#অপরাজিতা_২(অপরাজিতা গল্পের পরের অংশ)
#৩য়_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
রাজিতা ফ্রেস হয়ে বেডশিট চেঞ্জ করে শুতে যাবে তখন আনান ল্যাপটপে কাজ করছিলো৷ ল্যাপটপের দিক থেকে মুখ না ঘুরিয়েই আনান রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“একটু কিছু রান্না করতে পারবে? খুব ক্ষুধা লেগেছে!”
রাজিতা আনানের দিকে এগিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলতে লাগলো,
–“আনান সাহেবের আবার ক্ষুধাও লাগে বুঝি! তা কি রান্না করবো মিস্টার ক্ষুধার্ত বাবু!”
–“দেখো ক্ষুধা লাগতেই পারে! এতে অবাক হওয়ার কি আছে! রান্না করতে পারলে যাও! আর না হলে চুপচাপ শুয়ে পড়ো!”
রাজিতার নিজেরও ক্ষুধা লেগেছিল৷ তাই রান্না ঘরে গিয়ে পাস্তা রান্না করে নিয়ে আসলো৷ খাবারের ট্রে আনানের সামনে রেখে বলল,
–“এই নিন মহারাজা! আপনার খাবার! এর বেশি আমি এখন আরকিছু করতে পারলাম না!”
–“আচ্ছা এবার খেয়ে নাও! আমার ক্ষুধা নেই! তোমার জন্য বললেতো আর এখন রান্না করতে না! তাই আমার কথা বলেছি!”
রাজিতা রেগে গিয়ে বলল,
–“তুমি একটা খারাপ লোক! এতরাতে আমাকে দিয়ে রান্না করালে! আমি কত ক্লান্ত! দয়ামায়া কিছুই নেই!…..এতই যদি আমাকে খাওয়ানোর শখ নিজে রান্না করলেই পারতে!”
শেষের কথাগুলো রাজিতা আস্তে-আস্তে বলল।আনান ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
–“কিছু বললে আমাকে! আমি রান্না করে তোমাকে খাওয়াবো! দিবাস্বপ্ন দেখো!”
কথাটা বলতেই রাজিতা ওকে পাস্তা খাইয়ে দিয়ে হাসতে থাকে। ওর হাসি দেখে আনান নিজেও হেসে ফেলে।
তারপর রাজিতা মনে-মনে ভাবতে থাকে,’আজ হোক বা কাল! রান্নাতো আমি তোমাকে দিয়ে করাবোই মিস্টার ভাবওয়ালা!’
সকালে আনান রাজিতাকে ওর চাচার বাসায় রেখে ভার্সিটিতে চলে গেলো আর বলল,
–“আমি ক্লাস শেষ করে ওখান থেকে সোজা নিশাদদের ওখানে চলে যাবো৷ তুমি ওদের সাথে চলে যেও। ”
–“আচ্ছা ঠিক আছে। তবে তুমি দেরি করবে না কিন্তু! তাড়াতাড়ি চলে আসবে!”
আনান একটা হাসি দিয়ে বলল,
–“আরে বাবা বললামতো তাড়াতাড়ি আসবো। তোমাদের জুনিয়র ব্যাচের একটা ক্লাসটেস্ট না থাকলে আজকেও যেতাম না! কি আর করার বলো!”
–“ওকে! একদিন ভার্সিটিতে না গেলে কিছু হবেনা! এটা তোমাকে কে বোঝাবে! আচ্ছা যাও! বায়..”
কথাগুলো বলেই রাজিতা ওর চাচার বাসায় ঢুকলো। আর আনান ভার্সিটির দিকে চলে গেলো।
রাজিতারা নিলাকে নিতে চলে এসেছে। আনান এখনো আসেনি। ওর কেন যেন ভালো লাগছে না এখানে।
রাজিতা এক জায়গায় চুপচাপ বসে ছিলো৷ অনেকক্ষণ ধরে দেখছে যে, একজন মহিলা ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ রাজিতার অস্বস্তি লাগলো তাই ও উঠে আরেক জায়গায় চলে গেলো যেখানে নিলা আর রিমিরা ছিলো৷ কিন্তু একটু পর মহিলাটা ওখানে গিয়েও উপস্থিত! রাজিতা রিমিকে ডেকে ওর কানে-কানে বলতে লাগলো,
–“দেখ রিমি ওই মহিলাটা তখন থেকে আমার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে! এখানে এসেছি তাও পিছু নিয়েছে! উনার মতিগতি আমার ভালো ঠেকছে না!”
রিমি ওর কথা শুনে হাসতে-হাসতে রাজিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে লাগলো,
–“তোকে মনে হয় উনার খুব পছন্দ হয়েছে! ছেলে-টেলে আছে হয়তো! তাই ওমনভাবে দেখছে! আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করবো নাকি! ”
–“তোর সবকিছু ফাইজলামি মনে হয় নাকি! আমি সত্যিই বলছি! ওই মহিলাটা আমাকেই দেখছে! দেখ এখনো কেমন তাকিয়ে আমাদের কথা বলা দেখছে!”
–“আরে ভাই আমিওতো সত্যিই বলছি! দেখবি একটু পর এসে তোর নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করবে! তারপর জিজ্ঞেস করবে তুই বিবাহিতা কিনা! ”
–“তোকে বলাই আমার ভুল হয়েছে!”
–“শোন, যদি জিজ্ঞেস করে যে তুই বিবাহিতা কিনা তাহলে কিন্তু বলবি যে, তুই অবিবাহিতা! তারপর দেখ কি হয়!”
বলেই রিমি এবার জোরেশোরে হাসতে লাগলো৷ ওকে হাসতে দেখে নিলা ধমক দিয়ে বলল,
–“এই রিমি চুপ করবি! নতুন আত্মীয় বাড়ি এসে কেউ এভাবে হাসে! ভদ্রভাবে থাকতে পারছিস না!”
ঠিক তখনি ওই মহিলাটা ওদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। রাজিতারতো ভয়ে হাত-পা অবশ হয়ে আসছে!
মহিলাটা একদম রাজিতার সামনে এসে থামলো। তারপর মুখে একটা হাসি নিয়ে রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“তোমার নাম কি মা?”
রাজিতা প্রথমে আশেপাশে তাকালো। তারপর নিজের ডানহাতের শাহাদাত আঙুল নিজের দিকে নিয়ে অবাক চোখে বলল,
–“জ্বি! আমি?”
মহিলাটি এইবার একটু লম্বা হাসি দিয়ে বলল,
–“হ্যাঁ, তুমি! তোমার নাম কি? ”
রাজিতা এইবার আমতা-আমতা করে বলল,
–“জ্বি আমার নাম রাজিতা! আপনি?”
এইকথা বলে ও রিমির দিকে তাকালো। রিমি ওর পাশ থেকে মিটিমিটি হাসছে।
–“তুমি কি কনেপক্ষের লোক?”
মহিলাটির কথা শুনে রাজিতা উনার দিকে তাকালো। তারপর উত্তর দিলো,
–“জ্বি ”
–“তোমরা কয় ভাইবোন?”
–“জ্বি, আমি একাই। আমার কোনো ভাইবোন নেই।”
–“তোমার বাবা-মা কি করেন?”
রাজিতা এইবার কন্ঠটা একটু ভারি করে বলল,
–“আমি ছোট থাকতেই উনারা মারা গেছেন।”
মহিলাটাও ওর সাথে মনটা একটু খারাপ করে বলল,
–“সরি! তুমি কোথায় থাকো? মানে বড় হয়েছো কোথায়?”
–“আমার চাচ্চুর কাছে৷ ”
–“ওহ আচ্ছা, নতুন বউ তোমার কি হয়?”
–“চাচাতো বোন।”
রাজিতা এইবার বিরক্ত হয়ে গেছে প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে। কিন্তু বয়স্ক একজন মহিলা! কিছু বলতেও পারছে না! ও বারবার রিমির দিকে তাকাচ্ছে। আর রিমি মিটিমিটি হাসছে ওকে দেখে।
–“তোমার কি বিয়ে হয়েছে?”
মহিলাটির এই প্রশ্ন শুনে রাজিতা ভয় পেয়ে গেলো। তাহলে রিমির কথাটাই ঠিক মনে হয়! ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিমি এসে বলল,
–“না আন্টি, আমার বোনের বিয়ে হয়নি! কোনো ভালো ছেলে থাকলে বলতে পারেন!”
উনি এইবার একটা হাসি দিয়ে রিমির দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“আর তুমি?”
রিমি বলল,
–“আমি ওর আরেক বোন।মানে চাচাতো বোন আর কি!”
–“ছেলেতো কতই আছে! তবে আমি ওকে সেজন্য এসব জিজ্ঞেস করছি না! আসলে আমার একটা মেয়ে ছিলো সে তোমার বোনের মতই দেখতে ছিলো কিছুটা!”
মহিলাটার কথা শুনেই রাজিতা আনমনে বলে উঠলো,
–“সুবহা?”
রাজিতার মুখে ‘সুবহা’ নাম শুনে ওই মহিলা আর রিমি দুজনেই অবাক হয়ে গেলো৷ মহিলাটা তাড়াতাড়ি করে বলল,
–“তুমি চিনতে নাকি আমার মেয়েকে?”
রিমিও বলে উঠলো,
–“রাজি? তুই উনার মেয়েকে চিনিস?”
রাজিতা একটা ঢোক গিলে বলল,
–“দেখিনি কখনো! গল্প শুনেছি! ”
এমন সময় নিশাদের ছোটবোন রিমা এসে রাজিতাকে বলল,
–“রাজিতা ভাবি, ভাইয়া এসেছে। আপনাকে খুঁজছে!”
রিমার রাজিতাকে ভাবি ডাকা শুনে মহিলাটি বললেন,
–“তুমি বিবাহিতা? ”
রিমি কিছুটা লজ্জা পেলো৷ রাজিতাও লাজুক চোখে রিমির দিকে তাকালো তারপর মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
–“সরি আন্টি! রিমি আপনার সাথে মজা করেছে!আমি আসছি একটু!”
–“আচ্ছা যাও।”
তারপর রাজিতা ওখান থেকে চলে যেতেই সুবহার মা রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“তোমার বোনতো বিবাহিতা! তা ছেলে কি তোমার নিজের জন্য খুঁজছিলে তাহলে?”
বলেই উনি হেসে ফেললেন৷ রিমিও লজ্জা পেয়ে ওখান থেকে চলে গেলো।
আনান রাজিতার জন্য একটা ফুলের মালা কিনে এনেছে। রাজিতাকে দেখতে পেয়েই রাজিতার চুলে ফুলের মালাটা গুজে দিতে লাগলো। রাজিতা বলল,
–“এতক্ষণে আসার সময় হলো! আমি তখন থেকে অপেক্ষা করছি!”
আনান রাজিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
–“আমার রাজ্যটা রাজাকে খুব মিস করছিলো মনে হয়!”
ঠিক তখন সুবহার মা ওখানে এসে আনানকে দেখে চমকে গেলো৷ উনি আনানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
–“আনান?”
আনান আর রাজিতা কিছুটা সরে দাঁড়ালো। ওখানে আরো অনেকেই ছিলো। রাজিতা মহিলাটাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“আন্টি, আপনি আনানকে চিনেন? ”
কথাটা বলার পরেই ওর মনে পড়লো যে, আনানতো উনার মেয়ের বয়ফ্রেন্ড ছিলো। চিনতে পারার-ই কথা!
–“সরাসরি কখনো দেখিনি। সুবহার ফোনে ছবি দেখেছিলাম। আর ওর মুখে অনেক গল্প শুনেছি। আমিতো ভেবেছিলাম সুবহার পর আর কাউকে ভালই বাসতে পারবে না! কিন্তু দেখো!”
কথাটা বলতেই উনার চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। উনি সেটা মুছে হাসার চেষ্টা করে বলল,
–“এতে ওর দোষটাই বা কোথায়! মানুষের জীবনটাই যে এমন বিচিত্রময়! কারোর জন্য কারোর জীবন কি আর থেমে থাকে! আমাকেই দেখো! মেয়েটাকে ভুলে কি সুন্দর সেজেগুজে দাওয়াতে এসেছি! হাসছি! সবার সাথে গল্প করছি!”
আনান মাথাটা নিচু করে রেখেছে৷ সুবহার মায়ের সাথে এত বছর পর এভাবে দেখা হবে এটা ও ভাবতেই পারেনি। রিমি রাজিতাকে খুঁজতে-খুঁজতে ওখানে চলে এসেছিলো। রিমি উনার কথার কোনো মানে না বুঝতে পেরে সুবহার মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“আন্টি আপনি আনান ভাইয়ার ছবি দেখেছেন? মানে আনান ভাইয়া আর সুবহা…. ”
এটুকু বলতেই উনি রিমিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–“তুমি যা ভাবছো তা নয় মা! ওরা দুজন দুজনকে পছন্দ করতো।এইটুকুই! রাজিতা, কিছু মনে করো না মা! এখনতো আমার মেয়ে নেই! আর আনান অনেক ভালো ছেলে! সুবহা বলতো মাঝেমধ্যে ওর কথা। নিশাদ আমাকে জানায়নি যে, আনান বিয়ে করেছে তাও আবার সুবহার মতো…. ”
এটুকু বলে উনি ওখান থেকে চলে গেলেন। রাজিতাকে দেখে উনি খুশি হয়েছিলেন৷ তবে আনানের সাথে রাজিতাকে দেখে উনার মেয়ের কথাটা খুব বেশি মনে পড়ে যায়। আজ উনার মেয়ে থাকলেও হয়তো আনানকে বিয়ে করতো! আনান ওকে এভাবে খেয়াল রাখতো!
উনি চলে যেতেই রিমি রাজিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
–“তারমানে আনান ভাইয়া সব জেনেই তোকে…আর তুইওতো সুবহাকে চিনিস! তারমানে তোরা দুজন মিলে..”
রাজিতা তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলো,
–“না রিমি, তুই যা ভাবছিস তা নয়! আমিতো কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছি!”
আনান একদম চুপ হয়ে আছে। সুবহার মাকে দেখে ওর একটু কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই!
নিয়ন এসে আনান আর রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“তোরা কি এখানে দাঁড়িয়েই গল্প করবি নাকি! নিশাদ ডাকছে চল৷ কিছু খাওয়া-দাওয়া করে বিদায় হই!…. এভাবে পুতুলের মতো সবকটা দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? ”
রিমি রাজিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
–“তোর সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে!”
চলবে….?