অন্তরালের অনুরাগ পর্ব-৩২+৩৩

0
861

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩২

শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকায় ফিরবার জন্য তারা বাস জার্নিকেই বেছে নিয়েছে। এবারের সবকিছুই সবার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। আর নতুন তো সবকিছুকেই আরও মধুর করে তোলে। তাহলে সেখানে নতুন সম্পর্কের শুভলগ্নে হোক না সবকিছু নতুনভাবে। ক্ষতি কি তাতে?
সবার সুবিধার জন্য একটা বড় দুটো এসি বাস রিজার্ভ করা হয়েছে। দুইপরিবারের সবাই একএক করে বাসের সিটে গিয়ে বসতে লাগল। প্রিয়তী অর্ণবও পিছনের সারির একটা সিটে বসেছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন বিবাহিত দম্পতির প্রাইভেসির জন্য একটু আলাদা জায়গা চায়। তাই আগেভাগেই নিজেদের সুবিধামতো তারা বসে পড়ল। নীলা সাদিদও প্রিয়তী অর্ণবদের সাথে একি বাসে উঠল। তারাও বাসের একেবারে শেষ সিটের একটিতে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করেছে। গুটিকয়েক সদস্য তাদেরকে আড়চোখে দেখলেও পরমুহূর্তেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হলো। কেননা দুইজনের আংটিবদলের কথাটা ইতিমধ্যে সবার কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছে।
শান্তও সবার পিছু পিছু হেলতে দুলতে এগিয়ে আসলো। নীলাদের সামনের সিটটিতে সে খুব আয়েশ করে দখল করল। গতরাতের সবকিছুকে ভুলে প্রিয়বন্ধুর সাথে লম্বা জার্নিটা এনজয় করতে রিয়াদও হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই বাধঁল বিপত্তি। আসার দিনকার মতো এবার আর তানবীর নিজেকে গুটিয়ে রাখল না। বরং পিছন থেকে হুড়মুড়িয়ে এসে মৃদু ধাক্কায় রিয়াদকে পাশের সিটে ফেলে দিয়ে সে শান্তর পাশের সিটটি দখল করল। আচমকা তার এমন আক্রমণে রিয়াদসহ সবাই মোটামোটি ভরকে যায়। কিন্তু তানবীর একেবারে স্বাভাবিক। যেন একটু আগে কিছুই হয়নি৷ রিয়াদ নিজেকে ধাতস্থ করে খানিকটা রাগ দেখিয়ে বলল,

— ‘ এসব কি অভদ্রতা? এমন করে ধাক্কা দেবার কি মানে? ‘
— ‘ ধাক্কা কবে দিলাম৷ আমি আসছিলাম তোমার সাথে কাঁধ লাগল। আর নিজেকে সামলাতে না পেরে তুমি পড়ে গিয়েছ। এখানে আমার কি করার আছে? ‘
— ‘ একদম মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি আমাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছেন। ‘
— ‘ ওহ্ তাই বুঝি? এমনটা তোমার মনে হচ্ছে? আমিতো এমনটা ভাবছি না। তুমি এমনটা মনে করলে আমার সেখানে কিছুই করার নেই৷ ‘

শেষ৷ তার বাক্যটুকু সমাপ্ত করে সে আবারও সিটে গা এলিয়ে দিলো৷ শান্তশিষ্ট পরিবেশটাকে মুহূর্তেই গুমোট করে দিয়ে সে আয়েশ করে আড়মোড়া ভাঙল। শান্ত পাশ থেকে ভয়াতুর চোখে শুকনো ঢুক গিলছে৷ তার একটাই ভয় আবার যেন কোনো ঝামেলা না হয়। বড়দের নজর এখনও তাদের উপর পরেনি। তাই সবকিছু যেন স্বাভাবিকভাবে শেষ হয় সে শুধু মনে প্রাণে এই কামনাই করে যাচ্ছে।
তানবীর পূর্বেকার ন্যায় ভীষণ শান্তভাবে চোখ বন্ধ করতেই এবার পাশ থেকে রিয়াদ আবারও ক্ষেপা স্বরে বলে উঠল,

— ‘ আমি ওর পাশে বসব। আপনি দয়া করে আরেকটা সিটে গিয়ে বসুন। ‘

তানবীর সাথে সাথেই চোখ খোলল। নির্বাক। কিন্তু চোখগুলো রক্তলাল। এতক্ষণের সব শিষ্টতার পাঠ চুকিয়ে সে এবার নিজস্ব ক্যারেকটারে ফিরে আসলো।

— ‘ শুনিনি কি বললি? আবার বল? ‘

রিয়াদ কিছুটা হকচকিয়ে গেল। তারপরও পূনরায় বাক্যটা রিপিট করতেই তানবীর রাগিস্বরে ধমকে উঠল,

— ‘ তোর কথাতেই নাকি? আমি উঠব না এই সিট থেকে। তোর যা খুশি কর গিয়া। ‘

রিয়াদ বুঝতে পারল এই ঘাড়ত্যাড়া লোকের সাথে কথা বললেই ঝামেলা বাঁধাবে। আর সে এখন ভালো মুডটা তার সাথে ঝগড়ায় খারাপ করতে চায় না৷ তাই শান্তকেই বলল,

— ‘ এই তুই উঠ। এখানে বসতে হবে না৷ আমরা পিছনে গিয়ে বসব। ‘

শান্তর গলায় এবার কাটা বেঁধে যাবার অবস্থা। এই ছেলের কি মাথা খারাপ? কার সামনে কি বলছে?
তাকে উঠতে না দেখে রিয়াদ আবারও বলল,

— ‘ এই, উঠছিস না কেন? জলদি উঠ। ‘

তানবীর রিয়াদকে কিছু না বলে শান্তর দিকে তাকালো। মুখে উপচে পরা হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ‘ যাবে? যাও৷ ‘

শান্ত ঢুক গিলল। সে নিশ্চিত এটা ঝড়ের পূর্বাবাস। সে শুধু ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না জানাল। তানবীরের ঠোঁটের কোণের হাসি বিস্তৃত হলেও পাশের জনের তীক্ষ্ণ স্বরে সেটা মিলিয়ে গেল।

— ‘ মানে কি? এই লোকের সাথে তুই কেন বসবি? আমার রাগ তুলবি না শান্ত৷ উঠে আয়৷ ‘

বাক্যটুকু সমাপ্ত করেই সে এবার কিছুটা এগিয়ে এসে তানবীরের উপর দিয়েই শান্তর হাতটা চেপে ধরল। বিষয়টা দ্রুতটায় ঘটেছে বিধায় শান্ত – তানবীর সেটা আঁচ করতে পারেনি৷ কিন্তু এই মুহূর্তে রিয়াদের দ্বিতীয় বাক্য শুরু করার পূর্বেই সে সজোরে আবারও এক ধাক্কা খেল। রাগী তানবীর বেশ জোরেই ধাক্কাটা দিয়েছে। তাই সিটের হাতলে লেগে রিয়াদ মোটামোটি ব্যাথা পেয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে সেটা সহ্য করে সোজা হতেই তানবীর ফোঁসে উঠে তেড়ে যেতে নিলো। শান্ত আর চুপ থাকতে পারল না। খামচে ধরল তানবীরের হাতের কব্জি।

— ‘ প্লিজ না৷ বড়রা সবাই এখানে রয়েছে। প্লিজ আবারও ঝামেলা করবেন না৷ আমি রিয়াদকে বলে দিচ্ছি।
এই শুন, আমি এখনেই উনার পাশে বসব। তুই প্লিজ আরেকটা সিটে বসে যা। ‘

তানবীর তীক্ষ্ণ চোখে শান্তর ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকল। কপালের রাগে দপদপ করা রগটা যেন ক্ষণে ক্ষণে মিলিয়ে যেতে লাগল। একসময় সম্পূর্ণ মিলিয়ে যেতেই সে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসল। অতঃপর বিনাবাক্য খুবই ভদ্র ছেলের ন্যায় সিটে বসল। রিয়াদের দিকে একপলক তাকিয়ে শান্তর ডানহাতটা নিজের মুঠিতে নিলো। এতটা জোরে না বললেও হতো। কিন্তু সে যেহেতু শুনানোর উদ্দেশ্যই রয়েছে তাই শুনিয়েই বলল,

— ‘ আমার মাথা ব্যাথা করছে। কিছুক্ষণ বিরক্ত করবে না। আর অন্যজনও যেন না করে। নতুবা তোলে আছাড় দিতে দ্বিতীয়বার ভাবব না কিন্তু। ‘

শান্ত গলায় রাগী ওয়ার্নে পরিবেশ শান্ত হলো। রিয়াদ এখন চোখ প্রায় কোটর থেকে বের করে তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। তানবীরের শান্তর প্রতি এতো অধিকারবোধ দেখে এতটুকুতো সে ইতিমধ্যে বুঝেই নিয়েছে। আর সেখানেই তার যত রাগ। সে এতদিন কোন দুনিয়ায় ছিল? তার পিছন পিছন আর কি হলো? এতটা নির্বোধতো সে ছিল না। তাহলে!

______________

বাস ছেড়েছে অনেকক্ষণ। কয়েকদিনের ব্যবধানে আজ সম্পর্কগুলো নিজেদের পূর্ব পরিচিত নাম পাল্টিয়ে নতুন নামে সেজেছে। প্রেয়সী হয়েছে প্রিয়তমা। প্রেমিক হয়েছে প্রিয়তম। ইশশ বর্তমান নামগুলো এতটা মিষ্টি কেন? পবিত্র বন্ধন বলে? হয়তো হবে।
রিয়াদ এখনও পাশের সিটে বসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে। কিন্তু সেই রাগের অবিশিষ্ট ফলাফল হিসেবে কোনো ধ্বংসলীলা লিখা নেই। সে তার মিষ্টি রাগ নিয়ে খেঁকিয়ে আবারও বলল,

— ‘ হারামিরদল, তোদেরকে আবারও একদফা থাপড়ানো দরকার। তোদের মতো শাঁকচুন্নির জন্য আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলেটা কি মাইরটাই না খেল। শক্ত হাতের মাইর। ‘

নীলা পিছন সিট থেকে একটু জোরেই হাসল। সাদিদ চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সে ঠোঁটে আঙ্গুল চাপল। শান্তর দৃষ্টি এলোমলো। সে বারবার শুকনো ঢুক গিলে এপাশ ওপাশ দেখছে। রিয়াদ তাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও তেতে উঠল,

— ‘ তুই আমার সাথে জীবনেও কথা কইবি না। তোরে আমার বিয়েতেও দাওয়াত দিমু না৷ বন্ধুর বিয়ে না খাওয়ার শোকে শোকে তুই কাতর হইয়া মইরা যাবি৷ আর আমি তোর খাটিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণখোলে হাসব। বেয়াদব মহিলা। ‘

— ‘ অবিবাহিত মেয়েদেরকে মহিলা ডাকতে নেই। ‘

শান্তর বিড়বিড়িয়ে কথাটুকু রিয়াদের কানে পৌঁছাতেই সে আবারও একদফা ঝাড়ল। শুধু ঝাঁটা তুলতে বাকি ছিল। তানবীর পাশের সিটে বসে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। তার বন্ধ চোখেও দুষ্টু হাসির রেখা। শান্ত অনেকক্ষণ যাবত তীক্ষ্ণ চোখে তাকে পরখ করছে। অবশেষে রাগ চেপে না রাখতে পেরে বলল,

— ‘ আমাকে ঝামেলায় ফেলে রেখে আপনি নিশ্চিতে বসে রয়েছেন? ‘

তানবীর চোখ খোলল। নিষ্পলক কিছু মুহূর্ত পার করে দিয়ে বিস্ফোরণজনক বাক্য উচ্চারণ করল।

— ‘ তাহলে কি করব? কোলে নিব? আসো নেই৷ ‘

বলেই ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে নিজের হাতদুটো তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। শান্ত রেগে গিয়ে ধুম করে তার হাতে চড় বসাল। শুকনো হাতের থাপ্পড় খেয়ে তানবীর মেকি রাগ দেখাল,

— ‘ তোমার সাহস তো কম নয়। নিজের থেকে এত বড় মানুষের গায়ে হাত তুলো। থাপ্পড় মেরে একেবারে গাল লাল করে ফেলব। ‘

শান্ত কিছুক্ষণ নির্বাক চাহনিতে তানবীরের মুখশ্রীতে স্থির দৃষ্টি নিবন্ধ করল। অতঃপর চোখদুটো হালকা জ্বলে উঠতেই দ্রুত নজর সরিয়ে নিলো৷ কেটে গেল ক্ষীণ অভিমান মিশ্রিত প্রহর। তানবীর এখনও ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। আর এতক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে স্মৃতির পাতায় জমা করেছে প্রেয়সীর অভিমান এবং হালকা রাগের আভাসে ফুটে উঠা পূর্ণ মুখশ্রী। কিন্তু সময়টা হিসাবের বাহিরে চলে যাচ্ছে বিধায় তানবীর নিজেকে মনে মনে ধমকে উঠল। আপনমনে বার কয়েকটা বিশ্রি গালি দিয়ে পাশের সিটের দিকে এগিয়ে আসলো। নিজের খুব কাছে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে শান্ত জানালার পাশে আরও চেপে বসল। তানবীর আবারও নিঃশব্দে হাসল। হাতের উপর হাত রাখতেই শান্ত সেটা ঝটকা মেরে দূরে সরাল। সে আবারও কার্য পূর্ণরায় করল। অভিমানী শান্তও নিজের জায়গায় বহাল থাকল। তানবীর মনে মনে বিড়বিড় করল,

— ‘ একটু বেশি হয়ে গেল না-কি? ‘

শান্ত শুনেও সেটা না শুনার বান করে নাকটা আরও ফুলিয়ে নিলো। তা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। তানবীর এবার চারপাশটা একবার পরখ করে নিয়ে একেবারে শান্তর শরীর ঘেঁষে বসল। শান্তর রাগ-অভিমানের পর্ব ভুলে শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। শিহরিত হয়ে কেঁপে উঠা শান্তর শরীরের প্রবহমান কম্পন তানবীরও টের পেল। ফলে দুষ্টু মস্তিষ্কে আরও দুষ্টুমি খেলে বসল। সে নিজের বলিষ্ঠ হাতটা শান্তর জামার উপর দিয়েই চিকন কোমড়ের একপাশে রাখল। শান্তর কম্পন আরও বাড়ল। চোখ খোলে রাখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। থেকে থেকে সেগুলো কেঁপে উঠে বন্ধ হতে চায়ছে। আর শান্ত নিজের জোরের বলে সেগুলো আঁটকে রেখেছে। তানবীর কিছু মুহূর্ত পর দুষ্টুর লেবেল আরেকটু বাড়িয়ে শান্তর কোমড়ে আস্তে করে নিজের হাতটা বুলালো। কোমড়ের একপাশ থেকে হাতটা ক্রমশ সামনের দিকে নিয়ে আসতে গেলেই শান্ত নিজের কাঁপা হাতটা দিয়ে তানবীরের হাতটা নিজের পেটে চেপে ধরল। চোখগুলো এতক্ষণে নিজেদের যুদ্ধে বিজয় লাভ করে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সে একেবারে নিচুস্বরে কাঁপা কন্ঠে বলল,

— ‘ শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি বোধহয় মরে যাব। ‘
— ‘ এতদিন জীবিত থাকার সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা কারও ভালো লাগেনি। আমার জীবন অতিষ্ঠ করে এখন নিজের প্রাণ নিয়ে সংশয়বোধ করা হচ্ছে? সেটাতো হতে দেওয়া যায় না। আমি তাকে মেরেই ফেলব। একেবারে মেরে ফেলব এই অশান্ত নামের মেয়েটাকে। ‘

তানবীরের ঘোর লাগা কন্ঠে এতক্ষণ হুঁশ না থাকলেও রাগটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সে হাতের কনুই দিয়ে তানবীরের পেটে খোঁচা মারল। নরম জায়গায় লাঠির ন্যায় আঘাত লাগায় মৃদু ব্যাথায় তানবীরের চোখ খানিকটা কুঁচকে এলো। রাগ মিশ্রিত ধমকের স্বরে বলল,

— ‘ এই মাইয়া সমস্যা কি? খোঁচা মারছ কেনো? বাস থেকে এক ধাক্কা দিয়া ফালাই দিমু। ‘
— ‘ আমি কি তাকিয়ে তাকিয়ে আপনার মুখ দর্শন করব না। আমিও ধাক্কা দিব। ধাক্কা দিতে না পাড়লে লাথি দিব। ‘
— ‘ কি? এত বড় দুঃসাহস? তোলে আছাড় মারব। ‘
— ‘ এহ্ আসছে আমার বীরওয়ালা? ‘
— ‘ বীর নয়তো কি? কোনদিক দিয়ে আমাকে বীরের চেয়ে কম মনে হয়? ‘

শান্ত বিরক্তিমাখা চোখে একবার তানবীরকে তীক্ষ্ণ চোখে উপর নিচ পরখ করল। তার চেহারায় তানবীরের বীরত্ব নিয়ে বেজায় সন্দেহ। তানবীর টিপটিপ চোখে শান্তর সন্দেহভরা দৃষ্টি অবলোকন করল। সময়ের দীর্ঘতা বাড়তেই আবারও খেঁকিয়ে উঠল,

— ‘ এই মেয়ে, এই। এমন ড্যাবড্যাব চোখে কি দেখস? মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলবি। আ’ম তানবীর হাসান। কি শুনলি? তানবীর। অর্থাৎ বীর। ‘
— ‘ কচুর বীর। ‘

শান্তর ব্যাঙ্গাত্বক স্বর তানবীরের কর্ণকোহরে পৌঁছে গেল। এবং সে রাগে তেতে উঠে মারার জন্য হুড়মুড়িয়ে আসলো।

— ‘ তবে রে অশান্ত মাইয়া। দাঁড়া আজ তোরে খাইছি। ‘

তানবীর শান্তকে চেপে ধরে অনবরত সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বাসে যে আরও অর্ধশতাধিক লোক রয়েছে সেদিকে তাদের দৃষ্টি নেই৷ খুনসুটিময় মিষ্টি ভালোবাসায় তারা এখন সুখের ভেলায় বহমান।
নীলা সাদিদ তাদের পিছনের সিটেই বসেছে। এতক্ষণ তাদের মিষ্টি ঝগড়াঝাঁটিগুলো তারাও শুনে গিয়েছে। দুইজনের চোখেই প্রশান্তিময় তৃপ্তি। নীলাকে হাসতে দেখে সাদিদ নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। নীলা হাসিমুখেই তার চোখে চোখ পরতেই ভ্রুজোড়া বাঁকা নাচালো। সাদিদ মৃদু হেসে খানিকটা এগিয়ে আসলো। নীলা তাতে কিছুটা ভরকে গেল। কেননা এই ব্যক্তিকে মোটেও ভরসা-বিশ্বাস করা যায় না৷ নির্লজ্জের একশেষ। আর বাসেও দুইপরিবারের অনেকজন বিদ্যামান। এই মুহূর্তে লজ্জাজনক কিছু ঘটিয়ে বসলে মানসম্মান কিছু আর থাকবে না। তাই সে বড় বড় চোখ করে জানালার সাথে মিশে একেবারে চেপে বসল। নীলাকে এমন করে পিছিয়ে যেতে দেখে সাদিদের কপাল কুঁচকে এলো। পরমুহূর্তেই তার হাবভাব বুঝে উঠতে পেরে কুঞ্চিত ভ্রুযুগল আরও খানিকটা কুঁচকে নিলো। অতঃপর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে আচমকা তার দিকে ঝুঁকে পড়ল। নীলা হকচকিয়ে যেতেই সাদিদ রসিকতা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

— ‘ সবসময় বুঝি এই ধান্দায় থাকো? নটি গার্ল। বাসেও রোমান্স চাও? ‘

বলেই সে ঠোঁট এলিয়ে হাসল। আর ভ্রু বাঁকিয়ে নাচাতে লাগল। নীলা হতবিহ্বল। পুরোপুরি বাকরুদ্ধ! কি বলে এই লোক? সে কখন এমনটা চেয়েছে?
নীলার অবস্থা বুঝে সাদিদ তার কানে মৃদু স্বরে ফিসফিসিয়ে আবারও বলল,

— ‘ এতো আদর করেও মন ভরেনি? কিন্তু এখন যদি বাসে আদর করি, তাহলে সবাই কি মনে করবে? ‘

বাক্যটা সমাপ্ত হতেই কপট রাগে নীলা তাকে মৃদু ধাক্কা দিলো। অভিযোগের স্বরে বলল,

— ‘ সবসময় আজেবাজে কথা। অসভ্য-নির্লজ্জ লোক কোথাকার। ‘

সাদিদ আবারও নীলার অগোচরে নিঃশব্দে হাসল। বরাবরের মতোই দিনদুনিরার সবকিছুকে পরোয়া না করে নীলাকে কাছে টেনে আনলো। নীলা এই ছেলের এমন সব উদ্ভট কান্ডে দিশেহারা। এমন অবুঝ মানুষ হয়? তাও আবার এই বয়সে?
সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেই সাদিদ বাঁধা দিলো৷ ঠোঁটের হাসি মুছে খানিকটা রাগি স্বরে আওড়াল,

— ‘ আরেকবার নড়াচড়া করলে মার দিব। চুপচাপ বসো। ‘

গম্ভীর কিন্তু শান্ত স্বরের শীতল কথায় নীলা নড়াচড়া বন্ধ করল। সাদিদের রাগকে সে বরাবরই বড্ড ভয় পায়। যদিও জানে তাকে সে কখনও আঘাত করবে না। কিন্তু অনেকে বলে না, কথায় না হলে কাজে কি হবে? নীলার ক্ষেত্রেও একিইরকম। সাদিদের কার্য সম্পাদন করতে হয় না। মুখ নিঃসৃত বাক্যই নীলাকে পুরোপুরি দমিয়ে দিতে যথেষ্ট।
নীলাকে এমন মুষড়ে যেতে দেখে সাদিদের বড্ড মায়া লাগল। তার ছোট্ট একটা ধমকেই কেমন বাচ্চাদের মতো চুপসে গিয়েছে। সাদিদ খুব মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে প্রিয়তমার মুখশ্রীতে হাত রাখল। আলতো করে গালে হাত বুলিয়ে মোহনীয় স্বরে বলল,

— ‘ বউপাখি? ‘

নীলা তাকালো না। অভিমান জমেছে। এই ব্যক্তিটা তাকে সবসময় ধমকের উপর রাখে। কথা বলবে না সে। সাদিদ গালে আরেকটু গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতেই নীলা কেঁপে উঠল। সাদিদ হাত না সরিয়েই মাথা খানিকটা নিচু করে নীলার প্রায় সমানে সমানে মুখ রেখে বলে উঠল,

— ‘ তুমি জানো না? আমার কলিজা এটা। ‘

বাক্যটুকু সমাপ্ত করে সাদিদ থামল। গাল বুলিয়ে কানের পিছনে হাত রেখে নীলার মুখটা উঁচু করল। ইতিমধ্যে জলে চিকচিক করা আখিঁদ্বয়ের মুক্ত কণাগুলো বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্য সযত্নে মুছে নিয়ে আবারও বলল,

— ‘ আমার কলিজাটাকে কি কখনও আমি মারতে পারি? বলেছি বিধায় এতো কান্না? ‘
— ‘ সব..সময় এমন করে..ন৷ ‘

নীলার কান্না মিশ্রিত নিচুগলার অভিযোগটা শুনে সাদিদ তার গাল টেনে ধরল। ইশশ শক্ত হাতে গাল ব্যাথা করে দিয়েছে। নীলা চকচক করা চোখে গাল ঘষতে ব্যস্ত। আর নিজেকে সাদিদ থেকে দূরে সরাতে। কিন্তু সে কি এতো ভালো মানুষ? নীলা চাইলেই কি সে হতে দিবে?
তাই নীলার চাওয়াকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে একপাশ থেকে নিজের বুকের হৃদযন্ত্রের উপরে তার মাথাটা চেপে ধরল। নিঃসন্দেহে, নিঃসংকোচে, সবার দৃষ্টির আড়ালে প্রিয়তমার ললাটে ভালোবাসার স্পর্শ আঁকলো। পিঠ বাড়িয়ে ধরে রাখা হাতটা আরেকটু শক্ত করে চোখ বন্ধ করল। অপরহাতটি দিয়ে আলতো হাতে বারকয়েক চুলে হাত বুলিয়ে বলল,

— ‘ ভালোও তো বাসি। সেটা বুঝ না? শুধু শাসনগুলো গুনতে থাকবে? ভালোবাসার পরিমাণটা গুণতে চেষ্টা করা কি উচিত নয়? ‘

নীলা চোখ তুলে তাকালো। সে অভিমান করেছে৷ কিন্তু সাদিদ কি কোনোভাবে তার কথায় কষ্ট পেয়েছে? তার চিন্তা ধারার মধ্যেই সাদিদ আবারও বলে উঠল,

— ‘ থাক বাদ দাও। গুণতে চেষ্টা করার দরকার নেই৷ সেটা তোমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। আর তাছাড়া বউপাখিটাকে এতকষ্টের কাজ দিয়ে খাটাতে চাই না। এমনি আমার বউটা বড্ড নাজুক। ‘

বলেই দুষ্টুমি করে আবারও গালে টান দিলো। নীলা এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে স্বামীর কথা শুনলেও এবার কটমট চাহনি নিয়ে তাকালো। সাদিদ রাগের চেষ্টায়রত অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে আবারও হাসল। অবশেষে রাগটুকু নীলা সত্যিই দেখাতে পারল না। ঠোঁট বিস্তৃত করে মিষ্টি হাসলো। মাথা নিচু করে সাদিদের বুকের বামপাশে হাত রাখল। বুকে ঠোঁট চেপে সাদিদের অগোচরে ছোট্ট একটা ভালোবাসা দিতে চাইল। নীলা মনে প্রাণে সেই বিশ্বাসে থাকলেও অপরজনের কাছে হেরে গেল। সাদিদ যে তার পাখির নিঃশ্বাসটুকুর সাথেও পরিচিত। সেখানে জামার উপর হোক বা উন্মুক্ত, প্রিয়তমার কোমল উষ্ঠযুগল কি তাকে ছুঁয়ে যাবে আর সে সেটা বুঝতে অক্ষম থাকবে? এমনটাও কি হওয়ার কথা? এটাও কি সম্ভব?
সাদিদ নিঃশব্দে হাসল। নিজেকে নীলার ন্যায় গোপন করে নয়। বরং খুব নিবিড়ভাবে তাকে বুক পাঁজরের সাথে চেপে ধরে মাথায় চুমু খেল। দীর্ঘ ভালোবাসাময় এক উষ্ণ চুম্বন।

#চলবে…

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩৩ ☁☔☁

বাতাশে শীত শীত অনুভূতি। দূর আকাশে মেঘেদের ঘর্ষনে বিদ্যুৎ খেলা করছে। খনিকবাদেই বোধহয় পৃথিবীর বুকে আঁচড়ে পড়বে অসময়ের, অপ্রত্যশিত বর্ষন। কিন্তু ছেলেটি এখনও ঠাঁই দাঁড়িয়ে। তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে রাখা মেয়েটির কোমল হাত। অপরদিকে অভিমানিনী মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে। নিজের অক্ষিযুগল পাগল ছেলেটার থেকে লুকিয়ে। তানবীর এবার নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসল। ধরে রাখা হাতটা মৃদু টান দিলো। কিন্তু শান্ত ফিরে তাকালো না। তাই এবার খানিকটা জোরে টান দিয়ে তাকে বুকের উপর এনে ফেলল। অভিমান-রাগের সংমিশ্রণে শান্ত ধপাধপ তানবীরের বুকে কিল বসাল। কিন্তু সে রাগ ভুলে বরং হাসছে। একসময় ছোট্ট হাতদুটো নিজের একহাতে বন্ধ করে তার গালে বলিষ্ঠ হাতটা স্থাপন করে প্রেয়সীর অভিমানভরা মুখশ্রী উপরে তুলল। চারজোড়া চোখ মিলিত হলো৷ কিন্তু শান্ত দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে অপরদিকে তাকালো। তাকাবে না সে। সবসময় বেশি বেশি।

— ‘ কি করেছি আমি? একটা থাপ্পড়ে এত অভিমান কেন? তোর এতো ফালতু রাগ-অভিমান ভাঙানোর সময় আমার নাই৷ আমার মেলা কাম। ‘

এতবড় মিথ্যাবাদী! শুধু নাকি একটা। দুইদিন আগেও থাপ্পড় মেরে গাল লাল বানিয়ে ছেড়েছে। আজকেও বিনা কারণে বাসে তাকে দুই দুইটা থাপ্পড় মেরেছে। তারপরও গলার কি জোর! তাই এই মুহূর্তে দুটো মিষ্টি কথার পরিবর্তে এমন বিশ্রি কথাগুলো কর্ণকোহরে পৌঁছাতেই অভিমান ভুলে শান্ত এবার তেতে উঠল। ধাক্কা মেরে তানবীরকে নিজ থেকে দূরে সরাল। ডানহাতের বৃদ্ধঙ্গুল উঁচিয়ে তাকে শাসাল,

— ‘ খবরদার। আর যেন আপনাকে আমার ধারে কাছেও না দেখি। অসহ্যকর। ‘

শান্তর কথা শুনে তানবীর আবারও ঠোঁট এলিয়ে হাসল। বাক্যটুকুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজেদের দূরত্ব কমিয়ে আনল। স্পর্শ না করে তার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে নিচুস্বরের কুটিল বাক্য ছেড়ে দিলো,

— ‘ ক্যান? কাছে দেখলে কি করবি? নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবি না? ‘

বলেই তাকে দুষ্টু হেঁসে চোখ টিপ মারল। শান্ত এবার পায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তার পায়ে জুতো পিষল। হিলজুতোর আঘাত কেডসে্র উপর দিয়েও হালকা একটু লেগেছে। তানবীর শান্তর গাল চেপে ধরল। ককর্শ কন্ঠে বলল,

— ‘ বেশি সাহস বাড়ছে? কিছু কইতাসি না দেইখা মাথায় উঠবার লাগছস? তুইলা একেবারে আছাড় মারমু। ‘

শান্ত দ্রুত অশ্রুসিক্ত চোখগুলো নিচে নামালো। মেঝেতে নিবন্ধ করে এই হৃদয়হীন ছেলেটার কাছে বড় সাজতে চাইল। কি লাভ এমন মানুষের সামনে নিজের অশ্রুজল বিসর্জন দেওয়ার? মাথা নিচু করে শান্ত তানবীরের হাত গাল থেকে ছুটাতে চায়ছে। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। কান্না করতে চায়ছে না। তারপরও গলা দিয়ে যেন কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে চাইল। শান্ত সেটাকে পুরোপুরি অপ্রকাশিত করার চেষ্টা করে বলল,

— ‘ ছাড়ুন বলছি বেয়াদব ছেলে। আর কত ব্যাথা দিবেন! ছাড়ুন। ‘

তানবীর ছাড়ল না। বরং হাতটা আবারও শক্ত করতেই শান্ত ব্যাথাভরা চাহনি নিয়ে তানবীরের চোখের দিকে তাকালো। ইতিমধ্যে বৃষ্টির শুভ্র কণাগুলো এসে এই কাপলযুগলকে পুরোপুরি ভিজিয়ে তুলতে লাগল। প্রেয়সীর কপাল, মুখ, ঠোঁট বেয়ে বর্ষনের সাজ ফুটে উঠেছে। তারমধ্যেও অশ্রুসিক্ত আখিঁদ্বয় তানবীরকে নিজেদের শক্তপোক্ত অবস্থান জারি করছে। তানবীর হাত না ছাড়িয়ে শান্তকে কাছে টানল। সম্পূর্ণ দূরত্বটুকু মিটিয়ে কোমড় গড়িয়ে পিঠে হাত রেখে তাকে নিজের মুখোমুখি করল। অতঃপর বৃষ্টির জলগুলোকে শুষে নিয়ে অভিমানিনীর অভিমান মুছিয়ে দিতে লাগল।
শান্ত এমন কম্পনমান স্পর্শ নিতে পাড়ল না। ছিটকে দূরে সরতে চাইল। বাঁধ সাধল তানবীর। আরও নিবিড়ভাবে তাকে নিজের সাথে চেপে ধরল। নিজের দেওয়া প্রেয়সীর আঘাতপ্রাপ্ত গালে অধরযুগল শক্ত করে চেপে ধরল। বারকয়েক ঠোঁট নাড়িয়ে আদর খেল।
শান্তর অবস্থা সূচনীয়। শ্বাসটুকু এসে যেন গলায় আটকে রয়েছে। প্রাণপণে জীবনটাকে বাঁচানোর প্রয়াস। কিন্তু ছেলেটা বোধহয় তার ইচ্ছাতে নারাজ। মেরে ফেলতে চায়।
তানবীর গাল থেকে মুখ সরাল৷ কিন্তু নিজেকে নয়। শান্তর কপালে কপাল ঠেকিয়ে সিক্ত স্বরে বলে উঠল,

— ‘ আমি ব্যাথা দিব। আমি মলম দেব। প্রয়োজনে আমিই ব্যাথার কারণ হব। তারপরও আমি ব্যতিত অপর কেউ যেন এই অধিকার কখনও না পায়। ‘
— ‘ য..দি দেই? ‘

কাঁপা স্বরের বাক্যটা শুনে তানবীরের ভীষণ রাগ লাগল। তারপরও নিজেকে ধাতস্থ করে সামলে নিলো। কিন্তু কন্ঠে তিক্ততা ঢেলে বলল,

— ‘ মেরে ফেলব। পুরোপুরি শেষ করে দিব। ‘
— ‘ আমি দিব না সেই অধিকার। আপনি খারাপ। শুধু ব্যাথা দেন আমাকে। সবসময় বকেন আমাকে। আমি আপনাকে বুঝতে চাই। কষ্টটুকু পুরোপুরি মুছিয়ে দিতে চাই। কিন্তু আপনি নন৷ আপনি শুধু কষ্টই দিতে জানেন। আর কিছু নয়। তাহলে এমন মানুষকে কেন দিব সেই অধিকার? দিব না আমি। ‘

তানবীরের হাতটুকু ধীরে ধীরে আলগা হলো। কথাগুলো যেন তার বুকে তীরের মতো বিঁধল। সে নিজেকে সামলিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। এখানে থাকলে নিশ্চয়ই জমানো রাগটা প্রকাশ পেয়ে যাবে। তখন প্রেয়সীর নিকট আরও খারাপ হবে। সেটা এই মুহূর্তে চায় না সে।
সবসময় সবার চোখে খারাপ হতে ইচ্ছে করলেও এইমুহূর্তে কারও চোখে ভালো হতে ভীষণ ইচ্ছে জাগছে। মনের কোঠাতে সুপ্ত বাসনা জাগছে। ভালো হলে এই মেয়েটাকে বোধহয় তাকে অধিকারটুকু স্বাচ্ছন্দ্য বিলিয়ে দিবে।
তাই সে নিজেকে ছাড়িয়ে কয়েকপা পিছিয়ে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো৷ নিঃশব্দে জায়গাটা ত্যাগ করার ইচ্ছা নিয়ে সামনে পা বাড়াল। কিন্তু খুব একটা দূরত্ব তৈরি করা সম্ভব হয়ে উঠল না। পিঠে নিজের ছোট্ট মাথাটা কেউ এলিয়ে দিয়েছে। বুকের দুই পাশে এসে ঠেকেছে কোমল দুইটি হাত। শান্ত বারকয়েক দ্রুত শ্বাস টানল। নিজেকে
সামলাতে চেষ্টা করল। ততক্ষণ ছেলেটি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। সবসময় রাগ হলেও এবার অভিমান জমেছে।
ভালোবাসা বোধহয় নব্য ছাত্রের ন্যায় সবকিছুই নতুন করে শিখিয়ে তুলে৷ রাগ, অভিমান, ঝগড়া সবই যেন ভালোবাসার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। নিজেকে ঠিক অবস্থায় আনতে পেরেছে এমন বোধশক্তি হতেই শান্ত নিজেও অভিমানী কন্ঠে আওড়াল,

— ‘ এই হৃদয়হীন মানুষটার কষ্ট সহ্য করতে পারি না। বুকে চিনচিন ব্যাথা করে। যা সহ্য করা ভীষণ কষ্টকর। দম আটকে যাওয়ার পুরোপুরি জোগাড়। তাইতো তাকে নিজের থেকে আর বিন্দুমাত্রও কষ্ট দিতে চাই না। ভুল, অপমান, রাগ সবকিছুকে ছাপিয়ে যেতে চাই। কোনো কিছুকে ধরতে চাই না। শুধু সুখ টুকু ঝুলিতে কুড়িয়ে নিতে চাই। তার জন্য সুখের অশ্রু গড়াতে চাই। নিজের অজান্তেই এই মানুষটাকে নিজের সবটুকু দিয়ে বসে রয়েছি। তার থেকে কোনোরকম প্রত্যাশা ব্যতিত হৃদমাঝারে জায়গা দিয়েছি।
কিন্তু কিন্তু, যার জন্য আমার মন এতো কাঁদে সে কি বুঝে? আমার মনটুকু কি সে পড়তে পারে? না পাড়লে যে কষ্ট হবে৷ ভীষণ কষ্ট হবে। এতদিন সামলাতে পারলেও এখন পারব না। সে আমার সবটুকু শক্তি নিজের মধ্যে নিয়ে আমাকে পুরোপুরি শূন্য করে দিয়েছে। সে সত্যিই পাষাণ। হৃদয়হীন। ‘

তানবীর তারপরও পিছন ফিরল না। বুকের উপর রাখা হাতটা নিয়ে কেবল নিজের মুখশ্রীতে আলতো বুলাতে। তার চোখগুলো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। ইশশ কি শান্তি। এই মেয়েটা আরও আগে কেন তার জীবনে এলো না? কেন এতটা দেরি করল? তাহলেই তো তানবীরের জীবনের কালো অধ্যায়টা নিজের জায়গা তৈরি করতে ব্যর্থ হতো। তার সারাজীবন বোধহয় এই ছোট্ট একটা আফসোস থেকে যাবে, মেয়েটা কেন এলো না?
তানবীর এবার বন্ধ আখিঁদ্বয় উন্মুক্ত করে ঐ আকাশপানে তাকালো। সে সাক্ষী, ঐ অদেখা চাঁদ সাক্ষী। নিজের জীবনের কতগুলো মুহূর্ত সে এই আকাশপানে চেয়ে অতিবাহিত করেছে। নিঃশব্দে অভিযোগ করেছে। কিন্তু আজ কোনো অভিযোগের পালা নয়। বরং কৃতজ্ঞতা জানানোর সময়। তাদেরকে কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ জানাতে তানবীর প্রেয়সীর হাতের তালুতে দীর্ঘ চুমু দিলো। অতঃপর আবারও আকাশপানে তাকালো। নিঃশব্দে যেন বলতে চাইল,

— ‘ দেখ আজ আমি কতটা খুশি। কতটা আনন্দের ঢেউ আমার বুকে প্রবাহিত হচ্ছে। তোমাদের হয়তো অভিযোগ ছিল আমার প্রতি। তাই আজ দূর করতে চেয়ে খানিকটা চেষ্টা। এখন খুশুিতো আমার খুশি দেখে? এখন আর অভিযোগ করবে না তো? ‘

নিঃশব্দের কৃতজ্ঞতা যেন ঐ শব্দহীন আকাশও বুঝতে সক্ষম হয়েছে। তাই নিজের গতানুগতিক শব্দহীনতাকে ছাপিয়ে অনবরত মেঘের গুড়ুমগুড়ুম আওয়াজ তুলল৷ দূর আকাশে শব্দ করে মেষের ঘর্ষন হলো।
সময়গুলো যেন সেখানেই আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে দুইজন। এতটা সুখ লাগে কেন? প্রিয়মানুষ সংস্পর্শে আছে বলে? নাকি প্রিয় মানুষ সুখী আছে বলে?
তানবীর পিঠ ঘুরিয়ে শান্তর দিকে ফিরল। এতক্ষণ এত কথা বললেও এখন সে মাথা তুলেই তাকাতে পারছে না। কিভাবে বলে ফেলল এতসব?
তানবীর মৃদু হাসল। আঁজলাভরে শান্তর মুখটা ধরল। চোখে চোখ মিলিত হলো। বৃষ্টির পানিতে তানবীরের মুখের পানি শান্তর চোখে-মুখে এসে পড়ছে। তানবীর প্রেয়সীর বৃষ্টি ভেজা গালে অধরযুগল স্পর্শ করল। শান্তর হাতদুটো আপনাআপনি তানবীরের বুকের শার্ট খামচে ধরল। সে শান্তর গালে বৃষ্টি ভেজা শীতল ঠোঁটের উষ্ণ আদর দিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘ সব কষ্ট শুষে নিলাম। সব যন্ত্রণা শুষে নিলাম। এবারও অভিযোগ থাকবে? থাকবে, আমার প্রতি আরও রাগ-অভিমানের বর্ষন? নাকি এই মনকাড়া বর্ষনে দূর হবে প্রেয়সীর জমানো ঝুঁড়ি? ‘

শান্তর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটা মিলিয়ে গেল তানবীরের তীক্ষ্ণ স্বরে,

— ‘ ধুর বাল। এইসব প্রেম মার্কা বুলি আমার সাথে যায় না৷ মুখটা উশখুশ করছে। ‘

শান্ত কটমট চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকালো। তাই পরমুহূর্তেই সে নিজেকে কিছুটা দমিয়ে নিয়ে বলল,

— ‘ আরে এমন কইয়া তাকাইয়া কি দেখস? ডর করে তো। চোখ নিচে নামা। ‘

শান্ত চোখ নিচে নামাল না। বরং দ্বিগুণ রাগ দেখিয়ে বলল,

— ‘ একদম আমার সাথে কথা বলবেন না। ছিঃ কি বিশ্রি ভাষা৷ তুই-তুকারি ছাড়া মুখ দিয়ে কিছুই বাহির হয় না। বমি আসে আমার। দূর হন। ‘

শান্ত রাগ দেখিয়ে সামনে হাঁটা ধরল। তানবীর হেসে দিয়ে তার পিছনে দৌড় লাগাল। পিছন থেকেই তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরাতে শুরু করল। আচমকা এমন করাতে শান্ত ভীষণ ঘাবড়িয়ে গিয়েছে। ভয়াতুর কন্ঠে সে বলল,

— ‘ আরে আরে কি করছেন? পড়ে যাব তো। নিচে নামান আমাকে। কেউ দেখলে কি ভাববে? ‘

তানবীর শুনলো না। তাকে নিয়ে অনবরত ঘুরিয়েই গেল। হাসতে হাসতেই বলল,

— ‘ তোকে তুই বলব, তুমি বলব। এমনকি ভালোবেসে মাইরও দিব। সবকিছুই করব। এবং সেটা কেবল আমি-ই করব। ‘

তানবীরের পাগলামি দেখে শান্ত হাসছে। রাগ সব উড়ে গিয়ে মাটিতে পরিণত হয়েছে। কেবলমাত্র এই হাসিমুখটা দেখেই। এরজন্যই তো শান্তর নিঃশব্দে এত চেষ্টা। তানবীরের বিগত সব ভুলকেই একেবারে মাটি করে শান্ত তাকে আপন করে নিতে চেয়েছে। বয়সে ছোট হলেও মন থেকে সে বিশালতা দেখাতে চাই৷ এই ক্ষেত্রে তানবীরকে সে পুরোপুরি হারিয়ে দিতে চাই। না অতিত না বর্তমান, কোনো কালের কোনো অপ্রত্যশিত ঘটনা নিয়ে সে তানবীরের দিকে আঙ্গুল তুলতে ইচ্ছুক নয়।
থাক না কিছু রাগ, পরবর্তী মিষ্টি ভালোবাসার জন্য। যে রাগ ভুলতে গিয়ে প্রতিধানে দ্বিগুণ ভালোবাসতে হবে৷ দ্বিগুণ ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে হবে। জমানো রাগ দেখিয়ে দিনশেষে দ্বিগুণ ভালোবাসাময় খুনসুটিতে মেতে থাকা যাবে। থাক না কিছু, অপ্রত্যশিত রাগ-অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। সব ক্ষেত্রে যে জাহির করতে হবে এমনটাতো নয়। যদি রাগের বহিঃপ্রকাশে প্রিয়মানুষটির কষ্ট দ্বিগুণ হয় তাহলে প্রয়োজন কি সেই রাগের? ভালোবাসার উর্ধে কি কিছু হয়?

_________________

বারান্দার রেলিং ধরে দূর আকাশপানে তাকিয়ে রয়েছে নতুন বধুটি। প্রবল বর্ষনে তার চুল এলেমেলো হচ্ছে। প্রকৃতি যেন আজ নতুনরূপে সেজেছে। বর্ষনে নিজেকে নবীন পৃথিবীর ন্যায় সাজাতে যেন মহা ব্যস্ত। আর অপরদিকে নতুনের মতোই প্রিয়তীর পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। হাতভরা চুড়ি। মাঝখানে শুভ্র বর্ণের চমৎকার শাঁখা। সিঁথিবর্তী প্রিয়মানুষটার নামের সিঁদুর। নিজের এই নতুনরূপে প্রিয়তী লাজুক হাসল। বসার ঘর থেকে অনবরত হইহট্টগোলের আওয়াজ আসছে। সবাই তাদের আগামীকালের রিসিপশন পার্টি নিয়ে প্ল্যান করে চলেছে। প্রিয়তী রুমে থেকেও স্পষ্ট তাদের চেঁচামেচি শুনতে পারছে। যেটাতে সে নিজেও হাসছে। তার এই হাস্যউজ্জ্বল মুখটি দর্শনের জন্যই বোধহয় সেই মানুষটি এসে তার পিছনে দাঁড়াল। প্রিয়তী কারও উপস্থিতি টের পেয়ে পিছনে ফিরল। অর্ণব পাঞ্জাবির পকেটে দুইহাত দিয়ে তার নব্য বধুটির দিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। প্রিয়তীর তার চোখের দৃষ্টিতে এবার লজ্জা পাচ্ছে।
ইশশ আজকাল অর্ণব সামনে আসলে তার এতো লজ্জা লজ্জা পায় কেন? এতদিনতো এমনটা হতো না। দুইজনে একসাথে কত সময় কাটিয়েছে। কত যায়গায় মুক্ত পাখির ন্যায় ছুটে বেড়িয়েছে। কিন্তু আজ মানুষটি সামনে আসলে এতো লজ্জা লাগে কেন? সম্পর্কের নামের পরিবর্তনের জন্য?
অর্ণব ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসতেই প্রিয়তী এবার লজ্জা ভুলে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।

— ‘ আরে তুমি এখানে কেন? ঠাম্মা দেখলে কিন্তু ভীষণ রাগ করবে। জলদি বের হও। ‘

অর্ণবের মুখটা মুহূর্তেই ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেল। ইশশ আবারও যতসব নিয়ম। অর্ণব বিনাবাক্য রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। তার রাগীমুখটা মনে করতেই প্রিয়তী একদফা হাসল। ফোনটা হাতে নিয়ে সে দ্রুত অর্ণবকে টেক্সট করল,

— ‘ এত রাগ কেন মহাশয়? জানেন? আপনি রাগলে না আপনাকে পিকুর বিড়ালের মতো লাগে। আপনি পিকুর বিড়ালটাকে চিনেন তো? যে সমসময় গাল ফুলিয়ে হুতুমপেঁচা হয়ে থাকে? ঠিক একই রকম আপনাকেও লাগে। ‘

প্রিয়তী মেসেজটি সেন্ড করে আবারও একদফা হাসল। প্রিয়তীর রুম থেকে বেড়িয়ে এসে অর্ণব গোমড়ামুখেই বড়দাদাদের সাথে এসে বসল। সবাই বিয়ের পরবর্তী নিয়মকানুন নিয়ে ব্যস্ত আলাপ করছে। হায়রে, এখানেও নিয়ম? অর্ণব নিজের মনেই বিরক্তিকর সুর টানল,

— ‘ যতসব ফালতু নিয়ম। ‘

মেসেজের টুনে অর্ণব পকেট হাতিয়ে ফোন বের করল। প্রিয়তীর মেসেজ। পুরোটা মেসেজ পড়ে অর্ণবের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। মুহূর্তেই গোমড়ামুখটা তার হাসিমুখে পরিণত হলো। দাদারা আড়চোখে তাকাতেই অর্ণব ধরা খেল। খানিক কেশে গলা পরিষ্কার করে সে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে উঠে এলো। একটু সাইডে গিয়ে মেসেজের রিপ্লাই করল। তার ঠোঁটের কোণে মুহূর্তেই দুষ্টু হাসিরা ঝুলে পড়ল। এইমুহূর্তে প্রিয়তমার রক্তিম বর্ণের মুখশ্রীটা দেখার জন্য বড্ড লোভ হচ্ছে।
কিন্তু ইচ্ছে থাকতেই এই মুহূর্তে উপায় নেই। আবারও নিয়মের বেড়াজালে আটকে যেতে হলো।
প্রিয়তী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুলে চিরুনি করছিল। তখনই ফোনটা ছোট্ট একটা আওয়াজে ভেজে উঠল। প্রিয়তী না দেখেই আন্দাজ করতে পাড়ছে এই মুহূর্তে ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটি কে? সে হাসিমুখেই হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নিলো। ইনবক্স চেক করতেই তার গলা প্রায় শুকিয়ে কাঠ হবার জোগাড়। সে শুকনো একটা ঢুক গিলে কপালে হাত দিলো। এসি চলাকালীনও তার কপালে বিন্দু বিন্দু মুক্তদানারা ভেসে আসলো। সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তার বুকের ধকধক আওয়াজটা যেন সে নিজেই শুনতে পারছে। সে কাঁপা হাতে আবারও ফোনটা নিলো। আরেকটাবার সেখানে নজর বুলাল,

— ‘ ওহ্ তাই নাকি? আমি হুতুমপেঁচা! তাহলে বেশ ভালো। আর তাহলে আপনি নিশ্চয়ই এটাও জানেন হুতুমপেঁচারা কি করে? কিন্তু আমিতো এতসব জানি না। কিন্তু আজকে এই হুতুমপেঁচাটা একজনকে কামড়াবে৷ খুব খুব কামড়াবে। তার লাল মুখটা আরও লাল লাল করবে। জানতে চাইবেন না মানুষটি কে? যার ঠোঁটের নিচে ছোট্ট একটি কালো তিল রয়েছে। যার হাসিতে চোখ হাসে। যার হাসিতে কারও বুক ফাটে। আমি সেই নির্দয় মানুষটির কথা বলছি। চিনেন কি তাকে? ‘

প্রিয়তী ফোনটা বুকে চেপে ধরল। চোখ বন্ধ করতেই পাশ থেকে গড়িয়ে পড়ল বিন্দু জল। সবসময় কি অশ্রুকণা শুধু কষ্টের হয়? সুখের হয় না? প্রিয়তীরও আজ সেই সুখেই গাল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। কতটা মাস, কতটা বছর সে এই মুহূর্তগুলোর জন্য অপেক্ষা করে গিয়েছে। আজ সেই মুহূর্তগুলো সত্যিই চলে এসেছে। অতঃপর স্বামীর লজ্জাবাণে প্রিয়তী দ্রুত মুখ ডেকে নিলো। শ্বাস দ্রুত বয়ছে তার। লজ্জা, ভয়, নতুন সব অনুভূতিরা এসে তাকে পুরোপুরি চেপে ধরেছে। একবারে আষ্টেপৃষ্টে তাদের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়েছে তাকে।

____________________

বৃষ্টির কণাগুলোর সামনে বৃহৎ আকারের আমগাছটা পুরোপুরি দেয়াল হতে পারছে না। তাই এতএত পাতা-ঢালের ভিড়েও নীলার শরীরে মৃদু পানির ছিটা এসে পড়ছে। নীলা অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র বিরক্ত নয়। বৃষ্টি তার নিকট বরাবরই ভীষণ পছন্দের জিনিস। তার যত বিরক্ত সব হচ্ছে সাদিদকে নিয়ে। ঠিক মানুষটাকে নিয়ে নয়, বরং তার পাগলামিগুলোকে নিয়ে। কিছুক্ষণ আগে কি পাগলামিটাই না করল।
অর্ণব আর প্রিয়তীর পরিবারের অনেক বড় সদস্যরাই বাসে তখন উপস্থিত ছিল। সাদিদের এমন করে নীলাকে নিয়ে বাস থেকে নেমে যাওয়াটা তারা হয়তো ভালো চোখে দেখেনি। কিন্তু নীলা এতো করে বলেও সাদিদকে এই কথাটুকু বুঝাতে পারল না। তার ঘাড়ত্যাড়া জামাই নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। সবকিছুকে অদেখা করে সে নীলাকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছানোর কিছুটা আগেই নেমে পড়েছিল। আসার সময় কি সুন্দর নতুন জামাইকে বলে আসলো,

— ‘ নতুন জামাই, আমাদের ব্যাগপত্রগুলো কষ্ট করে ডাইভার দিয়ে পৌঁছে দিয়েন৷ আপনার বিয়ে উপলক্ষে বউয়ের সঙ্গে প্রেম হয়নি। তাই এখন প্রেম করতে যাচ্ছি। প্রতিদান হিসেবে তো এতটুকু কষ্ট অবশ্যই করতে পারবেন। ‘

নীলার এসব ভাবতেই এখনও গালগুলো টকটকে লাল হচ্ছে। সে চোখ নামিয়ে নিচে তাকালো। তাকে এতএত লজ্জা দিয়ে এই ছেলেটা কি নিশ্চিতে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে রয়েছে। ঘুমানোর কি জায়গার অভাব? সবার সামনে এতো লজ্জা দিয়ে এখন এসে তিনি নির্জন এই গাছতলায় শয়ন জমিয়েছে। আশ্চর্য! নীলা বিরক্তিমাখা কন্ঠে বিড়বিড় করে করে আওড়াল,

— ‘ নির্লজ্জ লোক। ‘

— ‘ পাখি কিছু বললে? ‘

নীলা আবারও দ্রুত নিচে তাকালো। এতক্ষণ পাশ ফিরে ছিল। সাদিদ এখন চোখ খোলে তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। সে প্রথম ভাবল বলবে না। কিন্তু পরমুহূর্তেই খানিকটা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,

— ‘ জ্বি বলেছি। আপনি একনম্বরের নির্লজ্জ পুরুষ। ‘

সাদিদ তার কথায় ঠোঁট কামড়ে হাসল। মুহূর্তেই উল্টো হয়ে নীলার পেটে মুখ গুঁজল। টপাটপ গুটিকয়েক চুমু খেয়ে নিয়ে বলল,

— ‘ সাহস থাকলে আবার বলো। ‘

নীলার শ্বাস আটকে যাবার জোগাড়। এই ছেলেটা এমন করে কেন? সে জানে না, নীলার এসবে শ্বাস গলায় এসে আটকে যায়?
সাদিদ উত্তর না পেয়ে নীলার পেটে মুখ ঘষতেই নীলা তার মাথার চুল খামচে ধরল। আটকে যাওয়া কন্ঠে বলল,

— ‘ নি..র্লজ্জ। ‘

সাদিদ নীলার অগোচরে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। অতঃপর জামার উপর দিয়ে পেটে আস্তে করে দাঁত বসাল।

— ‘ ইশশ। ‘

নীলার গলা হতে ব্যাথাজনক আওয়াজ বেড়িয়ে আসতেই সাদিদ হাসতে লাগল। নীলা রেগে গিয়ে তাকে কোল থেকে উঠানোর জন্য নড়াচড়া শুরু করল। সাদিদ তার কান্ড দেখে হাসির শব্দ আরও বাড়িয়ে দিলো। দুইজনের বিপরীত ক্রিয়াতে কিছু মুহূর্ত কেটে গেল। নীলা এবার হাল ছেড়ে দিয়েছে। সাদিদের মতো শক্ত সামর্থ্য ছেলের সঙ্গে তার মতো কাঠি কি পেরে উঠতে পারে?
নীলাকে জোরে শ্বাস টানতে দেখে সাদিদ দুষ্টুমি ছেড়ে এবার উঠে বসল। তাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে পিঠ হাত বুলিয়ে নরমস্বরে ডেকে উঠল,

— ‘ পাখি, খুব কষ্ট হচ্ছে? ‘

নীলা হাঁফাতে হাঁফাতেই হাসল। তার এতটুকু সমস্যাতে সাদিদের চেহারার রং পালটে গিয়েছে। নীলা জোরে কয়েকটা শ্বাস টেনে নিজকে স্বাভাবিক করল। অতঃপর মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে উত্তর দিলো।

— ‘ না। ‘

সাদিদ তাকে টানল। নিজের বুকে মাথাটা চেপে ধরল। তাকে এরকম করতে দেখে ইতিমধ্যে বুকটা ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখন যেন আঘাতের উপর ঠান্ডা বরফের ছোঁয়া লাগছে। ব্যাথাটাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল।
হঠাৎ দূরে একটা বাজ পরতেই নীলা মৃদু কেঁপে উঠে সাদিদের পিঠ খামচে ধরল। সাদিদ বুঝতে পেরে হাতের বাঁধন আরও শক্ত করল। ভরসা দেওয়ার কন্ঠে বলল,

— ‘ ভয় নেই জান। আমি আছিতো। ‘

নীলা মুখ তোলে তাকালো। সাদিদ তার চোখেই নিষ্পলক তাকিয়ে রয়েছে। নীলা মৃদু হাসল। চোখে চোখ রেখেই নিজেও প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,

— ‘ আমি জানি তো। সবাই ছেড়ে গেলেও এই লোকটা কখনও ছাড়বে না৷ আর সে থাকতে ভয় কেন? ‘

সাদিদ হাসল। প্রিয়তমার কপালের মাঝ বরাবর চুম্বন আঁকল। আবেশে নীলার চোখজোড়া সাথে সাথেই বন্ধ হলো।
অতঃপর বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

— ‘ আল্লাহ যেন আমাকে সেই তাওফিক দান করে। আমি যেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার এই ছোট্ট পাখিটাকে আগলে রাখতে পারি। তাকে যেন সমস্ত ঝড়ঝাপটা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি৷ সৃষ্টিকর্তা যেন ততটুকু সুযোগ আমাকে দেন। ততটুকু সময় যেন পাই। ‘

নীলা মুগ্ধ দৃষ্টিতে শুনল। কিন্তু মনের কোঠাতে চাপা অভিমান জমল। সাদিদকে জোর পূর্বক ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। পৃথিবীর বুকে ঢলে পড়া জোরালো বর্ষনকেও উপেক্ষা করে হনহনিয়ে হাঁটা ধরল।
সাদিদ খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেল। ভালোই তো ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ আবার কি হয়ে গেল?
কিন্তু নীলার অবস্থান বুঝতে পেরেই আর এক মুহূর্তও ভেবে সময় নষ্ট করল না। দৌড়ে তার পিছু নিলো।
নীলা কোনোদিক না তাকিয়ে হেঁটেই চলছে। থাকবে না সে। কোনোভাবেই এই লোকের কাছে যাবে না সে। সবসময় বেশি বেশি। জঘন্য লোক।
সাদিদ দৌড়ে এসে পিছন থেকে নীলার হাত টেনে ধরল। এক ঝটনায় নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে উঠল,

— ‘ এই মেয়ে, সমস্যা কি? এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে এসেছ কেন? জ্বর আসবে না? তাড়াতাড়ি চলো। ‘

বলেই সে নীলার হাত টেনে গাছতলায় নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু সে গেল না। পায়ের পাতা দিয়ে মাটি আঁকড়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাদিদ অবাক দৃষ্টিতে পিছনে ফিরল। কন্ঠে চমকিতভাব নিয়েই আবারও বলল,

— ‘ কি হচ্ছে কি? এমন করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? শরীর খারাপ করবে। ‘
— ‘ করুক। শরীর খারাপে মরে যেতে চাই। ‘

সাদিদ হতবিহ্বল। শরীর যেন অসার হয়ে পড়েছে। কন্ঠনালী আটকে গিয়েছে। প্রবল বর্ষনে দুইজনই একেবারে ভিজে জবজবে অবস্থা। চুঁইচুঁই করে মাথা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তারমধ্যে দুইজনে স্থির দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। পুরোপুরি পলকহীন, শব্দহীন। বৃষ্টির রিনিঝিনি আওয়াজ ব্যতিত সবকিছুই নিজস্বধারা থেকে বিরত।
সাদিদ চোখ বন্ধ করল। হয়তোবা কোনোকিছু লুকানোর প্রয়াস। কিন্তু পাড়ল না। সম্ভব হয়ে উঠল না নিজেকে পুরোপুরি লুকিয়ে ফেলার। কেননা নীলার চোখের সামনে তার রক্তলাল আঁখিদ্বয় দৃশ্যমান হলো। তাতে যেন আগুনের ফুলকি ঝড়ছে। নিজের শক্ত হাতটা নীলার কোমল গালে স্থান দিতে গিয়েও সাদিদ পারল না। গালের একেবারে সন্নিকটে এসে থেমে গেল সেটা। চোখের দৃষ্টিতে মৃদু কাঁপমান অবস্থা বুঝা যাচ্ছে। নীলা ভয়ে চোখ-মুখ খিঁচে রেখেছে। সে বোধহয় এতক্ষণে গাল লাল হয়ে যাবার পুরোপুরি সম্ভাবনা দেখেছিল। কিন্তু এখনও ব্যাথা অনুভব না হতেই সে চোখ তুলল। সাদিদকে কাঁপা হাতটা উঁচিয়ে রাখতে দেখে শুকনো ঢুক গিলল। মুখে যায় বলুক এই ছেলেটাকে সে যমের মতো ভয় পায়।
সাদিদ রক্তলাল চোখে নীলার বাহুতে চেপে নিজের কাছে আনল। বাহু ছেড়ে গলায় শক্ত হাতে চেপে ধরল। নীলার দম বের হয়ে যাবার জোগাড়। শ্বাস ফেলতে পারছে না। অপরদিকে সাদিদের ছাড়ার নামগন্ধ নেই। নীলার চোখ-মুখ উল্টে যেতে নিলেই সাদিদ তাকে ঝটকা মেরে ছেড়ে দিলো। নীলা ছাড়া পেয়ে জোরে জোরে কাশছে। অপরদিকে সাদিদ তাকে বরাবরের মতো আগলে নিতে আসছে না৷ কষ্ট হচ্ছে কি-না সেটা জানতে চাচ্ছে না। সে পিঠ দেখিয়ে সামনে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীলাকে স্বান্তনার পাঠ শুনাবে কি? বরঞ্চ জোরে ধমকে উঠল,

— ‘ আমার রাগ কমছে না। জলদি রাগ কমা। ‘
— ‘ কি..? ‘
— ‘ বেশি কথা বললে থাপড়িয়ে দাঁতের কপাটি ফেলে দিব। রাগ কমা জলদি। ‘

নীলা অবাক। সাথে হতবাক। সাথে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কিসের রাগ? কার রাগ?
নীলার এখানে রাগার কথা। উল্টো সাদিদ নিজের রাগ দেখাচ্ছে। নীলার কোনো গতিবেগ না দেখে সাদিদ এবার তেড়ে আসলো৷ নীলাকে কোনোকিছু বুঝার সুযোগ না দিয়ে হাতের বাঁধনে পিঠ আগলে নিজের সাথে তাকে চেপে ধরল। মুহূর্তেই জামার ওড়নাটা ফেলে দিয়ে গলা সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করল। নীলাকে আর কিছু বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়ে গলার একপাশে শক্ত কামড় বসাল। নীলার চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার অবস্থা। প্রাণটা বোধহয় মাত্রই বের হয়ে যাবে। সাদিদের কানে নীলার আর্তনাদ পৌঁছাল। কিন্তু তারপরও সে নিজেকে ছাড়িয়ে আনলো না। শুভ্রবর্ণের গলাটা লালচে করে তবে সে পিছু হাটল।
জোরে জোরে শ্বাস টানছে। তারপরও যেন রাগ তার মাথায় চেপে বসেছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সে নীলাকে আবারও টানল। দুইজোড়া ঠোঁট মিলিত করল। সমস্ত রাগ প্রিয়তমার অধররযুগলে ঢেলে দিতে লাগল। এতক্ষণের সবকিছুই নীলার পুরোপুরি মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এই ছেলের শরীরের এতো জোর, নীলা সেখানে চাইলেও কিছু করতে পারে না।
খনিকবাদে রাগটা একটু আয়ত্তের ভিতরে আনতে সক্ষম হয়েছে বোধ হতে সাদিদ তাকে ছাড়ল। নীলা অবিশ্বাস্য চাহনিতে তার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। সাদিদ সেটা দেখল। কিন্তু রাগ ভুলে গলে পানি হলো না। শুধু চোখ রাঙিয়ে ছোট্ট একটা বাক্য সমাপ্ত করল।

— ‘ প্রথমবার এবং শেষবার। আর কোনোদিন ভুলেও এই কথা শুনলে সত্যিই তোকে মেরে ফেলব। পুরোপুরি মাটিচাপা দিয়ে দেব। ‘

বলে হনহনিয়ে কয়েককদম সামনে এগিয়ে গেল। নীলা পিছন থেকেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে সাদিদ নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে। সে মাথা নিচু করে নিজেকে সামলাতে এখনও জোরে জোরে শ্বাস টানছে।
নীলা এতক্ষণ অবাক ছিল। আর এখন হাসি পাচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবে হাসি চেপে রাখছে। এই ভয়ংকর আগ্নেয়গিরির শ্রবণে এখন হাসির আওয়াজ পৌঁছালে নিঃসন্দেহে তুলকালাম কান্ড বাঁধাবে। নীলা গুটিগুটি পায়ে সামনে এগিয়ে গেল। পথিমধ্যে সাদিদের ছুঁড়ে ফেলা ওড়নাটা মাটি থেকে তুলে আবারও শরীরে দিয়ে দিলো। সাদিদের পিছনে গিয়ে গলা কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল। কিন্তু উল্টো রাম ধমক খেয়ে বসল।

— ‘ দূর হ পাখি৷ নতুবা আজে সত্যিই মেরে ফেলব। ‘

নীলা নিঃশব্দে হাসল। তাকে রাগিয়ে দিতে নিজেও আরেকটু দুষ্টুমি করল,

— ‘ তাহলে আমি নিজেই মরে যাব। ‘

সাদিদ উল্কার গতিতে পিছু ফিরল। আবারও শক্ত হাতে নীলার গাল চেপে ধরল। তার হাত কাঁপছে, সাথে সে নিজেও। কাঁপা ঠোঁটগুলো নাড়িয়ে সে আবারও বলল,

— ‘ একেবারে মেরে ফেলব৷ ‘

নীলা এবার হাসল৷ বেশ শব্দ করে হেসেই সাদিদের বুকে মুখ গোঁজল। নিজের দুইহাত তার পিঠে রেখে তাকে পুরোপুরি ধরতে চাইল। অতঃপর বলল,

— ‘ বাহবা! এত রাগ? ‘

সাদিদ উত্তর দিলো না। রাগে কথাও বলল না। এমনকি নীলাকে ছাড়িয়েও নিলো না এবং নিজেও তাকে ধরল না। শুধু হাত সোজা রেখে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। শুভ্র বর্ণের মুখশ্রী তার রক্তিম আভায় ছেয়ে আছে। চোখ-মুখ রক্তজবার ন্যায় উজ্জ্বল। তাকে শব্দহীন দেখে নীলা-ই আবার অভিযোগের সঙ্গে সুর তুলল,

— ‘ রাগ আমার করার কথা। অথচ সেখানে উল্টো রাগ করছেন আপনি! এটা ঠিক? ‘
— ‘ তোকে আমি কি করেছি? দূর হ আমার সামনে থেকে। নতুবা সত্যিই খারাপ কিছু করে ফেলব৷ ‘
— ‘ খারাপের আর বাকি রেখেছেন কি? গলা চেপে ধরেছেন। গালও ধরেছেন৷ আমি এখনও ব্যাথা পাচ্ছি। ‘

সাদিদ আড়চোখে একবার প্রিয়তমার গাল এবং গলা দেখল। কিন্তু রাগকে প্রাধান্য দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। নীলা সেটা লক্ষ্য করে আরেকদফা হাসল। সাদিদকে তার নিকট এখন পুরোপুরি বাচ্চা মনে হচ্ছে। যে অল্পতেই মুখ ফুলিয়ে বসে। রাগ কমাতে কামড়ে দিতে আসে।

— ‘ নিজেই তো প্রথমে বলেছিলেন৷ সেই জন্য আমিও অভিমান করে বলেছি। তার জন্য এত রাগ? ‘
— ‘ মিথ্যাবাদী! তোকে আমি কি বলেছি? ‘
— ‘ আপনিই তো প্রথমে মৃত্যু কামনা করেছেন। মৃত্যু নিয়ে এতসব বলেছেন। তাই আমিও করলাম৷ এবার সমান সমান। ‘

সাদিদ তেড়ে আসলো। নীলার গলায় আরেকটা কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘ তোর সমান সমান তোকে গুলিয়ে পানির সাথে খাওয়াব। বেয়াদব মেয়ে৷ ‘

নীলা এবারও রাগ করল না। গলায় হাত ঘষতে ঘষতে বলল,

— ‘ রাক্ষস একটা। শুধু কামড়াকামড়ি করে। ‘

সাদিদ এতক্ষণে মৃদু হাসল। কিন্তু নীলার সামনে প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক। শুধু মুখ বাড়িয়ে আঘাতের স্থানগুলোতে উষ্ণ স্পর্শ দিলো। নীলা চোখ বন্ধ করল। মনে মনে আওড়াল,

— ‘ এই পাগল প্রেমিকটাকে সে ভালোবাসে। পাগলাটে বরটাকেও ভালোবাসে। বড্ড বেশি। ‘

সাদিদ মুখ তুলল। নীলার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলে উঠল,

— ‘ আদরও করে। কিন্তু মাইরও দিতে পারবে। আর কখনও যেন এমনটা না শুনি। আমি বলতে পারব৷ কিন্তু তোমার জন্য এই শব্দ নিষিদ্ধ। একেবারে গর্দান যাওয়ার অপরাধযোগ্য অপরাধ। তাই ক্ষমা মিলবে না৷ ‘

নীলা সাদিদের বুকে আস্তে একটা কিল বসাল। সেয়ানা পাবলিক। নিজের বেলায় সব ঠিক৷ তার বেলায় ভুল। সুস্থ মস্তিষ্কের সেয়ানা পাগল।

#চলবে…