না হয় বুঝলাম কিন্তু আমি কেন? ‘
— ‘ শান্ত তুমিতো আরও আগে। তোমাকে ছাড়া নীলাঞ্জনার যাওয়া প্রায় ইম্পসিবল। ‘

শান্ত সাদিদের দিকে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। সাদিদের কথাটা তার বোধগম্য হয়নি। সাদিদ-ই তাকে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিলো।

— ‘ নীলাঞ্জনা এইমুহূর্তে পরিবারকে জানাতে চায় না৷ তাই এভাবে আমার সাথে না জানিয়ে ওর যাওয়াটা সম্ভব নয়। তাহলে অনেক কথা উঠবে। তাই তোমাকেই এইদিকটা সামলাতে হবে। বলতে পারো ভালো কিছুর বিনিময়ে ছোটখাটো মিথ্যা বলতে হবে। তোমার উপর এই ক্ষেত্রে আমার পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। ‘

সাদিদের কথায় শান্ত হাসল। উপস্থিত সবাইও হাসছে। সবাই এটা সেটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেই সাদিদ নীলাকে টেনে কোণায় নিয়ে গেল। নিজের দুইহাত দেয়ালে রেখে নীলাকে বাহুবন্ধনে আঁটকে ধরল। নীলার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ‘ তখন ছাড়া পেলেও হিসাব কিন্তু ছাড়িনি বউ। কড়ায় গন্ডায় হিসাব করছি। সময়মতো সবকিছু সুদে-আসলে উশুল করব। রেডি হও বউপাখি। নিজের ভাগের একবিন্দুও আমি ছাড় দিব না। ‘

নীলার দম প্রায় আটকে যাবার অবস্থা। এখন থেকেই তাকে সাদিদের যেসব ভয়ংকর কথার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, না জানি হাতে পেয়ে তার কি হাল করে? নীলা একপলক চোখ উঁচিয়ে তাকালো। সাদিদের ঘোর লাগা দৃষ্টি দেখে পরমুহূর্তেই সে চোখ নামিয়ে নিলো৷ কিন্তু কিছু করার নেই। এটা-ই মানতে হবে। সাদিদের জেদ চেপেছে। এই বান্দাকে এখন কোনোভাবেই মানানো যাবে না। নীলা বাকি সবাইকে লক্ষ করে আশেপাশে তাকালো। সবাই দার্জিলিং ভ্রমণ নিয়ে কথা বলছে৷ কিভাবে কি করবে, কোথায় কোথায় যাওয়া হবে এসব নিয়ে প্ল্যান করছে। আপাতত নীলা-সাদিদকে দেখার সময় তাদের নেই। কেননা সবকিছুকে ছাপিয়ে এবার যাত্রা হবে দার্জিলিং। মেঘের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত এই পাহাড় কন্যার বুকে হানা দিতে নব্য দম্পতি এবং তার বন্ধুরা ছুটে আসছে।

__________________

আরিফ মাহমুদ সোফায় বসে আছেন। দৃষ্টি তার তীক্ষ্ণ। কেননা এই দুইটা পাঁজি মেয়ে তাকে সেই কখন থেকে বসিয়ে রেখেছে। কি কথা বলবে বলবে করে ঘণ্টা পার করে ফেলছে। তিনি এবার কিছুটা রাগী স্বরে বললেন,

— ‘ তোমরা কি সত্যিই কিছু বলতে চাও? বলার থাকলে বলো নতুবা আমার দরকারী কাজ আছে। ‘
— ‘ আঙ্কেল আর একটু বসেন। মুখ দিয়ে কথাটা বের হতেই চাইছে না৷ একেবারে গলায় এসে আটকে রয়েছে। ‘
— ‘ কি এমন কথা বলতে চাও যে গলায় এসে আটকে রয়েছে? ‘
— ‘ না মানে আঙ্কেল, আসলে না মানে…

আরিফ রহমান নীলার দিকে তাকালেন। সে সাথে সাথে দৃষ্টি নত করল। তিনি তাদের দুইজনের মতিগতি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না। শান্তও একবার নীলার দিকে তাকালো। লম্বা একটা শ্বাস টেনে সে এবার একদমে বলে ফেলল,

— ‘ আঙ্কেল আমাদের ভার্সিটি থেকে নাফাখুম জলপ্রপাতের উদ্দেশ্য যাবে। মাঝপথে থানচি, মিলন ছড়ি, বগালেক, স্বর্ণমন্দির, নীলাচলসহ আরও অনেকগুলো স্পট ঘুরে দেখানো হবে। ‘
— ‘ সেটাতো বেশ ভালো কথা। ‘
— ‘ আঙ্কেল আমি এবং নীলও তাদের সাথে যেতে চাচ্ছি। ‘

আরিফ মাহমুদ এবার খানিকক্ষণ চুপ থেকে চিন্তা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরেই হাসিমুখে বলে উঠলেন,

— ‘ যাবার হলে যাবে। মানা করছে কে? আমার জীবনেও আমি এসবে বহুতবার গিয়েছি। ‘
— ‘ আসলে আঙ্কেল অনেকগুলো স্পট তো তাই সময়টা একটু বেশি লাগবে। চার রাত পাঁচ দিন। ‘
— ‘ যদি সিকিউরিটি ব্যবস্থা এবং মেনেজমেন্ট ভালো থাকে তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।
— ‘ ও আঙ্কেল আপনার মতো মানুষ হয় না। ‘

বলেই শান্ত খুশিতে গিয়ে আরিফ মাহমুদকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। নীলাও মাথা নিচু করে মুখ টিপে হাসছে। যাক এদিকের ঝামেলা তাহলে মিটে গিয়েছে। আব্বু রাজি মানে আম্মুও রাজি।
শান্ত নীলাকে বাই বলে তাদের বাসা থেকে খুশিমনে চলে গেল। দার্জিলিং যাচ্ছে তার কতশত জিনিস গুছিয়ে নেওয়া বাকি। শান্ত যেতেই নীলাও রুমে আসলো। রুমে আসতেই ফোনের আওয়াজ কানে আসতে ফোনটা সে হাতে নিলো। সাদিদ কল দিচ্ছে।

— ‘ আসসালামু আলাইকুম। ‘
— ‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম বউপাখি। কি করো? ‘

নীলা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল। এই ছেলেটাও না সবসময় তাকে এসব বলে লজ্জা দিতে থাকে।
নীলা নিচুস্বরে বলল,

— ‘ এতক্ষণ আব্বুর রুমে ছিলাম। আব্বু রাজি হয়েছে। যাওয়ার পারমিশন দিয়েছে। ‘
— ‘ বাহ্ শশুরমশাই তো গ্রেট। বিনা ঝামেলাতেই মেয়ের হানিমুনের ব্যবস্থা করে দিলো। ‘
— ‘ চুপ করুন তো, সবসময় বাজে কথা। ‘
— ‘ আরে বাজে কোথায়? হানিমুনই তো। ‘
— ‘ আব্বু কি এসব জানে? জানলে দুইজনের পা ভেঙে দিবে। ‘
— ‘ বলছে তোমাকে! দেখবে আরও দ্রুত যাবার জন্য উঠে পড়ে লাগবে। আমরা যত দ্রুত কাছাকাছি আসবো তারাও ততদ্রুত নানা-নানু হয়ে যাবে। এমন খুশির খবর থেকে কে বাদ পড়তে চায়? ‘

নীলার মুখ লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে। বোধহয় এখন-ই লাল বর্ণে মুখ পুরো জ্বলে যাবে। নীলার নিঃস্তব্ধতা দেখে সাদিদ ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসল। সে খুব ভালো-ই বুঝতে পাড়ছে অপরপাশে নীলার কি অবস্থা। কিন্তু সে যে অতটাও ভালো নয়। তাই নীলাকে আরও লজ্জায় ফেলতে বলল,

— ‘ বউ, আমি কিন্তু আর ওয়েট করতে পাড়ছি না। কবে নাগাদ যে কাগজপত্রের সব ঝামেলা মিটবে, আর কবে যে তোমাকে একান্তভাবে নিজের কাছে পাব। পাখ, আমি পুরো অধৈর্য্য হয়ে গিয়েছি।
তুমি জানো আমাদের ফাস্ট নাইট নিয়ে ইতিমধ্যে আমি কতশত প্ল্যান করে ফেলেছি? আমি আমাদের বিশেষ মুহূর্তটাকে খুব স্পেশালভাবে কাটাতে চাই। কোনো কিছুর কমতি রাখতে একদমই চাচ্ছি না।
এই তুমি কি শুনছ? কোনো কথা বলছ না কেন? ‘

সাদিদ ফোন হাতে নিয়ে দেখল ফোনটা ইতিমধ্যে কেটে দেওয়া হয়েছে। সে রাগ করল না বরং হাসল। সে ভালো করেই জানে এর
পিছনের কারণটা। তবুও সে তার দুষ্টুমি বুদ্ধিতে ফোনের মেসেজ অপশনে গেল।
মেসেজ টোনের আওয়াজে নীলা চোখ খোলে তাকালো। সাদিদের এসব লজ্জাজনক কথা শুনে এতক্ষণ তার অবস্থা পুরোপুরি কাহিল। লজ্জায় সে কুঁকড়ে যাচ্ছে। নীলার শরীর মৃদু কাঁপছে। সে কাঁপা হাতে ফোনটা চেক করল।

— ‘ এত লজ্জা! কিন্তু পেলেও লাভ নেই বউ। তোমাকে আর ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আমাকে এত জ্বালানোর ফল, তোমাকে এবার সবগুলো পইপই করে করে ফিরত দিব৷ সুতরাং তৈরি থেকো বউপাখি। সাদিদের ভালোবাসাময় জ্বালা কাকে বলে, এবার তুমি হারে হারে টের পাবে। ‘

নীলা বিছানা ধরে ফ্লোরে বসে গেল। মাথাটা বিছানায় ঠেকিয়ে সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। শরীর তার অবশের ন্যায় অনুভব হচ্ছে। দূরে থেকেই সাদিদের লজ্জাবাণে নীলা কুঁকড়ে যায়। না জানি যখন একান্তে থাকবে তখন কি অবস্থা হবে? নীলা সেসব ভাবতেই পাড়ছে না। কল্পনা করার শক্তিও তার মধ্যে এখন অনুপস্থিত। সাদিদ দূরে থেকেই তাকে অনবরত লজ্জা দিয়ে শুষে নিচ্ছে।
সামনের দিনগুলোতে কি হবে বা নিজেকে কিভাবে সামলাবে সেটা নীলার কাছে বড্ড অজানা। এখনতো কেবল সময়-ই সঠিক উত্তর দেবার জন্য একমাত্র অবলম্বন।

___________________

অবশেষে দীর্ঘ কয়েকদিনের পাসপোর্ট, ভিসা, রুম বুকিং সহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে দার্জিলিং যাবার কাঙ্ক্ষিত সময়টা এসে গিয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভোর নগরী, পাহাড়ে ঘেরা অপূর্ব চিরহরিৎ ভূমির দার্জিলিংয়ে যাওয়া নিয়ে সবাই বেশ উৎসুক। সাদিদ, তানবীর এবং অর্ণব পূর্বে দার্জিলিং ভ্রমণে আসলেও নীলা, শান্ত এবং প্রিয়তীর জন্য এটাই প্রথম। তাই তাদের উত্তেজনাও চরমে। নীলা কিছুতা জড়তা, ইতস্ততায় ভুগলেও সাদিদ আছে পুরোপুরি অস্থির হয়ে। এতটা দিন সে প্রতিটা মুহূর্তে চরম অস্থিরতায় বিরাজ করেছে। সাথে নীলাকেও তার অসহ্যকর লজ্জাবাণে কুঁকড়ে দিয়েছে। নীলার পক্ষে সেসব দাঁত চেপে সহ্য করা ব্যতিত আর কোনো উপায় ছিল না। নতুবা সাদিদ ভালোর ভালো কিন্তু খারাপের একশেষ। তার কথামতো চলতে পাড়লে সে খুব-ই ভালো। কিন্তু সামান্য এদিক-সেদিক হলেই তার অন্তর কাঁপানো ধমক-টমক খেয়ে ফেলতে হয়। আর নীলা এতদ্রুত হার্ট ফেইল করে পরপারগামী হতে চায় না। তাই ভদ্র মেয়ের মতো কথা শুনে ফেলাতেই মঙ্গল।
সাদিদরা গাড়িতে করে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে এসে নামল।

নীলা বাস জার্নিতে ক্লান্ত হয়ে যায়। আর ঢাকা থেকে দার্জিলিং জার্নির জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক সড়কপথ হচ্ছে উত্তরবঙ্গের বুড়িমারি সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়া।
চ্যাংড়াবান্দা দিয়ে ভিসা করা থাকলে ঢাকা থেকে লালমনিরহাটের বুড়িমারি সীমান্তে ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়া শেষ করে, চ্যাংড়াবান্দা থেকে বাসে শিলিগুড়ি চলে আসা যায়। তারপর শিলিগুড়ি জিপ স্টেশন থেকে দার্জিলিংগামী টাটা সুমো বা কমান্ডার জিপের টিকিট কেটে সরাসরি দার্জিলিং চলে আসার পথ। ভাড়া জনপ্রতি ১২০ ভারতীয় রুপির মতো। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলং যেতে প্রায় আড়াই ঘন্টা সময় লাগে।
সাদিদরা এতটা জার্নি সহ্য করতে পাড়লেও নীলার হয়তো সেক্ষেত্রে বেশ কষ্ট হবে। তাই সাদিদ যতটুকু সম্ভব নীলার জন্য সাচ্ছন্দ্যবোধের ব্যবস্থা করেছে। বিমানে গেলে ঢাকা-শিলিগুড়ি লম্বা বাস জার্নিটা কম হবে। তাই তারা বিমানপথে বাগডোগরা পর্যন্ত যাওয়ার প্ল্যান করেছে।
ঢাকা থেকে বিমানে যেতে চাইলে ঢাকা–কলকাতা–বাগডোগরা ফ্লাইটে যেতে হবে। তারপর বাগডোগরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে সেখান থেকে ট্যাক্সিতে দার্জিলিং যেতে পারবেন। বাগডোগরা থেকে দার্জিলিয়ের দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটার। ট্যাক্সিতে যেতে সময় লাগবে প্রায় দুই ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটের মতো।

মেঘের দেশ স্বপ্নিল ভুবনের দার্জিলিং শহরে এসে পৌঁছাতেই সবার মুখে এক তৃপ্তির রেখা ফুটে উঠল। জার্নির ক্লান্তিটা এই অতি সৌন্দর্যের কাছে নিতান্তই ফিকে মনে হচ্ছে। সবাই চলন্ত ট্যাক্সির জানালা দিয়ে শহরের এই সৌন্দর্য অবলোকন করছে।
সাদিদ একহাতে নীলাকে কাছে টেনে যত্নে আগলে নিলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠল,

— ‘ ভালোলাগছে? ‘
— ‘ ভীষণ। খুব সুন্দর, আমি হয়তো ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না! ‘

নীলার চোখে মুখে মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ দেখে সাদিদও মৃদু হাসল। এগিয়ে এসে নীলার কপালের একপাশে চুমু দিয়ে আদর দিলো। নীলা দ্রুত ট্যাক্সিতে অবস্থিত বাকি সবার দিকে একপলক তাকালো। সবাই তাদের অবস্থা দেখে মুখ টিপে মিটমিটিয়ে হাসছে। নীলা তা দেখে লজ্জায় দ্রুত মাথা নুড়ালো। সাদিদটাও না, বড্ড বেশরম।

তারা দার্জিলিং শহরের ফোর স্টার হোটেল সেন্ট্রাল হেরিটেজে রুম বুকিং করেছে। বাকিদের জন্য দুইটা ডাবল বেডের দুই রুম নেওয়া হয়েছে। আর নীলা সাদিদের জন্য বিগ সাইজের একটা রুম।

নীলা রুমে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। মুখে অনাবিল খুশির পাশাপাশি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছুটা ক্লান্তি চলে আসছে। সাদিদ রুমে ডুকে নীলাকে এমন অবস্থায় দেখে হাসল। ল্যাগেজগুলো রেখে নীলার পাশে বসে তার মাথায় আলতো করে হাত বুলালো। মাথায় সাদিদের স্পর্শ পেতেই নীলা চোখ খুলে তাকালো।

— ‘ বেশি কষ্ট হচ্ছে? ‘

নীলা মৃদু হাসল। মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে বলল,

— ‘ না তেমন না। আপনিতো কষ্ট করতে দিলেন-ই না। ‘
— ‘ তারপরও যতটা করেছ তোমার জন্য অনেক। এখন কষ্ট করে আরেকটু উঠো তো। ওয়াসরুমে গিয়ে একটা হট শাওয়ার নাও। তখন দেখবে শরীরটা অনেক ঝরঝরা লাগবে। ‘
— ‘ এখানে তো অনেক ঠান্ডা। এখন শাওয়ার নিতে পারব না। ‘
— ‘ আরে অবুঝ পাখি, গরম পানি দিয়ে করবে। শাওয়ার না নিলে শরীর আরও বেশি মেজমেজ করবে। ততক্ষণে আমি কফি আর হালকা নাস্তার অর্ডার করে দিচ্ছি। ‘
— ‘ আচ্ছা। ‘

নীলা এবার ভাদ্র মেয়ের মতো উঠে বসল। টলতে টলতে সে ওয়াসরুমের দিকে এগিয়ে গেল। সাদিদ সেদিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর রুম সার্ভিসকে হট কফি দিতে বলল।
নীলা ফ্রেস হয়ে আসতেই সাদিদও ফ্রেস হয়ে নিলো। কফি আর হালকা নাস্তা করা শেষ হতেই সাদিদ বলে উঠল,

— ‘ পাখি এখনতো প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আজকে আর কোথাও ঘুরতে যাব না। কাল সকাল সকাল ঘুরতে বেড়িয়ে যাব। এখন তাহলে একটু ঘুমিয়ে নাও। এতটা জার্নির পর একটু ঘুমিয়ে নিলে তোমার ভালো লাগে। কয়েক ঘণ্টা পর উঠে তারপর আবার ডিনার করবে। ‘
— ‘ আপনি ঘুমাবেন না? ‘

সাদিদ মৃদু হেসে বিছানায় শুয়ে নীলার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। নীলা এতক্ষণ অন্য ভাবনাতে মগ্ন থাকলেও এখন আবারও একঝাঁক লজ্জা এসে তাকে ভর করল। সাদিদের সাথে এইভাবে একরুমে, এক বিছানায় থাকতে প্রথমবার বিধায় নীলার বেশ জড়তা কাজ করছে। নীলাকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে সাদিদ-ই তাকে টান দিয়ে নিজের পাশে শুইয়ে দিলো। দুইজনের উপর মোটা কম্বলটা ভালোকরে দিয়ে দিলো। নীলাকে অন্যপাশে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদিদ বলে উঠল,

— ‘ পাখি, বুকে আসবে? ‘

নীলা সাদিদের মুখের দিকে তাকালো। সবসময় দুষ্টুমি করলেও নীলা জানে সাদিদ কখনও তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর খাটাবে না। নীলার মর্জি ব্যতিত সাদিদ কখন-ই তাকে নিজের কাছে টানবে না। এতটুকু বিশ্বাস তো নীলা সাদিদকে চোখ বন্ধ করেই করতে পারে।
নীলার মুখে ভালোবাসার মানুষটার জন্য সীমাহীন শ্রদ্ধা প্রকাশ পেল। সে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে সাদিদের বুকে মাথা রাখল। নীলা সাদিদের বুকে মাথা রাখতেই সাদিদ তাকে দুইহাতে টেনে নিজের সাথে আর নিবিড়ভাবে মিশিয়ে নিলো। নীলার মাথায় শব্দ করে দীর্ঘ একটা চুমু খেল।

— ‘ তুমি হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না আমার আজ কতটা শান্তি অনুভব হচ্ছে। বুকটা এই উষ্ণতার জন্য কতটা পুড়েছে তার হিসাব রাখা দুঃসাধ্য বউ। বুকটা এবার দার্জিলিয়ের পরিবেশের মতোই শীতল হয়ে গেল। ‘

নীলা সাদিদের মুখে এমন কথা শুনে তার বুকে মুখ গোঁজে নিঃশব্দে হাসল।
সাদিদের কাছেও এই মুহূর্তটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তার প্রাণপাখি তার এতটা কাছে। একি বিছানায়, একই কম্বলের নিচে তারা অবস্থান করছে। এমন একটা দিনের প্রত্যাশা সাদিদের কত করেছে সেটা কেবল সে-ই জানে। আর আজ দুইজনে এতটা কাছে আছে, ভাবতেই সাদিদ খুশিতে পুলকিত হচ্ছে। এর থেকে সুখের মুহূর্ত আর কি হতে পরে?
সাদিদ মাথা নিচু করে নীলার দিকে তাকালো। তার চোখের পাতা মৃদু নড়াচড়া করছে। ক্লান্তিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই বোধহয় সে ঘুমিয়ে যাবে।
সাদিদ নিজের চোখ বন্ধ করে নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
সাদিদের এসব জার্নিতে প্রবলেম হয় না। সে স্বাভাবিক ভাবেই নীলার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। মিনিট দশেক পর-ই সাদিদ তার বুকে নীলার ঘন নিঃশ্বাস অনুভব করতে পাড়ল। তার প্রাণপাখি ঘুমিয়ে পড়েছে।
সাদিদ মৃদু হেসে নীলাকে আস্তে করে বালিয়ে শুইয়ে দিলো। তার একটা ফ্রেশ ঘুম প্রয়োজন। সাদিদ ঝুঁকে এসে একদৃষ্টিতে নীলার মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার ডান গালে হাত রেখে বাম গালে চুমু দিলো। একে একে নীলার গালে, কপালে গুটিকয়েক চুমু খেল। নীলার ক্লান্তিতে এসবে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই। সাদিদ আবারও নীলাকে এমন গভীরভাবে ঘুমাতে দেখে হাসল। আবারও সে কপালে দীর্ঘ একটা চুমু খেয়ে আদর করল।
তারপর আস্তে করে নীলার পাশে শুয়ে তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। নীলা ঘুমিয়ে পড়লেও সাদিদের যে ঘুম হবে না। একে তো নীলা তার এতটা কাছে রয়েছে। দ্বিতীয়ত তাদের মধ্যে বৈধ সম্পর্ক। নিজের স্ত্রী এতটা কাছে থেকেও দূরে থাকলে এটা যে সহ্য করা যায় না। সাদিদের জন্যতো আরও কষ্টদায়ক। সে যে নীলাকে খুব বেশি চায়। সেটা হোক শারীরিক বা মানসিক। কোনো ক্ষেত্রে-ই নীলার প্রতি সামান্য দূরত্বটা সে সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু সাদিদ তাকে ভীষণ ভালোভাবে। তাই নীলাকে ভালোবাসতে চায়, কষ্ট দিতে নয়। নীলা যে এখন প্রচন্ড ক্লান্ত সেটা সাদিদের বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না। তাইতো এতকাছে থেকেও সে নীলাকে কাছে টানেনি। নীলা হয়তো সাদিদের কথা ভেবে না করতে পারত না। কিন্তু সাদিদ যে এমনটা করবে না। এই মেয়টাকে ভালোবাসে সে। সে তাকে সীমাহীন চায়। দুষ্টুমি করে হয়তো বারবার লজ্জায় ফেলে, বিনা কারণে হেনস্তা করে। কিন্তু তাই বলে যে তার কষ্ট বুঝবে না এমন প্রেমিক বা স্বামী সে নয়।
সাদিদ নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে তার ঘুমন্ত মুখটার দিকে আবারও তাকালো। একদৃষ্টিতে মুগ্ধ চোখে নিজের প্রাণপাখিটাকে দেখতে লাগল। এ মুগ্ধতার যেন কোনো শেষ নেই। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর, একটা সময় সে আবেগময় কন্ঠে নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ ভালোবাসি পাখি। খুব বেশি। ‘

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১৭ ❤💙❤

এতটা পথ জার্নি করে গতরাতটা নীলা বেঘুরে ঘুমিয়েছে। সাদিদও আর বিরক্ত করেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নীলা নিজেকে খুব ফ্রেস অনুভব করল। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়াতে নীলার ঘুম সাদিদের আগেই ভেঙে গিয়েছে। নীলা চোখ পিটপিট করে খোলে তাকালো। তারপাশেই সাদিদ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে।
কিন্তু নীলা বেশ অবাক হলো একটা জিনিস লক্ষ করে। দার্জিলিয়ে বরাবরই ঠান্ডা বেশি। এককথায় বলা চলে অসময়ে বৃষ্টিপাত, কুয়াশা আর বছরের একটা নিদিষ্ট সময়ে হালকা তুষারপাতে আবহাওয়াতে সবসময়-ই শীতশীত ভাব। আর নীলার মতো শীতকাতুরে মেয়ে হলে তো কথায় নেই। রুম হিটার থাকলেও নীলার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে। সে কম্বল মুড়িয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছে। কিন্তু অপরপাশে সাদিদের শরীর উন্মুক্ত। হয়তো বা নীলাকে জড়িয়ে রয়েছে বিধায় কম্বলটা সরাতে পারেনি। সেই জন্য নিজের পরনের শার্টটা-ই খোলে পাশে রেখে দিয়েছে। সাদিদের সাথে এমন উন্মুক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে বিধায় নীলার বেশ লজ্জা লাগতে লাগল। কিন্তু তারপরও সে বেহায়ার মতো সাদিদের মুখমন্ডল পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ইশশ কি মুগ্ধতা তার চোখে-মুখে। নীলা হাত বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করতে গিয়েও লজ্জা পেয়ে সরিয়ে নিলো। কিন্তু বেহায়া চোখজোড়াকে সামলাতে পাড়ল না। সাদিদের বক্ষরোমে নীলার নজরটা আটকে রইল। সুগঠিত পুরুষদিপ্ত শরীরের সাথে বক্ষরোমটা খুব সুন্দরভাবে মানিয়ে গিয়েছে।
নীলা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। সে আবার কবে থেকে এতটা নির্লজ্জ হয়ে গেল?
হয়তো বা সঙ্গ দোষে অটোমেটিকলি প্রভাব পড়েছে। আপনমনে ভেবেই নীলা নিঃশব্দে লাজুক হাসল। কম্বল সরিয়ে বিছানা থেকে উঠতে গেলেই হাতে টান পড়ল। নীলা কিছু বুঝার উঠে আগেই সাদিদ তাকে হেঁচকা টানে বিছানায় ফেলে তার উপর আধশোয়া হলো। নীলা তার এমন কান্ডে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।

— ‘ এমন করেছেন কেন? ‘
— ‘ তোমার জন্য। ‘
— ‘ মানে? আমি আবার কি করলাম? ‘
— ‘ এতক্ষণ ধরে আমাকে দেখে কোনো ফ্রি না দিয়েই চলে যাচ্ছ? এটাতো খুব অন্যায়। ‘

নীলা শুকনো একটা ঢুক গিলল। সাদিদ কিভাবে টের পেল? সে তো ঘুমিয়ে ছিল। নীলা হার না মেনে চাপাবাজীতে লাগল,

— ‘ এ..কদম মিথ্যা কথা বল..বেন না। আ..মি এমন কিছু করিনি। ‘
— ‘ তাই বুঝি? তাহলে এমন আটকে যাওয়া গলায় কথা বলছ কেন? ‘
— ‘ না মানে আপনার জন্য। আপনার এমনভাব দেখলে যেকোনো মানুষের-ই কন্ঠ আটকে যাবে। ‘

নীলার মিথ্যা কথায় সাদিদ মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে হাসল। পরমুহূর্তেই নীলার দুইহাত বিছানার সাথে ঠেসে ধরে সাদিদ নিজের মুখ তার মুখের একদম কাছে নিয়ে গেল। নীলার মুহূর্তের মধ্যেই দৃষ্টি এলেমেলো হতে লাগল। সাদিদের তপ্ত নিঃশ্বাস নীলার চোখ মুখে পরতেই সে মৃদু কেঁপে উঠতে লাগল।

— ‘ কিন্তু তোমারতো সবকিছুই আটকে যায়। এই যেমন এখনকার কথাটাই বললে। ‘

সাদিদের টিটকারি কথায় নীলা মুখ ফিরিয়ে লাজুক হাসল। আবারও উঠতে চাইলে সাদিদ বাধা দিলো।

— ‘ আমার পাওয়া না দিয়ে কোথায় যাচ্ছ? ‘
— ‘ কিসের পাওয়া? ছাড়ুন, আমি উঠব। ‘

নীলা লজ্জায় দাপাদাপি করতেই সাদিদ তাকে আবারও ঠেসে ধরল। ক্রমশ নেশাক্ত কন্ঠে বলল,

— ‘ তোমাকে তো ক্লান্তি দূর করার সুযোগ দিলাম। ফলস্বরূপ, আমার ক্লান্তি দূর করাতো তোমার জন্য বাধ্যতামূলক। ‘

সাদিদ এতটুকু বলে থামল। নীলার আরেকটু কাছে এসে তার নিচের ঠোঁটে সাদিদ নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল রাখল। ঠোঁটে সাদিদের আঙ্গুলের স্পর্শ পেতেই নীলা মৃদু কেঁপে উঠল। সাদিদ কয়েকবার আলতো করে তার ঠোঁটে স্লাইড করতে করতে নেশালো কন্ঠে বলল,

— ‘ আমার ক্লান্তি দূর করার এনার্জি দিবে না? ‘
— ‘ প্লি..জ উঠতে…

নীলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাদিদ তার অধরে নিজের অধর ছুঁয়ে দিলো।
নীলার মনে হচ্ছে তাকে কেউ কারেন্ট দিয়ে শক দিচ্ছে। ভিতরে নাম না জানা ভূমিকম্পের ন্যায় অনুভব হচ্ছে। নীলা সাদিদের উন্মুক্ত পিঠ খামচে ধরল। ধারালো নখের আঁচড়ে পিঠ বোধহয় ছিলে যাচ্ছে। সাদিদ আরও একবার নীলার ঠোঁটে আদর দিয়ে নিজেকে সরিয়ে আনলো। নীলার বুক ক্রমশ উঠানামা করছে। জীবনে প্রথম সাদিদের থেকে এমন স্পর্শ পেয়ে নীলা নিজেকে ঠিক সামলাতে পাড়ছে না। সাদিদ নীলার অবস্থা দেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ এইটুকুতেই এই অবস্থা? সামনে তুমি কি করবে সেটা আমি ভাবতেই পাড়ছি না। ব্যান্ডেজ তো শিওর একবক্স লাগবে। ‘

নীলার লজ্জায় লাল হওয়া মুখ ফিরিয়ে, চোখ খোলে সাদিদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। মানে সে সাদিদের কথাটা ঠিক আঁচ করতে পারেনি। সাদিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে বলল,

— ‘ এখন-ই বোধহয় পিঠ কেটে রক্ত বের হচ্ছে। সামনের জন্যতো বক্স লাগবেই। ‘

নীলার লজ্জায় বোধহয় কান দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। সে সাদিদকে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে নিজের উপর থেকে সরাল। তারপর একদৌড়ে ওয়াসরুমে। সাদিদ সেদিকে তাকিয়ে শব্দ করেই হেসে দিলো।

___________________

নাস্তার পরপরই তারা টেক্সি নিয়ে দার্জিলিং শহর ঘুরার জন্য বেড়িয়ে পড়ল। হানিমুন কাপল সাদিদ-নীলা পিছনের সিটে বসেছে। সাদিদ নীলাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে দার্জিলিং শহর উপভোগ করতে লাগল। ডাইভারের পাশে অর্ণব বসেছে। তার আর প্রিয়তীর মধ্যে মান-অভিমান পর্ব চলছে। তাই দুইজনে আলাদা সিটে বসেছে। তানবীরের খুশি আর দেখে কে! কিন্তু পরমুহূর্তেই যখন শান্তর পাশাপাশি তাকে বসতে হলো তখন-ই তার খুশি হাওয়া হয়ে গেল। অর্ণবের সাথে একপ্রকার কথা কাটাকাটি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে নিজের জায়গায় অনল। তানবীর রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে শান্তর পাশে গিয়ে বসল। শান্তও তানবীরের পাশে বসতে হচ্ছে বিধায় বেশ ইতস্ততবোধ করছে। সেও প্রিয়তীকে মাঝখানে বসতে বলেছে। কিন্তু প্রিয়তীরও এককথা,

— ‘ নো ওয়ে। এই ঝগড়ুটে তানবীরের জন্য আমার বাবুর সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছে। এই ছেলের পাশে আমি কিছুতেই বসব না। ‘
— ‘ একটা থাপ্পড় মারব মিথ্যা কথা বললে। তোর নিজের জন্য কথা শুনেছিস। ‘

তানবীর সাইড থেকে আবারও প্রিয়তীর সঙ্গে লাগতে গেলে সাদিদ ধমকে উঠল,

— ‘ চুপ কর তোরা। আর একটা কথাও বলবি না। দাদা আপ গাড়ি স্টার্ট কিজিয়ে। ‘

টেক্সির চালকও তাদের ঝগড়ায় অবাক দৃষ্টি রেখে গাড়ি স্টার্ট করল। গন্তব্য এখন জাপানিজ টেম্পল এবং পিস প্যাগোডা। শান্ত প্রিয়তীকে অনেক বলেও রাজি করাতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে তাকেই মাঝখানে বসতে হয়েছে। সে একটা বিষয় ভেবে কূল করতে পাড়ছে না, এমন সাধারণ বিষয় নিয়ে এই ছেলেটা এতটা ঝগড়া কিভাবে করতে পারে!

আসলে ঝগড়ার উৎপত্তির ঘটনা ঘটেছিল নাস্তা শেষ করে আসার টাইমে। যখন তানবীর দাঁত চেপে প্রিয়তীকে বলেছিল,

— ‘ আমরা দার্জিলিং এসেছি। পাহাড়ের রাণী বলা চলে। কিন্তু তুই এমন বান্দরের মতো সেজে এসেছিস কেন? মনে হচ্ছে পাহাড় রাজ্যে নই কোনো ভূত রাজ্যে এসেছি৷ ‘
— ‘ কি! এতবড় কথা? তুমি আমার মেকাপ নিয়ে আজেবাজে কথা বলছ? এতবড় সাহস! ‘
— ‘ এখানে সাহসের কি দেখলি? তোর মতো খচ্চর মেয়ের জন্য আমাকে নিজের মূল্যবান সাহস খরচ করতে হয় না। ‘
— ‘ তুমি আবারও আমাকে অপমান করছ? ‘
— ‘ তোকে সম্মান করার কোনো কারণ খোঁজে পাচ্ছি না। ‘

তাদের ঝগড়াঝাঁটির মনোভাব দেখে পাশ থেকে অর্ণবসহ সবাই দ্রুত হাজির হলো।

— ‘ কি হয়েছে বাবু? ‘
— ‘ দেখ না বাবু, এই তানবীরটা আমাকে যাচ্ছে তাইভাবে অপমান করছে। ‘
— ‘ এই শালা, কি বলেছিস? ‘
— ‘ হালারপুত শালা কইবি না। তোর মতো বাবুর বোনকে আমি বিয়ে করতে বইসা রইছি না। ‘
— ‘ ফালতু কথা বাদ দিয়ে কি বলেছিস সেটা বল। ‘
— ‘ চরম সত্যি একখান কথা। তোর এই বাবুকে আমার ভূত বলে মনে হচ্ছে। ভাবছিলাম খাইয়া-টাইয়া কিছু পরিস্কার হইয়া যাইব। কিছু হয়ছে কিন্তু যতলা লাগাইছে এখনও কয়েক কেজি বাকি৷ আমি শুধু এইটাই বললাম। ‘
— ‘ দেখলে বাবু? কি বাজে কথা! আমি শুধু প্রাইমার, কন্সিলার, ফাউন্ডেশন, কম্পেক্ট, আইলাইনার, আইসেডো, ম্যাট লিপস্টিক আর অল্প কিছু জিনিস দিয়ে মেকাপ করেছি। এটা কি খুব বেশি? ‘

প্রিয়তী বাবুর মতোই ফেইস বানিয়ে কথাটা বলল। অর্ণব একটু গলা কেশে তানবীরের দিকে তাকালো। এখন এই ছেলেকে কিছু বললে শিওর উল্টো হাতাহাতিতে লেগে যাবে। তাই বেশ নরম গলায় প্রিয়তীকে বলল,

— ‘ বাবু বেশি না, এইযে এই কমলা লিপস্টিকটা অল্প একটু মুছে দাও। সাথে চোখের উপরে লাল লাল এগুলো যা লাগিয়েছ একটু মুছে ফেল। দেখবে তোমাকে আরও বেশি সুন্দর লাগবে। ‘
— ‘ তারমানে তুমিও এই তানবীরের সাথে মিলে কথা বলছ? খবরদার আমার কাছে আসবে না। তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই। ‘

এই বলে প্রিয়তী রাগ দেখিয়ে সামনে চলে যেতেই অর্ণব পিছন থেকে হাত টেনে ধরে। প্রিয়তী আরও রেগে গিয়ে সবার সামনেই তার হাত ঝাটকা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল। যার জন্যই অর্ণবেরও রাগ হয়েছে।
দার্জিলিং শহরের পাহাড়ি রাস্তাগুলো বেশ আঁকাবাঁকা। আচমকা গাড়ির মোড় ঘুরতেই শান্ত বেখেয়ালিতে তানবীরের গায়ের উপর এসে পড়ে। আর তৎক্ষনাৎ তার ভাবনাতে বেঘাত ঘটল। আচমকা শান্তর এভাবে ব্যালেন্স হারানোটা তানবীরও আন্দাজ করতে পারেনি৷ তাই সে শান্তর কোমড় চেপে ধরল। পুরুষালী শক্ত হাতের ছোঁয়াতে শান্ত বর্তমান সবকিছু ভুলে শিহরিত হতে লাগল। সে একেবারের তানবীরের সাথে মিশে রয়েছে।
উপস্থিত সবাইও এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে চমকে গিয়েছে। তানবীর আড়চোখে বাকি সবাইকে দেখে শান্তর কোমড় থেকে হাত সরিয়ে তাকে ধমকে উঠল,

— ‘ চোখ কোথায়? দেখছিলে না সামনে মোড় রয়েছে? যতসব। ‘

তানবীর রাগ দেখিয়ে জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কিন্তু অপরদিকে শান্ত আজ একদমই রাগ করেনি৷ তার জানা নেই কিন্তু তার রাগ হচ্ছে-ই না। বরং তার অজান্তে খুব খুশি অনুভব হচ্ছে। কেননা বাউয়াল রিসোর্টের সেদিনের রাতের পর থেকে তানবীর তার সাথে ভুলেও কথা বলেনি। একপ্রকার তার ছায়াও মারাতে সে অনিচ্ছুক। এরপর থেকে বারকয়েক দেখা হলেও তানবীর তাকে একপ্রকার এড়িয়ে গিয়েছে। যেখানে শান্তর রাগ করবার কথা সেখানে তানবীরের এমন আচরণ তার বোধগম্য হয়নি। কিন্তু আজ রাগ করে হলেও তানবীরের মুখে নিজের জন্য কোনো শব্দ শুনে শান্তর ভালোলাগছে। অজান্তেই তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল। আড়চোখে তানবীরের মুখের একটাপাশ দেখতে পেয়ে তার হাসির রেখা বিস্তৃত হলো।

.

জাপানিজ টেম্পল এবং পিস প্যাগোডাতে এসে নীলাসহ সবাই মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল। সত্যি কথা বলতে গেলে এরকম নান্দনিক শিল্প চোখে দেখলে মুগ্ধতা এসে বিরাজ করবেই। দার্জিলিং শহেরের উঁচু ইমারতগুলোর মধ্যে এই পিস প্যাগোডা অন্যতম। দার্জিলিং শহর থেকে ১০ মিনিটের ডাইভিং ডিসটেন্সে অবস্থিত এই দোতলা সাদা বৌদ্ধ মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল ট্রেডিশনাল জাপানিজ স্টাইলে ১৯৭২ সালে। মন্দির থেকে অল্প দূরেই রয়েছে পিস প্যাগোডা। যেখানে ভগবান বৌদ্ধের চারটি অবতার দেখানো হয়েছে। এই প্যাগোডার টপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ দার্জিলিয়ের পাহাড় শ্রেণির অতিব সুন্দর দৃশ্যপটের দেখা মিলে।
নীলা শুধু ছবিতেই এই কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে হইহট্টগোল দেখে এসেছে। আজ চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে খুশিতে তার চোখে অশ্রুকণার অস্তিত্ব প্রকাশ পেল। সাদিদ নীলাকে একহাতে বুকে চেপে ধরে নিঃশব্দে হাসল। সে নীলার অনুভূতি বুঝতে সক্ষম। তারা যখন সর্বপ্রথম এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হয়েছিল, আবেগে তারাও আপ্লূত হয়েছিল।

প্যাগোডা থেকে তারা রওনা দিলো হ্যাপি ভ্যালি টি ষ্টেটের উদ্দেশ্য। দার্জিলিং চকবাজার থেকে এই টি ষ্টেটটির দুরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। দার্জিলিং ভ্রমণে আসবেন অথচ দার্জিলিয়ের বিখ্যাত টি ষ্টেট দেখবেন না, এমনটা কি হয়? তাই কাছ থেকে দার্জিলিং চা বাগান না দেখলে অনেক কিছু মিস করে যাবেন।
এটি ১৮৫৪ সালে স্থাপিত ৪৪০ একর জমির উপর বিস্তৃত দার্জিলিং শহরের দ্বিতীয় প্রাচীন চা বাগান। এখানে কিছু কিছু চা গাছ রয়েছে যেগুলো প্রায় ১০০ বছরের বেশি পুরনো। দেড় হাজারের বেশি শ্রমিক এই হ্যাপি ভ্যালি টি ষ্টেটে কাজ করে।
ছবির ন্যায় সুন্দর এই চা বাগানটির মাঝখান দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হাঁটা, এবং ফেক্টরিতে গিয়ে সরাসরি চা প্রসেসিং দেখা এক অসাধারণ অবিজ্ঞতা বলা চলে। এই সুন্দর চা বাগান থেকে পুরো শহরের প্যানোরোমিক ভিউ দেখা যায়। ১০০ রুপি খরচ করে গাইডের মাধ্যমে পুরো চা বাগানও চা উৎপাদন দেখতে পাওয়া যায়। আবার ইচ্ছে থাকলে এখানে চা খাওয়ার সাথে চা পাতা কেনারও সুযোগ আছে।

সাদিদরা একদম অরিজিনাল হ্যাপি ভ্যালি টি ষ্টেটের চা খেতে ফ্যাক্টরির একদম সামনে চলে আসলো। আশেপাশে আরও অনেকগুলো টি-শপ রয়েছে। কিন্তু অরিজিনাল হিসেবে এর তুলনা হয় না।
একজন লোকাল মহিলা এখানে হ্যাপি গোল্ডেন নামে ছোট একটি চায়ের শপ চালান। তিনি মূলত ফ্যাক্টরির চায়ের পাতা সংগ্রহ করে চা বানান।
সাদিদরা সবাই ব্ল্যাক টি নিলো। চায়ের কাপে একচুমুক দিয়েই নীলা-শান্ত প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,

— ‘ ওয়াও। অসাধারণ টেস্ট। এরজন্যই বোধহয় দার্জিলিয়ের এই টি ষ্টেট এত বিখ্যাত। জাস্ট অসাধারণ। ‘

বাকি সবাই তাদের উচ্ছাসিত মনোভাব দেখে হাসল। তানবীরও আড়চোখে শান্তকে দেখতে লাগল। মুহূর্তেই তার বুকের বামপাশে তীক্ষ্ণ একটা ব্যাথা অনুভব করতেই সে দ্রুত দৃষ্টি ফিরাল। অন্যপাশে তাকিয়ে বারকয়েক জোরে শ্বাস টানল। সাদিদ তাকে খেয়াল করে বলল,

— ‘ কিরে, তুই ঠিক আছিস? ‘
— ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। আমার চা খাওয়া শেষ। আমি ট্যাক্সির কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তোরা আয়। ‘

তানবীর কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত জায়গা ছেড়ে সামনে হাঁটা দিলো। শান্ত তার গমনপথের দিকে তাকালো। সে কিছুতেই এই ছেলেটাকে বুঝে উঠতে পারে না। এতক্ষণ কতো দুষ্টুমি করছিল। আর হঠাৎ করেই এমন গম্ভীর!
সাদিদরাও চা খেয়ে বাগান থেকে বেড়িয়ে পড়ল। সাদিদ ট্যাক্সির সামনে এসে অর্ণব আর তানবীরের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ আজকে আর বেশি দূরে কোথাও ঘুরতে যাব না। এখান থেকে বেড়িয়ে ইসলামিয়া হোটেলে লাঞ্চটা করে অবজারভেটরি হিলে চলে যাব। সেখানটা ওদেরকে দেখিয়ে সোজা হোটেলে। ‘

সাদিদের কথাটা ধরতে দুই দুষ্টু বন্ধুর বেশি সময় লাগল না। তারা দুইজনে দুইপাশ থেকে সাদিদের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে মিটমিটিয়ে বাঁকা হাসছে। সাদিদ তাদের কর্মকান্ডে নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথা নিচু করে হাসতে লাগল। নীলা চোখ বাকিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাদেরকে পরখ করতে লাগল। বিষয় কিছু বুঝতে উঠতে না পেরে বোকার মতো প্রশ্ন করল,

— ‘ কেন? আর কোথাও গেলে কি সমস্যা? ‘

নীলার বোকামার্কা প্রশ্ন শুনে অর্ণব আর তানবীর পেট ধরে হাসতে লাগল। এবার শান্ত-প্রিয়তীও এই দুই বাদরকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগল। শান্তর বোধহয় এতক্ষণে সত্যিই শান্তি ফিরে এসেছে। সে একদৃষ্টিতে মুগ্ধ চোখে তানবীরের ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসি দেখতে লাগল। কিন্তু পরমুহূর্তেই তানবীর আর সাদিদের হাবভাব দেখে পাশে দাঁড়ানো প্রিয়তীর দিকে তাকালো। তারা দুইজন-ই একে অপরের দিকে তাকালো। দুইজনের দৃষ্টি মিলিত হতেই তারা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল। তারপর মানসম্মান রক্ষার্থে ভদ্র মেয়েদের মতো নিজেদের জায়গা ত্যাগ করে দ্রুত গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসল। মনে মনে দুইজন-ই আওড়াল,

— ‘ সবগুলো বেশরম। এমনভাবে কেউ লোক সম্মুখে বলে? ‘

নীলা এখনও ভিতুর ডিমের মতো এই অদ্ভুত মানবরূপী জীবগুলোকে দেখছে। সাদিদ এগিয়ে এসে নীলার পাশে দাঁড়াতেই সে আবারও বলে উঠল,

— ‘ সবাই এমন করল কেন? আমিতো কিছুই বুঝতে পারলাম না। ‘

সাদিদ এবার নীলার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে দাঁড় করাল। নীলা আশেপাশে তাকাতেই সাদিদ তার নাকে নিজের নাক ঘষা দিয়ে বলে উঠল,

— ‘ তোমার এসব বুঝার কথাও না। তুমিতো আমার পিচ্চি বউপাখি। ‘
— ‘ আ..মি বুঝি পিচ্চি? ‘
— ‘ সরি মাই ডিয়ার ওয়াইফ। পিচ্চি বাট এডাল্ট পিচ্চি। ‘

বলেই সাদিদ নীলার গালে আলতো করে কামড় বসাল। নীলা গাল ঘষে চোখ বাঁকিয়ে তাকাতেই সাদিদ তাকে চোখ টিপুনি দিলো। আর নীলা আবারও লজ্জা পেয়ে আশেপাশে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করল। দুষ্টু সবগুলো কিন্তু গাড়িতে বসে হানিমুন কাপলের এই মিষ্টি রোমান্সটা দেখতে মিস করল না।

.

তারা বাগান থেকে বেড়িয়ে সোজা লাঞ্চের জন্য ইসলামিয়া হোটেলে চলে আসলো। দার্জিলিং মসজিদের পাশে অবস্থিত এই হোটেলটা ট্রোরে আাসা বাঙালিদের জন্য খুবই বিখ্যাত একটা হোটেল। খাবারের প্রাইজ রিজেনেবল কিন্তু স্বাদে অনন্য।
দার্জিলিং এর স্থানীয়রা ভাতের সাথে গরুর মাংস এবং মসুর ডাল খেতে খুব পছন্দ করে। তাই সাদিদরা প্লেইন রাইসের সাথে মসুর ডালসহ তান্দুরি চিকেন, ভেজ ফ্লাইড রাইস, মটর পনির, পনির বাটার মাসালা, চিকেন মাসালা, বিফ বুনা, বিফ কাবাব, বিফ মম এবং বিফ চিলি অর্ডার দিয়েছে। জম্পেশ একটা লাঞ্চ শেষে তারা একটু রেস্ট নিয়ে দার্জিলিয়ের দ্য মল এবং অবজারভেটরি হিলের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়ল।
চৌরাস্তা স্কোয়ারের নিকটবর্তী দার্জিলিয়ের এই মল সবসময় জমজমাট। দোকানপাট, বেকারি, রেস্টুরেন্ট, চা, নানারকম স্ট্রিট ফুড, ঘোড়ায় চলাসহ এই মল পর্যটকদের জন্য এক আনন্দময় স্থান।
সাদিদরা সবাই ঘুরে ঘুরে মলটা দেখতে লাগল। তারা টুকিটাকি কেনাকাটাও করল। ফ্যামিলির সবার অগোচরে এই ভ্রমণ বিধায় বেশি কিছু নেওয়া যাচ্ছে না। নতুবা জিনিসপত্র দেখে ধরা পড়ার সম্ভবনা থাকবে। সাদিদ ঘোড়া দেখে নীলার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ ঘোড়ায় চড়বে? ‘
— ‘ না, না এসবে উঠব না। ‘
— ‘ কেন? দার্জিলিং ভ্রমণে আসলে তো সবাই এই সুযোগটুকু হাতছাড়া করতে চায় না। ‘
— ‘ আসলে ভাইয়া আমি একটা নিউজ প্রোর্টালে পড়েছিলাম। আমাদের কক্সবাজারে যেসব ঘোড়ায় চড়া হয় তারা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অনেক ঘোড়া মারাও যায়। আর তাছাড়া নিজেদের খানিক আনন্দের জন্য এসব নিরীহ প্রাণীদের কষ্ট দিয়ে কি লাভ? ‘

সাদিদ নীলার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ধীরে ধীরে তার চোখে-মুখে নেমে আসলো উপচে পড়া মুগ্ধতা। সে নীলাকে একহাতে বুকের সাথে আগলে নিয়ে সবাই সামনেই কপালের একপাশে ভালোবাসার স্পর্শ আঁকল। এই মেয়েটা তাকে আর কতভাবে মুগ্ধ করবে? সবারও তো এমনটাই চিন্তা করা ধরকার। মানুষদের আনন্দ দিতে যদি নিরীহ প্রাণীদের কষ্ট দিতে হয়, তাহলে দরকার কি এই আনন্দের?
উপস্থিত সবাই সাদিদের কান্ড দেখে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগল। নীলা সাদিদের এমন আচরণে ভীষণ লজ্জা পেল। সে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ আপনি এমন নির্লজ্জ কেন? সবাই কি ভাবছে! ‘
— ‘ প্রতিনিয়ত এতো মুগ্ধ করো কেন? তাহলে যে এমনটা করতেই হয়। ‘

ইশশ কি নির্লিপ্ত উত্তর। নীলা নিচুস্বরে বললেও তানবীর শুনে নিয়ে বলতে লাগল,

— ‘ নীলা, ভালোবাসায় মাঝেমধ্যে নির্লজ্জ হতে হয়। প্রেমে যদি নির্লজ্জতা না থাকে তাহলে সেটা পানসে লাগে। কথায় বলে না টক-ঝাল-মিষ্টি। সো সবকিছুর কম্বিনেশন দরকার আছে। ‘

নীলা তানবীরের উত্তরে আরও লজ্জা পেল। শান্তর চোখে এবার মুগ্ধতা এসে ভিড় জমালো। ছেলেটা সুন্দর করেও কথা বলতে পারে। বোধহয় শান্তর জন্যই সে নিজের রাফ এন্ড টাফ বিহেভিয়ার বরাদ্দ করে রেখেছে। শান্ত তানবীরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সাদিদরা ঘুরে মলটা দেখতে লাগল। নীলা, শান্ত, প্রিয়তী সবার জন্য সাদিদ এখানকার দোকান থেকে পাহাড়ি পোশাক কিনে নিলো। কিছু জিনিসের মূল্য নয় বরং এর স্মৃতি মূল্যবান। তারাও হাসিমুখে ড্রেসটা নিয়ে নিলো। সাথে তারা দার্জিলিং বিখ্যাত স্ট্রিটফুড মম (মাংস বা সবজি দিয়ে পিঠার মত খাবার) খেল। লাঞ্চ করে আসাতে খুব বেশি খেতে পারেনি। কিন্তু গুটিকয়েকে তৃপ্তির কোনো কমতি ছিল না। তারা দার্জিলিয়ের কমলাও খেল।
নীলা আর খেতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু সাদিদ জোর করে তার মুখে কমলার একটা কোয়া পুরে দিতেই তার চোখ বড় বড় হলো। সাদিদের দিকে তাকিয়ে সে গালে হাত দিয়ে হেসে দিলো। সত্যিই দার্জিলিং শহরের কিছু জিনিস শুধু মুখে বলে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অসাধারণ দৃশ্যপট, অসাধারণ সব খাবারের স্বাদ। তারা সবাই হাতে কমলা নিয়ে হেঁটে হেঁটে খেতে লাগল।
তারা এখন মহাকাল মন্দির পরিদর্শনে যাবে।

মলের ঠিক পেছনেই রয়েছে মহাকাল মন্দির। যা অবজারভেটরি হিলের উপরে অবস্থিত। মলের পিছনে ডানদিকের রাস্তা দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা উপরে উঠলে এই মন্দিরটি দেখতে পাবেন।
মহাকাল মন্দিরটি মূলত ভগবান শিবের মন্দির।
সাদিদরা মন্দিরের প্রবেশের পূর্বেই কমলার খোসাগুলো সব ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। কেননা এখানে প্রচুর বানর দেখা যায়। তারা নরমালি কোনো আক্রমণ না করলেও খাবার সামগ্রী অথবা তাদের সাথে লাগতে গেলে আক্রমণ করতে পারে। এই মন্দিরটিকে ইউনিক বলা চলে। কেননা এখানে হিন্দু ধর্মাবলীর দেব-দেবীর সাথে বৌদ্ধ ধর্মাবলীদেরও চক্র দেখতে পারবেন। দুই ধর্মের সহাবস্থান দেখা যায় এখানে।
তারা সন্ধ্যানাগাদ এখানে ঘুরাঘুরি করে সবকিছু দেখল। সারাদিন ভালো কাটলেও আচমকা বৃষ্টি শুরু হলো। দার্জিলিয়ে এটা নতুন নয়। এখানে বৃষ্টি যেকোনো সময় হতে পারে। এর পূর্বাবাস স্থানীয়রা ব্যতিত দেওয়া কষ্টকর। নীলাদের সাথে ছাতা না থাকায় তারা সবাই-ই মোটামোটি ভিজে গিয়েছে। দার্জিলিয়ের মতো ঠান্ডার জায়গায় বিকেলে এমন বৃষ্টিতে ভিজে সকলের হাড়-গোড়সহ কাঁপতে লাগল। তারা দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে উঠল। সাদিদ সাথে সাথেই জ্যাকেটের চেইন খোলে নীলাকে বুকে টেনে আনলো। টিস্যু দিয়ে মুখ-মাথা মুছে দিতে লাগল। এতক্ষণের রাগ-অভিমান দার্জিলিয়ের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল। অর্ণবও প্রিয়তীকে টেনে বুকে নিয়ে আসলো। যতটুকু সম্ভব পানি মুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। মেয়েটার একটা দিকে একটু বাড়াবাড়ি থাকলেও মনটা পরিস্কার। সেটা অর্ণবের থেকে ভালো আর কে জানে? প্রিয়তীও এবার মিষ্টি হেসে অর্ণবের বুকে মুখ গোঁজল। তানবীরের হাতে কয়েকটা টিস্যু পেপার। তার হাতগুলো শান্তর দিকে সেগুলো এগিয়ে দিতে নিশপিশ করছে। কিন্তু কিছু একটার সাথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দিতে পাড়ছে না। শান্ত নিজেই মাথা-মুখ মুছতে লাগল। হঠাৎ তানবীরের দিকে চোখ পরতেই সে বলে উঠল,

— ‘ এভাবে মাথা না মুছে বসে রয়েছেন কেন? মুছে ফেলুন নতুবা ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘

তানবীর কোনো প্রতিউত্তর করল না। সে এবার সামনে বসেছিল। তাই মুখে রাগ জমিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে টিস্যু দিয়ে মুছতে লাগল।
কারও তেমন খিদে না থাকায় রাতের খাবারটা তারা পার্সেল করে নিয়ে নিয়েছে। কেননা দার্জিলিং শহর রাত আটটার পর বন্ধ হয়ে যায়। হোটেলে ফিরে যে যার রুমে চলে গেল।
সাদিদ দরজার লক খোলতেই নীলা প্রথমে প্রবেশ করল। মুহূর্তেই তার মুখটা অটোমেটিকলি হা হয়ে গেল। সাদিদ দরজা লক করে পিছন থেকে তার পেট জড়িয়ে ধরল। নীলার কাঁধে মুখ ঘষে বলল,

— ‘ বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছ। চেইঞ্জ করবে না? ‘
— ‘ জ..জ্বি। ‘

নীলার এতক্ষণে সবকিছু মাথায় আসছে। তখনকার তাদের দুষ্টু কথাগুলোও একএক করে তার মাথায় আসতে লাগল। সে এবার লজ্জায় পুরোপুরি জমে যাচ্ছে। সাদিদ তার কাঁধে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,

— ‘ তাহলে ড্রেসটা চেইঞ্জ করে নাও। নতুবা ঠান্ডা লেগে যাবে। ‘

নীলা বিনাবাক্য ট্রলি ব্যাগের দিকে এগিয়ে যেতেই সাদিদ বাধা দিলো।

— ‘ লাগবে না। ওয়াসরুমে তোমার কাপড় পেয়ে যাবে। ‘

নীলার এবার শ্বাস আটকে যাবার অবস্থা। কিন্তু সে এবারও শব্দহীনভাবে ওয়াসরুমের দিকে এগিয়ে গেল। জানতে চেয়ে কি হবে? সাদিদের যে এসব পূর্বপরিকল্পিত।
নীলা ওয়াসরুমে গিয়ে আরেকদফা অবাক হলো। রুমের মতো ওয়াসরুমও ফুল দিয়ে সাজানো। লাল গোলাপে ছেয়ে আছে চারপাশ। লজ্জায় নীলার গাল ক্রমাগত লাল হতে লাগল। ওয়াসরুমের একপাশে একটা ঝুড়িতে নীলা একটা চিরকুট লাগানো দেখতে পেল। সাদিদের হাতের গুটিগুটি অক্ষরে লেখা,

— ‘ তাড়াতাড়ি চলে আসো। আমি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ‘

ঝুড়ির ভিতরে হাত দিয়ে নীলা শপিং ব্যাগ খোঁজে পেল। আকাশি-সাদা রঙের মিশেলে পাতলা একটা ওয়েটলেস শাড়ি। তাতে শাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় বাদবাকি জিনিস। ব্লাউজটা দেখে নীলার চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সাদিদ যে দুষ্টুর সাথে সাথে অসভ্যের শিরোমনি নীলা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আরও রয়েছে শাড়ির সাথে মিলিয়ে দুইজোড়া কাঁচের চুড়ি। এসব দেখে নীলার শরীর কাঁপতে লাগল। কিন্তু এখন কিছু করারও নেই। সাদিদ তার কথাতে অনড়। সে আগেই বলে রেখেছিল। নীলাও না পেরে রাজি হয়েছিল। কিন্তু এখন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলাতে পাড়ছে না! এখন কি হবে?
নীলা শাড়িটা পাশে রেখে গরম পানি নিলো। শরীর বেশ শীতশীত করছে। অসময়ের নতুন জায়গায় বৃষ্টিতে জ্বর-সর্দি বাঁধিয়ে দিতে পারে। তাই শরীর এবং মাথায় গরম পানি ঠেলে অল্প সময়ে একটা শাওয়ার নিয়ে নিলো। হাত কাঁপা সত্বেও সে শাড়িটা কোনোভাবে পড়ার চেষ্টা করল। শাড়ি আর ব্লাউজের এমন করুণ অবস্থা দেখে নীলার এখন হাত-পা ছড়িয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। সাদিদ বাহির থেকে দরজায় নক করল,

— ‘ এইপাখি কি করো এতক্ষণ? পানির শব্দ কিসের? তুমি কি শাওয়ার নিয়েছ? ‘

নীলার গলায় আওয়াজ আসছে না। সাদিদ আবারও আওয়াজ দিলো,

— ‘ এই কি হলো? কথা বলছ না কেন? বেবি, আর ইউ ওকে? ‘
— ‘ জ্বি আ..সছি। ‘

নীলা কাঁপা গলায় কথাটা বলেই ওয়াসরুমের দেয়ালে শরীর ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। আরও কিছুক্ষণ পার হতেই বাহির থেকে সাদিদের চিন্তিত গলা শুনে নীলা দরজা খোলল।
দরজার সামনেই সাদিদ দাঁড়িয়ে ছিল। নীলাকে দেখে তার বুকটা শব্দ করে ধকধক করে উঠতে লাগল। সাদিদ দুষ্টুমি করে শাড়ির সাথে কোনো সেফটিপিন রাখেনি। তাই এমন শাড়ি সামলে রাখতে নীলার বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। সে শাড়ির আঁচল দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাদিদ একটা ঢুক গিলে মাথা ঝাঁকাল। নীলাকে বলে সেও ফ্রেশ হতে চলে গেল। সাদিদ যেতেই নীলা যেন হাফ ছাড়ল। এতক্ষণ গলায় এসে দমটা আটকে রয়েছিল। চুল ভিজে থাকায় নীলা ড্রায়ার নিয়ে চুল শুকাতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল। আর চোখ ঘুরিয়ে সে আবারও রুমটা দেখতে লাগল। রুমে কোনো ইলেকট্রিক লাইট নেই। শুধু অগণিত ক্যান্ডেল দিয়ে পুরো রুমটা আলোকিত করা। লালগোলাপ এবং রজনীগন্ধা দিয়ে বিছানাসহ পুরো রুমটা সুন্দর করে সাজানো। এত ফুলের মনোরম সুভাসে মন পুলকিত হতে বাধ্য। নীলার রুম পর্যবেক্ষণের মধ্যেই সাদিদ দরজা খোলে বেরিয়ে আসলো। সেও বোধহয় শাওয়ার নিয়েছে। তাই চুুল কপালে লেপ্টে আছে। টুপটুপ করে পানি পড়ছে। সাদিদের বুক উন্মুক্ত। শুধু কালো একটা টাওজার পরনে। নীলা বুঝতে পারে না এই ছেলের কি ঠান্ডা-টান্ডা লাগে না নাকি? নীলাতো রুম হিটার থেকেও কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সাদিদ সাদা টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে নীলার দিকে এগিয়ে আসলো। চোখে তার গভীর দৃষ্টি। সাদিদ টাওয়েলটা পাশে রেখে ড্রায়ারটা হাতে নিলো।

— ‘ আমি হেল্প করছি। ‘

নীলা কিছু না বলে চুপচাপ কাঁপা হাতে দিয়ে দিলো। সাদিদ বেশ যত্ন নিয়ে নীলার ভেজা লম্বা চুলগুলো শুকিয়ে দিলো। ড্রায়ারটা রেখে নীলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার চুলে মুখ গোঁজল। বার কয়েক লম্বা করে নাক টেনে প্রাণপাখির চুলের মনমাতানো ঘ্রাণ শুকলো।
নীলার অবস্থা এইদিকে কাহিল। সাদিদ তাকে দাঁড় করিয়ে আয়না দিয়ে তার উপর থেকে নিচে একদৃষ্টিতে চোখ ভুলিয়ে নিলো। সাদিদের এমন বেশরম চাহনি দেখে নীলা সম্ভব হলে এখন-ই দরজা খোলে দৌড় দিবে। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়। কেননা, সাদিদ যে তাকে আজ নিজের জালে আটকে নেবার পুরোপুরি ফন্দি এটেছে। সাদিদ নেশাক্ত চাহনি নিয়ে নীলার গলায় মুখ গোঁজল। নীলা কেঁপে উঠে সঙ্গে সঙ্গে শাড়ি খামচে ধরল। সাদিদ নীলার গলায় মুখ ঘষে ভেজা ঠোঁটে উষ্ণ স্পর্শ দিতে লাগল। সাদিদের খোঁচা দাড়ির আঘাতে নীলা স্থির থাকতে না পেরে, দূরে সরে যেতে চাইলেই সাদিদ তাকে টেনে এনে তার কোমড় চেপে ধরল। সাদিদ তার পেটে হালকা চেপে ধরে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে আবেগময় কন্ঠে আহ্বান জানালো।

” আমি কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া অনেক দেখেছি।
কিন্তু সব ভুলেছি যেদিন তোমার প্রেমে মজেছি।
প্রেম নাকি ভালোবাসা তখন বুঝতে ছিলাম নারাজ।
কিন্তু তোমার মাদকতা করেছে আমাকে বাধ্য।
আজ বলতে দ্বিধা নেই,
ভালোবাসি।
হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
পরিমাণ করা দুঃসাধ্য, নাম দেওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর।
কিন্তু নিরদ্বিধায় বলতে পারব,
অন্তরের অন্তস্থল থেকে আমি তোমায় ভালোবাসি।
তাই তোমাকে চাই।
এতটুকু ভালোবাসাও আমার কম মনে হচ্ছে।
তাই তোমাকে আরও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে চাই।
নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে চাই।
নিজের অফুরন্ত ভালোবাসায় তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চাই।
পাব কি সেই অধিকার? দিবে কি সেই অধিকার? ”

নীলা সাদিদের বুকে হেলে পড়ে চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বামপাশের হৃদযন্ত্রটা বোধহয় বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। নীলাকে নিশ্চুপ দেখে সাদিদ আবারও বলল,

— ‘ ভালোবাসি। আর সারাজীবন বাসব। কিন্তু এইক্ষেত্রে তোমার অনুমতি ব্যতিত আমি শিকল দিয়ে শক্ত-পোক্তভাবে বাঁধা। উত্তর দাও পাখি। আমি অপেক্ষা করছি। ‘

সাদিদের আবেগমাখা ঘোর কন্ঠের কাছে নীলাকে হার মানতে হলো। সে চোখ খোলে আয়নায় সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদও তাকালো। দুইজনের দৃষ্টি মিলিত হতেই নীলা একবার চোখ বুজে ইশারায় নিজের হ্যাঁবোধক অনুমতি দিলো। সাদিদ তৃপ্তিজনক মৃদু হেসে নীলার গলায় আবারও একটা শব্দ করে চুমু খেল। নীলা লাজুক হেসে মাথা নিচু করল।
সাদিদ আয়নার নীলাকে আরও একবার দেখে নীলার আঁচলটা কাঁধ থেকে নিচে ফেলে দিলো। নীলা বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকাতেই সাদিদের নেশালো চোখ দেখতে পেল। সাদিদের চোখজোড়া তার শরীরের নিষিদ্ধ বাঁকগুলোতে ঘুরঘুর করছে। নীলাআর পাড়ল না। চোখ খিঁচে বন্ধ করল। সাদিদ তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে পাঁজাকোলে নিয়ে ফুলেসজ্জিত বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। নীলাকে আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সেও বিছানায় আসলো। নিজের ভর নীলার উপর দিতেই নীলা মৃদুস্বরে আহ্ করে উঠল। সাদিদ মৃদু হেসে তাকে চুমু দিয়ে আদর করতে লাগল। নীলা এখনও চোখ বন্ধ করে রাখাতে সাদিদ তার গালে হাত রেখে মিষ্টিস্বরে বলল,

— ‘ বউ, চোখ খোলো। ‘

নীলা চোখ খিঁচে মাথা নাড়িয়ে না করল। তাই সাদিদ আবারও বলল,

— ‘ চোখ খোলো প্লিজ। আমার জন্য। ‘

নীলা তার কথা ফেলতে পাড়ল না। সাদিদ তাকে চোখ খোলতে দেখে হাসল। নীলার কপালে দীর্ঘ চুমু দিয়ে আদর করল। নীলার সমস্ত মুখ লজ্জায় ইতিমধ্যে লালাভ বর্ণ ধারণ করেছে। সাদিদ মুখ এগিয়ে নীলার ভেজা অধরে নিজের অধর স্পর্শ করল। নীলা আবারও চোখ বন্ধ করে সাদিদের উন্মুক্ত পিঠ খামচে ধরল। সাদিদ নিজের এতদিনের জমানো সব তৃষ্ণা মিটিয়ে নীলাকে আদর দিতে লাগল। ভালোবাসাময় কাপল যুগলের ভালোবাসার আরও একটাদাপ বুঝি এই পাহাড়ের রাণীর বুকেই পূর্ণতা পেতে লাগল।

#চলবে…