অপরাজিতা ২ পর্ব-০৫

0
141

#অপরাজিতা_২(অপরাজিতা গল্পের পরের অংশ)
#৫ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

রাজিতাকে দেখে রনকের মনে ক্ষণিকের জন্য যে আশা জেগেছিলো আনানকে দেখামাত্র তা ধূলিস্যাৎ হয়ে গেলো। রনকের ভাগ্যটা আসলেই অনেক খারাপ! যাকেই ভালবাসে সেই ওকে ছেড়ে চলে যায়! ভেবেছিলো সুবহাকে না পেলেও সুবহার মতো দেখতে কাউকেতো পেয়েছে! কিন্তু সেটাও দেরি করে ফেলেছে! সে এখন অন্য কারোর সম্পত্তি!মনটা খারাপ হয়ে যায় রনকের!

নিলা রিমিকে খুঁজছিলো বাড়ি যাওয়ার জন্য৷ সে রিমি আর সুবহার মায়ের কথা কিছুই শুনতে পায়নি ভেবে রিমি হাফ ছেড়ে বাঁচলো!

সবাই বের হচ্ছে যাওয়ার জন্য। রিমি রাজিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

–“সরি রাজি! আমি সেদিন এইসব কিছুই জানতাম না। আমি ভেবেছিলাম যে, বাবা তোকে সবটা বলাতেই তুই বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলি! আসলে তখন পরিস্থিতিটাই এমন ছিল যে….”

–“কিরে তোরা দুজনে কি গুজগুজ করছিস!”

নিলার কথা শুনে থেমে যায় রিমি। তারপর আমতা-আমতা করে বলল,

–“কিছুনা! রাজিকে কত করে বলছি যে, আজ আমাদের ওখানে চল! ও কিছুতেই রাজি হচ্ছে না! ”

নিলা একগাল হেসে বলল,

–“আরে ভাই রাজি না হলেতো আর কিছু করার নেই! ছেড়ে দে ওকে! ”

রাজিতা তবুও কিছুই বলল না। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আনানের সাথে গাড়িতে উঠে বসল। নিলারাও ওদের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। গাড়িতে রাজিতা অনেক চুপচাপ ছিলো। আনান বুঝতে পারলো যে, ওর মনটা ভীষণ খারাপ। তাই আর কিছু বলল না। মাঝেমধ্যে চুপ থেকেই ভালবাসার মানুষটিকে সাপোর্ট করতে হয়!

রাত প্রায় ১টার বেশি বাজে। রাজিতার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ও দেখতে পায় যে, আনান শান্তিতে ঘুমাচ্ছে৷ কিছুক্ষণ ঘুমন্ত আনানের মুখের দিকে চেয়ে থেকে ওর কাল রাতের কথাটা মনে পড়ে যায়! অতোরাতে ওকে দিয়ে রান্না করিয়েছিলো! মনে পড়তেই হাসি পায় রাজিতার।

রুমের লাইটটা অন করে দেয় রাজিতা। তারপর আনানের কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে,

–“আনান, আনান,…. ”

কয়েকবার ডাকতেই আনান আস্তে করে চোখ খুলে। তারপর রাজিতাকে সামনে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে! আমতা-আমতা করে বলতে থাকে,

–“তুমি? ঘুমানো বাদ দিয়ে কি করছো? নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে? তখনতো কিছুই খেলে না! জানো যে, না খেয়ে থাকতে পারো না! তারপরেও না খেয়ে থাকবে! আমার কোনো কথা শুনলেতো! দেখো ফ্রিজে আইসক্রিম আছে, এখন ওটা খেয়েই রাত পার করো! ”

রাজিতা রাগী চোখে আনানের দিকে তাকায়। তারপর কাথাটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে আনানের পাশে৷ তারপর বলে,

–“আমি কি বলেছি যে, আমার ক্ষুধা পেয়েছে! ”

–“তাহলে এতরাতে ঘুম বাদ দিয়ে আমাকে কেন ডাকছো?”

–“আমার কি হলো না হলো সে খেয়াল তোমার আছে! নিজেতো আরামে ঘুমাচ্ছে! এদিকে মাথাব্যথায় আমি যে, সারারাত জেগে ছটফট করছি সেদিকে খেয়াল নেই!”

বলেই মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে রাজিতা৷ আনান ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে,

–“কিন্তু আমিতো তখন দেখলাম যে, তুমি ঘুমাচ্ছো! ”

–“এমনি চোখ বন্ধ করে ছিলাম! তুমি কি তা বোঝো নাকি! যাও তুমি ঘুমাও! আমার কথা ভাবতে হবে না!”

–“আচ্ছা বাবা! আমি মাথাটা টিপে দিচ্ছি তুমি ঘুমানোর ট্রাই করো! ”

কিছুক্ষণ মাথাটা টিপে দিতেই রাজিতার চোখে ঘুম নেমে আসে৷ রাজিতা ঘুমিয়েছে ভেবে আনান ওর হাত সরাতেই রাজিতা আবার বলে উঠে,

–“ঘুম আসছে না! এভাবে কাজ হবে না।”

–“আচ্ছা আমি দেখি মাথাব্যথার কোনো ওষুধ আছে কিনা!”

–“ওষুধে কাজ হবে না!”

–“তাহলে?”

রাজিতা হাসি চেপে রেখে বলে,

–“যদি সত্যি আমার মাথাব্যথা কমাতে চান তাহলে এক কাপ আদা-চা বানিয়ে আনুন!”

রাজিতার কথা শুনে আনান অবাক হয়ে যায়৷ তারপর বলে,

–“চা বানাবো? আমি? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি! আমি কখনো রান্নাঘরের ধারে-কাছেও যাইনি! আর আমি বানাবো চা? তাও আবার এতরাতে?”

–“আচ্ছা যেতে হবে না! আমার কষ্ট হবে তাতে তোমার কি!”

–“কিন্তু চা খেলেতো আরো ঘুম হবে না! বানানো না হয় বানালাম!”

আনানের কথা শুনে রাজিতা বলে উঠে,

–“ও মাগো! মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে! কেউ নেই আমাকে দেখার!”

তারপর মেকি কান্না জুড়ে দেয়। আনান ওকে শান্ত করে বলে,

–“আচ্ছা বাবা যাচ্ছি! তাও চুপ থাকো একটু! এতরাতে কেউ জেগে গেলে কি ভাববে! চা কীভাবে বানাবো?”

রাজিতা আনানকে বলে দেয় কীভাবে চা বানাতে হবে৷ আনান বিড়বিড় করতে-করতে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতেই রাজিতা হাসিতে ফেটে পড়ে। কাল ওকে দিয়ে রান্না করিয়েছে! আজ তার প্রতিশোধ নিবে! এতরাতে রান্না করতে কেমন লাগে বুঝুক একটু!

আনান অনেক কষ্টে এক কাপ চা বানায়৷ গরম কেটলি হাত দিয়ে ধরার কারণে হাতে সাথে-সাথেই ফোস্কা পড়ে যায়। তারপর চা-টা নিয়ে রুমে প্রবেশ করেই রাজিতাকে ডাকতে থাকে। কিন্তু রাজিতা তখন ঘুমে অচেতন!

আনান রাজিতাকে ডাকতে গিয়েও আর ডাকে না! ও ভাবে যে, মেয়েটা সারারাত ঘুমায়নি! মাত্র ঘুমিয়েছে! এখন আর ডেকে লাভ নেই! কিন্তু এত কষ্ট করে চা বানালো সেটাতো আর নষ্ট করা যায়না! তাই চা-টা আনান নিজেই পান করে নেয়।

চা খেয়ে সহজে আর ঘুম আসে না আনানের। রাজিতার উপরে রেগে ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাতেই ওর সব রাগ গলে পানি হয়ে যায়! এই মেয়েটার উপরে যে ও কখনো রেগে থাকতে পারবে না! এই মেয়েটার জন্য ও যেন সব করতে পারে! হাতের ফোস্কাটার দিকে নজর যেতেই আনান হেসে ফেলে আর নিজ মনেই বলে উঠে,”এটাও হয়তো ভালবাসার একটা চিহ্ন!”

সকালে নিজের মায়ের চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙে যায় আনানের। রাতে ঘুমাতে দেরি হওয়ায় উঠতেও দেরি হয়ে গেছে৷ রাজিতাও উঠে গেছে৷ ও চেঁচামেচি শুনে রান্নাঘিরের দিকে যেতেই ওর মায়ের ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনতে পায়,

–“নিয়তি তুই স্বীকার করে নিলেইতো হয় যে, রাতে কিচেন পরিষ্কার করিস নি! আমার মিথ্যা কথা একদম পছন্দ নয়! রাজিতাও কিচেনে আসেনি! আমিও আসিনি! তাহলে কি ভুত এসেছিলো! ”

নিয়তি ভয়ে-ভয়ে জবাব দেয়,

–“ভাবি আমি মিথ্যা কেন বলব? আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি রান্নাঘর পরিষ্কার করেছি৷ কিন্তু কীভাবে এমন হলো!”

–“আবার মিথ্যে! সত্যি বললেইতো আমি আর কিছু বলিনা! আচ্ছা বাদ দে! পরিষ্কার করে ফেল৷ অপরিষ্কার কোনোকিছু আমার একদম পছন্দ নয়! বিশেষ করে রান্নাঘর! পরবর্তীতে যাই ভুল করিস না কেন সত্যটা বলবি! একদম মিথ্যা বলবি না!”

আনান লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ওখান থেকে চলে আসতে গেলে রাজিতা ওকে দেখে ফেলে৷ তারপর মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,

–“মা আপনি শুধু-শুধু নিয়তি আন্টিকে দোষ দিচ্ছেন! আমি জানি রাতে কে এসেছিলো কিচেনে!”

ওর কথাশুনেই আনান ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,

–“কে? কে ঢুকেছিলো কিচেনে? তুমি কীভাবে জানবে! তুমিতো ঘুমাচ্ছিলে!”

রাজিতা আনানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,

–“আরে তুমি এখানে কি করছো? আর আমি ঘুমালে কি হবে আমি জানি কে এসেছিলো কিচেনে!”

আনানের মা গলা উচিঁয়ে বলে,

–“কে এসেছিলো? ”

–“একটা লম্বা,কালো, দাঁত বড়, নখ বড়, গরুর মতো চোখ, হাতির শুড়ের মতো নাক, আর গরুর লেজের মতো চুলওয়ালা রাক্ষস ঢুকেছিলো কিচেনে!”

বলেই হেসে ফেলে রাজিতা। আর রাজিতার কথা শুনে ওর শাশুড়ী আর নিয়তিও জোরে-জোরে হাসতে থাকে৷ আর আনান রাগে ফুসতে থাকে৷ তারপর রাজিতার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ওখান থেকে নিজের রুমে চলে যায়!

আনানের সাথে মজা করে রাজিতার মনটা ফুরফুরে হয়ে গেছে৷ কালকের কথাগুলো যেন সব ভুলে গেছে। আনান রাজিতার উপরে রাগ করলেও ওর হাসিমুখ দেখে সব ভুলে গেছে৷ তারপরেও ইচ্ছে করেই রেগে থাকার অভিনয় করছে রাজিতা ওর রাগ ভাঙানোর জন্য কি করে তা দেখার জন্য।

ভার্সিটি যাওয়ার সময়ও রাজিতা বারবার সরি বলতে লাগলো আনানকে৷ কিন্তু আনান মুখটা গম্ভীর করে রইলো৷ একটা কথাও বললো না রাজিতার সাথে।

গাড়ি থেকে নামতেই আনান আর রাজিতা বুঝতে পারলো যে, সবাই কেমন করে যেন তাকাচ্ছে ওদের দিকে৷ রাজিতা ভাবতে থাকে যে, ওর মুখে কিছু লেগে আছে কিনা! তারপর আনানকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিস করে বলে,

–“আচ্ছা আমাকে কি আজ আজব দেখাচ্ছে? মুখে কি কিছু আছে? ড্রেস কি এলোমেলো? ”

আনান ওর দিকে ভালো করে দেখে বলে,

–“সবতো ঠিক-ই আছে! সমস্যা কি? ”

–“দেখো সবাই আমাদের দিকে কীভাবে যেন তাকাচ্ছে! ”

–“আমাদের সৌন্দর্যে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেছে মনে হয়!”

বলেই মিষ্টি একটা হাসি দেয় আনান। রাজিতা ওর পিছনে হাঁটতে থাকে আর বলে,

–“আজগুবি! মানুষের খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই! আমাদের সৌন্দর্য দেখছে! দেখি আপনার মুখে আবার কিছু নেইতো!”

–“কি যে বলো না! যাও ক্লাসে যাও! ”

বলেই আনান ওর অফিসরুমে চলে যায়৷ ক্লাসের মধ্যেও সবাই রাজিতাকে কেমন চোখে দেখছে। তবে কেউ কিছু বলছে না। একবার ওরদিকে তাকিয়ে সবাই মাথা নিচু করে ফেলল। কেউ কোনো কথা বলছে না। ও রুমে ঢুকায় রুমটা আরো চুপচাপ হয়ে গেলো৷ রাজিতা ব্যাগটা নামিয়ে মালিহার পাশে বসে ওকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“ক্যাম্পাসে আজ কি কিছু হয়েছে? আর ক্লাসেই বা কি হয়েছে? সবাই এত চুপচাপ? ”

মালিহা রাজিতার চোখের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়৷ তারপর আমতা-আমতা করে বলে,

–“সরি রাজিতা! ”

রাজিতা ওর কথা শুনে অবাক হয়ে যায়৷ তারপর ওরদিকে তাকিয়ে বলে,

–“সরি মানে? কি হয়েছে?”

এমন সময় ওর এক ফ্রেন্ড এসে জানালো যে, আনান নাকি ওকে ডেকে পাঠিয়েছে। ও আনানের অফিসরুমে ঢুকতেই আনান ওর হাতে নিজের ফোনটা দিয়ে রাগী গলায় বলল,

–“দেখো কি করেছো! আমি এমনি তোমায় সেদিন অতো বকাবকি করেছিলাম! যেই ভয় পাচ্ছিলাম তাই হলো!”

রাজিতা আনানের ফোনের নিউজটা দেখে চমকে উঠে৷ শিরোনামটা হচ্ছে,

“ক্লাসরুমে শিক্ষককে প্রপোজ! অত:পর বিয়ে!”

চলবে…?