অপরিচিত প্রিয়জন পর্ব-১০+১১

0
293

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_১০
#এম_এ_নিশী

–বিয়ে করে এনেছি ওকে। বউ হয় আমার।

রূপসী কেবল শরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়েছিলো। ইফাদের কথাটি শুনে শরবত গলায় আটকে যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়ে যায় তার। বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে বেহাল দশা। চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। মারিয়া উঠে এসে রূপসীর মাথায় পিঠে হালকা চাপড় দিতে থাকে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ইফাদের মুখপানে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেন কোনো বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে। রূপসী একটু ঠিক হলে মারিয়া ইফাদের দিকে তাকিয়ে বলে,

–এসব কোন ধরনের মজা ভাই! যদিও এমন মজা তুই কখনোই করিস না তবে আজ কি হলো?

–এমন মজা করিনা জানোই যখন তখন ভাবছো কেন এটা মজা?

মারিয়া এবার বিস্ফোরিত নয়নে একবার ইফাদের দিকে তো আরেকবার রূপসীর দিকে তাকাতে থাকে। রূপসীর তো আর চোখ তুলে তাকানোর ক্ষমতা নেই। মারিয়া কোনো কথাই বলতে পারছে না। ইফাদ তাই নিজেই আবার বলে উঠে,

–যেহেতু ও এখানেই থাকবে ওকে ওর ঘরটা দেখিয়ে দাও আপু। একটু ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিক।

মারিয়া তখনো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইফাদ চোখের সামনে তুড়ি মেরে বলে,

–কি হলো আপু? এতোটা হারিয়ে যেও না। যাও না ওকে ওর রুমটা দেখিয়ে দাও।

ইফাদ ইশারায় মারিয়াকে বোঝায় রূপসীর সামনে সবটা বলা সম্ভব না। মারিয়া তা বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

–রূপসী, এসো আমার সাথে।

রূপসী মারিয়ার পিছু পিছু যেতে থাকে। বেশ সাজানো গোছানো ছিমছাম একটি রুমে নিয়ে আসা হলো তাকে। মারিয়া রূপসীর দিকে তাকিয়ে বলে,

–তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। আর কোনো কিছুর প্রয়োজন পড়লে বলবে আমাকে।

মারিয়া চলে যাচ্ছিলো। রূপসী পিছু ডেকে বলে,

–একখান কথা কমু?

–হ্যা বলো। কিছু লাগবে?

রূপসীর খুব লজ্জা লাগছে তবুও বলাটা দরকার। তাই আমতাআমতা করে বলেই ফেললো,

–আমি তো আমার কোনো কাপড় লইয়া আসিনাই। কি পড়মু যদি কইতেন…

–ওহহ আচ্ছা এই ব্যপার। দাঁড়াও একটু।

মারিয়া আলমারি থেকে একটা আকাশী রং এর সালোয়ার কামিজ বের করে দিলো রূপসীর হাতে।

–আমার একমাত্র ননদ মিষ্টির জামা এটা। আর রুমটাও ওর। ও কিছুদিনের জন্য বাড়িতে গিয়েছে। তোমারই বয়সী। আশা করি জামাটা তোমার ফিট হয়ে যাবে।

রূপসী কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে। মারিয়া আবার বলে,

–ফ্রেশ হয়ে নাও তবে। আমি আসছি।
—-
সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসে ফোনে চোখ লাগিয়ে রেখেছে ইফাদ। মারিয়া এসেই তার মাথার পিছনে চাটি মেরে বলে,

–তোর ব্যপারটা কি বল তো? তুই কি মেয়েটাকে ভাগিয়ে এনেছিস নাকি?

আচমকা মারিয়ার আগমনে ইফাদ একটু চমকে গেলেও সামলে নেয় নিজেকে। মারিয়ার প্রশ্ন শুনে একটু শব্দ করেই হাসলো। তারপর সামনে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলে,

–যদি বলি এক প্রকার ভাগিয়েই এনেছি, তাহলে কি বলবে তুমি?

মারিয়া ইফাদের কান টেনে ধরে বলে,

–মজা নিচ্ছিস আমার সাথে, তাই না রে।

ইফাদ হাসতে থাকে। মারিয়া এবার করুণ স্বরে বলে উঠে,

–প্লিজ ভাই! এতো চাপ নিতে পারছি না তো আর। বল না এবার। বল নইলে সত্যি সত্যি মার খাবি কিন্তু।

–আচ্ছা আচ্ছা বলছি শোনো।

রূপসীর পাচার হওয়া থেকে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, দিদার এর নোংরামি, মারামারি অতঃপর গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে তাদের চাপের মুখে বিয়ে সমস্তটাই বেশ সময় নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে ইফাদ। সবটা শুনে মারিয়া হতভম্ব হয়ে বসে রয়েছে। এতো কিছু ঘটে গিয়েছে অথচ কেউ কিচ্ছু জানে না। মারিয়া প্রশ্ন করে বলে,

–এখন কি করবি? বাড়িতে জানাবি না?

–আপাতত তুমি আর দুলাভাই ছাড়া কেউ জানবে না। যেহেতু রূপসীকে তোমাদের কাছে রাখতে হচ্ছে তাই তোমাদের জানানো। নয়তো, কেউই জানতো না ব্যপারটা।

–সব না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুই রূপসীর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবি, মেলামেশা করবি কারো না কারো তো নজরে পড়বেই। তখন কি করবি?

–তোমাকে কে বললো আপু আমি রূপসীর সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবো?

–তবে?

–আমি আমার কাজের জায়গায় চলে যাচ্ছি। কাল সকালেই। যতদিন না রূপসীর পড়াশোনা শেষ হচ্ছে তত দিন আমি ওর সাথে দেখা সাক্ষাৎ বা কোনো প্রকারের কোনো যোগাযোগ করব না।

–সে কি কথা ভাই। তুই তোর বউ এর কাছ থেকে দূরে থাকবি?

–আপাতত বউ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় তো পসিবল হচ্ছে না আপু, কাছে দূরে থাকা তো আরো বহুদূরের ব্যপার।

মারিয়া আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই সেখানে ওয়াহিদ এর আগমন ঘটে। ওয়াহিদ মারিয়ার স্বামী। ইফাদকে দেখেই বলে উঠে,

–আরেহহ! সালাবাবু যে! কি খবর? তোমার তো দেখাই পাওয়া যায় না ভাই। অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছো? ওমা! একি তোমার মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?

–আহহ! দুলাভাই, একমাত্র আপনারই কত্ত খেয়াল আমার প্রতি। অথচ আসার পর থেকে আপু তো একবারও জিজ্ঞেস করলো না।

মারিয়া টিটকারির স্বরে বলে উঠে,

–এই জবে ঢোকার পর থেকেই তো তোকে যেখানে সেখানে ব্যান্ডেজ লাগানো অবস্থায় দেখছি। এখন তো এমন হয়েছে যে, তোকে ব্যান্ডেজ ছাড়া না দেখলেই বরং অবাক লাগবে।

–দেখেছন দুলাভাই, আপনার বউ আমাকে কিভাবে অপমান করলো?

–আহহা মারিয়া, কেন শুধু শুধু আমার সালাবাবুটাকে এভাবে বলছো। সে যে কাজের সাথে যুক্ত তা কি ছোটো খাটো ব্যপার নাকি, হুমম!

ওয়াহিদ বেশ সরল মনের মানুষ। হাসিখুশি, মজা আড্ডায় থাকতেই বেশি ভালোবাসেন। হঠাৎ তিনি ভিষণ উৎফুল্ল হয়ে বললেন,

–শোনো সালাবাবু আজ যখন এসে পড়েছো তবে রাতটা থেকে যাও। আজ রাতে বারবিকিউ পার্টি করব বুঝেছো?

ফট করে মারিয়া তেজ দেখিয়ে বলে উঠে,

–তোমার খালি দুদিন পরপর উদ্ভট সব কীর্তি কলাপ।

–বিবাহিত মানুষদের এসব বিনোদনের প্রয়োজন আছে বুঝছো! নইলে তোমার মতো দাজ্জাল বউদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গলায় দড়ি কলসি বেঁধে প্রাণ ত্যাগ করতে হতো। কি বলো সালাবাবু?

ইফাদ মাথা নেড়ে নেড়ে জবাব দেয়,

–ঠিক ঠিক।

মারিয়া ভিষণ ক্ষেপে গিয়ে বলে,

–ওহহ! আমি দজ্জাল তাই না। আজ যদি তোমার বারবিকিউ পার্টির গুষ্টি উদ্ধার না করেছি তো দেখে নিও।

এই বলে রাগে গজগজ করতে করতে মারিয়া উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। মারিয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে দুই সালা-দুলাভাই হো হো করে হাসতে থাকে।

রূপসী গোসল সেরে বের হতেই হাসির শব্দ শুনতে পায়। ধীর পায়ে সেই উৎস ধরে হেঁটে যেতেই সামনের রুম থেকে বেরিয়ে আসা এক আগন্তুকের সাথে আচমকা বেশ জোরেশোরে ধাক্কা লাগে তার। সে টাল সামলে নিতে পারলেও সামনের মানুষটি ধপাস করে পড়ে যায়। রূপসী মুখে হাত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। কি আকাম যে করে ফেললো সে এই নতুন বাড়িতে এসে! আল্লাহ বাঁচালেই হয়। রূপসী কাছে এসে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

–আপনে ব্যথা পায়ছেন?

এমন ধীর, নম্র ও অপরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সামনের মানুষটি। রূপসীকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আগাগোড়া বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রূপসীকে ভালো করে দেখে নেয়। মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে আছে। ভাবছে তাকে এখন বিশাল বকা দেওয়া হবে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা একটু মুচকি হেসে বললো,

–রিল্যাক্স! ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। আমি তোমাকে মারব না। বাই দ্যা ওয়ে, আমি ওয়াহাব। মোহাম্মদ ওয়াহাব তালুকদার। নামটা কি ব্যাকডেটেড লাগছে? লাগলেও কি করার। দাদামশাই ভালোবেসে রেখেছেন যখন আমৃত্যু এটা গায়ে লাগিয়ে নিয়েই বেড়াতে হবে। ওপপস! সরি সরি! একা একাই বকে যাচ্ছি। তোমার নামটাই তো জানা হলো না। কি নাম তোমার?

–রূপসী।

–ওয়াও! নাইস নেম। কিন্তু শুধুই কি রূপসী? আগে পিছে কিছু নেই?

–রূপসী নূর।

–দিস ইজ অলসো আমেজিং নেম ইয়ার। ইন ফ্যাক্ট টু মাচ সুইট! বাট তুমি এখানে মানে আমাদের বাসাতে কিভাবে এলে ঠিক বুঝলাম না..

–ও আমার এক কলিগের রিলেটিভ হয় ওয়াহাব।

পিছন থেকে আসা ওয়াহিদের কন্ঠস্বর শুনে দুজনেই পেছনে ফিরে তাকায়। ওয়াহাব অবাক হয়ে বলে,

–কি বলো ভাইয়া! তাই নাকি?

–হুমম। পড়াশোনার সুবাদে এখানে এসেছে। তো আমিই বলেছি আমাদের বাড়িতে রাখার কথা। মিষ্টিও তো ওর ব্যাচমেট। দুজনে একসাথে পড়াশোনা করবে এখানে থেকেই।

–গুড ডিসিশন ভাইয়া। তুমি খুব ভালো করেছো।

–কিন্তু তোকে যে আমার একটা পার্সেল আনতে বলেছিলাম কুরিয়ার থেকে। না এনে বসে আছিস কেন?

–সেটাই আনতে যাচ্ছিলাম আর এই ম্যাডামের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে না সরি সাইডে সাইডে সংঘর্ষে কিছু সময়ের জন্য চিৎপটাং হয়ে ছিলাম তাই ভুলেই গিয়েছি।

রূপসী লজ্জিত মুখে বলে,

–আসলে আমি দ্যাখিনাই আপনেরে। ভুল হইয়া গেছে। কিছু মনে কইরেন না।

–কাম অন রূপসী। ইটস ওকে! আমি কিছু মনে করিনি।

ওয়াহিদ তাড়া লাগিয়ে বলে,

–আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। ওয়াহাব জলদি যা কুরিয়ার অফিসে।

–হুম হুম যাচ্ছি। আর হ্যা রূপসী ফিরে এসে আরো ভালোভাবে পরিচয় হবে। ওকে!

রূপসী ভদ্রতাসূচক হাসি ছুঁড়ে দেয়। ওয়াহাব যেতে যেতে ভাবে, “সি ইজ রিয়েলি ভেরি সুইট!”

ওয়াহাব চলে যেতেই রূপসী ওয়াহিদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। ওয়াহিদ সেই দৃষ্টির মানে বুঝতে পেরে রূপসীর দিকে তাকিয়ে বিস্তৃত হাসি দিয়ে বলে,

–ভাবছো তোমাকে কলিগের রিলেটিভ বলে মিথ্যে পরিচয় দিলাম কেন? ইফাদ আমাকে সবই বলেছে। তোমার আসল পরিচয় তো এই মুহুর্তে গোপন রাখাটা খুবই জরুরি। তাই এই মিথ্যে বলা। যাতে কেউ সন্দেহ না করে।

–কিন্তু আপনেরে তো চিনলাম না।

–ওহহ আমার পরিচয়ই তো দেওয়া হয়নি। আমি মোহাম্মদ ওয়াহিদ তালুকদার। ইফাদের বড় বোন মারিয়ার স্বামী।

–আর যিনি চইলা গেলেন?

–ও হচ্ছে আমার একমাত্র ভাই। আরো একটা ছোটো বোন আছে আমার। একদম তোমার মতো। বাড়িতে গিয়েছে। ফিরে এলেই দেখতে পাবে। যাই হোক তুমি ড্রয়িংরুমে যাও না, ওখানে ইফাদ বসে আছে একা একা।

–আইচ্ছা।

ওয়াহিদ চলে গেলে রূপসী আবার ঘরে ফিরে আসে। তার খুব ইচ্ছে করছিলো ইফাদের কাছে গিয়ে বসতে। একটু কথা বলতে। কিন্তু মানুষটার সাথে তো এখন তার অন্যরকম এক সম্পর্ক। সে মানুক বা না মানুক। রূপসী তো মানে। মনে প্রাণে মানে। কারণ ওই অপরিচিত মানুষটি আচমকাই তার প্রিয়জন হয়ে গিয়েছে। এক অপরিচিত প্রিয়জন।

চলবে…….

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_১১
#এম_এ_নিশী

সন্ধ্যা নামার কিছু সময় পরপরই শুরু হয়ে যায় ওয়াহিদের স্পেশাল বারবিকিউ পার্টি। মারিয়া, ওয়াহিদ, ওয়াহাব, ইফাদ, রূপসী সহ রয়েছে আরো দুটো ফ্যামিলি যারা মারিয়াদের প্রতিবেশী। এতো এতো মানুষে গমগম করছে ছাদ। সবাই মিলে হাসি, মজা, হুল্লোড়ে বেশ কাটাচ্ছে সময়টা। শুধু রূপসীর মনটাই কেমন যেন পানসে হয়ে আছে। অন্য সময় হলে হয়তো এই পার্টি টা সে একাই মাতিয়ে দিত। কিন্তু এই মুহুর্তে তা না পারার কারণ, তার ভিষণ বাবা, মা, বোনের কথা মনে পড়ছে। তাদের হারিয়ে ভাগ্যক্রমে পেয়েছে আরেক প্রিয় মানুষ। কিন্তু সে ও তো দূরে দূরে। রূপসীর নিজেকে বড্ড একলা মনে হতে থাকে। এই এতো এতো মানুষজনের ভীড়েও নিজের নিঃসঙ্গতা অনুভব করে মনটা উদাসীন হয়ে যায় তার বারেবারে। ধপ করে কারো পাশে বসার আওয়াজ পেয়ে পাশ ফিরে তাকায় রূপসী। ওয়াহাব হাসি হাসি মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে বলে,

–হেই সুইট গার্ল! একা একা বসে বসে কি করছো এখানে? মন খারাপ নাকি?

রূপসী মলিন হেসে মাথা নাড়ে। ওয়াহাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখার ভান করে বলে,

–উঁহু! মনে হচ্ছে মন খারাপ। বাড়ির কথা মনে পড়ছে নিশ্চয়ই।

এবার রূপসীর চোখে জল চলে এলো। সেই জল আড়াল করতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। ওয়াহাব লাফ দিয়ে তার মুখের সামনে এসে বলে,

–ওমা! তুমি কাঁদছো কেন? তার মানে সত্যি তোমার বাড়ির জন্য মন খারাপ করছিলো তাই না? কোনো ব্যপার না। এখানে কিছুদিন থাকলে সমস্ত মন খারাপ পালিয়ে যাবে বুঝছো। বিশেষ করে আমার বোনটা যদি এসে যায় ও থাকলে তো তোমার আর কাওকেই প্রয়োজন পড়বে না। এখন চলো এই পার্টি টা এনজয় করো। বারবিকিউ পার্টি কেমন হয় জানো?

রূপসী মাথা নেড়ে না বলে। ওয়াহাব দাঁড়িয়ে রূপসীকে হাত ধরে টেনে তুলে বলে,

–চলো তোমাকে দেখাই এবং শেখাই কিভাবে বারবিকিউ করতে হয়। চলো! চলো!

ওয়াহাব রূপসীকে হাত ধরে একপ্রকার টেনে টেনেই নিয়ে যায়। এই দৃশ্য একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইফাদের দৃষ্টিগোচর হতেই তার মুখভঙ্গিমার এক আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল।

ইটের ওপরে তারের নেট বিছানো। তার ওপর মসলা মাখানো বড় বড় পিস মুরগির মাংস সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নিচের কয়লার আগুনে পুড়ে পুড়ে চলছে সেসবের বারবিকিউ হওয়ার প্রস্তুতি। তার পাশে বসেই মারিয়া প্রতিবেশী ভাবিদের সাথে গল্প করছে। তার থেকে একটু দূরে ওয়াহিদ তার সঙ্গীদের সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত। এদের মধ্যে ইফাদের সমবয়সী দুজনও ছিলো যাদের সাথে ইফাদও বেশ আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে খেয়াল তার বারবার লাগামছাড়া হয়ে রূপসীর দিকে চলে যাচ্ছে। যেখানে ওয়াহাব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রূপসীকে বারবিকিউ প্রক্রিয়া বর্ণনা করছে। বর্ণনা শুনে কখনো বা রূপসীর চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে কখনো বা কপাল কুঁচকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আগ্রহ নিয়ে এটা ওটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ওয়াহাবও যেন বেশ মজা পাচ্ছে রূপসীর সঙ্গ। কিন্তু এসবের মাঝে ইফাদের ভিতরে কোথাও একটা জ্বালার সৃষ্টি হচ্ছে যার কারন উদঘাটন তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না। আনমনে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বসে, “আর ইউ জেলাস?” সাথে সাথে নিজেই নিজেকে জবাব দেয়, “নো ওয়ে।” নিজের স্বভাববিরুদ্ধ আচরণের মুখোমুখি হওয়ায় কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলে সে যার দরুন তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা আড্ডায় মত্ত মানুষগুলো আড্ডা থামিয়ে দেয়। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সেদিকে খেয়াল করতেই ইফাদ বুঝতে পারে ভুল করে ফেলেছে সে। ভিষণ বিব্রত হয়ে ভাবতে থাকে কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবে। আমতাআমতা করতে করতে বলে,

–আব আসলে, মনে হয় আমার একটা জরুরি কাজ ছিল। করতে ভুলে গিয়েছি। ইউ ক্যারি অন। আমি আসছি।

ইফাদ দ্রুত বেগে স্থান ত্যাগ করে যেন পালাতে পারলেই বাঁচে। বাকিরা কিছু সময় ইফাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে পুনরায় আড্ডায় মশগুল হয়ে যায়।

রূপসী ওয়াহাবের কাছে জানতে চায়,

–পুড়াইয়া মাংস খাওন যায় কেমনে? গন্ধ করবো না?

–আরে না পাগল। কত রকমের মসলা দেওয়া হয়েছে দেখলেই তো। আর ঠিকঠাক সিদ্ধ হয়ে গেলে কোনো গন্ধ থাকবে না। সো চিল!

–আসলেই খাওন যায় তো?

–অবশ্যই খাওয়া যাবে। আমরা তো কত খেলাম এভাবে। ভিষণ মজা।

রূপসীর কেমন যেন লাগতে থাকে। সে ভাবে এভাবে খেলে হয়তো কাঁচা মাংসই খাওয়া লাগবে। মুক চোখ বিকৃত করে সে ওখান থেকে সরে আসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ইফাদের অনুপস্থিতি টের পেয়ে আবার মন খারাপ হয়ে যায় তার। দূরে থাকলেও মানুষটাকে দেখতে তো পাচ্ছিল। সেটাই তার জন্য পরম শান্তির ছিল। কিন্তু এই শান্তিও যেন তার কপালে সইলো না।

সখিনা বেগম হেলে দুলে চলছেন। কখনো প্লেট বাসন আনা কখনো পানির ব্যবস্থা করা। সবকিছু এমন রঙে ঢঙে করছে যেন এসব কিছুর আয়োজন তিনিই করেছেন, তার অধীনেই চলছে সব। ২৬-২৭ বছর বয়সী সখিনা বেগম মারিয়াদের বাসায় রান্নার কাজ করেন। কখনো কখনো অন্যান্য টুকিটাকি কাজও করে দেন। তবে তার জন্য এক্সট্রা পেমেন্টও নিয়ে থাকেন। বলা যায় তার ভাবটাই আলাদা। পুরো ভিআইপি লেভেলের। তবে এই মুহুর্তে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও হাস্যকর বিষয় হচ্ছে তিনি সানগ্লাস পড়ে চলাফেরা করছেন। এই রাতের বেলা তাও আবার বাসার ছাদে সানগ্লাস পড়ে ঘোরাঘুরি তাকে স্মার্ট নয় বরং হাসির খোরাক বানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সখিনা বেগম সেসব বুঝতে চান না। তিনি তার ভাব বজায় রেখেই চলেন সবসময়। যদিও এই ভাব ধরে রাখতে গিয়ে কতবার যে প্রেস্টিজ পাংচার হয়েছে তার হিসেব নেই। এইতো দুপুরের ঘটনা। রূপসীকে খেতে ডাকতে গিয়ে বলেন,

–এইযে নতুন আফা খাইতে আসেন।

সখিনা বেগম শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করলেও আঞ্চলিকতা পুরোপুরি দুর হয়না। যখন তিনি পুরোপুরি শুদ্ধ ভাষায় বলতে পারেন না তখন ভুলভাল ইংরেজি বলার অপচেষ্টা চালান। সখিনা বেগমের কথা শুনে রূপসী লাফিয়ে উঠে বলে,

–আপনেও আমাগো ভাষায় কথা কন? আপনেও কি আমাগো গেরামের?

–না আমার গেরাম থুক্কু গ্রাম অইন্য মানে অউন্য। আপনের ভাষায় কথা কইনা মানে কলি না আরে না না বলি না বলি না।

সখিনা বেগমের ভুলভাল শুদ্ধ ভাষা উচ্চারণ শুনে রূপসী মুখ টিপে টিপে হাসে। তা দেখে সখিনা বেগম তেঁতে উঠে বলে,

–এই যে নতুন আফা আপনে এইবাবে আমারে ইনশালট করতে পারেন না। আপনে নতুন বইলা মাফ করে দিলাম। আই পরগিব উ। (আই ফরগিভ ইউ)।

রূপসী মাথা চুলকে কথাটির মানে বুঝার চেষ্টা করে। সখিনা বেগম ভাব নিয়ে হেঁটে যান। রূপসীও পিছনে পিছনে যেতে থাকে। তবে তার চোখ চারপাশে তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে খুঁজতে থাকে। সখিনা বেগম প্লেট নিয়ে এগিয়ে আসছিলেন। রূপসী অন্যমনস্ক ছিলো এবং সখিনা বেগম ভাব নিয়ে ছিলেন, ফলাফলঃ দুজনের মুখোমুখি সংঘর্ষে রূপসীর ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়া আর সখিনা বেগমের চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়া সেই সাথে সখিনা বেগমের কান ঝালাপালা করা বিলাপ,

–আব্বা গো, আম্মা গো, আল্লাহ গো, আই ফিনিশ। আই শেইষ না না শ্যাষ। ওহহহহহ!

সখিনা বেগম দুহাত দুদিকে দিয়ে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে আছেন। রূপসী দ্রুত উঠে গিয়ে সখিনা বেগমকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু সখিনা বেগম যেন গ্লু দিয়ে আটকে আছেন মেঝের সাথে। হাত নড়ছে কিন্তু শরীর একচুলও নড়ছে না। রূপসী মুখ কাঁচুমাচু করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে ইফাদ, ওয়াহাব, ওয়াহিদ আর মারিয়া চারজনেই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকিদের চোখ বড় বড় হয়ে থাকলেও ইফাদ নির্বিকার। হঠাৎই রূপসীকে চমকে দিয়ে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এবারও ইফাদ চুপচাপ। শুধু ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির ঝিলিক খেলে গেলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। রূপসীর ভিতরটা ছটফট করে ওঠে সেদিনকার মতো ইফাদের প্রাণখোলা হাসি দেখার পিপাসায়।

চারপাশে ইট দিয়ে মাঝখানে কিছু কাঠের টুকরো, খড়ি রেখে তাতে আগুন জ্বালানো হয়েছে। অন্ধকারে পরিবশটিতে একটু ক্যাম্পিং এর ছোঁয়া লাগানোর চেষ্টা। সবাই গোল হয়ে বসে আছে আগুনের চারপাশে। মানুষজন বেশি হওয়ায় আগে পিছে করেই বসতে হয়েছে সবাইকে। রূপসীর সামনে একটু ডানে সখিনা বেগম বসে আছেন। মুখে তার গম্ভীর ভাব ধরে রাখার চেষ্টা। আর বামদিকে একটু পাশাপাশি বসে আছে ওয়াহাব। রূপসীর বিপরীতে মুখোমুখি ইফাদ। এখানে আসার পর থেকে একবারের জন্যও রূপসীর সাথে কথা বলেনি সে এমনকি তার দিকে ফিরেও দেখছে না। রূপসীর কষ্ট হলেও তা চেপে রেখে সবার সাথে আনন্দে যোগ দেয়। পাশের ফ্ল্যাটের এক ছেলে গিটার নিয়ে বসে আছে। উদ্দেশ্য গান করা। ওয়াহাব বলে উঠে,

–হৃদয় গান শুরু করো এবার। মহল একদম ঠিকঠাক।

গিটারে হালকা টুংটাং শব্দ তুলে হৃদয় নামের ছেলেটি গান শুরু করে,,

উমউম হুমহুম উমউম হুমহুম
কাগাজ কে দো পাংখ লেকে উড়া চালা যায় রে
জাহা নেহি জানা থা ইয়ে ওয়াহিন চালা হায় রে
উমর কা ইয়ে তানাবানা সামাঝ না পায়ে রে
জুবান পে জো মোহমায়া নামাক লাগায়ে রে
কে দেখে না ভালে না জানে না দায়ে রেএএএ
দিশেহারা কেমন বোকা মনটা রে…

গানের প্রতিটি তালে, লয়ে, সুরে ইফাদ যেন রূপসীকে অনুভব করছিলো। এমন অদ্ভুত অনুভূতি তাকে চিন্তিত করছে তবুও অনুভূতিগুলো বড্ড বেয়াড়া হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। সে আড়চোখে রূপসীকে দেখে যাচ্ছে বারবার।
রূপসী মন দিয়ে গান শুনছে। তার গানটা ভিষণ মনে ধরেছে। সুর যেন হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেখেয়ালে চোখ দুটো ইফাদের দিকে যেতেই রূপসীর মনে হলো ইফাদ যেন তার দিকেই তাকিয়ে ছিল সে তাকাতেই হয়তো চোখ সরিয়ে নিল। পরীক্ষা করার জন্য রূপসী অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ইফাদ তাকে দেখছে কিনা। যখনই তার মনে হচ্ছে ইফাদ তাকিয়েছে ঝট করে সে ও ফিরে তাকায়। কিন্তু নাহ ইফাদের দৃষ্টি অন্যদিকে স্থির। এভাবে বার কয়েক এই কান্ড চালিয়েও রূপসীকে হতাশ হতে হয়।
এদিকে রূপসীর কান্ড গুলো দেখে ইফাদের ঠোঁটের কোণে ফুটে থাকা মৃদু হাসি সকলের আড়ালেই থেকে গেল। এমনকি রূপসীও দেখল না। রূপসী ঠিকই ধরেছিল। ইফাদের দৃষ্টি বারবার তার দিকেই যে আটকাচ্ছিল তবে কৌশলে সে চোখ সরিয়ে নিত যার ফলে রূপসী তাকে ধরতে পারল না।
এদিকে একবারও ইফাদকে ধরতে না পেরে রূপসীর মন মেজাজ বিগড়ে গেলো। “ঠ্যাংএর মাথা আমার”- বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলতে বলতে আচমকা কি মনে করে যেন সে সামনে বসা সখিনা বেগমের পিছন বরাবর সজোরে লাথি মেরে বসে। হঠাৎ আক্রমণে সখিনা বেগম মুখ থুবড়ে উল্টে পড়ে সেই সাথে শুরু হয়ে যায় তার বিখ্যাত বিলাপ। রূপসী হকচকিয়ে যায়। লাফিয়ে সরে গিয়ে মুখ চেপে ধরে বিরবির করে বলে, আল্লাহ গো, আবার আকাম কইরা ফালাইলাম!

চলবে……