#অপরাজিতা_২(অপরাজিতা গল্পের পরের অংশ)
#৪র্থ_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
সুবহার মায়ের কথাগুলো শোনার পর থেকে আনান আর রাজিতা দুজনের-ই মন খারাপ। আনানের রাজিতার জন্য বেশি মন খারাপ হচ্ছে৷ কোনো মেয়েই তার স্বামীর আগের প্রেমিকা বা বউয়ের কথা শুনে খুশি হবে না!
খাওয়ার সময় আনান রাজিতাকে এটা-সেটা তুলে দিচ্ছিলো। কিন্তু রাজিতা একটু খেয়েই উঠে পড়লো। ওকে উঠতে দেখে নিয়ন বলে উঠল,
–“কিরে রাজি! আমাদের রেখেই উঠে যাচ্ছিস! অন্তত আনানের খাওয়া শেষ করতে দে।”
রাজিতা আস্তে করে বলল,
–“আমার খাওয়া হয়ে গেছে, শুধু-শুধু বসে থাকার কি দরকার! আপনারা খেয়ে আসুন।”
বলেই ওখান থেকে চলে গেলো রাজিতা। আনানও খাওয়া রেখেই উঠে গেলো। নিয়ন অবাক হয়ে রিমিকে বলল,
–“রাজিতা আর আনানের মধ্যে কোনো ঝগড়া হয়েছে নাকি? তুই জানিস কিছু?”
রিমি খাবার চিবুতে-চিবুতে উত্তর দিল,
–“আমি কি করে জানবো! রাজিতা আমাকে বললেতো! আরে কিছুই হয়নি! বাদ দাওতো! হয়তো আনান ভাইয়ার আসতে লেট হয়েছে! তাছাড়া আর কি!”
–“ঝামেলা না হলেই ভালো! মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে! আর যেন কষ্ট না পেতে হয়!”
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিয়ন।
আনান কিছুক্ষণ খোঁজার পর রাজিতাকে খুঁজে পেলো৷ একপাশে একা দাঁড়িয়ে আছে৷ আনান পেছন থেকে গিয়ে বলল,
–“তুমি কি রাগ করেছো আন্টির কথায়? দেখো আমি এর আগে কখনো আন্টিকে দেখিনি! আমি জানতাম না যে আজ উনি এখানে আসবে!”
আনানের কথা শুনে রাজিতা চমকে পিছনে তাকায়৷ তারপর আনানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“আন্টির কথায় রাগ করার কি আছে? উনিতো ঠিক-ই বলেছে তাইনা? কারোর জন্য কারোর জীবন থেমে থাকে না। আসলে আন্টির কথায় আমার বাবা-মায়ের কথাটা আজ খুব মনে পড়ছে! আমিওতো তাদের ছাড়া হাসি-খুশি আছি তাইনা? ”
–“সরি রাজিতা, আমি জানিনা কি বলে তোমাকে সান্ত্বনা দেবো। তবে এটুকু বলতে পারি যে, যারা চলে যায় তাদের আত্মাকে খুশি রাখার জন্য হলেও আমাদের ভালো থাকতে হয়! তোমার বাবা-মা তোমাকে খুশি দেখলে তাদের আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি পাবে!”
–“তুমিও কি সুবহার আত্মার শান্তির জন্যই আমাকে…”
এটুকু বলতেই আনান ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“দেখো রাজিতা, আমি তোমাকে আগেও বলেছি যে, তোমার সাথে আর কারোর তুলনা চলেনা। এমনকি সুবহারও না! তুমি আমার একমাত্র বউ! তুমিই আমার জীবনের অর্ধাঙ্গী! তুমি ছাড়া আমি আমার জীবন এখন কল্পনাও করতে পারি না! আমি জানিনা তুমি আমাকে কতটুকু বিশ্বাস করো। কিন্তু আমি তোমাকে…”
এটুকু বলতেই রাজিতা আনানকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে আর বলতে থাকে,
–“আমি যে এখন একমাত্র তোমাকেই বিশ্বাস করি! তুমি আর কখনো আমার এই বিশ্বাসের শহরটা ভেঙো না! তাহলে আমি যে নিঃস্ব হয়ে যাবো!”
তারপর আনান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে থাকে।
–“রাজিতা তোকে আমি তখন থেকে খুঁজছি আর তুই এখানে!…..সরি আনান ভাইয়া, আমি আপনাকে দেখতে পাইনি!”
রিমির কথা শুনে আনান আর রাজিতা দুজনে দুদিকে সরে যায়। তারপর রাজিতা আনানকে ঠেলে ওখান থেকে পাঠিয়ে দিয়ে চোখের পানিগুলো মুছে মুখে হাসি এনে বলে,
–“কি হয়েছে? সবাই বের হয়েছে যাওয়ার জন্য?”
রিমি রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে দুষ্ট একটা হাসি দিয়ে বলে,
–“বাব্বাহ ভালবাসা! যেখানে-সেখানে তোমাদের প্রেম জেগে ওঠে! লোকজন তোমাদের দেখলেতো রোমিও-জুলিয়েট ভাববে!”
রাজিতা লজ্জা পেয়ে বলল,
–“তুলনা করার আর কাউকে পেলিনা! ট্র্যাজেডি নাটকের নায়ক-নায়িকাকে টেনে আনলি! আমাদেরতো… ”
রিমি রাজিতাকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে-হাসতে বলল,
–“হ্যাঁ, তোমাদেরতো রোমান্টিক লাভ-স্টোরি!”
–“আচ্ছা হয়েছে৷ খুঁজছিলি কেন সেটা বল। ”
–“বললাম না তোকে একটা কথা বলার আছে।”
–“হ্যাঁ বল, কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা! এমন গরু খোঁজার মতো করে খুঁজছিস আমায়!”
রিমি আশেপাশে দেখে নিয়ে বলল,
–“এই সুবহা আর আনান ভাইয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই মা আর নিলা আপুকে জানানো যাবেনা!”
–“কেন? কি হয়েছে? উনারা জানলে কি হবে?”
–“সরি রাজিতা! আমি তোর অগোচরে তোর কি কি ক্ষতি করেছি তার সবটা শুনলে তুই হয়তো আমায় কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবি না!”
রাজিতা রিমির কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। তারপর বলে,
–“তুই এসব কি বলছিস রিমি! তুই আমার ক্ষতি করেছিস? কই নিয়ন ভাইয়ার ব্যাপারটা ছাড়া আমারতো আরকিছু মনে পড়ছে না! কি বলছিস তুই এসব?”
–“তোর বিয়ের দিন আমি বাবা আর তোর শশুরের বলা কথাগুলো শুনে ফেলি।”
রাজিতা অবাকের চরম পর্যায়ে গিয়ে বলে উঠে,
–“মানে? তুইও সেদিন-ই জানতে পেরেছিলি যে, আনান পুরোপুরি সুস্থ?”
–“হ্যাঁ, আর তুই চলে যাওয়ার পরেই আমি মা আর নিলা আপুকে সবটা বলে দেই।”
–“কি বলেছিলি?”
–“আমি বলেছিলাম যে, তুই আর বাবা মিলে আনান ভাইয়াদের সাথে সব প্ল্যান করেছিলি আনান ভাইয়ার সাথে নিলা আপুর বিয়ে ভেঙে নিজে বিয়ে করার!কিন্তু নিলা আপু আর মা সেদিন আমার কথা বিশ্বাস করেনি! আর পরদিন যখন দেখলো যে, আমার কথাই ঠিক তখন…”
রাজিতা রিমিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–“আর সেজন্যই ছোট আম্মু আর নিলা আপু আমার আর আনানের সাথে ওমন ব্যাবহার করেছিলো?”
–“হ্যাঁ! আমাকে ক্ষমা করে দে রাজিতা! বিশ্বাস কর, এখন আমি তোর ভালো চাই! আর তাই চাইনা যে, এই বিষয়টা মা আর নিলা আপু জানুক৷ তাহলেতো আমার বলা মিথ্যাগুলোকে সত্যি ভেবে আবার তোকে ভুল বুঝবে!”
রিমির উপর রাজিতা ভীষণ রেগে যায়। কিন্তু কি বলবে বুঝতে পারে না। রিমি ওকে এত ঘৃণা করতো! এটা ভেবে ও অবাক হয়ে যায়! রিমি আর কিছু বলতে যাচ্ছিলো। রাজিতা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“প্লিজ রিমি তুই আমার সামনে থেকে এখন চলে যা একটু! আমাকে একটু একা থাকতে দে! সবাই যাওয়ার সময় আমাকে ডাক দিস!”
–“রাজিতা প্লিজ, আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা কর!”
–“প্লিজ রিমি! আমাকে একা ছেড়ে দে!”
রিমি ওখান থেকে গিয়ে আনানকে পাঠিয়ে দেয় রাজিতার কাছে৷ এটাও বলে দেয় যে, রাজিতার যেন খেয়াল রাখে একটু! আনান রাজিতার কাছে চলে যেতেই রিমি সুবহার মাকে খুঁজতে থাকে। উনি যদি নিলা বা ওর শশুরবাড়ির কাউকে সুবহা আর আনানের ব্যাপারটা বলে দেয়! ওর শুশুরবাড়ির কেউ নিশ্চয়ই এখনো জানেনা কথাটা! নইলে আনানকে দেখে সেদিন-ই বলে দিতো সবাইকে! আর নিলা জানলেতো কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিতে পারে!
সুবহার মাকে খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হয়না রিমির। সামনেই একটা ছেলের সাথে কথা বলছিল। রিমি ভাবে যে, ওটা হয়ত উনার ছেলে হবে। রিমি কিছু বলার আগেই সুবহার মা রিমিকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
–“এই যে মেয়ে! তোমার নান কি যেন? রিমি…”
রিমি উনাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
–“জ্বি আন্টি৷ আমি রিমি।”
–“হ্যাঁ, রাজিতা তোমাকে এই নামেই ডাকছিলো। মনে আছে।….দেখেছিসতো তোর ফুপি এতটাও মন ভোলা হয়নি এখনো! ”
পরের কথাগুলো উনি ওই ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলল৷ তারমানে ওইটা উনার নিজের ছেলে নয়। উনার ভাইয়ের ছেলে। রিমি কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে৷ নিজের ফুপির মুখে এমন কথা শুনে ছেলেটি হাসতে-হাসতে বলল,
–“আচ্ছা ফুপি আমি তোমাকে বলেছি যে, তুমি মনভোলা! আমিতো শুধু বলেছি যে তুমি…..”
এটুকু বলতেই উনি রিমিকে উদ্দেশ্যে করে বলল,
–“রিমি তুমিই বলোতো তোমার চাচাতো বোন রাজিতা দেখতে কিছুটা আমার মেয়ের মতো না?”
রিমি আমতা-আমতা করে বলল,
–“আসলে আন্টি আমিতো আপনার মেয়েকে দেখিনি! তবে আপনিই বলেছিলেন যে, ও দেখতে…”
–“আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি রাজিতাকে ডেকে আনো। রনক নিজে চোখেই দেখুক আমি ঠিক বলছি কিনা! আমার চোখ অতোটাও খারাপ হয়নি!”
–“ফুপি তুমি না! আমি কি ওভাবে কিছু বলেছি তোমাকে!”
ফুপু-ভাতিজা খুনসুটি করতে থাকে৷ আর এই ফাঁকে রিমি গিয়ে রাজিতাকে ডেকে আনে৷ রাজিতাকে দেখে রনকের মুখ হাঁ হয়ে যায়! সুবহার সাথে এই মেয়ের চেহারায় এত মিল কি করে থাকতে পারে!
আনান পাশে থাকায় রাজিতা রিমির সাথে চলে আসে৷ কিন্তু একটা ছেলে ওর দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছে দেখে ওর অস্বস্তি হতে থাকে! ও মাথা নিচু করে ফেলে। সুবহার মা নিজের ভাতিজাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“কি আমি বলেছিলাম না তোর চোখ কপালে উঠে যাবে একে দেখে! এইবার এই বুড়ীর কথা বিশ্বাস হলো!”
নিজের ফুপুর কথায় রনক রাজিতার থেকে চোখ নামিয়ে নেয়। আর মনেমনে বলতে থাকে,’ সুবহাকে আমি পাইনি! কিন্তু একে আমি হারাতে চাইনা! জাস্ট ওয়েট মাই কুইন! আমি তোমাকে আমার করেই ছাড়বো! এট এনি কস্ট’। তারপর নিজের ফুপিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“হ্যাঁ ফুপি তুমি ঠিক-ই বলেছিলে! কিন্তু কোন সম্পর্ক না থাকা সত্বেও দুটি মেয়ের চেহারা কি করে এক হতে পারে!”
–“আমিও এটাই ভাবছি! কীভাবে সম্ভব! ”
রাজিতা এবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটু শান্ত হয়৷ তারমানে সুবহার মতো দেখতে বলেই এই ছেলেটাও ওর দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে! রনক নিজের হাত বাড়িয়ে দেয় রাজিতার দিকে৷ তারপর বলে,
–“হ্যালো, আই এম রনক তাহমিদ জয় ৷ ইউ? ”
রাজিতা কিছু বলার আগেই আনান নিজের হাত রনকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
–“সি ইজ রাজিতা। মাই ওয়াইফ…”
রনক কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে আনানের সাথে হাত মিলায়৷ তারপর বলে,
–“আসলে আপনার ওয়াইফ দেখতে হুবহু আমার কাজিনের মতো! তাই…”
আনানও মুখে হাসি এনে বলে,
–“হ্যাঁ, বাট সরি টু সে দ্যাট, সে আপনার কাজিন নয়! ”
এরপর আনান আর রনক কথা বলতে থাকে৷ রাজিতা নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।
রিমি সুবহার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“আন্টি, আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে৷ একটু এদিকে আসবেন?”
সুবহার মা রিমির সাথে যেতেই রিমি কোনো প্রকার ভূমিকা ছাড়াই বলে উঠে,
–“নিশাদ ভাইয়ার পরিবারের কেউ কি জানে আনান ভাইয়া আর সুবহা আপুর কথা?”
–“কেন মা? তুমি হঠাৎ এসব কেন জিজ্ঞেস করছো?”
–“আগে বলুন না আন্টি? প্লিজ!”
–“আমি নিজেইতো কখনো আনানকে দেখিনি! ওরা চিনবে কি করে! আর আমি এসব কাউকে বলিওনি! সবাইতো জানে ওর বয়ফ্রেন্ডও ওর মতো সুইসাইড করে মারা গেছে!”
–“দেখুন আমি আপনার মেয়ের ব্যাপারে কিছুই জানিনা! সেটা না হয় পরে জেনে নেবো! কিন্তু আপনি প্লিজ এই ব্যাপারে কাউকে কিছু জানাবেন না! আপনার নাম্বারটা দিয়ে দিন, আমি আপনাকে সবটা পরে জানিয়ে দেবো!”
–“কোন ব্যাপারে? কি বলছো?আমিতো কিছুই বুঝছি না!”
–“কাউকে এটাই বলবেন না যে, আনান আর সুবহা আপুর রিলেশন ছিলো, আর রাজিতা দেখতে সুবহার মতই! ”
–“আচ্ছা ঠিক আছে বলব না। কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে কি?”
কেউ এসে পড়বে ভয়ে রিমি কি বলতে কি বলছে তা ও নিজেই জানে না! উনার কথা শুনে রিমি বলল,
–“ব্যাপারটা হচ্ছে….”
বলতেই রিমি থেমে যায়৷ ও দেখে যে ওর সামনেই নিলা দাঁড়িয়ে আছে! নিলা কখন এসেছে এখানে? ও কি পুরো কথা শুনে নিয়েছে? এসব ভেবেই অস্থির হয়ে পড়ে রিমি৷ তারপর ধীরপায়ে নিলার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে রিমি।
চলবে..?