অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-১৮+১৯

0
1005

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১৮

সাদিদ জেগে উঠে নির্নিমেষ প্রাণপাখির ঘুমন্ত স্নিগ্ধ মুখটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর নীলা সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছে। গতরাতের কথা ভাবতেই সাদিদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। তৃপ্তিদায়ক হাসি। তার জীবনের মধুর রাতগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে সেটি পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে সাদিদ নিজের ডানহাতটা নিয়ে নীলার মাথায় রাখল। অনেক ভালোবাসায় এবং যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। নীলা ঘুমের মধ্যেই আরাম পেয়ে সাদিদের সাথে আরও মিশে গেল। সাদিদ মৃদু হেসে নীলার মাথায় চুমু খেল। বুকের মধ্যে আরেকটু টেনে নিয়ে খুব যত্নে হাত বুলাতে লাগল।
কিছু সময় পর নীলার ঘুমটাও ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরপরই সে যে জিনিসটা উপলব্ধি করল সেটা হলো কারও হৃদয়ের ধুকপুকানি। নীলা পিটপিট করে চোখ খোলে তাকালো। তাকে কেউ নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সে মাথা উপরে তুলে তাকাতেই সাদিদের সঙ্গে দৃষ্টি মিলিত হলো। সাদিদ নীলার এলেমেলো চুলের সাথে ঘুমে হালকা ফোলে উঠা মুখটা একপলক দেখে নিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

— ‘ গুড মর্নিং সুইটহার্ট। ‘

নীলারও হাসল। কিন্তু পরমুহূর্তেই রাতের কথা আবারও মাথায় চলে আসতে তার দৃষ্টি নত হলো। এলেমেলো চোখে সাদিদের উন্মুক্ত বুক দেখতে লাগল। সঙ্গে ঠোঁটের কোণায় এসে যুক্ত হলো লাজুক রেখা। সাদিদ তীক্ষ্ণ চোখে নীলার সবটা পরখ করছে। তাকে অবাক করে দিয়ে নীলা নিজেকে সাদিদ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করল। সাদিদ প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই বিষয়টা আঁচ করতে পারল। নীলা রাতেও একবার এমনটা করেছে। সাদিদ নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল। তারপর নীলার দিকে এগিয়ে গেল। সাদিদের কাছে আসা টের পেয়ে নীলার শরীর মৃদু কাঁপতে লাগল। সাদিদ একেবারে নীলার শরীর ঘেঁষে এসে, তাকে পিছন থেকে টেনে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। কম্বলের ভেতর দিয়ে হাত নিয়ে নীলার কামিজ বেধ করে পেট জড়িয়ে ধরল। সাদিদের উষ্ণ স্পর্শ পেতেই নীলা আবারও থেকে থেকে কেঁপে উঠল। সরতে চাইলে সাদিদ বাধা দিলো। নীলার কাঁধে মুখ গোঁজে দুষ্টুস্বরে বলল,

— ‘ মর্নিং ও বললে না আবার গিফটও দিলে না। এটা কেমন অভদ্রতা? ‘

নীলা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। কিন্তু দৃষ্টি স্থির রাখতে পারল না। আবারও লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে আনল। সাদিদ এবার একটু উচ্চস্বরেই হাসল। নীলা তাতে আরও লজ্জা পেল। সাদিদ কম্বল পেঁচিয়ে নীলাকে টেনে বুকের উপর নিয়ে আসলো। তার গালে হাত রেখে মিহি স্বরে বলল,

— ‘ আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা। ‘

নীলা বিনাবাক্য সাদিদের বুকে মুখ গোঁজল। সাদিদ হাসতে হাসতেই তার মাথায় চুমু দিলো। তারপর বলল,

— ‘ আমার গিফট? তোমারটা তো দিয়ে দিলাম। ‘

নীলা বুঝতে পেরে হাসল। লজ্জা লাগছে প্রচুর। তারপরও সাদিদের উন্মুক্ত বুকে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিলো। সাদিদ প্রশান্তিতে নীলাকে আরও শক্ত করে আগলে নিলো। প্রতিটি সকাল মনোমুগ্ধকর হওয়ার জন্য এর থেকে বেশি সাদিদের আর কি চাওয়ার আছে?

_______________

নাস্তা খাওয়ার সময় ঘটে গেল আরেক বিপত্তি। সাদিদ-নীলা টেবিলে আসতেই দুষ্টুগুলোর মিটমিটানি শুরু। সাদিদ দুই বন্ধুকে বার কয়েকবার চোখ রাঙিয়েছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! তারা তাদের দুষ্টুমিতে মসগুল। নীলা লজ্জায় পারে না এখান থেকে দৌড় লাগাতে। তানবীরের হঠাৎ করে সাদিদের গলায় চোখ পরতেই তার চোখজোড়া তীক্ষ্ণ হলো। দার্জিলিয়ে বেশ ঠান্ডা। তাই দুইজনে এমন প্যাকেট হয়ে আসলেও কেউ কিছু মনে করেনি। কিন্তু সাদিদের গলায় মাফলারটা তার ঠিক মাথায় আসছে। ছোটবেলার বন্ধু হিসেবে সে ভালোই জানে এমন ঠান্ডাতে সাদিদ গলায় মাফলার পেঁচাবে না। তুষারপাত ব্যতিত তাকে মাফলাতে খুব কম-ই দেখা যায়। সে আচমকা সাদিদের গলার মাফলারে টান দিয়ে সেটা নিজের হাতে নিলো। বিষয়টা এতটাই দ্রুততার সহিত ঘটেছে যে সাদিদ সেটা আঁচ করতে পারেনি। সে কিছু বলবে তার আগেই তানবীর বলে উঠল,

— ‘ তোর তো ঠান্ডা কম তুই এসব পরেছিস কেন…

সে কথা থামিয়ে দিলো। একদৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগল। সাদিদের ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে ফাজিল ছেলেটাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিতে। তানবীরের দেখাদেখি সবাইও বিষয়টা খেয়াল করল। আর বুঝতে পেরে সবাই-ই মাথা নিচু করে ঠোঁট চেপে হাসতে লাগল। নীলার লজ্জায় মরে যাবার অবস্থা। সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ‘ আ..আমার শেষ। কাজ..

সে কথা অসম্পূর্ণ রেখেই দৌড়ে রুমে গেল। সাদিদ বন্ধুুগুলোর দিকে একবার চোখ রাঙিয়ে নীলার পিছু গেল। নীলা সোজা বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়েছে। দ্রুত শ্বাস উঠানামা করছে তার। সাদিদ দরজায় এসে দাঁড়াতেই নীলাকে দেখতে পেল। দরজাটা লক করে এসে সে নীলার পাশে বসল। আদরমাখা কন্ঠে ডেকে উঠল,

— ‘ পাখি? ‘
— ‘ জ্বি। ‘
— ‘ এই বউ?
— ‘ জ্বি। ‘
— ‘ এই প্রাণপাখি? ‘
— ‘ জ্বি। ‘
— ‘ এই বাবাইয়ের আম্মু? ‘
— ‘ জ…

নীলা এবার মুখ তুলে তাকালো। সাদিদের দুষ্টুমি বুঝে উঠতে পেরে লাজুক হাসল। সাদিদ নীলার পাশে শুয়ে পড়ল। একহাতে ভর দিয়ে নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল নির্নিমেষ। নীলা লজ্জা পেয়ে হাসল। নিচুস্বরে বলল,

— ‘ সবাই কি ভাবছে? আমার খুব লজ্জা লাগছে। ‘
— ‘ কি ভাববে? এটা আমাদের জন্য নরমাল বিষয়। দুষ্টুগুলো এমনিতে ফাজিল হলেও তোমার সামনে কিছু বলবে না। তাই তুমি নিশ্চিতে থাক। ‘
— ‘ তারমানে আপনার সামনে বলবে? ‘

সাদিদ ঠোঁট চেপে হাসল। নীলার কানের সাথে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ শুধু বলবে না। বহুত কিছু করবে। তোমার হয়তো সেসব হজমে কোলাবে না। ‘

বলেই সাদিদ নীলার কানের লতিতে আলতো করে কামড় বসাল। নীলা তার কথায় এবং কাজে আরও লজ্জিত হলো। সাদিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ‘ আর লজ্জা পেয়ে লাভ নেই ম্যাম। এবার আমাদের যেতে হবে। তাই উঠুন। ‘

নীলা লজ্জারাঙা মুখটা নিয়ে সাদিদের সাথে চলে আসলো। সবার কাছে আসতেই তারা টেক্সিতে গিয়ে বসল।

.

সাদিদরা পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুওলজিকাল পার্কের সামনে এসে থামল। এটি দার্জিলিং চিড়িয়াখানা নামে বেশি পরিচিত। প্রায় ৬৭.৫৬ একরের এই পার্ক হিমালায়ান পার্ক নামেও পরিচিত। দার্জিলিয়ে যত টুরিস্ট স্পট রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে এই দার্জিলিং জু দেখতে। কেননা এখানে এত বেশি দেখার জিনিস রয়েছে যে দেখে কূল করা যায় না। মোটামোটি ৩ ঘণ্টার উপর সময় লাগে এখানের সবকিছু ঘুরে দেখতে। পাহাড়ে অবস্থিত এই পার্কে হিমালায়ান অঞ্ছলের স্নো লিওপার্ড, সাইবেরিয়ান টাইগার, হিমালায়ান নেকড়ে, ক্লাউডেড লিওপার্ড, কালো ভাল্লুক ও রেড পাণ্ডার মতো বিরল কিছু প্রাণীসহ পাখি ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীদের দেখা মিলবে।
এই জুলজিকাল পার্কে ছড়িয়ে আছে দুই শতাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ, একশো বছরের পুরোনো বহু ওক গাছ এবং ৫০ এর বেশি প্রজাতির অাছে।
জুএর বার্ড সেকসনে আছে গোল্ডেন ফিজেন্ট, সিলভার ফিজেন্ট ও কালিজ ফিজেন্ট, আছে ব্লু গোল্ড ম্যাকাও, রেড আইড কুকু, বিভিন্ন ধরনের প্যারাকিট, গ্রে পিকক,হিমালয়ান মোনাল, হিল ময়নার মতন চোখ ধাঁধানো রংবেরংএর কিছু সুন্দর পাখি।
এটি বৃহস্পতিবার ব্যতিত সাপ্তাহিক বাকি দিন খোলা থাকে। উল্লেখ্য যে এখানে জু, হিমালায়ান মাউন্টেননিয়ারিং ইনস্টিটিউট এবং বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম একই সঙ্গে অবস্থিত। তাই ঘুরে দেখতে সময়ও লাগে প্রচুর। এখানে প্রবেশ টিকেটের মূল্য মাথাপিছু ভারতীয়দের জন্য ৬০ রুপি এবং বিদেশিদের জন্য ১০০ রুপি করে। ছয় বছরের ছোট্ট বাচ্চাদের জন্য টিকেটের প্রয়োজন হয় না। আর ক্যামেরার জন্য বাড়তি ১০ রুপি দিতে হয়। চিড়িয়াখানায় ঢুকার পরই দেখা যায় অনেকগুলো রাস্তা চিড়িয়াখানার বিভিন্ন দিকে চলে গিয়েছে। একটি সোজা উপরে, একটি ডানদিকে এবং একটি পিছনের দিকে। সোজা রাস্তাটাতেই প্রথমে যান। একটু এগিয়েই যান। দেখতে পাবেন তারের ফিল্ডের ভিতরে রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের। সাদিদরা সবাই ঘুরে ঘুরে সকল সংরক্ষিত প্রাণীগুলোকে দেখতে লাগল।
হঠাৎ একটা টাইগার খাঁচার মধ্যে থেকেই সামান্য আওয়াজ করতে শান্ত প্রায় লাফিয়ে উঠল। তারপাশে তানবীর থাকাতে সমস্ত আক্রমণ গিয়ে পড়ল তার উপর। তানবীর চোখ গরম করে ধমক দোওয়ার জন্য তার দিকে তাকালো। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনোভাব বর্জন করে নিষ্পলক তাকালো। কয়েক মুহূর্ত পর শান্তর বর্তমান পরিস্থিতি খেয়াল হতেই ধুকপুক করা বুক চেপে ধরে ভয়ার্ত চোখে তানবীরের দিকে তাকালো। অপরাধী কন্ঠে তার বাহু ছেড়ে দিয়ে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ সরি। ‘

তানবীর আবারও শান্তকে একপলক দেখে নিয়ে প্রতিউত্তর না দিয়ে সামনে চলে গেল। শান্ত প্রকাশ না করলেও ভিতর ভিতর আহত হলো। তানবীরের এমন দায়সারা এড়িয়ে যাওয়া মনোভাব তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। এটলিস্ট সমস্যা কোন জায়গায় সেটাতো বলবে!

সাদিদ নীলাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে হাঁটছে। নীলা নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ এভাবে ধরে আছেন কেন? সবাই কি ভাবছে? ‘

সাদিদ নীলার কথা শুনে তাকে নিজের সাথে আরেকটু জড়িয়ে নিলো। বুকে চেপে ধরে বলল,

— ‘ কি ভাববে? ভাববে বরটা তার পাখিবউটাকে ভীষণ ভালোবাসে। ‘
— ‘ কচু। ভাববে বরটা একটা নির্লজ্জের কারখানা। ‘

সাদিদ নীলার কথায় শব্দ করে হাসল। তাকে আরও ক্ষেপাতে ফিচেল কন্ঠে বলল,

— ‘ বউ কিউট হলে শুধু নির্লজ্জ নয় আরও বহুত কিছু হওয়া লাগে। ‘

নীলা আস্তে করে সাদিদের বাহুতে কিল বসাল। তাতে সাদিদ আরও জোরে হাসল। উপস্থিত অনেকেই তাদেরকে খেয়াল করছে বিধায় দুষ্টু সাদিদ আপাতত দুষ্টুমি বন্ধ করল।

তারা আরও এগিয়ে যেতে যেতে বিপন্ন প্রায় প্রাণী স্নো লেপার্ড, রেড পান্ডা, শিয়াল, হিমালয়ের স্যালামাণ্ডার, ব্ল্যাক প্যান্থার, তিব্বতীয় নেকড়ে, নীল ভেড়া, হিমালয়ের মোনাল, ধূসর ময়ূর, রক্ত রঙ্গীন পক্ষীসহ আরও অনেক বিপন্ন প্রাণীদের দেখতে পেল। এককথায় অসাধারণ এক অবিজ্ঞতা।
নীলার তাদেরকে দেখে ভালো লাগলেও হঠাৎ মনটা খারাপ হলো। সাদিদ টের পেয়ে বলল,

— ‘ কি হয়েছে? ‘
— ‘ না কিছু না। ‘
— ‘ একদম মিথ্যা কথা বলবে না। তোমার চোখ স্পর্শ অন্য কিছু বলছে তাই চুপচাপ বলে ফেল কি হয়েছে। ‘
— ‘ এদেরকে খাঁচায় বন্দি ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই? এদেরকে এভাবে দেখে আমার খারাপ লাগছে। ‘

সাদিদ নীলার মনোভাব বুঝতে পেরে তাকে বুকে আগলে নিয়ে বলল,

— ‘ পাখি, সবকিছুতো আমাদের হাতে থাকে না। এইটাও সেইরকম। এদের দায়িত্ব সরকারের উপর। আমরা চাইলেও এদের দায়িত্ব নিতে পাড়ব না। কিন্তু হ্যাঁ অবশ্যই আমরা তাদের ভালো থাকার জন্য আর্থিক সহায়তা করতে পারব। এবং আমরা সেটাই করব। ‘
— ‘ সত্যিই? ‘

সাদিদ হেসে নীলার নাক টিপল। তারপর বলল,

— ‘ আমার পাখি সত্যি। ‘

নীলাও হাসল। এবার সেও সাদিদের পিঠে হাত দিয়ে তার সাথে আরও মিশে দাঁড়াল। মাথা উঁচিয়ে নির্নিমেষ দেখতে লাগল সাদিদ নামক এই সুপুরুষটাকে। যে শুধুমাত্র নীলাকেই ভালোবাসতে জানে না বরং সবাইকে ভালোবেসে আগলে রাখাটাই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ভালোবাসে সে। এই ছেলেটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।
সাদিদ নীলার এমন চাহনি দেখে ভ্রুজোড়া নাচিয়ে বলল,

— ‘ কি? ‘
— ‘ না, কিছু না। ‘
— ‘ আমার উত্তর করে পাব? নাকি এখনও সময় হয়নি? ‘

নীলার মনের কথাটা আচমকা সাদিদের কন্ঠে শুনে নীলা হকচকিয়ে গেল। সাদিদ তার অবস্থা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল। কপালের একপাশে আদর দিলো। নীলা সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে লাজুক হেসে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ অপেক্ষা করুন। সবুরের ফল মিষ্টি হয়। ‘
— ‘ এমনিতেই ডায়বেটিসের আশংকায় চিন্তিত বউ। আর মিষ্টি হলে যে নামহীন রোগে আক্রান্ত হবো। ‘

নীলা এবার জোরেই সাদিদের বুকে চিমটি কাটল। মিনমিনিয়ে বলল,

— ‘ অসভ্য পুরুষ। ‘

.

তারা হিমালায়ান মাউন্টেননিয়ারিং ইন্সটিটিউটে পৌঁছাতেই এভারেস্ট বিজয়ী শেরপা তেনজিং নোরগের স্মৃতিস্তম্ভটি দেখতে পেল। কি সাহসী মানব। ১৯৫৩ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছিল এডমন্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগে। তারই স্মৃতিচরণে এবং সাধারণ মানুষকে পর্বতারোহণের ব্যাপারে উৎসাহিত করাই ছিল এর লক্ষ্য। বিশ্বের অন্যতম পর্বতারোহণ কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত এই ইন্সটিটিউটের ভিত্তিস্তর স্থাপিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। বিশ্বের অসংখ্য পর্বতারোহী তাদের দক্ষতা বিকাশের জন্য এখানে আসে। বর্তমানে এখানে বেসিক ক্লাইম্বিং থেকে অ্যাডভান্স লেভেলের ক্লাইম্বিং সহ বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দেওয়া হয়। আর বর্তমানে পর্যটন স্পট হিসেবেও এই ইন্সটিটিউট যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই ইন্সটিটিউটের ভিতরে একটি মিউজিয়ামও রয়েছে। যেখানে পর্বত আহরণের জন্য বিখ্যাত বিভিন্ন জিনিস রাখা হয়েছে।
পর্বতারোহীদের জন্য বা সাধারন ট্রেকারদের জন্য এই মিউজিয়াম খুঁটিয়ে ঘুরে দেখা অবশ্যই উচিত। তাদের কাছে এটা সোনার খনির সামিল। স্যার হিলারি এবং তেনজিং নোরগের ব্যবহৃত পর্বতারোহণের সরঞ্জাম, এবং পর্বতারোহণের জন্য সে যুগে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম, দুষ্প্রাপ্য ছবি, এবং শিক্ষামূলক বেশ কিছু বিষয় জানা যায় এখানে আসলে। কিন্তু এই মিউজিয়ামের ভিতরে ছবি তোলা এলাউড নয়।

সাদিদরা বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামও পরিদর্শন করল। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল নাম না জানা অনেক কিছু। বিভিন্ন পশু পাখির দেখা পাওয়া যায় এই মিউজিয়ামে। ১০০-১৫০ রুপি খরচ করে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে ছবি তোলারও সুযোগ আছে।
নীলারা উৎসাহ নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সবাই যখন মিউজিয়াম দেখতে মসগুল তখন তানবীর এবং অর্ণব সাদিদকে টেনে সাইডে আনল।

— ‘ কি করিস? এমন টানাটানি করছিস কেন? ‘
— ‘ নাইলে আর কি করব? তোর তো দর্শন-ই পাওয়া যাচ্ছে না। ‘

সাদিদ তানবীরের কথায় হাসল। হাসিমুখেই বলল,

— ‘ আচ্ছা বল, কি বলতে চাস। ‘

এবার তানবীর আর অর্ণব একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিচকে হাসি হাসল। তানবীর পকেট থেকে কাগজে মুড়ানো একটা পেকেট নিয়ে সাদিদের হাতে তোলে দিলো। সাদিদ প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তাকাতেই সে বলল,

— ‘ খোলে দেখ। ‘

সাদিদ আর কিছু না বলে পেকেটটা ছিড়তেই ভিতরের জিনিস দেখে দ্রুত তার পকেটে ঢুকাল। দুই বন্ধুর পিঠে ঘুষি বসাতে বসাতে বলল,

— ‘ হারামির দল, এসব কি? ‘
— ‘ আরে শালা মারস ক্যান। এই লাইগা কয় আজকাল কারও ভালা করন নাই। ‘
— ‘ লাথি খাবি। এসবকে ভালো বলে? নীলাঞ্জনা দেখতে কি ভাববে বুঝতে পাড়ছিস। ‘
— ‘ হারামি এবার থাম। হাড়গোড় ভাইঙা ফেলতাছস। তোর নীলাঞ্জনার জন্যই এই উপকার করলাম। এখন ধন্যবাদ না জানিয়ে আমাদেরকেই মারছিস। ‘
— ‘ সাদি থাম। এবার কিন্তু আসলেই ব্যাথা লাগছে। ‘

সাদিদ এবার থামল। এখনও চোখ গরম করে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বন্ধুগুলো আসলেই এক একটা বদমাশের অংশবিশেষ। তানবীর শার্টের কলার ঠিক করতে করতে আবারও সাদিদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। নিচুস্বরে মিনমিন করল,

— ‘ শালা তোর লাইগ্গা চুরি করি আর তুই কস চোর? ‘

সাদিদ আবারও চোখ গরম করে তাকাতেই তানবীর তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে দুষ্টু হেসে বলল,

— ‘ আরে চেতস ক্যান? তুই তো বউ পাইয়া বেসামাল হইয়া গেছস। তাই আমরা দোস্তরা তোর উপকারের লাইগ্গা এই মহৎ কাজটা করলাম। ‘
— ‘ হারামি এটাকে মহৎ কাজ বলে? ‘
— ‘ ঐ মহৎ নয়তো আর কি? যদি কোনো অঘটন ঘটাইয়া ফেলস! তাইলে কি হইবো? তোর তো ইদানিং কোনো কিছুতেই হুঁশ নাই। আমরাও এসব ভুললে চলব? ‘

সাদিদ এবার হেসে ফেলল। তানবীর আর অর্ণবকে হাসতে হাসতেই আরও একদফা উত্তম-মাধ্যম দিলো। সাদিদ মার দিয়ে হাসছে আর তারা বিনিময়ে মার খেয়েও হাসছে। এ যেন বন্ধুতের এক সুন্দরতম দৃশ্য। সাদিদ দুইবন্ধুর কাঁধ জড়িয়ে ধরে হেসে বলল,

— ‘ ইডিয়টের দল আমাকে কি তোদের গর্দভ মনে হয়? আমাদের বিয়েটা যেহেতু এখনও পরিবারের সবাই জানে না, তাহলে তোদের কি মনে হয় আমি এইসব দিকে খেয়াল রাখব না? আমার সব দিকেই খেয়াল আছে। তাই তোদের এমন মহৎ চিন্তার প্রয়োজন নেই। ‘

— ‘ আরে দোস্ত রাইখা দে। তুই যা চিজ একস্ট্রা থাকা দরকার। বলা তো যায় না…

সাদিদ এবার কথা শেষ করবার আগেই দুটুকে দৌড়ানি লাগাল। তারা দম ফাটানো হাসিতে মেতে উঠে দৌড়াচ্ছে। সাদিদের ঠোঁটের কোণায়ও হাসির রেখা। অবশ্য তাতে লজ্জার ছিটেফোঁটাও নেই। সে কি আর নীলা নাকি?

মিউজিয়াম থেকে বাহির হয়ে তারা সেন্ট জোসেফ কলেজটা দেখে আসতে গেল। বহু পুরনো এই কলেজটার নামডাক অনেক। বছর পুরনো এই কলেজটি অনেকেই হয়তো মুভিতে দেখেছেন। শাহরুখ খানের সেই বিখ্যাত মুভি ‘ম্যায় হু না’ এটার কথা কার অজানা? এই কলেজেই সেটির শুটিং হয়েছিল। কিন্তু কলেজের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি নেই। কিন্তু সাদিদ কি না দেখে এমননি ফিরে যাবার লোক? দারোয়ানের সাথে ভাব করে মোটা অঙ্কের রুপি ঘুষ দিয়ে নীলাদের নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। কলেজ প্রাঙ্গন থেকেই চোখে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধকর রূপ। সাদিদরা বহু পুরনো এই কলেজটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। নীলার এনার্জি লেবেল এবার জিরোতে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই সে একসাইডে বসে পড়ল। আচমকা এমন হওয়াতে সাদিদ দ্রুত কাছে আসলো। চিন্তিত হয়ে বলল,

— ‘ এই পাখি, কি হয়েছে? ‘
— ‘ কিছু না। একটু পানি দিন। ‘

নীলা মুখে হাসি নিয়েই বলল। সাদিদ দেরী না করে পানির বোতল খোলে নিজেই তাকে খাইয়ে দিলো। নীলা পানি খেয়ে সাদিদের বুকে হেলে পরে জোরে জোরে শ্বাস টানতে লাগল। সাদিদ তাকে একটু রেস্ট নিতে দিলো। মিনিট দশেক পর নীলা বুকের থেকে মুখ তুলে হাসল। সাদিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই বলল,

— ‘ সরি সকালের নাস্তাটা ভালো করে করিনি। তাই বোধহয় একটু খারাপ লেগেছিল। ‘

সাদিদের চোখে-মুখে এতক্ষণ চিন্তারা বাসা বাধলেও এবার রাগের কুন্ডলী প্রকাশ পেল। সম্ভব হলে নীলাকে তোলে সে এখনই আছাড় মারে। সাদিদ দ্রুত উঠে গিয়ে অর্ণবের ছোট কাঁধ ব্যাগ থেকে কেক নিয়ে আসলো। নীলার উপর রেগে মেগে একশেষ। তারপরও রাগ নিয়ে নিজেই কেক খাইয়ে দিতে লাগল। নীলা বিনাবাক্য নতজানু করে খেতে লাগল। এখন কিছু বলা-ই মানে ফ্রিতে মাইর।
কলেজ দেখা ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছিল। তাই সাদিদ বলেছিল ফিরে যাবে। কিন্তু তাদের এখনও কেবেল কার যাওয়া বাকি। তাই নীলা অনড় থাকল। কেননা সে ভালো-ই জানে সাদিদ এমনটা তার জন্য বলছে। কিন্তু নিজের জন্য সবার আনন্দ মাটি হবে তাই নীলা জেদ ধরেছিল। যাবে মানে যাবেই। যার জন্য শেষ পর্যন্ত সাদিদ রাজি হয়েছে। কিন্তু নীলার সাথে একটা কথাও বলেনি।

তারা রোপওয়ের জন্য গেল সিংহমারি নর্থ পয়েন্টে, যা সেন্ট জোসেফ কলেজের কাছেই।
রোপওয়ে বা কেবেল কার যা কিনা দেশের প্রথম কেবেল কার সার্ভিস। এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। কলেজের উল্টোদিকে একটা খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। ২০-২৫টা ধাপ, উঠে বাঁ দিকে একটু এগোলেই চোখে পড়বে রোপওয়েতে ঢোকবার গেট যার পোশাকি নাম রংগিত ভ্যালি প্যাসেঞ্জার কেবেল কার। পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার।
নীলা এতক্ষণ মেনে নিলেও এবার এসে সাদিদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। ইনিয়েবিনিয়ে বলল,

— ‘ শুনছেন? না মানে…

সাদিদ চোখ গরম করে তাকাতেই সে আবারও চুপসে গেল। এমন করে তাকায় কেন? মনে হয় চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবে!
নীলার প্রচন্ড খারাপ লাগছে। না হয় একটা মিথ্যা কথা বলেই ফেলেছে। সেই জন্য সবার সামনেও এমন করবে? নীলার চোখ ছলছল করে উঠল। কিন্তু সাদিদের আড়ালে চোখ মুছে সামনে এগিয়ে গেল। কিন্তু সাদিদ যে তার প্রাণপাখিকে ছায়ার মতো আগলে রাখতে চায়। তাই তার লোকানো অশ্রুজলও স্বামীর নিকট প্রকাশিত হলো।
নীলা মনমরা হয়ে সবার সাথে হাঁটতে লাগল। সাদিদ থেকে খেয়াল রাখছে কিন্তু শব্দছাড়া। তাদেরকে রোপরয়ের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হলো।
সিজেন টাইমে বেশ বড়ো লাইন হয় টিকিটের। রাউন্ড ট্রিপের ভাড়া বড়দের জন্য ২০০/- এবং ছোটোদের (৩-৮ বছর) ১০০/-
সিজেনের সময় সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত টিকিট কাউন্টার খোলা থাকে। অফ সিজেনে (বর্ষাকালে এবং শীতকালে) ১০টা থেকে ৪টে পর্যন্ত এই পরিসেবা পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতি মাসের ১৯ তারিখ এই পরিসেবা বন্ধ থাকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।
সিংহমারি বেস স্টেশন (৭০০০ ফিট) থেকে কেবেল কার যায় নীচের তুকভার (৬০০০ ফিট) টি এস্টেট স্টেশনে। এই আড়াই কিলোমিটার যাত্রাপথে সময় লাগবে মিনিট ১৫। এখানে নেমে কিছুটা সময় কাটানো যায়, ঘোরা যায় চা বাগানে, চাইলে টি প্রসেসিং দেখার গাইডেড ট্যুর নেওয়া যায়। বেঞ্চে বসেও উপভোগ করা যায় রংগিত ভ্যালির অপার সৌন্দর্য। আর যদি ইচ্ছা করে তবে পাশেই একটি বাড়ির ছাদে ক্যাফেটেরিয়া আছে, সেখানে গিয়ে চা, কফি বা মোমো খেয়ে দেখতে পারবেন।
এই কেবেল কার চড়ার কিন্তু বেশ একটা অন্যরকম মজা আছে, বেস স্টেশন থেকে চলা শুরু করে কেবেল কার আপনাকে নিয়ে হটাৎ করে ঝুলে পড়বে রংগিত ভ্যালির উপর। প্রায় ১০০ ফিট নীচে পাহাড়ের ঢালে চা বাগান, বাঁশের ঝার, জংগলের উপর দিয়ে ঝুলে ঝুলে কিন্তু ধীর গতিতে যেতে থাকবেন তুকভারের দিকে। প্রথম প্রথম একটু ভয় লাগতে পারে তবে দার্জিলিঙয়ে ৩৬০ ° প্যানোর‍্যামিক ভিউ সেই ভয়কে জয় করবেই আর যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে তাহলে তো কথাই নেই, দূরে চোখে পড়বে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফাবৃত্ত শৃঙ্গরাজি। চারপাশের রুদ্ধশ্বাস দৃশ্যতে মন নেচে উঠতে বাধ্য। কিন্তু এত সৌন্দর্যও দুইজন ব্যক্তি অনুভব করতে পাড়ছে না। তাদের মন খারাপে উপস্থিত বাকি সবারও আনন্দে ভাটা পড়েছে। নীলা অনুভূতিহীন দৃষ্টি নিয়ে কেবেল কারের বাহিরে দিয়ে তাকিয়ে আছে। কত এক্সাইটেড ছিল এই রোপওয়ে নিয়ে। অথচ এখন কিছুই ভালো লাগছে না। সাদিদের রাগ থাকলেও আপাতত সেটাকে এক সাইডে রেখে নীলাকে টেনে বুকে আনলো। একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বাহিরে তাকালো। আচমকা সাদিদের স্পর্শে নীলা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। কিন্তু সাদিদের এমন একটা ভাব যেন এই মুহূর্তে বাহিরে তাকানো ছাড়া তার অন্য কোনো কাজ নেই। নীলা নিঃশব্দে হাসল। সাদিদের বুকে মুখ গোঁজল। তারপর আশেপাশে সবার দিকে একবার আড়চোখে তাকালো। একটি কেবেল কারে ছয়জন বসতে পারে। তাই তারা সকলেই এখানে রয়েছে। কিন্তু সবাই অন্যদিকে দৃষ্টি রেখে সৌন্দর্য উপভোগ করছে। নীলা একবার সাদিদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে তার বুকে চুমু দিলো। সাদিদ মাথা নিচু করে তাকালো। হাসি পাচ্ছে তারপরও সে রাগী দৃষ্টি রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আমি কিছু ভুলিনি। মিথ্যা বলার শাস্তি হাড়ে হাড়ে টের পাবে। ‘

নীলার মুখটা চুপসে গেল। মাথা নিচু করে বিড়বিড় করল।

— ‘ খারাপ একটা। ‘

সাদিদ আবারও অন্যদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল।

সাদিদ-নীলার এক হওয়াতে যেন সবার মাঝেও আনন্দের ঢেউ নেমে এসেছে। সবাই এখন সত্যিকার অর্থই রোপওয়ের আসল আনন্দ উপলব্ধি করছে।
বাকি সময়টুকু তারা বেশ আনন্দের সাথে কাটালো। তারপরও ঘুরে ফিরে আজকের মতো হোটেলে ফিরল। রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার রুমে চলে গেল।
সাদিদ রুমে এসেই ওয়াসরুমে গিয়ে ফ্রেস হলো। এখনও চাপা রাগে নীলাকে এড়িয়ে চলছে। মেয়েটা কেন তাকে বুঝে না? নিজের প্রতি অবহেলা কেন করবে সে?
সাদিদ ফ্রেস হয়ে এসে বিনাবাক্য বিছানায় শুয়ে পড়ল। নীলার এবার খারাপের সাথে সাথে রাগও হচ্ছে। সে ধুম করে গিয়ে বাহিরের কাপড় নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল। সাদিদ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নীলার ভাবসাব দেখল। কিছু সময় পার হলো তারপরও তাকে এভাবেই থাকতে দেখে সাদিদ বলল,

— ‘ ড্রেস চেইঞ্জ করে এসে ঘুমাও। ‘

নীলার কোনো আওয়াজ পাওয়া গেল না। সাদিদের রাগ লাগছে। তাই আবারও ধমকের স্বরে বলল,

— ‘ যেতে বলেছি না? ‘

নীলা এবারও কিছু না বলাতে সাদিদ রেগে কাছে আসতেই সে থমকে যায়। নীলার শরীরে হাত দিতেই তার বুকটা কেঁপে উঠে। কেননা তার প্রাণপাখিও নিঃশব্দে কেঁদে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাদিদ আর রাগ ধরে থাকতে পারল না। তাকে টেনে সোজা করে শুইয়ে সমস্ত মুখে আদর দিতে লাগল। নীলার হেঁচকি উঠে গিয়েছে। সাদিদ তার লাল হওয়াতে নাকটাতেও চুমু দিয়ে বলল,

— ‘ প্লিজ আর না। অনেক কেঁদেছ। পুরো মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। ‘
— ‘ আপনি খুব খারাপ, খুব। ‘
— ‘ আচ্ছা আমি খারাপ। এবার চুপ করো। নতুবা কিন্তু আবারও ধমক দিব। ‘

নীলা চোখ ছোট্ট ছোট্ট করে তাকাতেই সাদিদ হাসল। দুই চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বলল,

— ‘ কথা না শুনলে তো ধমক দিব-ই। ‘
— ‘ সবকথা-ই তো শুনি। কোনটা না শুনলাম। ‘
— ‘ তাহলে আজ মিথ্যা বললে কেন? না খেয়ে বলেছ তুমি খেয়ে নিয়েছ। এতবড় মিথ্যা? ‘
— ‘ আমার খিদে ছিল না। ‘
— ‘ দেখ পাখি, ভালোবাসি বলে ভেব না মাইর দিতে পারব না। আর কখনও খাবার নিয়ে মিথ্যা না ফাঁকিবাজ করলে তোলে আছাড় মারব। ‘

নীলা রাগ মিশেলে চোখ ছোট করে তাকালো। সাদিদ মৃদু হেসে নীলার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

— ‘ জ্বি এমনটাই হবে। এইক্ষেত্রে আপনাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। তোমার জন্য হলে মাফ করতাম। কিন্তু আমার প্রাণপাখির ক্ষতি আমি কখনোই হতে দিতে পারি না। তাই নো ছাড়াছাড়ি। ‘

নীলা অবাক হলো। সাথে প্রশ্ন এসে ভির জমালো। তাহলে সে কে? তার তো কোনো দাম-ই দেখা যাচ্ছে না।
সাদিদ নীলার নাকটা টেনে দিয়ে বলল,

— ‘ এবার যাও। নাকি সকালের মতো আমি আসব? ‘

নীলা সাইড থেকে একটা বালিশ নিয়ে সাদিদকে আস্তে করে আঘাত করল। সাদিদ পেট ধরে হাসছে। নীলা লজ্জা পেয়ে ওয়াসরুমে ছুটল। খোলা চুলগুলোকে হাত খোঁপায় পেঁচাতে পেঁচাতে বেড়িয়ে আসলো। সাদিদ অপলক চেয়ে থাকল। নীলা ভেজা চোখ-মুখ টাওয়েল দিয়ে মুছে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল। ঠান্ডা প্রচুর। তাই হাত পায়ে লোশন লাগিয়ে বিছানায় উঠে আসলো। বালিশে মাথা রাখতেই সাদিদ এসে তার উপর ঝুকল। নিষ্পলক কিছু সময় চেয়ে থেকে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলল,

— ‘ এই? ‘
— ‘ হুম? ‘
— ‘ তুমি কি খুব ক্লান্ত? ‘

নীলা উত্তর দেওয়ার জন্য সাদিদের মুখের দিকে তাকালো। তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল-নীল হলো। লাজুল হেসে অপরদিকে মুখ ফিরাল। নীলার অবস্থা দেখে সাদিদও নিঃশব্দে হাসল।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ১৯

খুব সকালে সাদিদ নীলাকে জোর করে ঘুম থেকে টেনে তুলেছে। তাই নীলার আধখোলা চোখে মৃদু রাগের আভাস। সে বারবার ঝিমাচ্ছে। আর সাদিদ তাকে টান দিয়ে তুলছে।

— ‘ এটা কি পাখি? এবার অন্ততপক্ষে উঠ। ‘
— ‘ ইশশ বিরক্ত করছেন কেন? আমি মাত্রই ঘুমিয়েছি। তাই আমি এখন ঘুমাব। আপনি আমাকে অনেক জ্বালিয়েছেন। তাই এখন আমি আপনার কোনো কথা শুনব না। ‘

বলেই নীলা আবারও বিছানায় এলেমেলো হয়ে শুয়ে পড়ল। সাদিদের এবার সত্যিই হাসি পাচ্ছে। নীলা ঘুমের ঘুরে এমনটা বলছে। নতুবা জেগে থাকলে সে কখনও সাদিদের সাথে এমনটা করবে না। সাদিদ বেশ ভালোই বুঝতে পাড়ছে। কিন্তু সেও যে নিরুপায়। সাদিদ ঘড়িতে সময় দেখল। ৩ বেজে ৪০ মিনিট। এখন হোটেল থেকে বেরুতে না পাড়লে আসল সৌন্দর্যটা মিস হয়ে যাবে। যা সাদিদ দার্জিলিং এসে কোনোভাবেই চাইবে না। তাই সে কম্বলের উপর দিয়েই নীলাকে শক্ত করে চেপে ধরল। নীলার দম প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। সে দ্রুত চোখ খোলে তাকাল। নিজের উপর সাদিদকে দেখে রাগীস্বরে বলল,

— ‘ এসবের কোনো মানে হয়? ‘

সাদিদ হাসল। একটু ঝুকে এসে নীলার রাগে লাল হওয়া নাকটাতে চুমু দিয়ে বলল,

— ‘ মানে হয় কি হয় না, সেটা ঘুম থেকে উঠলেই বুঝতে পারবে। ‘
— ‘ আমি ঘুমের জন্য চোখ খোলতে পাড়ছি না। প্লিজ এখন ঘুমাতে দিন। ‘
— ‘ না পাখি। এখন সম্ভব নয়। এসে না হয় আবার ঘুমিয়ে নিও। ‘
— ‘ তারমানে উঠতেই হবে? ‘
— ‘ জ্বি মহারাণী উঠতেই হবে। ‘

নীলা রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে আবারও উঠে বসল। নীলার ঢুলুঢুলু মুখটা দেখে সাদিদ তার দুই গালে হাত রাখল। তারপর কপালে ভালোবাসার দীর্ঘ চুমু আঁকল। নীলা নতজানু হয়ে লাজুক হাসল। সাদিদ তাড়া দিতেই সে উঠে ওয়াসরুমে গেল। নীলাকে যেতে দেখে সাদিদও দরজা খোলে বাহিরে গেল। তানবীরদের রুমে বারকয়েক বার নক করতেই অর্ণব এসে দরজা খোলল। তার পিছু পিছু তানবীরও উঠল।

— ‘ রেডি হয়ে নে। আমরা একটুপরই বের হব। ‘
— ‘ সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুই এত ভোরে উঠতে পাড়লি? আমরা তো ভেবেছিলাম তোদের সাক্ষাৎ পাওয়া মুশকিল হবে। ‘

সাদিদ অর্ণবের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি দেখে তার বাহুতে ঘুষি লাগাল। তারপর আবারও তাড়া দিয়ে হাসতে হাসতেই নিজেদের রুমে চলে আসল। আসার সময় প্রিয়তীদেরও ঢেকে আসার জন্য বলে গেল।
সবাই ইতিমধ্যে রেডি হয়ে নিচে নেমে এসেছে। ঠান্ডার মধ্যে এত ভোরে বাহিরে হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে। তাই সবাই বেশ মোটা কাপড়ের গরম জামা পরে বের হয়েছে।
খুব সকালে বের হতে হবে বিধায় তারা রাতেই ট্রেক্সি ঠিক করে রেখেছিল।
নীলা টেক্সিতে বসে বলে উঠল,

— ‘ এত সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছি আমরা? আরও পড়ে গেলে কি হতো? এতো সকালে কেউ কোথাও যায়? ‘

নীলার কথায় সাদিদ হাসল। তাকে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,

— ‘ টাইগার হিল। খুব সুন্দর একটা জায়গা পাখি। তোমরা দেখলেই বুঝতে পারবে। আর সকালে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, আমরা টাইগার হিলের সানরাইজ দেখব৷ এবং সেটাতো লেইট করে গেলে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া লেইট করলে তোমরা হয়তো দেখতেই পারবে না। কেননা সেখানে গেলেই দেখবে কতশত লোকের উপস্থিতি। লেইট করে গেলে ভালোভাবে দাঁড়ানোর জায়গাই পাবে না। ‘
— ‘ ওহ্ আচ্ছা। ‘

নীলা আর কিছু বলল না। সাদিদের মুখের কথাটাই তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য। সুতরাং এখানে আর কিছু বলার থাকতেও পারে না।
প্রচুর ঠান্ডায় তাদের টেক্সি টাইগার হিলের উদ্দেশ্য ছুটে চলছে। তারা কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল এত ভোরেও অসংখ্য গাড়ি রাস্তায় চলছে। গাড়ির সংখ্যা দেখে সত্যিই অবাক হতে হচ্ছে। নতুবা এমন ভোরে কোনো স্থানে যাবার জন্য টুরিস্টদের এতো ভিড় সত্যিই চোখে পড়ে না। সবাই হয়তো সৌন্দর্যে ভরা টাইগার হিলের উদ্দেশ্য-ই যাচ্ছে। নীলা গাড়ির জানালার গ্লাস দিয়ে রাস্তার অগণিত হলুদবাতিগুলো দেখছে।

দার্জিলিং শহরের সর্ব উচ্চ স্থান হচ্ছে টাইগার হিল। এখানে ভ্রমণে এসে যদি টাইগার হিলের সানরাইজ না দেখেন সেক্ষেত্রে বিশাল কিছু মিস করে যাবেন। সারা পৃথিবী জুড়ে টাইগার হিল বিখ্যাত এর অসাধারণ সানরাইজের জন্য। এছাড়া এখান থেকে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং উচ্চতম শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট দেখা যায়। সমুদ্র তল থেকে প্রায় ৮ হাজার ৪৪২ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এই জায়গাটি দার্জিলিং থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সানরাইজের সময় টারগার হিল থেকে অপূর্ব রঙের খেলা দেখা যায়। পূর্ব দিগন্তে যখন লাল সূর্যের উদয় হয় তখন উত্তর দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া যেন জ্বলে উঠে। রূপালী চূড়া যেন সোনালী রূপ ধারণ করে। আর তার সামনে নিচের দিকে তাকালে দেখতে পারবেন তখনও রাত রয়ে গিয়েছে। দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট ঘরবাড়িতে তখনও ইলেকট্রনিক আলো জ্বলছে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। স্বচোখে না দেখলে উপলব্ধি করা কঠিন।
টাইগার হিলে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠতে হয় ভোর ৪টার দিকে। সম্ভব হলে আরও আগে। কেননা সময়মতো উঠতে না পাড়লে প্রচুর গাড়ির লাইনের পিছনে পড়তে হবে। এবং এরকমও হতে পারে শেষের এক কিলোমিটার পথ আপনাকে হেঁটে উঠতে হবে। তার ফলস্বরূপ ভালো পজিশন পাওয়া যাবে সানরাইজের ভিউ দেখার জন্য। কেননা টাইগার হিল জায়গাটিতে বরাবরই প্রচুর লোকের সমাগম দেখতে পাওয়া যায়। তাই যত তাড়াতাড়ি হোটেল থেকে বেরুতে পারবেন তত তাড়াতাড়ি এখানে পৌঁছাতে পারবেন। এবং খুব সুন্দর ভিউ দেখতে পারবেন। দার্জিলিয়ের এত ঠান্ডায় এত সকালে ঘুম থেকে উঠা একটু কষ্টসাধ্য। কিন্তু একটু কষ্টের জন্য এমন একটা অবিজ্ঞতা মিস করা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই সাদিদও একটু কষ্টের জন্য নীলাদের এই সুযোগটা মিস করতে দিতে চাইল না।

অবশেষে তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য তারা পৌঁছে গিয়েছে। নীলা আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে সাদিদের দিকে তাকালো। সে নীলার দিকেই তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। আসলে সাদিদ সত্যিই বলেছিল। এখানে এত ভোর বেলাতেও লোকসমাগমের অভাব নেই। প্রচুর টুরিস্ট ইতিমধ্যে এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে। সাদিদরাও তাড়াতাড়ি আসাতে সানরাইজ দেখার জন্য ভালো একটা জায়গা পেল। নীলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে সাদিদ পূর্ব আকাশে দৃষ্টি দিলো। প্রিয়তী-অর্ণব, তানবীর-শান্ত সকলেই দলবেঁধে বাকিদের মতো সূর্যাদয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই পূর্ব আকাশে লাল সূর্যের দেখা মিলতে লাগল। আর উপস্থিত সবাই আনন্দ-উচ্ছাস করতে শুরু করল। কেউ কেউ আবার এই সুন্দর মুহূর্তটাকে ক্যামেরা বন্দি করতেও বাদ পড়ল না। নীলা সূর্যাদয়ের এমন সুন্দর দৃশ্য চোখের সামনে দেখে আবেগে আপ্লূত হয়ে সাদিদের বুকে হেলে পড়ল। চক্ষু তার খুশিতে ম্লান হলো। সাদিদ সবটাই বুৃঝতে সক্ষম। তাই সে মৃদু হেসে নীলাকে আরও শক্ত করে নিজের বাহুবন্ধনে বন্দি করল। নীলা মুগ্ধতার বহিঃপ্রকাশ করতে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ অসাধারণ! ‘
— ‘ এখনও ঘুম থেকে জোর করে তোলার জন্য রাগ করে থাকবে? ‘

নীলা সাদিদের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,

— ‘ কখনও না। এমন সৌন্দর্য দেখার জন্য এমন শতঘুমকে ভেঙে উঠতেও আমি দ্বিধা করব না। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পাড়ছি না। নিজেকে বাকরুদ্ধ মনে হচ্ছে। ‘

সাদিদ আবারও হাসল। সত্যিই নীলাকে সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে হবে না। কেননা কিছু জিনিস ভাষায় প্রকাশ করে বুঝানো দায়। সেটা উপলব্ধি করে নিতে হয়।
সাদিদ নীলার সাথে সাথে অর্ণব-প্রিয়তী এবং তানবীর-শান্তও সমানতালে টাইগার হিলের এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছে।
শান্ত আবেগে আপ্লূত হয়ে পাশে থাকা তানবীরের হাত চেপে ধরল। তানবীর সাথে সাথে শান্তর ধরে রাখা হাতের দিকে তাকালো। শান্তর অবশ্য সেদিকে বিশেষ কোনো খেয়াল নেই। সে টাইগার হিলের অবর্ণনীয় সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। তানবীরও আবার সামনের দিকে তাকালো। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল মিষ্টি হাসি।

সানরাইজের পর ধীরে ধীরে টাইগার হিলের লোকসমাগমও কমতে লাগল। সাদিদরা টেক্সির কাছে চলে আসলো। নীলার মুখে এখনও উপচে পড়া খুশি।

— ‘ এবার যাত্রা কোথায়? ‘
— ‘ আমরা এখন যাব রক গার্ডেন। কাকু আপ রক গার্ডেন চালিয়ে। ‘

টেক্সি ডাইভার সাদিদের অনুমতি পেয়ে রক গার্ডেনের উদ্দেশ্য গাড়ি ছুটালো।
রক গার্ডেন নামটাই নীলার কাছে বেশ অন্যরকম লাগছে। না জানি দেখতে কেমন হবে। নীলার ভাবুকতা দেখে সাদিদ তার গালে টুকা দিলো। নীলা তার দিকে ফিরে হেসে ফেলল।

— ‘ মহারাণী, কি চিন্তা করেন? ‘
— ‘ চিন্তা করছি দার্জিলিং শহরটা এত সুন্দর কেন? আমিতো বারবার বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। ‘

সাদিদ এবার নীলার কাছে এগিয়ে আসলো। সামনের সকলের দিকে একপলক তাকিয়ে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ সৌন্দর্য তো বাকরুদ্ধ হবার জন্যই। কিন্তু আমার পাখিটার সৌন্দর্য যে আমার চোখে আরও বেশি আরও প্রকট। আমিও তো প্রতিবার বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। আমার কি হবে? ‘

নীলা মাথা নিচু করে লাজুক হাসল। সাদিদ সবসময়-ই এমন করে। নীলাকে লজ্জা দিতে সে কখনও পিছুপা হয় না।
টেক্সি যত চলতে লাগল রাস্তার আশেপাশের সৌন্দর্য দেখে তারা ততই মুগ্ধ হতে লাগল। বলা বুঝানো কঠিন। কিন্তু রক গার্ডেনে যাওয়ার পথের এই রাস্তাটুকুর সৌন্দর্যে বলে শেষ করা যাবে না।
রক গার্ডেন যতটা সুন্দর ঠিক তার থেকেও বেশি সুন্দর এই দশ কিলোমিটার পথ। চারপাশে চা বাগানের সৌন্দর্য চোখ ধাঁধিয়ে দিতে বাধ্য। এই পঁচিশ মিনিটের রাস্তাটি খুব সক্রিন্ন এবং খাঁড়া। কিন্তু এই রাস্তা থেকে দার্জিলিয়ের পাহাড় শ্রেণীর ভিউ অসাধারণ। যারা ফটোপ্রেমিক তারা নিঃসন্দেহে কয়েকদফা গাড়ি থেকে নেমে এর সৌন্দর্য ক্যাপচার করতে চাইবেন। কেননা রাস্তাটা আসলেই মনোমুগ্ধকর।
সাদিদ টেক্সি ডাইভারকে বলে গাড়ি থামাল। তারা সবাই গাড়ি থেকে নেমে এই অপরুপ সৌন্দর্য অবলোকন করল। প্রিয়তী তো ফটোপ্রেমী। তাই অর্ণবকে দিয়ে নিজের অগণিত ছবি তুলল। বেচারার চেহারা দেখার মতো ছিল। সাদিদরাও তুলল। নীলাকে সাথে নিয়ে সে এই জায়গাটারও সৌন্দর্য ক্যাপচার করল। শান্ত- তানবীরও ছবি তুলল। তানবীরের মনটা বড্ড নিশপিশ করছে শান্তর সাথে এই মনোরম সৌন্দর্যে ভরা জায়গাটার স্মৃতি জমিয়ে রাখতে। কিন্তু কিছু একটা জড়তার জন্য মুখ ফুটে বলে উঠতে পাড়ছে না। তাই সে এবার খানিকটা বুদ্ধি খাটাল,

— ‘ দোস্ত চল, সবাই কিছু গ্রুপ ফটো তুলি। ‘
— ‘ হুম মন্দ হয় না। ‘

সবাই একসাথে কতগুলো ছবি তুলল। আর তানবীরও এবার সুযোগে শান্তর পাশে দাঁড়িয়ে কতগুলো স্মৃতি জমিয়ে নিলো।
তারা আবারও টেক্সিতে চড়ে বসল। কিছুসময় পরই আঁকাবাঁকা পাহাড়ের রাস্তা পার হয়ে তারা চলে আসলো কাঙ্ক্ষিত রক গার্ডেন। অপূর্ব এক দৃশ্যপট।
পাহাড়ের বিশাল বিশাল পাথরকে স্তরে স্তরে কেটে এই রক গার্ডেন তৈরি করা হয়েছে। এই কারণে এটিকে রক গার্ডেন বলা হয়। এখানে অনেকগুলো ঝর্ণা দেখতে পাবেন। যেগুলো কিছু প্রাকৃতিক এবং কিছু কৃত্রিমভাবে বানানো হয়েছে। এটি দার্জিলিং শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অনেকটা নিচু এলাকায় অবস্থিত। এখানে অপূর্ব একটা ঝর্ণা রয়েছে যেটা অনেক উঁচু থেকে নেমে এসেছে। নিচে থেকে বুঝা যায় না উপরের কোন জায়গা থেকে ঝর্ণার সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য এটি দেখার জন্য সিঁড়ি বেয়ে অনেকটাই উপরে উঠতে হয়। উপরে উঠাটা কষ্ট সাধ্য হলেও এর পুরস্কার পেয়ে নিরাশ হবেন না। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সেখানে যথেষ্ট জায়গা এবং ফুলের বাগান রয়েছে। চাইলে উপর থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারবেন। এই গার্ডেন বা পার্কটি সকাল ১০ থেকে বিকাল ৪টা অব্দি খোলা থাকে।

নীলারা ঘুরে ঘুরে রক গার্ডেন পুরোটা দেখতে লাগল। রক গার্ডেনের আশেপাশে কোনো খাবার রেস্তোরাঁ নেই। তারা যথেষ্ট ভোরে রউনা দিয়েছিল। তাই সাদিদ সবার জন্য শুকনো খাবার হিসেবে কেক, বিস্কুট, চিপস, জুস নিয়ে এসেছিল। তারা সবাই গার্ডেনের-ই বেঞ্চে বসে হালকা নাস্তা করে নিলো। তারপরও পুরোটা গার্ডেন দেখা শেষে পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়ল।

তারা এবার চলল দার্জিলিং বিখ্যাত ট্রয় ট্রেনে রাইড করার জন্য।
তাই সাদিদরা আসলো দার্জিলিং হিমালায়ান রেলওয়ে। ১৮৭৯-১৮৮১ সালের মধ্যে এই রেললাইনটি তৈরি করা হয়েছিল। ভারতের নিঊ জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং এর পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তা ও বাঁকের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করা ছোট্ট বাষ্প ইঞ্জিন চালিত ট্রেন দার্জিলিংয়ে পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ভারতের সবচেয়ে উঁচু রেল সার্ভিস হলো এই দার্জিলিং হিমালায়ান রেলওয়ে। এই টয় ট্রেন জার্নিটি দার্জিলিয়ে আসা টুরিস্টের জন্য এক অবর্ণনীয় অবিজ্ঞতা হয়ে থেকে যায়। “দার্জিলিং টয় ট্রেন” হিসেবেও পরিচিত এই ট্রেন জার্নি দার্জিলিং এর এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। ছোট ছোট কোচকে এই বাষ্পচালিত ইঞ্জিন টেনে নিয়ে খাঁড়া পাহাড়ে উঠছে।
আপনি আর কোথায় দেখতে পারবেন এমন নজরকাড়া সৌন্দর্য? অনেকেই কোলকাতাও বলিউডের বিভিন্ন মুভিতে এই ট্রেনের চারপাশের চমৎকার দৃশ্য দেখেছেন।
তাই কোনোভাবেই এই স্পট ঘুরে দেখা এবং ট্রয় ট্রেনে উঠার অবিজ্ঞতা মিস করা উচিত নয়।
দার্জিলিং-ঘুম-দার্জিলিং এই জয় রাইডের ভাড়া পড়বে ১০০০ টাকা ডিজেল ইঞ্জিনের জন্য।
এবং বাষ্পচালিত বা স্টিম ইঞ্জিনের জন্য ভাড়া পড়বে ১৬০০ টাকা। এগুলো সবই ফাস্ট ক্লাস কোচ। পাঁচ বছরের কম শিশুদের জন্য টিকিটের প্রয়োজন হয় না।
সাদিদ আগেই টিকেট কেটে রেখেছিল। তাই তারা সকলে ট্রয় ট্রেনে উঠে বসল। নীলা ট্রেনে বসেই খুশিতে বলে উঠল,

— ‘ আমি এই ট্রেনের দৃশ্য শাহরুখ খানের একটা মুভিতে দেখেছি। হ্যাঁ মনে পড়েছে দিল ছে। একটা গান ছিল না? ছাইয়া ছাইয়া। এই গানটাতে। ‘

নীলার উৎসাহ এবং খুশি দেখে সাদিদসহ সবাই হাসল। নীলা তীক্ষ্ণ চোখে সবাইকে দেখছে। সে এখানে হাসির মতো কি বলেছে!

— ‘ হ্যাঁ দোস্ত আমিও দেখেছি। বোধহয় এই ট্রেনে চড়ে অনেক মুভি করা হয়েছে। অনেকগুলো মুভির দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে কিন্তু নাম একটারও মনে পড়ছে না। ‘

শান্তর কথায় সবাই আরেকদফা হেসে নিলো। তানবীর সুযোগটা মিস করতে চাইল না। তাই সে বেশ রসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ এইসব-ই হচ্ছে জ্ঞানের খেলা। মাথায় বুদ্ধি-সুদ্ধি না থাকলে এসব জিনিস মনে রাখা যায় না। ‘
— ‘ নিজে মনে হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর? ‘
— ‘ সেটা না হয়। কিন্তু জ্ঞানী। ‘
— ‘ খালি কলসি বাজে বেশি। ‘
— ‘ কলসিতে যথেষ্ট পানি রয়েছে। চোখের অভাবে দেখতে পাচ্ছ না। ‘
— ‘ আপনি কি আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি কানা বলছেন? ‘
— ‘ সেটাতো তুমি বললে। আমি কখন এই শব্দ উচ্চারণ করলাম? ‘

তানবীরের কথা শুনে সবাই ঠোঁট টিপে হাসছে। শান্ত সবার দিকে অসন্তোষ দৃষ্টি তাকিয়ে পুনরায় তানবীরের দিকে তাকালো। সে নিশ্চয়ই এখন কিছু একটা বলে ফেলত। কিন্তু তানবীরের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে নিজেকে সংবরন করল। আজ কতদিন পর তানবীর তার সাথে ঝগড়া করছে। বিষয়টাতে রাগ করার কথা থাকলেও শান্তর রাগ হচ্ছে না৷ বরং খুব ভালো লাগছে। সে মনে মনে ঠিক করে নিলো তানবীরের ঝগড়ুটে রূপটাই তার প্রিয়। কিছু মানুষকে চুপচাপ মানায় না। তানবীরও ঠিক সেইরকম।
শান্ত হাসিমুখে ট্রেনের বাহিরে মনোযোগ দিলো। খুব সুন্দর দৃশ্য। মনে হচ্ছে কোনো বাস্তব ছবি চলছে। সে হাসিমুখেই জিজ্ঞাস করল,

— ‘ জিজু এই ট্রেন কোথায় যাবে? ‘
— ‘ আমরা মূলত ট্রয় ট্রেন রাইড করতে আসছি। সাথে দার্জিলিয়ের আরও দুইটা টুরিস্ট স্পট রয়েছে ঘুম এবং বাতাসিয়া লুপ। বাতাসিয়া লোপে এমনিতেও আসা যায়। কিন্তু আমরা ট্রয় ট্রেনে করে এই জায়গাগুলোও দেখতে পারব। কেননা যাত্রাপথে টয়-ট্রেন বাতাসিয়া লুপে দশ মিনিট বিরতি দেয়। আর ঘুম স্টেশনে দাঁড়ায় প্রায় আধঘন্টা। তাই আমরা আলাদাভাবে বাতাসিয়া লুপ আসিনি। কেননা বিরতির সময়টুকুতেই আমরা বাতাসিয়া লুপ আর ঘুম ষ্টেশন ঘুরতে পারব। ‘
— ‘ বাহ্ তাহলে গ্রেট হবে। ‘
— ‘ হুম সেটাই তো হওয়ার কথা। ‘

সাদিদের কথা শুনে যেন শান্ত-নীলার উৎসাহ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা খুব গভীর দৃষ্টি নিয়ে
ট্রয় ট্রেনের চলমান বাহিরের দৃশ্যপটগুলো অবলোকন করছে।
ট্রয় ট্রেন কোথাও কোথাও এতটা ধীরে চলে যে, দেখা যায় পাশের ঘরবাড়ির বা স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা ট্রেনে লাফিয়ে উঠতে পাড়ছে এবং নেমেও যাচ্ছে। কিন্তু এখনকার ডিজেল ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে ইঞ্জিন বেশি শক্তিশালী এবং ট্রেনের গতিও তুলনামূলকভাবে বেশি। যদিও এখনকার বেশিরভাগ ট্রয় ট্রেন ডিজেল ইঞ্জিনে চলে। তারপরও জয় রাইড হিসেবে এখনও বাষ্পচালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। সাদিদরা সবাই ট্রয় ট্রেনের এই মনোরম জার্নি উপভোগ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। ট্রয় ট্রেন রাইডের সময় ছবির মতো কত পাহাড়, লোকালয় গ্রাম পিছনে ফেলে ছুটে চলে। আর সেসব গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চা এমনকি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষও আপনার দিকে হাত নাড়াতে থাকে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। তাই এই জার্নির স্বাদ নিতে হলে ট্রয় ট্রেন মিস করা উচিত নয়।

ট্রেন ধীরে গতিতে চলে আসে বাতাসিয়া লুপে। ট্রেন থামতেই সাদিদরা সবাই নিচে নেমে পড়ল। আজকে সকালের নাস্তাটা খুব ভারী হয়নি। তাই সবার-ই মোটামোটি ঘুরে এখন ক্লান্ত লাগছে। তারা দার্জিলিং বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড মোমো দেখতে পেল। তাই সবাই মোমো খাওয়া শুরু করল। সেদিন পেট ভরা থাকায় তেমন একটা খাওয়া হয়নি। তাই আজকে সবাই সেই হিসাবটা ভালোভাবেই পুষিয়ে
নিলো। নীলাতো হিসেবের থেকেও বেশি খেল এই সবজি মাংস দিয়ে বানানো পিঠা পুলি। বলাবাহুল্য সাদিদের খুশি কোন পর্যায়ে।
খেয়ে পেট ভরে তারা বাতাসিয়া লুপটা ঘুরে দেখতে লাগল।
বাতাসিয়া লুপ দার্জিলিং হিমালয়ান হেরিটেজ রেলওয়ের সমতল থেকে ৭৪০৭ ফুট ওপরে, দার্জিলিং শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরত্বে ভারতীয় রেলের সর্বোচ্চ রেল স্টেশন।
বাতাসিয়া লুপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এর অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা দেখার জন্য একটি চমত্‍কার দৃশ্য। হিল কার্ট রোডে (এনএইচ ৫৫) অবস্থিত। আপনি এর সকল গৌরবের মধ্যে দার্জিলিয়ের প্যানোরামিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
বাতাসিয়া লুপের উপর থেকে সমস্ত দার্জিলিং শহরটাকে দেখা যায়। একেবারে ৩৬০ডিগ্রি এঙ্গেলে। অসাধারণ সেই দৃশ্য বাতাসিয়া লুপটি মাউন্টেনের দর্শকদের দর্শনের জন্য আকর্ষণ করে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং অন্যান্য তুষারপাত হিমালয় পর্বতগুলি এবং দার্জিলিং হিমালয়ান রেলপথের অসাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং আশ্চর্য দেখায়। যেখানে প্রায় অজ্ঞাতসারে রেললাইনটি একটি বৃত্তের সাথে আলোচনা করে এবং উচ্চতায় 1000 ফুট নিচে নামায়।
বাতাসিয়া লুপের কেন্দ্রে একটি ওয়ার মেমোরিয়াল দাঁড়িয়ে আছে। এই স্মৃতিসৌধটি জেলা সৈনিক বোর্ড, দার্জিলিং কর্তৃক সাহসী গোর্খা সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত হয়েছিল। যারা স্বাধীনতার পর থেকে জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিল।

সাদিদ নীলার হাতে হাত রেখে সামনে হাঁটছে। অর্ণব প্রিয়তীকে নিজের সাথে আগলে ফুসুরফাসুর করে কথা বলছে এবং বাতাসিয়া লুপের সৌন্দর্য অবলোকন করছে। তাদের এতো প্রেমের মধ্যে দুইজন ব্যক্তি শুকনো মরুভূমির ন্যায় হাহুতাশ করছে। শান্তর এসবে বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট না থাকলেও ভালোবাসাময় কাপলযুগলের এত মধুর সময় কাটানো দেখে তার এখন বিন্দু বিন্দু আফসোস হচ্ছে। ইশশশ আফসোস।
তানবীরও হাঁটতে হাঁটতে শান্তর পাশে এসে দাঁড়ালো। শান্ত আড়চোখে একবার তাকিয়ে আবারও সামনে তাকালো। তার চোখ-মুখের ভাব দেখে তানবীর-ই প্রথমে বলে উঠল,

— ‘ কি চিন্তা করো? ‘
— ‘ তেমন কিছু না৷ ‘
— ‘ তেমন কিছু না হলে কেমন কিছু? ‘

শান্ত মাথা নিচু করে হাসল। তারপর তানবীরের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ‘ বলতে পারি যদি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেন। ‘
— ‘ বাহ্বা একটার উত্তর দিয়ে আরেকটা জানতে হবে? ‘
— ‘ জ্বি এমনটাই। ‘
— ‘ আচ্ছা তাহলে বলো দেখি। কি জানতে চাও। ‘
— ‘ আপনি কি এতদিন কোনো কারণে আমার উপর রেগে ছিলেন? ‘

তানবীর হাঁটা থামিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। মুহূর্তেই তার মুখটা গম্ভীর হলো। তারপরও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,

— ‘ কই নাতো। তুমি এমনিতেই এমনটা চিন্তা করছ। ‘
— ‘ সত্যি বলছেন? আমার কিন্তু এমনটা মনে হচ্ছে না। ‘
— ‘ তুমি কিন্তু রুলস ব্রেক করছ। তোমার কথা ছিল আমি একটা উত্তর দিলে তুমিও দিবে। এখন আরেকটা প্রশ্ন করলে দুইটা হয়ে যাবে। ‘

শান্ত হেসে ফেলল তার কথায়। সে হাসি মুখেই বলল,

— ‘ আচ্ছা তাহলে বলছি। আপনি কিন্তু হাসবেন না। ‘
— ‘ ওকে কোনো হাসাহাসি হবে না। ‘
— ‘ আসলে ওদের এতো প্রেম-ভালোবাসা দেখে না আমারও একটা প্রেমের জন্য মারাত্মক আফসোস হচ্ছে। নিজেকে কেমন কাঠখোট্টা মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি যে ক্রাশ-ই খেতে পারি না। তাহলে ক্রাশের পরবর্তী লেবেল প্রেম করব কিভাবে? ‘

তানবীর কিছুটা চমকিত দৃষ্টিতে শান্তর দিকে তাকালো। শান্ত তাকে হাসতে মানা করলেও সে এবার পেট ধরে হাসতে লাগল। শান্ত চোখ বাঁকিয়ে তার দিকে তাকালো। যার অর্থ হাসাটা তার একদমই উচিত হয়নি। বরং কিছুটা কান্না করলে শান্তর বোধহয় খুশি লাগত।

— ‘ আপনি কিন্তু বলেছিলেন হাসবেন না। ‘
— ‘ সরি। কিন্তু কি করব? তোমার কথাটাই এমন যে আমি না হেসে পারলাম না। ‘

শান্ত রাগ দেখিয়ে সামনে হাঁটা ধরতেই তানবীর দ্রুত পা ফেলে তার হাতের কব্জিতে ধরল। শান্ত আচমকা তানবীরের এভাবে হাত ধরাতে অবাক দৃষ্টিতে তার হাতের দিকে তাকালো।
তানবীর সেটা খেয়াল করে শান্তর হাতটা ছেড়ে দিলো। কিন্তু শান্তর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ প্রেম করতেও বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। তোমার তো খালি মাথা। তাই এসব তোমার ভাগ্য নেই। ‘

বলেই তানবীর আবারও হাসতে লাগল। শান্ত এবার রাগে-দুঃখ-অপমানে তানবীরের পিছনে ছুটল। তানবীরও দুষ্টুমি করে দৌড় শুরু করল। মারতে পারুক বা বাঁচতে পারুক। কিন্তু দুইজনই জানে তারা একে অপরের সান্নিধ্যে পছন্দ করে। ঝগড়া লাগলেও দিনশেষে দুইজনই নিজের অজান্তেই একে অপরের পথ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু দু’জনই সেটা মানতে একেবারে নারাজ।

তারা ট্রয় ট্রেনে করে ঘুম স্টেশনটাও দেখল। ঘুম হচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং হিমালয়ান পার্বত্য অঞ্চলের একটি ছোট্ট পার্বত্য অঞ্চল। এটি দার্জিলিং পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের আওতায় আসে। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের ঘুম রেল স্টেশন ভারতের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন। এটি ২,২৫৮ মিটার (৭,৪০৭ ফুট) এর উচ্চতায় অবস্থিত। যাত্রা বিরতিতে তারা ঘুম রেলওয়ে স্টোপেজটা দেখে নিলো। তারপর আবারও ট্রয় ট্রেনে চড়ে সৌন্দর্যে ভরা এই মনোরম দৃশ্যপটকে বিদায় জানাতে হলো।

__________________

সাদিদরা বিকেলটা মলে কাটিয়ে হোটেলে ফিরে আসলো। নীলা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠাতে হোটেলে ফিরেই সে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। সাদিদ তার কান্ড দেখে হাসল। সে জানে এখন তালে বলেও কোনো লাভ হবে না। তাই সে ডিরেক্ট গিয়ে নীলাকে হেঁচকা টানে বসিয়ে কোলে তুলে নিলো। আচমকা এমন হামলায় নীলা হকচকিয়ে চোখ খোলল। চমকিত কন্ঠেই বলল,

— ‘ কি করছেন? ‘
— ‘ বউকে কোলে নিলাম। ‘
— ‘ সেটাই। কোলে নিয়ে কি করছেন? ‘

সাদিদ নীলার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তাকে নিয়ে সোজা ওয়াসরুমে ঢুকল। নীলার এতক্ষণে বোধগম্য হলো সাদিদ কি করতে চাইছে। তাই সে দ্রুত বলে উঠল,

— ‘ একটু পর ফ্রেস হবো তো। এখন একটু রেস্ট নিতে দেন। ‘
— ‘ সারাদিন বাহিরে ছিলে। শরীরে অনেক ময়লা। এখন ফ্রেস হয়ে একেবারে রেস্ট করো। তখন আমি বাধা দিব না। ‘

নীলা বুঝে গিয়েছে এই ব্যক্তিকে বলে কোনো লাভ হবে না। সে নিজের কথায় অনড়। তাই একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে জ্যাকেটে হাত দিলো। কিন্তু সাদিদকে এখনও বাহিরে যেতে না দেখে তার ভ্রুজোড়া কুঁচকে এলো। সে ভ্রু বাঁকা করে বলল,

— ‘ কি হলো দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? ‘

সাদিদ তার কথার উত্তর না দিয়ে বাঁকা হাসল। সাদিদের ঠোঁটের কোণায় এই হাসি দেখে নীলা একটা ঢুক গিলল। তাকে এমন করে হাসতে দেখলেই নীলার কলিজা কেঁপে উঠে। নিঃসন্দেহে তার মাথায় কোনো শয়তানী খেলা করছে।
ঠিক যেমনটা ভাবা। সাদিদ ওয়াসরুমের দরজাটা লাগিয়ে দিলো। তারপর নিজের গায়ের জ্যাকেট, ট্রি-শার্টটা খোলে ফেলল। ধীরে পায়ে নীলার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। নীলা গায়ের টপস চেপে ধরে পিছিয়ে যেতে লাগল। সে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আপনি এমন এগিয়ে আসছেন কেন? ‘
— ‘ আমিও তো বাহিরে ছিলাম৷ আমার গায়েও ময়লা আছে। তাই শাওয়ার নিব। ‘
— ‘ ওহ্ তাহলে আপনি আগে শাওয়ার নেন। আমি চলে যাচ্ছি। ‘

নীলা কথা শেষ করেই বাহিরে যাওয়া ধরতেই সাদিদ তার হাত টেনে ধরল। দুইহাতে নীলার কোমড় চেপে ধরে বলল,

— ‘ আগে-পরে দরকার কি? দুইজনে একসাথে করলেই তো হয়৷ ‘
— ‘ একসাথে? ‘

নীলা প্রায় চিল্লিয়ে বলে উঠল। নীলাকে এমন চেঁচাতে দেখে সাদিদ তাকে ওয়াসরুমের দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। তার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ কেন? একসাথে করলে সমস্যা কোথায়? আমরা বোধহয় আগে কখনও একসাথে করিনি? ‘

বলেই সাদিদ ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসতে লাগল। নীলার লজ্জায় গাল পুরো টমেটো হয়ে গিয়েছে। সাদিদ সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। তারপর আচমকা শাওয়ার ছেড়ে দিলো। সাদিদের শরীরে জিন্স ব্যতিত অন্য কিছু নেই। শাওয়ারের পানি তার চুল বেয়ে বেয়ে সমস্ত শরীরে পড়ছে। নীলাও ইতিমধ্যে ভিজে গিয়েছে। হালকা ঠান্ডায় সে মৃদু কাঁপছে। সাদিদ হাত বাড়িয়ে তার টপসটা খোলতে চাইলে নীলা দুর্বল হাতে তাকে বাধা দিলো৷ সাদিদও আর জোর করল না। কেননা সে ভালোই জানে নীলা এখনও পর্যন্ত সাদিদের সংস্পর্শে কতটা লজ্জা পায়। কিরকম কাচুমাচু করে। নীলা এবারও লজ্জায় এবং ঠান্ডায় মাথা নিচু করে রয়েছে। সাদিদ তার কানের পিছনে হাত দিয়ে তার মুখটা উঁচু করে ধরল। নীলার চোখ, ঠোঁট কাঁপছে। পানিতে ভিজে তার মুখে আরও স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে। মুখের বিন্দু বিন্দু জল কণাগুলোকে দেখে সাদিদের বড্ড হিংসে হচ্ছে। হিংসুটে প্রেমিক তাদেরকে শাস্তি দিতে লেগে গেল।
সে নীলার ডান গালে ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দিলো। একে একে বাম গালসহ, কপাল, নাক, নীলার পুরো মুখে চুমু খেল। নীলা সাদিদের স্পর্শে বারবার কেঁপে উঠতে লাগল। সাদিদ তার বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নীলার ঠোঁটে স্পর্শ করতেই নীলা কেঁপে উঠে সাদিদের উন্মুক্ত বুকে হাত রাখল। সাদিদ নীলার অবস্থা বুঝতে পেরে তার বুকে রাখা হাতটা নিজের হাতে নিলো। তারপর নীলার দিকে তাকিয়ে তার হাতের পিঠে শব্দ করে চুমু খেল। নীলা লাজুক হেসে সাদিদের উন্মুক্ত বুকে মুখ গোঁজল। আবারও একটা হাত সাদিদের বুকে রাখতেই নীলা লজ্জায় লাল হলো। সে ভাবতেই পুলকিত হচ্ছে যে এই সুদর্শন পুরুষটা তার ব্যক্তিগত। নীলার অধিকার এই মানুষটার উপরে সবচেয়ে বেশি। তার স্বামী সাদিদ নামক এই পুরুষটা। নীলা মাথা উঁচু করে সাদিদের দিকে তাকালো। শাওয়ারের পানিতে সে চোখ খোলে রাখতে পাড়ছে না। পিটপিট করে চোখ খোলে রেখে সে আবেগময় কন্ঠে বলল,

— ‘ কখনও ছেড়ে যাবেন না তো? ‘

সাদিদ আচমকা নীলার এমন কথায় খানিকটা ভরকে গেলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো। মৃদু হেসে নীলার গালে হাত রেখে কপালে দীর্ঘ চুমু খেল। তারপর নীলার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

— ‘ তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এই হাতটা ধরার জন্য আমি কতগুলো দিন অপেক্ষার প্রহর গুনেছি। আর আজ যখন এই হাতের মালিক আমার একান্ত ব্যক্তিগত প্রাণপাখি। আমার রাজ্যের রাণী। আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। তুমিই বলো সেই হাতটা আমি কিভাবে ছাড়ব? সম্ভব নয় পাখি। আমার পক্ষে সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি কেবল তোমার সান্নিধ্যে চাই। তুমি ব্যতিত না অন্য কাউকে আমার প্রয়োজন নেই আর আমি চাইও না। আমি কেবল তোমাকেই চাই পাখি৷ শুধু তোমাকেই। আমার সব ভালোবাসা কেবল তোমার জন্যই বরাদ্দ। অন্য কেউ এর ভাগ পেতে পারে না। আমি সেটা কখনও হতে দিব না। ‘

নিজের স্বামীর মুখে নিজের জন্য এতটা গভীর ভালোবাসা দেখে নীলার চক্ষু খুশিতে ম্লান হলো। সে সাদিদের পিঠ শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। সেও যে চায়। নিজের সবটুকু দিয়ে নীলা শুধু সাদিদকেই চায়। আজ, আগামী এবং জীবনের বাকি সবকটা দিন।
সাদিদ অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়াতে এবার নীলাকে ছেড়ে টাওয়েল হাতে নিলো। নীলার চুলগুলো মুছিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘ লজ্জাবতী লাজুকলতা, এবার ড্রেসটা চেইঞ্জ করে জলদি বাহির হন। ‘

নীলাকে বলে সাদিদ টাওয়েল জড়িয়ে ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। নীলা আবারও লাজুক হাসল। শুকনো জামা পরে নীলা বের হতেই সাদিদকে দেখতে পেল। সাদিদ ইতিমধ্যে ড্রেস চেইঞ্জ করে পাতলা একটা সাদা ট্রি-শার্ট আর টাওজার পরে নিয়েছে। সে বিছানায় বসে ফোন টিপছে। নীলাকে বের হতে দেখেই মিষ্টি করে হাসল। দরজায় নক পরতেই নীলা দ্রুত ওড়না গায়ে দিয়ে ঠিকঠাক হলো। সাদিদ এগিয়ে গিয়ে দরজা খোলে হোটেল বয়কে দেখতে পেল। সে তাদের জন্য কফি অর্ডার দিয়েছিল। সাদিদ কফি নিয়ে বিছানায় বসল। নীলাকে কাছে আসতে বললে সে দ্রুত কাছে এসে বসল।
সাদিদ তাকে টেনে নিয়ে নিজের বুকে হেলান দিয়ে বসাল। তারপর তার হাতে কফি মগ তুলে দিলো। তারপর নিজে একটা মগ নিয়ে তাতে চুমুক দিলো। এই সময়ে কফিটা বড্ড প্রয়োজন ছিল। নীলার কফি শেষ হতেই সাদিদ তাকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। নীলাকে বুকে নিয়ে চোখ বন্ধ করতেই সে আচমকা বলে উঠল,

— ‘ আমরা তো কাল চলে যাব। তাই না? ‘

সাদিদের মনটা আচমকাই খারাপ হয়ে গেল। দার্জিলিং শহরের থেকে এবার সাদিদের কাছে নীলার অনুপস্থিতিটাই বেশি কষ্টদায়ক লাগবে। সাদিদ দুইহাতে নীলাকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,

— ‘ আই উইল মিস ইউ পাখি। ‘

সাদিদের কন্ঠে কতটা আকুলতা মিশ্রিত ছিল নীলার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না। সে সাদিদের বুকে নাক ঘষে বলল,

— ‘ আমিও। খুব বেশি মনে পড়বে আপনার সাথে কাটানো এই সময়গুলো। ‘
— ‘ পাখি, আমার লাইফের মধুময় মুহূর্ত ছিল দার্জিলিয়ের এই সামান্য সময়টুকু। তোমাকে এতটা কাছে পাওয়া। জীবনের মধুময় ভালোবাসার মুহূর্ত দার্জিলিং আমাকে উপহার দিয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ এই দার্জিলিয়ের কাছে। ‘

নীলা হাসল। সত্যিই দার্জিলিং তাদের নতুন করে ভালোবাসা শিখিয়েছে। দিয়েছে জীবনের অতিব মধুময় মুহূর্তের কিছু স্মৃতি। তারা কৃতজ্ঞ এই দার্জিলিং শহরের কাছে।

#চলবে…