অন্তরালে কুয়াশার ধোঁয়া পর্ব-০৬

0
581

#অন্তরালে_কুয়াশার_ধোঁয়া
#পর্ব_6
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


কেডা?(দারোয়ান ভ্রু কুঁচকে)

আরিফ আর জয়!ওদের কাউকে চিনেন?কথাটা বলতেই ফ্যাক্টরিতে বিকট আওয়াজ হলো।

আমি আর দারোয়ান তাকিয়ে দেখি ফ্যাক্টরি দাউ দাউ করে জ্বলছে।আর যেই কান স্তব্ধ করা বিকট শব্দ হলো তা বোম্ব ব্লাস্টের।

আমি চোখ দুটো বড় করে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।ফ্যাক্টরির মধ্যে গেলে এখন ফ্যাক্টরির সাথে আমার দেহ টাও দাউ দাউ করে জ্বলত।আমি যেনো ফ্যাক্টরির দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে গেছি।একটুর জন্য মরার মুখ থেকে বেরিয়ে এলাম।এতক্ষন চারপাশে অনেক মানুষ জমে গেলো।আমি কোনো মতে সেখান থেকে পাস কাটিয়ে গাড়িতে এসে বসলাম।
বসেই ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি ছাড়তে।

আমি এখনও সেই শকড থেকে বের হতে পড়লাম না ঠিক তখনই একটা এসএমএস আসলো হোয়াটস অ্যাপ এ।ম্যাসেজটা দেখতেই আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেলো।কারণ এসএমএস এ লেখা ছিল,,

কি ভাবছেন?একটুর জন্য বেচেঁ গেছেন?না।আমি বাঁচিয়ে দিয়েছি।সাত বছর পর আপনাকে খুঁজে পেয়েছি।এতো সহজে মারবো না। তিলে তিলে মারবো।সাবধানে থাকবেন।পরেরবার হয়তো নাও ছাড় দিতে পারি।

এসএমএস দেখে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।যেই কারণে সাত বছর দেশের বাহিরে ছিলাম।যেই কারণে নিজের পরিচয় জলাঞ্জলি দিয়েছি সেই হলো।ওরা আমাকে খুঁজে বের করেই ফেললো।এখন কিছুতেই ওরা আমাকে ছাড়বে না।কিন্তু এখন আমার তার থেকেও বেশি চিন্তা হচ্ছে ঝুমের জন্য।আমার কারণে যদি ওর কিছু হয়?ওরা যদি ঝুমকে কিছু করে তখন আমি কি করবো?আমার ঝুম?

এইটা ভাবতেই ড্রাইভারকে বললাম

চাচা, ঝুমের স্কুলে যান তাড়াতাড়ি।

জ্বি। আম্মা।
বলেই উনি ঝুমের স্কুলের দিকে গাড়ি ঘুড়ালেন।


আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে ঝুমের স্কুলে ঢুকে ওকে খুঁজতে লাগলাম।ক্লাস রুম,ক্যাম্পাস পুরো স্কুল খুঁজেও ওকে পেলাম না। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে আধ ঘণ্টা আগে।কিন্তু তবুও ঝুমের তো আমার জন্য অপেক্ষা করার কথা।কিন্তু ঝুম কোথায়?তবে কি ওরা ওকে নিয়ে গেলো?আমার ছেলেটা।

বলেই আমি বেরিয়ে দারোয়ানকে ঝুমের কথা জিজ্ঞেস করলাম আর উনি আমাকে বললেন ওকে নাকি একটা সুট পড়া লোক নিয়ে গেছে।যার কালো গাড়ি ছিলো।

এইটা শুনে আমার মাথা যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিলো।আমি সেখানেই ধপ করে বসে পড়লাম।
হটাৎ করে আমার ফোন একটা কল আসলো।আমি ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ঝুমের গলা শুনতে পেলাম।

Mom? where are you?(ঝুম)

ঝুম?বাবা কোথায় তুমি?(আমি অস্বস্থি নিয়ে)

আম্মু আমি তো গুড আঙ্কেলের সাথে আমাদের রেস্টুরেন্টে।স্কুল ছুটির পর গুড আঙ্কেল আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে গেছে।তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য আমরা এখানে এসেছি।কিন্তু এখানে এসে জানতে পারি you didn’t come here।(ঝুম)

ঝুম বাবা তুমি ওখানেই থাকো।আমি যতক্ষণ না পর্যন্ত আসছি ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি কোথাও যাবে না।রেস্টুরেন্ট থেকে বেরও হবে না।
বলেই ফোন রেখে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠলাম আর ড্রাইভার চাচাকে বললাম রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে।

ওদিকে
হ্যালো মম?
যা মম ফোন কেটে দিলো।(ঝুম অভ্রর দিকে তাকিয়ে)

It’s okey চাম্প। তোমার আম্মু তো এখানেই আসছে।(অভ্র)

ইয়েস গুড আঙ্কেল।আচ্ছা গুড আঙ্কেল আজকে তুমি বাহিরে লাঞ্চ করার কথা বললে কেনো?(ঝুম)

কারণ তুমি আর তোমার আম্মু মিলে আমার জন্য রান্না করেছো।আমাকে ফ্যামিলি পার্সন ফিল করিয়েছো তাই!(অভ্র)

কিন্তু ওইটা আমাদের ডিউটি ছিলো না?যেহেতু my mom hit you,,does it hurt now? (ঝুম)

আরে ওটা বাদ দাও।আমি আমার চাম্পএর মত স্ট্রং।দেখো।
বলেই অভ্র ঝুমকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে লাগলো।আর ঝুমও খিলখিল করে হাসতে লাগলো।ঠিকই তখনই ঝুমুর হন্তদন্ত হয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো।

আমি রেস্টুরেন্টে ঢুকেই অভ্রর হাত থেকে ঝুমকে নিয়ে অভ্রকে জোরে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলাম তাও আবার রেস্টুরেন্টে সবার সামনে।

অভ্র আমার এই কাজ দেখে খুবই অবাক হয়ে গেলো।ও গালে হাত দিয়ে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

আমার ছেলেকে না বলে আনার সাহস হলো কি করে আপনার?দুদিনের পরিচয়ে এতটাও আপন হননি যে না বলে আমার ছেলেকে যেখানে সেখানে নিয়ে যাবেন।আমার আর আমার ছেলের থেকে দূরে থাকবেন।

বলেই ঝুমকে কোলে নিয়ে আমি চলে আসি।


বাড়িতে এসেই ঝুমকে ফ্রেশ করিয়ে খাইয়ে দাইয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছি।
আমি জানি ঝুম রেস্টুরেন্টের ব্যাপারের পর থেকে স্তব্ধ হয়ে গেছে।কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভয় পাচ্ছে।আমি এই প্রথম আমার ছেলের চোখে নিজের জন্য ভয় দেখতে পাচ্ছি।কিন্তু আমার কিছু করার নেই।আমি যে কাউকে বিশ্বাস করতে পারিনা।আজ যা হয়েছে তারপর তো ভুলেও বিশ্বাস করতে পারবো না।
ওরা যে আমাকে মারতে চায়!আমার সাথে যদি ঝুমের ক্ষতি করে তাহলে?আমার ভয় তীব্র হচ্ছে।আবার সেই সাত বছর আগের ভয় যেনো আমার ধরে ফেলেছে।ভেবেছি নিজেকে খুব শক্ত করেছি।কিন্তু না আমি সেই সাত বছর আগের ঝুমুর চৌধুরী তেই ফেসে আছি। ঝুমুর হতে পারছি না।আমার মধ্যে ঝুমুর চৌধুরী আবার জেগে উঠছে।

আমি এইসব ভাবতেই ঝুম আমার গালে হাত দিয়ে বললো
Mom,are you scared?

আমি ওরে আরো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম
হুম।mom is very scared!

Mom গুড আঙ্কেলের কোনো দোষ ছিল না।উনি তোমাকে আর আমাকে একসাথে লাঞ্চ করার জন্য নিয়ে যেতে এসেছিল।আমিই উনাকে বলেছি তোমাকে গিয়ে সারপ্রাইজ দেয়ার কথা।গুড আংকেলের কোনো দোষ নেই।(ঝুম)

আমি চুপ করে রইলাম।

আম্মু!(ঝুম)

হুম?(আমি)

তুমি না বললো ভুল করলে সরি বলতে দোষ নেই।তুমি কি গুড আঙ্কেলকে সরি বলবে?(ঝুম)

আমি তখনও চুপ।

ঝুম আর কিছু না বলে ঘুমিয়ে পড়লো।আমি কিছুক্ষন পর ওর কাছ থেকে উঠে ফোনটা বের করে মিতালী ফোন করলাম।

হ্যালো মিতালী?(আমি)

হ্যালো।কেমন আছো ঝুমুর!(মিতালী)

আলহাদুলিল্লাহ।আচ্ছা শোন একটা কথা ছিলো।(আমি)

কি কথা?(মিতালী)

আমি রেস্টুরেন্টটা বিক্রি করতে চাই।আমি আবার ঝুমকে নিয়ে বিদেশ চলে যাবো।(আমি)

কেনো?তোমার কি এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে?হলে বলো আমরা মিলে একটা সমাধান করতে পারি।(মিতালী)

না।তেমন কোনো সমস্যা নেই। শুধু দেশে থাকতে আমার একটু কষ্ট হচ্ছে এই আরকি!(আমি)

তোমার দেশে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?এই কথা আমার মানতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।(মিতালী)

মিতালী আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করো না।তুমি একটা ব্যবস্থা করো।আমি রাখি।
বলেই আমি ফোন কেটে দিলাম।


আমি বেলকনিতে রকিং চেয়ারে বসে বসে আছি।যেই প্রশ্নর উত্তর জানতে আমি এই দেশে এসেছি সেই টা তো হলোই না উল্টো ধরা পড়ে গেলাম।তবে যাইহোক কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই থাক।প্রশ্নের উত্তর জানতে গেলে এখন আমি আমার ছেলের আর নিজের বিপদ বাড়াবো।তার থেকে ভালো আমি অজানাই থাকি।আর যথা সম্ভব তাড়াতাড়ি চলে যাবো।
।বাহিরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলো।একটু পরেই দেখি কালো গাড়ি করে অভ্র আসলো।গাড়ি থেকে নেমেই উপর দিকে তাকাতেই আমাদের চোখে চোখ পড়লো।আর উনি অভিমানী হয়ে বেহায়া চোখদুটো নামিয়ে সিড়ির দিকে চলে যেতে লাগলো।

আমি উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম।আজ সত্যিই অনেক বড়ো ভুল করলাম।উনাকে ঐভাবে মাথা গরম করে না মারলেও পারতাম।উনি তো ভুল কিছু করেনি।উনি শুধু আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল। ঝুমকে খুশি রাখতে চেয়েছিলো।আর এইটাই তো উনার সাথে আমার চুক্তি হয়েছিল।আমি উনার জন্য রান্না করবো আর উনি ঝুম কে সময় দিবেন।কিন্তু এখন যেহেতু ভুলটা করেছি তাই সরি তো বলতেই হবে।আর কিছুদিনই তো আছি আমি এই দেশে।
ভেবেই কিচেনে গেলাম।গিয়ে কয়টা কাপ কেক বানাতে শুরু করলাম।

কিছুক্ষণ পর ঝুম উঠলো।উঠেই
আম্মু আম্মু করতে করতে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরে আসলো।

ঝুম?উঠে পড়েছো বাবা?কাপ কেক খাবে?(আমি)

আম্মু তুমি আমার ফেভারিট কাপ কেক বানাচ্ছ?(ঝুম খুশি হয়ে)

হুম।(আমি)

সব গুলো কি আমার?(ঝুম)

না।তোমার গুড আঙ্কেলের জন্যও বানিয়েছি।(আমি)

ওহহ!now I understand!(ঝুম মাথা ঝাঁকিয়ে)

What?(আমি কপাল কুচকে)

তুমি গুড আঙ্কেলকে সরি বলতে চাইছো!এই জন্য কাপ কেক বানাচ্ছ তাই না?(ঝুম বাকা চোখে তাকিয়ে)

বেশি কথা বলছো।(আমি)
আমাদের কথার মাঝখানে কলিং বেলটা বেজে উঠলো।

ঝুম গিয়ে দেখো তো কে?(আমি)

ইয়েস স্যার।
বলেই ঝুম দরজা খুলতে গেলো।

আমি ওর কান্ড দেখে হাসতে শুরু করলাম একটু আগেই উনি মনমরা হয়ে ছিলো আর এখন কতো হাসিখুশি।আসলে অভ্রর কথা শুনলেই ঝুম খুশি হয়ে যায়।

ঝুম কে এসেছে?(আমি)

আমি এসেছি।
বলেই মিতালী ঝুমের সাথে ঢুকলো।

আরে মিতালী তুমি যে।(আমি অবাক হয়ে)

তোমার কথা শুনে শান্তি লাগছিলো না।তাই নিজে থেকেই চলে আসলাম।সামনাসামনি কথা বলতে।(মিতালী)

খুব ভালো করেছো তুমি একটু বসো আমি আসছি।
বলেই কাপ কেক গুলো নিয়ে বের হতে যাবো ওমনি মিতালী প্রশ্ন করলো,,

এই কেক কার জন্য?

আম্মু তুমি যাও আমি আন্টিকে সব বলছি।(ঝুম মিতালীর হাত ধরে)

কোনো পাকামি করবে না কিন্তু ঝুম।(আমি)

ওকে আম্মু।
বলেই ঝুম আমাকে স্যালুট করলো।
আমি মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলাম।


চলবে,,,