অপরিচিত প্রিয়জন পর্ব-৮+৯

0
262

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_৮
#এম_এ_নিশী

গ্রামের মানুষের কানে দিদারের চিৎকার পৌঁছে গিয়েছিলো বেশ ভালোভাবেই। তাই তো হৈ হৈ করতে করতে এগিয়ে আসছে সবাই। রূপসীদের বাড়ির কাছে আসতেই সর্বপ্রথম আজমলকে দেখা গেলো। আজমলকে দেখে রূপসীর ভিতরটা কেঁপে ওঠে। শোয়েব কাকা, হারুন কাকা, আমিনুল কাকা সহ অনেকে এসেছে। মূল ফটক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই সকলের নজর পড়ে রূপসীর দিকে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইফাদ, আর মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া দিদারও নজর এড়ায় না কারোর। কেউ কেউ তো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রূপসীর হাতদুটোর দিকে যে হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে সে ইফাদের বাহু। ইফাদকে টেনে আনতেই তাকে এভাবে ধরতে হয়েছে রূপসীর গ্রামের মানুষদের দেখে ভয় পেয়ে সে কথা ভুলে গেছে সে।তবে গ্রামের মানুষদের জ্ঞানে যা খেলার তা যথাযথ ভাবেই খেলে গেছে। হারুন কাকা সামনে এগিয়ে এসে বলে,

–রূপসী! তুই কোনহান থেইকা আইলি?

রূপসী হারুন কাকার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

–কাকা, আমার আব্বা আম্মা কই?

হুট করে শোয়েব কাকা বলে উঠে,

–মাইয়া, নষ্টামি কইরা আইছো আবার বাপ মায়ের খোঁজ নিতাছো?

আমিনুল কাকাও মদদ জুগিয়ে বলে,

–এই মাইয়া তো গেরামের কলঙ্ক। এরে গেরামে ঢুকতে দিছে ক্যান?

পিছন থেকে আরেকজন চেঁচিয়ে বলে,

–আমার তো মনে হইতাসে এই মাইয়া ওই পোলার লগেই ভাগছিল। কিন্তু আকাম কইরা আবার গেরামে আইছে ক্যান?

আজমল রূপসীর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

–ক্যামনে ফিরলি তুই?

রূপসী আজমলের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় কোনো জবাব দেয় না।

গ্রামের মানুষজন একেকজন একেক ধরণের বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে যাচ্ছে রূপসীকে। ইফাদ এতক্ষণ সবটা চুপচাপ শুনলেও এবার সে চেঁচিয়ে বলে উঠে,

–চুপপ করুন আপনারা। একটা মেয়ের সম্পর্কে না জেনে না শুনে ভুলভাল মন্তব্য করা বন্ধ করুন।

–তুমি কথা কম কও। আমাগো গেরামের মাইয়া লইয়্যা ভাগছো আবার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কইতাছো।

–দেখুন আপনারা আমাকে ভুল বুঝছেন। আপনারা জানেন না, রূপসী এক নারী পাচারকারীর পাল্লায় পড়েছিলো। তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হলো। অথচ আপনারা তার ভালো মন্দ জানতে না চেয়ে তার চরিত্রে কাঁদা ছুড়তে ব্যস্ত।

–এইসব মনগড়ন কাহিনী শুনাইয়া লাভ নাই। আমরা মূরুখ হইতে পারি তই অবুঝ না। তুমি আমাগোরে বুঝাইতে আইসো না।

এতোক্ষণে দিদার মুখ খুলে,

–চাচা এই পোলা রূপসীরে লইয়্যা এইহানে নোংরামি করতাছিলো। আমি আইসা ধরতেই আমারে কি মাইরটাই না মারলো।

রূপসী আর ইফাদ দুজনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দিদারের দিকে। কি সুন্দর ভাবে সে নিজের কৃতকর্মের দায় ইফাদের ওপর চাপিয়ে দিলো। দিদারের দুজন সাঙ্গপাঙ্গ এসে তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ওদিকে আরেকজন ছুটেছে দিদারের বাবা গ্রামের মাতব্বরকে খবর দিতে।
ইফাদ রেগেমেগে আবার দিদারের দিকে এগোতে গেলেই রূপসী ওকে আটকে দেয়। এবার রূপসী বলে,

–বিশ্বাস করেন চাচা, এই দিদার ভাই-ই আমার লগে অসভ্যতা করবার চাইছে। এই মানুষডা তো ভালা মানুষ। উনি আইসাই আমারে বাঁচাইছেন।

ফট করে আজমল বলে,

–মিছা কতা কইস না রূপসী। আমি তোরে দেখছিলাম এই পোলার লগে গোপনে দেহা করতি তুই। এর লগেই তো তুই পালাইয়া গেছিলি।

আজমলের আরো একধাপ বাড়িয়ে বলা মিথ্যে শুনে রূপসী অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। রূপসী যেন তার দিকে আঙুল তুলতে না পারে তার জন্যই সে এতোটা বানোয়াট কথা বলে বসলো। ইফাদ বুঝে উঠতে পারছে না। এরা সত্যতা না জেনেই কিভাবে নিজেদের মতো সবটা সাজিয়ে নিচ্ছে।

রূপসী দুদিনের জন্য গায়েব ছিলো। হুট করে ফিরে এসেছে তাও আবার এক অচেনা পুরুষের সাথে। স্বভাবতই গ্রামের মানুষ এটাকে সহজভাবে নিবে না। শুরুতেই যেখানে দুজনের চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দিয়েছে গ্রামের মানুষ সেখানে দিদার আর আজমলের কথা তো তাদের কাছে রীতিমতো এক বিস্ফোরক ছিলো এবং অবশ্যই বেশি বিশ্বাসযোগ্য। গ্রামের মানুষজন হুলস্থুল লাগিয়ে দিলো। তবে একদল তাদের খারাপ বললেও আরেকদল রূপসীর পক্ষই নিলো। তারা রূপসীকে যথেষ্ট ভালো মেয়ে হিসেবে জানে। তার এমন কাজ তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। তবে এই দলের লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম। রূপসীর বিপক্ষে থাকা মানুষজন ইফাদ আর রূপসীকে বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত নিলো। এতগুলো মানুষের সাথে ইফাদ পেরে উঠবে না। তার একটা ফোন করা জরুরী ছিল। কিন্তু সে সুযোগ তার হয়ে উঠলো না। কয়েকজন এসে ইফাদকে টেনে নিয়ে গাছের সাথে বেঁধে দিলো। রূপসী বাঁধা দিতে গেলেও তাকেও ধরে বাঁধতে নিয়ে যায়। ইফাদ চিৎকার করে বলে উঠে,

–ভুল করেও রূপসীর গায়ে হাত দেওয়ার ভুলটা কেউ করবেন না। আমার সাথে যা করেছেন করেছেন। কিন্তু রূপসীর দিকে হাতটা বাড়ানো থেকেও বিরত থাকুন।

–এ্যাহ! দরদ দেখ পোলার। রূপসী তো তার নাগরেরে ভালাই মধু খাওয়াইছে।

ইফাদের কান গরম হয়ে যায় এসব কুরুচিপূর্ণ কথা শুনে। রূপসী লজ্জায়, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সমান তালে কেঁদে যাচ্ছে সে। তার জন্য আজ মানুষটার কি বিপদ হলো! ভাবতেই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। ইফাদ পুনরায় বলে উঠে,

–একটা ছেলেকে একটা মেয়ের সাথে দেখে আপানদের সম্মানে লাগলো অথচ এখন কয়েকজন পুরুষ মিলে মেয়েটাকে বাঁধতে যাচ্ছেন এখন আপনাদের সম্মানে লাগছে না? এটা আপনাদের কোন যুক্তির বিচার, বোঝান আমাকে?

ইফাদের শক্ত যুক্তির পৃষ্ঠে কেউ কোনো জবাব খুঁজে পেলো না। তারা রূপসীকে বাঁধলো না তবে চার পাঁচ জন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকলো যেন সে পালাতে না পারে। সকলেই মাতব্বরের আসার অপেক্ষা করতে লাগলো।

এই মাঝরাতে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে তুলে আনার জন্য মাতব্বর কুদ্দুস মিঞার বেজায় মেজাজ চটে আছে। তিনি রাগে গজগজ করছেন। তাকে বলা হয়েছে বিশাল ঝামেলা লেগেছে। কিন্তু কি ঝামেলা সেটাই কেউ বলেনি। রূপসীদের বাড়ির কাছে এসেই তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। রূপসী উধাও হওয়ার পর তার বাবা মা কে গ্রামছাড়া করেছে সে। তাদের বাড়িটাও সে দখলে নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এখন এখানে এতো জটলা কেন বুঝতে পারছেন না তিনি। রূপসী কি ফিরে আসলো?

কুদ্দুস মিঞা ভিড়ের মধ্যে আসতেই সমস্ত শোরগোল থেমে গেলো। একজন চেয়ার নিয়ে এসে দিলো। কুদ্দুস মিঞাকে দেখতেই দিদার অসহায়, করুণ আর্তনাদের ভান করে বলে উঠে,

–আব্বা, আব্বা গো ও আব্বা গো। আপনের পোলা বুজি আর বাঁচবো না।

কুদ্দুস মিঞা ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে আঁতকে ওঠেন। ছুটে এসে ছেলেকে দু’হাতে জড়িয়ে বলেন,

–আহারে আমার আব্বাজানের এ অবস্থা ক্যান? কেডাই করলো এত্তো বড় দুঃসাহস।

দিদারের সাঙ্গপাঙ্গদের একজন ইফাদকে দেখিয়ে বলে ওঠে,

–এই পোলায় করছে। রূপসীর লগে ফষ্টিনষ্টি করতে যাইয়া দিদার ভাই এর হাতে ধরা খাইছে তাই ভাই এর এই অবস্থা করছে।

রূপসী ফিরে এসেছে শুনে একটু চমকালেও তার সাথের ছেলেটাকে দেখে সে একটু ভরসা পেলো। রূপসী যে পাচার হয়েছিলো তা কুদ্দুস মিঞা জানে। সে ও এর সাথে জড়িত। এদের পাচার করার সুবাদে বেশ মোটা অংকের টাকা সে পায়। রূপসী ফিরে আসায় তার ভয় হলেও ইফাদকে দেখে সেটা কেটে গেলো। কারণ রূপসীর নামে যে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তার বাবা মাকে গ্রামছাড়া করেছে তা সত্য প্রমাণের জন্যই যেন ইফাদ তার কাছে গুটি হয়ে গেলো। আরো একটা চেয়ার আনার আদেশ করে কুদ্দুস মিঞা। চেয়ার এলেই তাতে দিদারকে বসিয়ে দিয়ে নিজের চেয়ারে বসে গম্ভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে ইফাদকে। রূপসীর প্রচন্ড ভয় হচ্ছে। নিজেকে নিয়ে নয়, তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে নিয়ে। সে জানে না মানুষটাকে কি কি ভয়ানক শাস্তি দেওয়া হতে পারে। কিছু সময় চুপ থেকে কুদ্দুস মিঞা গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

–এই পোলা আর এই মাইয়া আমাগো গেরামের বদনাম। এইসব নষ্ট পোলাপানগো বাঁইচা থাকার কোনো অধিকার নাই। একে তো নষ্টামি করছে আবার আমার পোালরেও মারছে। দুজনরে ইট পাথর মাইরা মাইরা ফেলান উচিত।

রূপসী আঁতকে ওঠে। তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে মেরে ফেলবে ভাবতেই তার বুক কেঁপে ওঠে। সেই সাথে বুকে চিনচিনে ব্যথাও অনুভব হতে থাকে। সে এখন কি করবে? কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছে না।

আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মকবুল এগিয়ে এসে বলে,

–এরা দুইজনে যহন আকাম কইরাই ফালাইছে তাইলে এক কাম করলে ভালা হয়। ওগো বিয়া দিয়া দেন।

রূপসী, ইফাদ চমকে তাকায় মকবুলের দিকে। এতো বড় সর্বনাশা কথা শুনতে প্রস্তুত ছিলো না কেউই। ইফাদের নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। সে যদি অবিবেচকের মতো তখন রূপসীকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে না যেত তবে এত বড় অঘটন ঘটতো না। তার নিজেকে নিজের মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। তাই তো গ্রামের লোকদের মারের কথা শুনে সে নিশ্চুপ ছিলো। ভেবেছে মার খাওয়াটাই তার জন্য শ্রেয়। তবে রূপসীকে বিয়ে! এটা তার জন্য অসম্ভব। কিছুতেই সে এ কাজ করতে পারবে না। এতে তার মৃত্যু হলেও কোনো আক্ষেপ নেই তার।
মকবুলের এই প্রস্তাবে গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সাই দেয়। বেশিরভাগ বলে উঠে, “হেইডাই ভালা!” তবে কুদ্দুস মিঞার প্রস্তাবখানা পছন্দ হলো না। সে চেয়েছিল রূপসীকে গ্রামের লোকদের হাতে মেরে ফেলতে পারলেই সে বেঁচে যেত। কোনোভাবে যদি রূপসী গ্রামের মানুষদের নারী পাচারের ব্যপারটা বিশ্বাস করিয়ে ফেলে তবে তা কুদ্দুস মিঞার জন্যই বিপদ। কুদ্দুস মিঞা শাসানোর সুরে বলে উঠে,

–এরা আমাগো গেরামে আইসা নষ্টামি করলো হের লাইগা শাস্তি তো অবশ্যই দিমু।

মকবুলও সাথে সাথে জবাব দেয়,

–হ মাতবর সাব ঠিক তবে দুজনের বিয়া দিয়া দিলেই তো কাম সারে। আপনি মাতবর সাব বড় মনের মানুষ মাইরা ফেলনের শাস্তি দেওন হেইডা আপনেরে মানাই না।

মকবুলের কথাতে সবাই বলতে থাকে,

–হ হ! ঠিক কথা।

মকবুলের প্রশংসাকে টপকে কুদ্দুস মিঞা মারার শাস্তির কথা আর বলতে পারে না। তবে তার ভিতরে রাগের সাথে সাথে ভয়টাও সমান তালে সৃষ্টি হচ্ছে।
তবুও নিজেকে সামলিয়ে বলে,

–তবে তাই হোক। কেউ কাজীরে খবর দে। আইসা বিয়া পড়াই যাক।

হুট করে ইফাদ বলে উঠে,

–অসম্ভব! এ বিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব হতে পারে না। রূপসীর এখনো ১৮ বছর হয়নি। ওকে বিয়ে করা মানে বাল্যবিবাহ করা যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। আর এই অপরাধ আমি কিছুতেই করতে পারব না।

মকবুল ছুটে আসে ইফাদের কাছে। কানে কানে ফিসফিস করে বলে,

–বাজান, তুমি মানা কইরো না। আমি তোমাগো জান বাঁচানোর লাইগা এই কতাখান তুলছি। তুমি রাজি হইয়া যাও বাজান। নইলে মাতবর তোমাগো বাঁচতে দিব না।

–আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না চাচা। মরণ হয় হোক তবুও এই অন্যায় কাজ আমি করব না।

–বাজান এমন কতা কইও না। নিজের লাইগা না হোক রূপসীর কতাখান চিন্তা করো। ওরেও মাইরা ফেলব।

মকবুলের কথা শুনে ইফাদ রূপসীর দিকে তাকায়। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার করুণ দশা। ক্রমাগত ভাবে কেঁপে কেঁপে কাঁদছে। হঠাৎ ইফাদের মনে পড়ে রূপসীর বলা সেই কথা, “আমার আব্বারও স্বপ্ন আমারে ম্যাজিস্ট্রেট বানাইবো।” এই মুহুর্তে এই লোকেরা মিলে রূপসীকে মেরে ফেললেও ও কিছুই করতে পারবে না। মেয়েটার স্বপ্নটা অপূর্ণই থেকে যাবে। তবে ওকে বিয়ে করলে সেটাও হবে অন্যায় কাজ। একজন ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এমন অন্যায় কাজ সে কিভাবে করবে? মন দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে তার। গ্রামের মানুষ আবার শোরগোল শুরু করে ইফাদের কথা শুনে। “পোলায় ফূর্তি করবো আবার বিয়া করবো না। তাইলে তো ওরে মাইরা ফালানো উচিত। রূপসী কাঁদতে কাঁদতে সবার কাছে হাতজোড় করে বলতে থাকে, ” উনি ভালা মানুষ উনারে ছাইড়া দেন। উনার লগে এমনডা কইরেন না। ছাইড়া দেন।” ইফাদ স্থির দৃষ্টিতে রূপসীর ক্রন্দনরত মুখটির দিকে তাকিয়ে আচমকা বলে উঠে,

–আমি রূপসীকে বিয়ে করবো। আপনারা কাজী সাহেবকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন।

চলবে….

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_৯
#এম_এ_নিশী

–আমি রূপসীকে বিয়ে করবো। আপনারা কাজী সাহেবকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন।

ইফাদের উচ্চারিত এই বাক্য রূপসীর কানে ঝংকার তোলে। রূপসীর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তোলে৷ কি বলছে এসব তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যার? বিয়ে! বাবা তো বলতো রূপসীকে কিছুতেই এতো জলদি বিয়ে দিবে না। বিয়ে হয়ে গেলে রূপসীর ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া আর হবে না। আচ্ছা, তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যার ও তো একজন ম্যাজিস্ট্রেট। তার সাথে রূপসীর বিয়ে হলে সে কি রূপসীর স্বপ্ন পূরণ করতে দিবে না? নাকি বাবার কথা সত্যি করে তিনিও আর পাঁচজনের মতোই এখানেই থামিয়ে দেবে রূপসীকে?
দুজন এসে ইফাদের বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে বসার ব্যবস্থা করে দেয়। এই গ্রামের মানুষেরাই একটু আগে তার হাত পা বেঁধে তাকে কতটা অসম্মান করছিলো আর এই মানুষগুলোয় এখন তাকে সম্মানের সহিত বসতে দিচ্ছে। শুধুমাত্র তাদের স্বার্থ পূরণ হওয়ায়।

বিয়ে শব্দটি ভিষণ মধুর। দুটো মানুষ পারিবারিকভাবে ও সামাজিক স্বীকৃতির মাধ্যমে এক হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় ভালোবাসায় মাখামাখি, একটু খুনশুটি, কখনো রাগ অভিমানের বর্ষণ সব মিলিয়ে এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত এক আত্মার সম্পর্ক।
সেই ‘বিয়ে’ নামক ঘটনাটি যদি বিশ্রী এক পরিবেশে জোরাজুরির মাধ্যমে ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় তবে তা অবশ্যই কোনো সুখকর স্মৃতি হয় না।

কাজী সাহেব আসেন। রূপসী ও ইফাদের সামনে বসে বিয়ে পড়ান। গ্রামের মানুষজনের উপস্থিতিতে দ্বিধান্বিত মন নিয়ে দুজনেই কবুল বলে বেঁধে যায় এক দৃঢ় সম্পর্কের বন্ধনে। যে সম্পর্ক আদৌ কোনো ভিত্তি পাবে কি না তা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত।

এই পুরোটা সময় ইফাদ থম মেরে বসে ছিলো। রূপসী শুধু কেঁদেই গেছে। সে তার বাবা, মা, বোনের খবর পাচ্ছে না। এদিকে ইফাদকে নিয়েও দুঃশ্চিন্তা ছিলো তার ওপর এখন আবার যোগ হলো এই বিয়ে। রূপসী যেন আর সামলাতে পারছে না এতো চাপ! মকবুল কাছে এসে রূপসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। রূপসী ফুঁপিয়ে উঠে বলে,

–কাকা, আমার আব্বা আম্মা কই?

মকবুল ব্যথিত কন্ঠে জবাব দেয়,

–তোর বাপ মা রে মাতব্বর গেরাম থেইকা বাইর কইরা দিছেরে রূপসী মা। তোরে চরিত্রহীনা কইয়া তোর বাপ মার ওপ্রে কলঙ্ক লাগাইলো। গেরামের হক্কল মাইনষে মিইলা তোর বাপ মারে বাইরা কইরা দিলো। আর তোগো বাড়িখান মাতব্বর নিয়া নিছে।

–কাকা, কই গেছ আমার আব্বা আম্মা কন না চাচা?

–হেইডাতো আমি জানি না রে মা। তই আমার মনে কয় তর ওই খালা যেইডা শহরে আছে হের কাছেই গেছে সম্ভবত।

–আমি এখন কি করমু কাকা? কই খুঁজমু আব্বা আম্মারে আমার ছোড্ড বোনটারে?

রূপসী হু হু করে কাঁদতে থাকে। ইফাদ পাশে এসে দাঁড়াতেই নিজেকে সামলে নেয় সে। করুণ দৃষ্টিতে ইফাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইফাদ মুখে থমথমে ভাব নিয়েই রূপসীর উদ্দেশ্যে বললো,

–আশা করি এখন আর এখানে কোন কাজ নেই।তবে এবার বেরোনো উচিত। নিশ্চয়ই কেউ আর বাঁধা দেবে না।

ইফাদ উত্তরের অপেক্ষায় নাকি অন্য কারণে জানা নেই কিছুসময় দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ ওভাবেই।দৃষ্টি সম্মুখেই নিবদ্ধ। তারপর ঝড়ের বেগে হনহনিয়ে হেঁটে চলে গেলো। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই যার যার বাড়ি চলে গিয়েছে। তামাশা তো শেষ! কুদ্দুস মিঞা শঙ্কিত মন নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। দিদারের উপচে পড়া রাগ খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না মারের ব্যথার দরুন। আজমল চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে রূপসীকে। কিছু একটা ভেবে সে ও প্রস্থান করে। মকবুল এসে রূপসীকে টেনে একটু আড়ালে নিয়ে গেলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,

–রূপসী মা তোর আব্বা যাওনের আগে তার মুরগী ছাগল, সবজি ক্ষেত সবগুলান বেইচা দিছিলো। যে টেহা পাইছে এগুলান আমারে দিছে। তোর খবর পাইলে তোর যেন দিয়া দেই। এই ল মা। টেহাগুলান ধর।

মকবুল একটি ছোট্ট কাপড়ের পোটলা রূপসীর হাতে ধরিয়ে দেয়। রূপসীর বুকভেঙে কান্না আসছে। কিন্তু সে আর কাঁদতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। টাকার পুটুলীটা নিয়ে কাকার কাছ থেকে বিদায় নিলো।। অতঃপর ধীর পায়ে এগোতে থাকে অজানা এক ভবিষ্যতের দিকে।
এই গ্রাম বিনা অপরাধে যে যন্ত্রণা তাকে দিলো তারপর এই গ্রামের দিকে ফিরে তাকাতেও ঘেন্না করছে রূপসীর।

গাড়ির দরজা খোলায় আছে কিন্তু ইফাদ বাইরে দাঁড়িয়ে নেই। রূপসী গাড়িতে বসে দরজা আটকে দিতেই গাড়ি ঝড়ের বেগে ছুটিয়ে নিলো ইফাদ। রূপসী ভয় পেয়ে গেলো। ভয়ে ইফাদের এক হাত খামছে ধরলো। ইফাদ নির্বিকার। সে চোখ মুখ শক্ত করেই গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রূপসী মনে মনে শুধু আল্লাহকে ডাকছে। আজ জান নিয়ে ফিরতে পারলেই হয়। হুট করে ব্রেক কষতেই রূপসী ছিটকে সামনে পড়ে যাচ্ছিলো তৎক্ষনাৎ ইফাদ এক হাতে ধরে ফেলে তাকে। হেঁচকা টানে সরিয়ে আনে। স্থির হতেই তাকে ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

–নেমে এসো।

ইফাদ নেমে পড়ে। কিন্তু রূপসীর দরজা সে খুলে দিলো না। রূপসী দরজা নিয়ে খানিকক্ষণ টানাটানি করতে থাকে। ইফাদ লক্ষ্য করতেই ফিরে এসে দরজা খুলে দেয়। রূপসী মাথা নিচু করে নেমে আসে।
সুনসান রাস্তা। দু একটা গাড়ি যাওয়া আসা করছে। অল্পক্ষণ পরেই ভোরের আলো ফুটে যাবে। আবার আলোকিত হবে চারপাশ৷ শুরু হবে ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত পদচারণা।
রাস্তার এক ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজনেই চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে ইফাদ বলে উঠে,

–তোমার বয়স কত?

রূপসী একবার চোখ তুলে তাকায়। ইফাদের চোখ মুখ কিছুটা স্বাভাবিক দেখা যাচ্ছে। রূপসী চোখ সরিয়ে আস্তে আস্তে জবাব দেয়,

–ষোলো।

–তুমি জানো ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে হওয়া বাল্যবিবাহ? যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

রূপসী মাথা নিচু করে আছে। কোনো জবাব নেই। ইফাদ ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। তারপর ধীর কন্ঠে বলে উঠে,

–তুমি এখনো অনেক ছোটো। তোমাকে কিভাবে কি বলব, কি বোঝাবো বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বলতে পারি তুমি পড়াশোনা করো, নিজের আর নিজের বাবার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালাও। আমি তোমার পাশে আছি ইনশাআল্লাহ পাশে থাকবো।

ইফাদের কথা শুনে রূপসীর সমস্ত দ্বিধা কেটে গিয়ে চকচক করে ওঠে চক্ষুদ্বয়। তার ম্যাজিস্ট্রের স্যার আর পাঁচজনের মতো নয়। তার স্বপ্ন পূরণে বাঁধা নয় বরং শক্তি হয়ে উঠবে তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যার। কিন্তু রূপসীর এই খুশিতে ভাটা পড়ে যায় ইফাদের বলা পরবর্তী কথাটি শুনে।

–কিন্তু…. আমার পক্ষে তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা বা অধিকার কোনোটাই দেওয়া সম্ভব না। তবে…

হয়তো আরো কিছু বলতে চাইলো। এটুকুই যথেষ্ট ভেবে থেমে গেলো। রূপসী ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। বিয়ে হয়েছে অথচ বউ হতে পারবেনা। বউ এর স্থান পাবে না। রূপসীর কপালে তবে এটাই ছিলো? ইফাদ সোজাসুজি তাকায় রূপসীর মুখের দিকে।

–কিছু বলবে না?

রূপসী না তাকিয়েই মাথা নেড়ে না বলে। ইফাদ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। রূপসী ঘুরে তাকিয়ে দেখে ইফাদ দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি রূপসীর দিকেই। ইফাদের দৃষ্টিতে কিছু একটা তো ছিলো। কিন্তু রূপসী তা ধরতে পারলো না।

সকাল পেরিয়ে বেলা হতে যাচ্ছে। কলিং বেলের শব্দে কপাল কুঁচকে তাকায় মারিয়া। এই অসময়ে কে এলো আবার? রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে দরজা খুলেই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায় সে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে আগাগোড়া ভালোভাবে দেখে নিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে,

–ইফাদ!! তুইই?

–বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে আপু?

–ওমা! তা কেন? আয় আয় ভেতরে আয়। তুই আমার বাড়িতে আসতে পারিস তাও নিজ ইচ্ছায়, আমি তো ভাবতেও পারছি না। তাই তো এতোটা অবাক হয়েছি।

মারিয়ার চোখ যায় ইফাদের পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ানো রূপসীর দিকে। সেদিকে দেখেই ইফাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
ইফাদ সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘরে ঢুকে পড়ে। ধপ করে সোফায় বসে বলে,

–খুব ক্লান্ত লাগছে আপু। এক গ্লাস শরবত আনো তো প্লিজ।

মারিয়া একবার ইফাদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় রূপসীর দিকে তাকিয়ে বলে,

–তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে এসো।

রূপসী প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। মারিয়া আবার বললো,

–বসো এখানে।

রূপসী জড়োসড়ো হয়েই সোফার এককোণে বসে পড়ে। ইফাদ বলে,

–রিয়াদ, রিমিকে দেখছি না কেন আপু? ওরা কোথায়?

–ভাই, এটা স্কুল টাইম। দুটোরই তো স্কুলে থাকার কথা তাই না?

–ওহহ সরি! খেয়াল করিনি।

মারিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রূপসীকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করছে। বোঝায় যাচ্ছে গ্রামের মেয়ে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ হলেও দেখতে নজরকাড়াই বটে। অল্পবয়সী এই মেয়ে তার ভাই এর সাথে কেন বুঝে উঠতে পারছে না সে। কিন্তু ভাই তার কারণটা তখনই বলবে যখন তার বলা উচিত বলে মনে হবে। এর আগে পেটে বোম মেরে দিলেও কেউ ওর মুখ খোলাতে পারবে না। ইফাদ আবার মারিয়াকে তাড়া দিয়ে বলে,

–কি হলো আপু! যাও না একটু শরবত নিয়ে এসো প্লিজ। পিপাসা পেয়েছে খুব।

মারিয়া উঠে দাঁড়ায়।

–বস, নিয়ে আসছি।

মারিয়া চলে যেতেই ইফাদ রূপসীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

–উনি হলেন মারিয়া আপু। আমাদের পরিবারের বড় মেয়ে। আমার একমাত্র চাচার বড় মেয়ে। আপু ভিষণ ভালো আর মিশুক একজন মানুষ। তবে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে পড়াশোনাটা আর করেননি।

রূপসী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

–ক্যান?

–আপুর নাকি পড়াশোনা ভালো লাগে না। তাই পরীক্ষা শেষেই বিয়ে দিয়ে দেয়। আপুর হাজবেন্ড ও যথেষ্ট ভালো। বর্তমানে মন দিয়ে সংসার করছে আপু। দুটো পিচ্চি পিচ্চি ছেলে মেয়েও রয়েছে। এলেই পরিচয় হবে তোমার সাথে।

–আমারে এইহানে ক্যান লইয়া আইছেন?

–কারণ তুমি এখানেই থাকবে।

রূপসী হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে এখানে কিভাবে থাকবে? এসব শহুরে মানুষদের সাথে সে কিভাবে চলবে? আবার তার বর ও তাকে বউ বলে স্বীকৃতি দেবে না। তবে সে কোন শক্তিতে থাকবে এখানে?
রূপসীর ভাবনার মাঝেই মারিয়া শরবত নিয়ে হাজির হয়। ইফাদ নিজের গ্লাসটি তুলে নেয়। মারিয়া রূপসীর দিকে একটি গ্লাস এগিয়ে দিয়ে সে ও বসে পড়ে। ইফাদ গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে বলে উঠে,

–আপু, ও হচ্ছে রূপসী। এখন থেকে তোমার কাছেই থাকবে?

–কিন্তু কে ও? কখনো দেখেছি বলেও তো মনে পড়ে না। তোর বান্ধবী হওয়ারও তো কোনো সুযোগ নেই। বাচ্চা মেয়ে। ওকে নিয়ে এলি কোথা থেকে সেটা তো বল?

ইফাদ পরপর আরো কয়েকবার গ্লাসে চুমুক দিয়ে অর্ধেকটা শরবত শেষ করে গ্লাসটি নামিয়ে রাখে। দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবে তারপর আড়চোখে রূপসীকে দেখে নিয়ে সরাসরি মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

–বিয়ে করে এনেছি ওকে। বউ হয় আমার।

চলবে…..