অন্তরালে কুয়াশার ধোঁয়া পর্ব-০৭

0
564

#অন্তরালে_কুয়াশার_ধোঁয়া
#পর্ব_7
Writer:: Shaanj Nahar Sanjida


ঝুম।কি হচ্ছে?(মিতালী ভ্রু কুঁচকে)

এদিকে এসো আন্টি আমি তোমাকে সব খুলে বলছি।
বলেই ঝুম মিতালীকে টেনে রুমের মধ্যে নিয়ে গেলো।

বাহ!আজকে তো আমার সাথে ভাব হয়ে গেছে তোমার!(মিতালী)

কারণ আন্টি তুমি অনেক ভালো।
বলেই ঝুম মিতালীকে নিচু করে ওর গালে চুমু দিল।

পরে মিতালীও ঝুমকে চুমু দিয়ে দুজন কাপ কেক খেতে খেতে গল্প করতে লাগতো।


অন্যদিকে
আমি মিস্টার অভ্রর রুমের কলিং বেলে চাপ দিলাম।বেশ কয়েকবার কলিং বেলটা বাজার পরেও উনি দরজা খুললেন না।
রাগে আরো জোড়ে জোড়ে বেল বাজাতে শুরু করলাম।

কিছুক্ষণ পর উনি দরজা খুললো

এতক্ষন লাগে দরজা খুলতে?
বলেই আমি উনার বাসার ভেতর ঢুকে গেলাম।

কারো বাসায় ঢুকতে অনুমতি লাগে মিস ঝুমুর!(অভ্রর গলা অভিমানী হয়ে)

আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে সোফায় গিয়ে বসে বললাম,,
এইটা আপনার কাছে থেকে দীক্ষা নিয়েছি। তা বলুন এতো দেরিতে দরজা খুললেন যে?

তাতে কি?এখন কি এই দোষের জন্য আমাকে আরেকটা থাপ্পড় দিবেন?(অভ্র আমার সামনে এসে সোফায় চেপে ধরলো)

আপনার কি আমার হাতের থাপ্পড় কি এতই ভালো লাগে খেতে?(আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে)

আপনি একা।তাও আমার ফ্ল্যাটে।এখন যদি আমি আপনার সাথে কি করে বসি?তখন কি করবেন আপনি?(অভ্র আমার কানের কাছে ফিসফিস করে)

আমি উনাকে হালকা করে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললাম
আমি আপনাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি কাছে আসা আমার একদম পছন্দ না।আমার সাথে আপনি ক্লোজ না।আরেকটা কথা আমার সাথে কি করবেন না,কি করবেন না?ওইটা নিয়ে আমাকে ভয় দেখাতে আসবেন না।কারণ এর থেকে আরো অনেক ভয় নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছি।তাই এইসব আমার কাছে খুবই তুচ্ছ।আর আমি খুবই দুঃখিত। সবার সামনে আপনাকে আমার ওভাবে মারা উচিত হয়নি।আমি ভুল করেছি তাই সাফাই গেয়ে নিজের ভুলের উপর পর্দা দিতে চাই না।(আমি অন্যদিকে মুখ করে)

সাফাই?কি সাফাই?আমি শুনতে চাই!(অভ্র)

মাফ করবেন।আপনি আমার কেউ না।আর আমি অপরিচিত মানুষদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পছন্দ করি।আর যেহেতু আমি ভুল করেছি তাই ক্ষমা চাইছি।আর এই কাপ কেক গুলো আপনার জন্য।খেয়ে নিবেন প্লিজ।আর আশা করি আমাকে ক্ষমা করে যেটুকু সময় আছি সেটুকু সময় আপনি দয়া করে ঝুমের সাথে অতিবাহিত করবেন।(আমি বলেই উনাকে দূরে সরিয়ে উঠে যেতে লাগলাম তখনই উনি আমার হাত ধরে বললেন)

যেটুকু সময় আছেন মানে?(অভ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে)

আমি আর ঝুম আবার বিদেশ চলে যাচ্ছি।(আমি মুচকি হেসে উনার থেকে হাত ছাড়িয়ে চলে আসলাম)


উনি চলে যাবেন?যাক না।তবে আমার এতো খারাপ লাগছে কেনো? দুদিনের পরিচয় তবুও কেমন যেনো খালি খালি লাগছে।আর আমি বললে কি ওরা থাকবে?আমি কি বলে ওদের আটকাবো?আমার তো ওদের উপর কোনো অধিকার নেই।তাহলে?

অভ্র নিজের সাথে নিজে এই কথা বলছে তখনই শুনতে পেলো ঝুমুর,ঝুম ঝুম বলে চিৎকার করছে।ঝুমুরের চিৎকার শুনে অভ্র তাড়াতাড়ি বাহিরে গেলো।

বাহিরের গিয়ে দেখলো ঝুমুর দের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা আর সেখান থেকেই ঝুমুর ঝুুম ঝুম বলে চিৎকার করছে।তাই অভ্র সেখানে এক মিনিটও দেরি না করে তাড়াতাড়ি ঝুমুরের ফ্ল্যাটে গেলো।গিয়ে দেখলো ঝুমুর একটা মেয়েকে(মিতালী) কোলে নিয়ে কাদছে।আর মেয়েটার মাথা থেকে প্রচন্ড রক্ত বের হচ্ছে।

অভ্র তাড়াতাড়ি ঝুমুরের পাশে বসে ওর গালে হাত দিয়ে বললো
কি হয়েছে,ঝুমুর?আমাকে বলুন।

ওরা আমার ঝুমকে নিয়ে গেছে।আমি আমার ঝুমকে বাঁচাতে পারলাম না।অবশেষে ওরাই জয়ী হলো।নিয়ে গেলো ওরা আমার ছেলেটাকে।(বলেই আমি অভ্রর বুকে মাথা দিয়ে কাদতে লাগলাম)

কি হয়েছে?এইসব কি করে হলো আমাকে খুলে বলো সব।(অভ্র)

আমি আপনাকে কেক গুলো দিয়ে যখন আপনার ফ্ল্যাট থেকে বের হলাম তখন দেখি আমাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলা।আমি ঢুকতেই দেখি মিতালী রক্তাত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে ছিলো আর সারা বাড়ির কোথাও ঝুম নেই।ওরা আমার ঝুমকে নিয়ে গেছে।(আমি কাদতে লাগলাম)

আপনি নিজেকে সামলান।আমি এক্ষুনি অ্যাম্বুলেন্স কে ফোন করছি আর সাথে পুলিশ কেও ফোন করছি।
বলেই অভ্র ফোন বের করে ফোন করতে লাগলো।

এদিকে আমার কাদতে কাদতে অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো।আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।


জ্ঞান ফেরার পর আমি নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করলাম।

আমি চোখ পিটপিট করে তাকাতেই দেখি অভ্র আমার পাশে বসে আছে।
অভ্র,আমার ঝুম?আমার ঝুমকে খুঁজে পেরেছেন?

পুলিশ এখনও ঝুমকে খুঁজছে।(অভ্র)

খুঁজছে মানে?এখন কয়টা বাজে?এতক্ষণে ঝুমের কোনো হুদিস দিতে পারলো না তারা?কি করছে তারা?
বলেই হাতের কেনোলা খুলে ফেলে বের হতে নিলাম তখনই অভ্র আমাকে আটকে বললো,,,

আপনার শরীর এখনও অনেক দুর্বল।আপনি প্লিজ উঠবেন না।

মিতালী?মিতালী কোথায়?(আমি অভ্রর দিকে তাকিয়ে)

অভ্র আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো।
আমি ওর বাহু ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম,,,
কি হলো বলুন?

উনি আমার কাধে ধরে বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলো।

আমিও অবুঝ শিশুর মতো তার পায়ের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে চলতে লাগলাম।উনি আমাকে মর্গে নিতে এলো।আমার উপরে মর্গ লেখাটা পরেই পা অবশ হতে লাগলো।আমি যেমনি পড়ে যেতে লাগলাম ওমনি অভ্র আমাকে ধরে ফেললো।ভিতর থেকে কান্নার শব্দ আসছে।আমি গলা শুনেই বুঝতে পারছি এইটা একটা মায়ের আর্তনাদ।উনার চিৎকার করে কান্না গুলো যেনো আমার কান গুলো স্তব্ধ করে দিচ্ছে।আমার অপরাধ বোধ আরো বেড়ে যেতে লাগলো।তবুও বেহায়ার মতো আমি মর্গে ঢুকলাম।আন্টি মিতালীর লাশের ওপর মাথা রেখে কাদছেন আর আঙ্কেল উনাকে ধরে রেখেছে উনিও চোখের জল ফেলছেন।উনাদের একমাত্র মেয়ে ছিলো মিতালী।

আমাকে দেখেই আন্টি কাদতে কাদতে বললো
দেখো না ঝুমুর আমার মেয়েটা কথা বলছে না।আমার হাসিখুশি মেয়েটার কি হয়ে গেলো?তোমার সাথে দেখা করার আগেও ও কতো হাসিখুশি ছিলো। ঝুমের সাথে দেখা করতে যাবে ঝুমুরের সাথে গল্প করবে।এইবার গিয়ে নাকি যেইভাবেই হোক ঝুমের সাথে ভাব করবে।আমার সবাই নাকি ঝুমের সাথে ভাব করে ফেলেছি একমাত্র ও বাদে।কিন্তু দেখো আমার মেয়েটা নিজেই ভাব নিয়ে চলে গেছে।ওদের একটাকেও ছাড়বে না ঝুমুর একটাকেও ছাড়বে না।

কথাগুলো বলতে বলতে আন্টি অজ্ঞান হয়ে গেলো। আঙ্কেল তাকে ধরে ফেললো।পরেই সবাই ধরাধরি করে তাকে কেবিনে শিফট করলো।

আমি আন্টির প্রতিটা কথাশুনে যেনো পুরাই পাথর হয়ে গেছি।ওদেরকে ছাড়বো না?কিন্তু আমিও যে ওদের মতোই অপরাধী।যদি আমি ফোন না করতাম তাহলে মিতালীও আসতো না।আর মিতালী না আসলে এই কান্ড ও হতো না।সব দোষ আমার।

আমার ভাবনার অবসান ঘটে যখন অভ্র আমার কাধে হাত রাখে।

ঝুমুর?আপনি ঠিক আছেন তো?

আমি উনার কথা শুনেই কাদতে কাদতে বসে পড়লাম।

সব হয়েছে আমার জন্য আমি সব কিছুর জন্য দায়ী। মিতালী আমার জন্য মারা গেছে।(আমি কাদতে কাদতে)

অভ্র আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো,,
আপনার কোনো দোষ নেই।ওরা ঝুমকে কিডন্যাপ করতে এসেছিল।আর মিতালী ওদের বাধা দেয়াতে ওরা মিতালীকে মাথায় আঘাত করে।আর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মিতালী সেখানেই মারা যায়।

আচ্ছা।আমার ঝুম?ওরা ওর কোনো ক্ষতি করেনি তো?(আমি অভ্রর বুক থেকে মাথা তুলে তাকিয়ে)

না।আমার মনে হয় ওরা ঝুমের কিছু করেনি।যদি কিছু করার হতো তাহলে সেখানেই করতো ওকে নিয়ে যেতো না।(অভ্র)

আল্লাহ।আমার ঝুমকে কিচ্ছু করো না।(আমি কাদতে কাদতে)


রাত বারোটায় হসপিটালে
আমি কেবিনের বেডে বসে আছি।কেবিনে একজন পুলিশ অফিসার আরো অনেক কর্মকর্তা এসেছে। অভ্রও বসে আছে আমার পাশে। অভ্র অনেক ভিআইপি একজন মানুষ।উনি খুব সহজেই বেস্ট অফিসারদের একটা টিম অর্গানাইজ করেছে শুধু মাত্র মিতালীর খুনি আর ঝুমের কিডন্যাপারদের খুঁজে বের করার জন্য।

ওরা যেই গাড়ি করে এসেছে ওইটা চুরির গাড়ি।ওরা এসেই প্রথমে দারোয়ানকে হামলা করে।দারোয়ানের কিছু করার আগেই ওরা ওর মাথায় বারি মারে।কিন্তু ভাগ্য ক্রমে উনি বেচেঁ যায়।সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে ওরা আটজন ছিলো।সবাই মাস্ক পড়েছিল।তবে চিন্তা করবেন না।আমরা ওদের খুঁজে বের করবো।তবে আপনি যদি কিছু জানেন তাহলে আমাদের প্লিজ বলুন।(অফিসার)

আমি চুপ করে ভাবছি উনাদের কি আমার আসল পরিচয় বলে দিবো?বলে দিলে কি উনারা আমার ঝুমকে খুঁজে বের করতে পারবে?আমার বাবার খুনিকে কি উনারা কি বের করতে পারবে?(আমি মনে মনে)

অভ্র আমার কাঁধে নিয়ে দিয়ে বললো
উনাদের যা জানেন বলে দিন এতে উনারা তাড়াতাড়ি ঝুমকে খুজে বের করতে পারবে!

ঠিকই এখন চুপ থাকা মানে ওদের আরো প্রশ্রয় দেয়া। যতো চুপ থাকবো ততই মিতালীর খুনি খোলা আকাশের নীচে থাকবে আর আমার ঝুমের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।না না, যাই হোক আর সব সত্যিটা আমাকে বলতেই হবে।
আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে উনাদের সব খুলে বললাম।আর আজকে সকালে দারোয়ান আমাকে যা বলেছে সব কিছু খুলে বলি।শুধু এইটা বাদ দিয়ে যে ঝুম আমার নিজের ছেলে না আর সেদিন রাতে আমি ঝুমকে পেয়েছি।আমি চাই না কেউ জানুক আমি ঝুমের মা না।আমি ঝুমের মম আর আমিই থাকবো।যেহেতু ওরা আমাকে মারতে চাই তাই এই ব্যাপারএ অফিসাররা না জানলেও চলবে।

আচ্ছা তাহলে আমরা খোজ নিয়ে দেখছি JK গ্রুপ এর মালিক কে?প্রথম জেরাটা তাকেই করতে হবে!তাহলে আমরা এখন আসি মিস ঝুমুর আর মিস্টার অভ্র।
বলেই তারা চলে গেলো।


আমি সকালে হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে মিতালীর বাড়ি যাই সেখানে ওর দাফন সম্পন্ন করে বিকেলে বাসায় ফিরি।এরইমধ্যে অনেক বার অফিসারদের ফোন করেছি উনারা শুধু বলেন
আমরা চেষ্টা করছি।

বিকেলে বাসায় ফিরে বেলকনিতে রকিং চেয়ারে বসে আছি।অভ্র গেছে বাহির থেকে খাবার আনতে।কাল রাত থেকে আমি আর অভ্র কেউ কিছু খাইনি।আমার শরীর চলার মত অবস্থায় নেই।
বাড়িটা আমার খুব ফাঁকা লাগছে।আমার ছেলেটা!ওর কথা ভাবতেই আমার খুব কান্না পাচ্ছে।আসার পর ওর প্রতিটা জিনিস পত্র গুলো নিয়ে কেঁদেছি।
হটাৎ করে রুমের ভেতর থেকে ফোনে একটা শব্দ আসলো।
আমি উঠে রুমের ভিতরে গিয়ে ফোন ধরতেই দেখি সেই আগের নম্বর থেকে এসএমএস আসছে।দুইদিন ধরে পুলিশ এই নম্বর ট্রেক করেও ধরতে পারছে না।আর এই নম্বর আমাকে এসএমএস দিলো!তবে এসএমএস এ লিখা ছিল

নিজের ছেলেকে যদি দেখতে চাও তবে নিচের অ্যাড্রেসে চলে এসো।
অ্যাড্রেসটা ছিলো আমার বাবার অফিসের যেটা এখন পরিত্যাক্ত।


চলবে,,,