অন্য পৃথিবীর পর্ব-০১

0
548

#অন্য_পৃথিবীর
#প্রথম_পর্ব
#লেখিকা_দিশা_মনি

১.
নীলা একটি নাইট ক্লাবে বান্ধবীদের সাথে ছিল।নাইট ক্লাবে সে আনন্দে মত্ত।অবশ্য হবে নাই বা কেন? বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে।সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নিয়েছে।যখন যা চেয়েছে পেয়েছে।কোন কিছুর অভাব নেই।তাই সাধারণ মানুষের ঘর চালানোই যখন বিলাসিতা তখন সে এসবে ব্যস্ত।নাইট ক্লাব থেকে ফেরার সময় সে তার বান্ধবীদের বলছিল,

‘এই দেখ আমার নতুন গাড়ি।কালই কিনেছি।এটা লিমিটেড এডিশন।দেশে মাত্র দুইরকম এমন গাড়ি আছে।যার মধ্যে একটি আমার।ভাবা যায়!’

নীলার বান্ধবীরা বলে,
‘ওয়াও নীলা।তুইতো খুব লাকি রে।আমার তো মাঝে মাঝে তোকে দেখে হিংসা হয়।’

‘হবেই তো আমার মতো ভাগ্য তো আর কারোর নেই।’

‘আরে রায়হান ভাই না।এদিকেই তো আসছে।’

হঠাৎ রায়হানকে দেখে নীলা খুবই বিরক্ত হয়।তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই নীলাকে একতরফাভাবে ভালোবেসে গেছে।কিন্তু নীলা বড়লোকের মেয়ে হওয়ায় সাহস করে বলতে পারেনি।

রায়হান মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে।রায়হানকে নীলা তাই কখনো পছন্দও করেনি।কিছুদিন আগেই রায়হান নীলাকে প্রপোজ করেছিল।কিন্তু বিনিময়ে জুটেছিল তিরস্কার।নীলা এমনকি তাকে ভার্সিটির সবার সামনে ছোটলোকের বাচ্চা বলে বাপ মা তুলে গালি দেয়।

রায়হান এগিয়ে এসে বলে,
‘তোমরা সবাই এখানে!’

‘হ্যাঁ তো তুমি কেন এসেছ? সেদিন এত অপমান করলাম তাও লজ্জা নেই।আবার চলে এসেছ।অবশ্য ছোটলোকদের আবার লজ্জা!’

‘মুখ সামলে কথা বলো নীলা।তোমার বাবার অনেক টাকা থাকতে পারে।কিন্তু আমি তোমার বাবার টাকায় খাইনা যে আমায় কথা শোনাবে।’

এরপর রায়হান সেখানে উপস্থিত সবাইকে তার বিয়ের কথা বলে।
‘মেয়েটি খুব ভালো।আমাদের মতোই মধ্যবিত্ত।কিন্তু অনেক সুন্দরী আর সুশিক্ষিত।আমি বলেছি সুশিক্ষিত।কারণ শুধু পড়াশোনা করলেই শিক্ষিত হওয়া যায়না অনেক জ্ঞানও লাগে।’

নীলা তার কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছিল।তাই গাড়ি চালিয়ে তার সামনে দিয়ে চলে যায়।সে চলে না যাওয়া পর্যন্ত রায়হান তাকিয়ে থাকে।

এদিকে নীলা গাড়িতে করে যাওয়ার সময় তার বয়ফ্রেন্ড রকি তাকে ফোন করে।রকির সাথে কথা বলায় সে এত মগ্ন ছিল যে কখন তার গাড়ির সামনে একজন লোক চলে আসে সে খেয়ালই করেনি।

নীলা এই ঘটনায় ভয় পেয়ে যায়।সে লোকটাকে সাহায্য না করে পালিয়ে যায় সেখান থেকে।এরপর বাড়িতে এসে খেতে বসে।তখনই সেখানে চলে আসে তার মা আমিনা বেগম।

‘এত রাতে বাড়ি ফিরলি যে? কোথায় ছিলি?’

‘তোমাকে কেন বলব? তুমি বোঝ কিছু? ছিলে তো গ্রামের মেয়ে।ভাগ্য ভালো আমার বাবা তোমায় বিয়ে করে এনেছে তাই এত বড়লোক বাড়ির বউ হতে পেরেছ।যাও তো আমায় বিরক্ত করোনা।’

‘মায়ের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় জানিস না।অবশ্য তুই জানবিও বা কি করে? বাবার আদরে একদম বাদর হয়ে গেছিস।তাড়াতাড়ি খেয়ে নে’

নীলা আর কথা না বলে খেয়ে নেয়।কিন্তু খাবার অর্ধেক রেখেই সে উঠে যায়।

আমিনা বেগম বলেন,
‘কিরে এখনো তো অনেক খাবার বাকি আছে খাবি না?’

‘আমার পেট ভরে গেছে আম্মু।ওগুলো ফেলে দাও।’

‘এই পৃথিবীতে কত মানুষ না খেয়ে থাকে তুই জানিস।আর তুই বলছিস ফেলে দিতে।’

নীলা আর কোন কথা না বলে চলে যায়।

আমিনা বেগম আক্ষেপের সুরে বলে, ‘মেয়েটাকে মানুষ করতে পারলাম না।’

অন্যদিকে নীলা রাতে হেডফোন চালিয়ে গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতে পারেনি।
সেই রাত ছিল অদ্ভুত রাত।

আমিনা বেগম রেডিওতে শোনেন।
আজ রাতে চাঁদ ও পৃথিবী খুব কাছাকাছি চলে আসবে।আজ খুব বিশেষ একটি দিক।আজ নাকি অন্য পৃথিবীর দরজা খুলে যায়।এসব শুনে আমিনা বেগমের খুব হাসি পায়।অন্য পৃথিবী আবার কি?

২.
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে অবাক হয়ে যায় নীলা।রাজপ্রাসাদ থেকে হঠাৎ এই কুড়েঘরে কিভাবে চলে এলো সেটাই সে ভেবে পাচ্ছিল না।

আমিনা বেগম তার সামনে এসে বলে,
‘উঠেছিস নীলা।চল কাজে চল।’

‘আম্মু।তুমি এসব কেমন ছেড়া পোশাক পড়েছ? আর কাজে যাব মানে? কিসের কাজ?’

‘তুই কি স্মৃতি হারিয়ে ফেললি নাকি? আমরা তো প্রতিদিনই চৌধুরী বাড়িতে কাজে যাই।’

‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? আমাদের কি কোনকিছুর অভাব আছে নাকি? যে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে যাব।আমাদের বাড়িতেই তো কত কাজের লোক।’

‘আমার মনে হয় তোর স্মৃতিশক্তি সত্যিই হারিয়ে গেছে।আর বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি চল।’

নীলার কাছে সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছিল।কিন্তু এটা কেমন স্বপ্ন? এমন স্বপ্ন কেউ আবার দেখে?

নীলা আর বেশি না ভেবে আমিনার সাথে চলে যায়।নীলা বারবার ভাবছিল সে কোন স্বপ্ন দেখছে।ঘুম ভাঙলেই সব শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু এই স্বপ্ন যেন কিছুতেই শেষ হতে চায়না।

নীলা আমিনা বেগমের সাথে চৌধুরী বাড়ি গিয়ে দেখে অনেক বড় একটা বাড়ি।একদম নীলাদের বাড়ির মতো।হঠাৎ পিছন থেকে গাড়ির আওয়াজ পেয়ে সরে যায় নীলা।গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলে রায়হান।

রায়হানকে দেখে নীলা অবাক হয়ে যায়।কি হচ্ছে এসব? রায়হান তো মধ্যবিত্ত ছিল হঠাৎ এত ধনী হলো কিভাবে? রায়হানের দিকে তাকিয়ে এটাই ভাবতে থাকে নীলা।

নীলাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রত বোধ করে রায়হান।সে বলে,
‘আমার দিকে এভাবে তাকাবেন না প্লিজ।মেয়েদের তাকানোতে আমার এলার্জি আছে।’

নীলা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না।হঠাৎ রায়হানের গাড়ির রেডিওতে শুনতে পায়,

‘গতকাল রাত ছিল বিশেষ একটি রাত।গতকাল চাঁদ এবং পৃথিবী খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল।কিছু জ্যোতিষী ধারণা করেন যে এই রাতে এই পৃথিবীর কোন এক মানুষ অন্য পৃথিবীতে চলে যায় এবং অন্য পৃথিবীর কোন এক মানুষ এই পৃথিবীতে চলে আসে।’

রেডিওর কথাগুলো শুনে রায়হান হেসে বলে,
‘হোয়াট আ ভোগাস থিংক।’

নীলা এতক্ষণে বুঝতে পারে তার সাথে আসলে কি হয়েছে।সে তার পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে চলে এসেছে।নীলার পায়ের নিচের মাটি সরে যায়।সে বিভিন্ন মুভিসিরিজে প্যারালাল ইউনিভার্স সম্পর্কে দেখেছে এই পৃথিবীতে সবকিছু পরিবর্তন হয়।তার মানে এখন তাকে সারাজীবন এই অন্য পৃথিবীতে গরীব হয়ে থাকতে হবে! ভাবতেই নীলা বলে ওঠে,
‘এটা হতে পারে না।’

আমিনা এবং রায়হান তার কথা শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

নীলা দৌড়ে পালিয়ে যায়।যদিও সে বুঝতে পেরেছে তার সাথে যা হচ্ছে সব সত্য ঘটনা কিন্তু তার মন মানতে চাইছে না।সে বারবার নিজেকে বোঝাতে চাইছে এইসব সে স্বপ্ন দেখছে কিন্তু তার মন কিছুই মানতে চাচ্ছে না।দৌড়াতে দৌড়াতে সে কখন একটি গাড়ির সামনে চলে আসে বুঝতেই পারেনি।মুহুর্তেই একটি গাড়ির ধাক্কায় সে ছিটকে পড়ে।
এরপর তার দুচোখে অন্ধকার নেমে আসে।যতক্ষণ তার জ্ঞান ছিল ততক্ষণ সে এইসব কিছুকে স্বপ্নই ভাবে এবং মনে করে জ্ঞান ফিরলেই বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে।
চলবে….