অন্য পৃথিবীর পর্ব-০২

0
290

#অন্য_পৃথিবীর
পর্বঃ২
লেখিকাঃদিশা মনি
নীলার জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে মেডিকেলে দেখতে পায়।নীলা ভাবছিল সে হয়তো নিজের পৃথিবীতে ফিরে যাবে।কিন্তু তার সামনে ছেড়া পোশাক পরিহিত আমিনাকে দেখে নীলা বুঝতে পারে সে এখনো অন্য পৃথিবীতেই আছে।

নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘আম্মু এখান থেকে আমায় নিয়ে চলো হাসপাতালে থাকতে আমার একদম ভালো লাগে না।’

‘নীলা তোর শরীর এখন কেমন আছে মা? তোর এ’ক্সিডেন্ট হলো কিভাবে?’

‘সেসব অনেক কথা।এত কথা বলার সময় নেই।আমাকে আগে এই হাসপাতাল থেকে নিয়ে চলো।কি বাজে পরিবেশ।এরকম সরকারি হাসপাতালে আমায় নিয়ে এসেছ কেন? ভালো একটা মেডিক্যালে নিয়ে যেতে পারোনি?’

‘আমাদের কি আর অতো টাকা আছে।আচ্ছা নীলা তুই সকাল থেকে এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছিস কেন?’

নীলা আর কোন কথার জবাব না দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে তখন ডাক্তার রকি এসে তাকে বলে, ‘আপনি এখনো অসুস্থ আছেন।এভাবে উঠবেন না।’

রকিকে দেখে নীলা অবাক হয়ে যায়।
‘রকি তুমি এখানে?’

‘আপনি আমার নাম জানলে কি করে?’

নীলার মনে পড়ে সে এখন অন্য পৃথিবীতে আছে তাই সে বলে, ‘আপনার কথা অনেক শুনেছি তো তাই আপনাকে দেখেই চিনে গেছি।’

‘আমি এতোটাও ফেমাস নই যে সবার মুখে আপনি আমার নাম শুনতে পারবেন।’
৩.
রাতে নীলা একটু সুস্থ অনুভব করে এবং উঠে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে।হাসপাতালের গন্ধ নীলার একেবারেরই সহ্য না।তার উপর সকাল থেকে এসি ছাড়া থাকতে গিয়ে তার অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে গেছে।

নীলা বাইরে এসে একটি নাইট ক্লাবে ঢোকার কথা ভাবে।কিন্তু সে এখন প্যারালাল ইউনিভার্সে আছে এটা ভেবেই তার সেই ইচ্ছে ঘুচে যায়।এরপর একটি দামী রেস্টুরেন্টে ঢোকে।কিন্তু তার জামাকাপড় দেখে তাকে ভিক্ষুক বলে বের করে দেওয়া হয়।

নীলার খুব খারাপ লাগছিল।তার খুব খিদেও পাচ্ছিল।তাই সে আর দেরী না করে বাড়িতে চলে যায়।তাকে বাড়িতে দেখে আমিনা বলে, ‘তুই এখানে, এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে গেলি?’

‘বেশি কথা না বলে আমায় ভাত খেতে দাও।সেই দুপুরে কোনরকমে হাসপাতালে মুরগী দিয়ে ভাত খেয়েছি।এতটুকু খাবারে পেট ভরে না।’

‘হাসপাতালে ছিলি তাও তো ভালো ভালো খাবার খেতে পাচ্ছিলি।বাড়িতে তো পেঁয়াজ আর মরিচ দিয়ে ভাত খেতে হবে।’

‘হোয়াট, আর ইউ ম্যাড? আমি পেঁয়াজ আর মরিচ দিয়ে ভাত খাব।আমি মাছ মাংস ছাড়া ভাত খেতে পারিনা জানোনা?’

‘আজ সকাল থেকে এত অদ্ভুত ব্যবহার করছিস কেন? তোর মাথায় কি সমস্যা হয়েছে।বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে।তোর আব্বু তো এখনো ফিরল না সেই কোন সকালে রিক্সা নিয়ে বেড়িয়ে গেছে।’

আমিনার কথা শুনে নীলার মাথা ঘুরতে থাকে।এ কোথায় এসে পৌছালো সে।এমনিতে তো কুড়েঘর গরমে থাকা যাচ্ছে না।তার উপর এসব খাবার!

নীলা সিদ্ধান্ত নেয় না খেয়েই থাকবে।কিন্তু পেট তো আর মানতে চায়না।শেষে বাধ্য হয়ে পিঁয়াজ মরিচ দিয়েই ভাত মেখে খেল নীলা।আজ নীলা বুঝতে পারছে মানুষ খাওয়ার জন্য কত কষ্ট করে।অথচ সে এতদিন কত মাছ,মাংস নষ্ট করেছে।আর আজ এই সামান্য কিছু খাবার খেয়ে তাকে পেট ভরাতে হচ্ছে।

নীলার বাবা নাজিম উদ্দীন বাড়িতে এসেই হাকডাক শুরু করেন।নীলা বাইরে আসতেই তিনি নীলাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
‘আল্লাহ আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে নীলা।তুই ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিস।’

‘আমি তো জানতাম নীলার আব্বু, আমাদের ঘরে আল্লাহ এক মেধাবী মেয়েকে পাঠিয়েছে।আজ দেখ আমাদের মেয়ে কত ভাগ্যবতী এত কষ্ট করে বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল।’

মা-বাবার কথা শুনে নীলা অবাক হয়ে যায়।একটা সামান্য বিশ্ববিদ্যালয়েই তো চান্স পেয়েছে এতো খুশি হওয়ার কি আছে।নীলা তো ছোটবেলা থেকেই ভালো ভালো স্কুল,কলেজে পড়েছে নিজের পৃথিবীতেও সে ভালো একটি ভার্সিটিতে পড়ত।যদিও নীলার পড়াশোনায় কোন মন ছিল না আর সে কোনদিন ভালো রেজাল্টও করেনি।বাবার টাকার জন্যই সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে।

তবে আজ নীলা বুঝতে পারছে যাদের কাছে কিছু নেই তাদের কাছে এসব কতটা আনন্দের।আজ নীলা অন্যরকম তৃপ্তি অনুভব করছে।
৪.
‘এতো রাতে তোর বাড়ি ফেরার সময় হলো রায়হান?’

‘আম্মু, তুমি এত বিরক্ত করো কেন? আমার ব্যাপারে নাক গলাতে বুঝি তোমার এত ভালো লাগে।নিজের কাজে মন দাওনা।’

‘মৌসুমীর সাথে কথা বলেছিস?’

‘কেন? মৌসুমীর সাথে কি কথা বলব?’

‘সে-কি তুই জানিস না তোর আব্বু তোর সাথে মৌসুমীর বিয়ে ঠিক করেছে?’

‘হোয়াট ননসেন্স।আমার পারমিশন না নিয়ে আব্বু আমার জীবনের এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে? আমার এসব বিয়ে-শাদিতে কোন ইন্টারেস্ট নেই।আমি জাস্ট স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে চাই।’

‘আমার টাকায় খেয়ে-দেয়ে তুমি স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারো না রায়হান।’

রমিজ চৌধুরীর কথাটা শুনে রায়হানের খুব বিরক্তি লাগে।রায়হানের সাথে তার মা-বাবার সম্পর্ক ভীষণ জঘন্য।ছোটবেলা থেকেই রায়হান সব সুযোগ সুবিধা পেয়ে অনেকটা ছন্নছাড়া হয়ে গেছে।রমিজ সাহেব ছোটবেলা থেকে কাজে ব্যস্ত তাই তার সাথে রায়হানের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।রায়হানের মা মনোয়ারাও ছোটবেলা থেকে তাকে শাসনে রাখার বৃথা চেষ্টা করে।তাই তাদের সাথে রায়হানের সম্পর্ক তলানীতে এসে ঠেকেছে।

‘আমাকে যখন জন্ম দিয়েছ আমার দায়িত্ব তোমাদের নিতে হবে।বাট আমি কখন বিয়ে করব সেটার ডিশিসন আমি নেব তোমরা না।আমাকে তো রাজীব ভাইয়া পাওনি যে তোমাদের কথায় উঠব বসব।’

কেয়ারলেস ভাব নিয়ে নিজের রুমে চলে যায় রায়হান।

তবে রায়হান নিজেও খুব চিন্তিত ছিল কারণ সে তার বাবাকে চেনে।তিনি যখন একবার বলেছেন বিয়ে দেবেন তখন তিনি রায়হানের বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন।

রায়হান বসে বসে ভাবতে থাকে কিভাবে বিয়ের প্ল্যান মাটি করবে।সারারাত ভেবেও সে কোন উপায় খুঁজে পায়না।

৫.
সকালে আমিনার ডাকে ঘুম ভাঙে নীলার।একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠে নীলা দেখে এখনো সে অন্য পৃথিবীতেই আছে।

‘তাড়াতাড়ি ওঠ নীলা।আমাদের তো কাজে যেতে হবে।আর মাত্র ক’টা দিন তোর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হলেই তোকে আর কাজে যেতে হবে না।’

নীলা আমিনার সাথে চৌধুরী বাড়িতে চলে যায়।একেবারে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে।আজ রায়হান আর মৌসুমীর বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা হবে।তাই অনেক রান্না করতে হবে।এসির বাতাসে এসে নীলা আনন্দ খুঁজে পায়।তার ইচ্ছে করছিল এই বাড়িতেই থাকার।

কিন্তু আমিনা বেগম তাকে যখন রান্নায় সাহায্য করতে বলে তখন তার মাথা ঘুরে যায়।জীবনে কোনদিন রান্নাঘরের পাশ দিয়ে হাটেনি আর আজ কিনা এতগুলো রান্না করবে।

কোন উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে সবজি কা’টতে শুরু করে।কিন্তু কিভাবে কি করবে বুঝতে পারে না।শেষে নিজের হাতই কে’টে ফেলে।অনেক রক্ত বের হতে থাকে।

রায়হান দৌড়ে এসে নীলার হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়।রায়হানকে দেখে নীলার খুব ভালো লাগছিল।যদিও নিজের পৃথিবীতে রায়হানকে একেবারেই সহ্য করতে পারতো না কিন্তু এই পৃথিবীর রায়হানের এটিটিউড,কেয়ারিং,স্মাটনেস সব তাকে আকর্ষিত করে।সে রায়হানের মধ্যে ডুবে যায়।

‘সাবধানে কাজ করুন।সবসময় কিন্তু আমি থাকব না ব্যান্ডেজ করার জন্য।’

রায়হানের কথায় নীলার ঘোর কা’টে।

আমিনা নীলার অবস্থা দেখে তাকে আর কোন কাজ করতে দেয়না।

খাবার রান্না হলে তিনি নীলাকে পরিবেশন করতে বলেন।নীলা পরিবেশন করতে গেলে রমিজ চৌধুরী মৌসুমী আর রায়হানের বিয়ের ঘোষণা করেন।

তখন রায়হান বলে,’আমি এই বিয়ে করতে পারব না।কারণ আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি।’

‘কাকে ভালোবাসো তুমি?’

রমিজ চৌধুরীর কথা শুনে রায়হান উঠে এসে নীলার হাত ধরে বলে ‘আমি নীলাকে ভালোবাসি।’
চলবে…….