অপরিচিত প্রিয়জন পর্ব-১২+১৩

0
296

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_১২
#এম_এ_নিশী

সখিনা বেগম যতটা না ব্যথা পেয়েছেন তার চেয়েও বেশি বিলাপ জুড়ে বসেছেন। সেখানে উপস্থিত সকলেই এমন কান্ডে বেশ মজা পেয়েছে। মিটমিট করে হাসছে সবাই পাছে সখিনা বেগম দেখে ফেলে এটম বোমা না হয়ে যান। দুজন মহিলা এসে সখিনা বেগমকে তুলে দাঁড় করান। সখিনা বেগম রূপসীর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

–এইযে নতুন আফা আর কইবার আমারে ফালাইবেন। আপনের লাইগা আমি আমার সব হাড্ডি হারাইয়া ফালাইতাছি।

রূপসী ধীর কন্ঠে বলে,

–আমি বুঝতে পারি নাই, আমি ইচ্ছা কইরা করিনাই। ভুল হইয়া গেছে মাফ কইরা দেন।

সখিনা বেগম পুনরায় তার ভাবে চলে যান। কেউ তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, এই ভাবখানা ধরে রাখতে আবার তিনি সানগ্লাসটি চোখে লাগিয়ে কোমড় বাকিয়ে হেঁটে চলে যান। সখিনা বেগম চলে যেতেই সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
রূপসী ভিষণ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ওয়াহাব তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

–রিল্যাক্স! চাপ নিও না। কোনো ব্যাপার না। চলো এবার বারবিকিউ খাওয়া যাক।

রূপসী নাক সিঁটকায়।

–ছিহহ! খাওন যাইব না। কেঁচা মাংস।

–শোনো মেয়ের কথা। খেয়ে দেখো একবার। তারপর বলিও।

ওয়াহাব নিজে প্লেটে তুলে সার্ভ করে দেয় রূপসীকে। কিন্তু কাঁটাচামচ, ছুরি এসব দিয়ে তো সে খেতে পারবে না। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে ইফাদ। তার ইচ্ছে করছে রূপসীর কাছে এসে নিজেই মাংসগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো করে দিতে যেন রূপসীর খেতে অসুবিধা না হয়। মেয়েটা তো এভাবে খেতে পারবে না। শেষে দেখা যাবে তার খাওয়ায় হলো না। তবে তাদের সম্পর্কটার ব্যপারে এখানে উপস্থিত কেউই অবগত নয় শুধু মারিয়া, ওয়াহিদ ছাড়া। এখন সে আগবাড়িয়ে রূপসীকে সাহায্য করতে গেলে অনেকেই সেটা সহজভাবে নিবে না। আপাতত সে কারো মধ্যে সন্দেহ আনতে চায় না। মারিয়া এসে ইফাদকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,

–কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন প্লেট হাতে নিয়ে। যা বসে পড়। বসে খেয়ে নে।

–হুম খাচ্ছি।

ইফাদ একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে। তবে খায়না। প্লেট হাতে নিয়ে ওভাবেই বসে থাকে। কারণ রূপসীও না খেয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার চোখে মুখে কেমন অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। কিভাবে খাবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না। ইফাদ ভাবলো সে আর এতো কিছু ভাববে না এবার সত্যি সত্যি উঠে গিয়ে রূপসীকে সাহায্য করবে। যখনই সে উঠে দাঁড়াতে যায় তখনই ওয়াহাব এসে রূপসীর পাশে বসে পড়ে। রূপসীর সমস্যা বুঝতে পেরে সে নিজেই সাহায্য করতে থাকে রূপসীকে। মাংস ছোট ছোট পিস করে কেটে দিচ্ছে যেন রূপসী সহজে খেতে পারে। তবে রূপসীর মনে পড়ে গেলো সেদিন রাতের কথা যেদিন রেস্টুরেন্টে বসে সে শহুরে কায়দায় খেতে পারবে না বলে ইফাদও তার মতো তার ভঙ্গিমায় খেয়েছে, তাকে সঙ্গ দিতে। কে কিভাবে দেখছে কি ভাবছে তার তোয়াক্কা না করেই। রূপসী বুঝতে পেরেছিল সবটাই। সেই মুহুর্তটাকে ভীষণভাবে মনে পড়তে থাকে তার।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে লক্ষ তারার মেলা দেখতে বেশ ভালো লাগছে রূপসীর। যদি এই মুহুর্তে একটা চাঁদ থাকতো, গোল চাঁদ তবে ব্যপারটা আরো জমে যেতো। রূপসী আনমনে এসবই ভেবে যাচ্ছে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই যার যার ঘরে ফিরে গিয়েছে। রূপসীর মনটা এখনো উদাসীন। তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যার তার সাথে কোনো কথাই বলছে না। যদিও সে বুঝতে পারছে তাদের ব্যপারে কেউ জানেনা বলেই হয়তো দূরে দূরে থাকছে। উনি তো তাকে বউ হিসবে স্বীকৃতি দিতে পারবে না বলা সত্ত্বেও রূপসীর মন কেন এতো আনচান করছে? কি চায়টা কি সে? রূপসী নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে কিন্তু নিরুত্তর থাকে সবকিছু।
দরজায় নক পড়ার আওয়াজে চমকে উঠে রূপসী। বারান্দার দরজা দিয়ে মাথা বাঁকিয়ে দেখার চেষ্টা করে কে এসেছে। বারান্দার দরজা আর রুমের দরজাটা মুখোমুখি। সেই মুখোমুখি দরজার পিছন থেকে আরো একজন মাথা হেলিয়ে উঁকি দেয় ভিতরে। সেই মানুষটাকে দেখতেই রূপসীর হৃদপিণ্ড ধক করে উঠলো। প্রচন্ড বেগে উঠানামা করতে থাকে। ভিতরে হয়তো শীতল বাতাস অনুভব করছে সে। কি বলবে কি করবে বুঝতে না পেরে সোজা দাঁড়িয়ে থাকে সে। অপরদিক থেকে ধীর কন্ঠে ভেসে আসে একটি প্রশ্ন,

–ভিতরে আসতে পারি?

প্রশ্ন শুনে রূপসী তাড়াহুড়ো করে বলে উঠে,

–আসেন আসেন ভিতরে আসেন।

মানুষটি ভিতরে ঢুকে সোজা বারান্দায় চলে আসে। রূপসীর তাকিয়ে মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দেয়। রূপসীর সমস্ত মন খারাপ নিমিষেই গায়েব হয়ে যায়। সে আলতো স্বরে ডেকে ওঠে,

–ম্যাজিস্ট্রেট স্যার!

মনুষ্য মনে কত রকমের অনুভূতি লুকায়িত তা হয়তো তারা নিজেরাও বলতে পারবে না। হুটহাট কখন কোন অনুভূতির সাথে পরিচিত হয়ে যেতে হয় যার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে অনুভূতি গুলো হয় প্রগাঢ়। তা অনুভবেও যেন শান্তি। রূপসীর কাছ থেকে “ম্যাজিস্ট্রেট স্যার” ডাকটা শুনে নিজের অন্তরে যেই শীতলতা অনুভব করল সে তার পিছনে যথাযথ যুক্তি দাঁড় করানোর ক্ষমতা হচ্ছে না তার। যদিও সেই যুক্তি খোঁজার আর কোনো প্রচেষ্টাও নেই তার। থাক না কিছু অনুভূতি, যা হুটহাট জেগে উঠে এক পরম ভালোলাগার রেশ লাগিয়ে রেখে যাবে। ক্ষনিকের জন্যই হোক, কিছু ভাল স্মৃতি তো হবে। ইফাদ রূপসীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকায়। সহজ সরল নিষ্পাপ একখানা মুখ, গভীর মায়াবী চোখ। সেই চোখের বিশেষত্ব তার বড় বড় পাপড়িগুলো। গালদুটো দেখলেই মনে হয় দুটো ছোট ছোট রসগোল্লা। জোরে জোরে টেনে দিতে ইচ্ছে করে। পুরো মুখজুড়ে একটা বাচ্চামি ভাব থাকলেও তাতে ব্যক্তিত্বের ছাপও স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। ইফাদ দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সে আটকা পড়ে যাবে চিরতরে যা একেবারেই অনুচিত। গম্ভীর তবে নরমস্বরে বলে উঠে,

–তোমাকে একটা কথা জানাতে এলাম রূপসী।

–কি কথা কইবেন ম্যাজিস্ট্রেট স্যার?

ইফাদ চোখ বুজে নেয়। রূপসীর ডাকটা তার ভিতর কাঁপিয়ে তুলছে। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলে উঠে,

–তুমি তো জানোই আপাতত আমাদের সম্পর্কটা সকলের কাছেই গোপন রাখা প্রয়োজন। যার কারণ তোমার আমার বিয়েটা বাল্যবিবাহের মধ্যে পড়ে। আমার যেই প্রফেশন তাতে এটা জানাজানি হলে খুব ঝামেলা হয়ে যাবে। আমার প্রফেশনাল লাইফ ও পারসোনাল লাইফে চরম প্রভাব ফেলবে। তুমিও পার পাবে না। তোমাকেও ভুগতে হবে। তোমার এখন পড়াশোনা করার সময়, নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সময়। এখন এধরণের ঝামেলা তোমার ক্যারিয়ারেও বিশাল ক্ষতি করে দিতে পারে।

ইফাদ থেমে যায়। কিছু সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। রূপসী তখনো ইফাদের দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে ইফাদ বুঝি তাকে অন্তত বউ এর মর্যাদাটুকু দেবে। কাওকে কিছু নাই বা জানালো তবে নিজেদের মধ্যকার সম্পর্কটাতো স্বাভাবিক করতে পারে। ইফাদ পুনরায় বলতে শুরু করে,

–আপু, দুলাভাই ভিষণ ভালো মানুষ। তাদের কাছে তোমার দায়িত্ব দিয়েছি মানে আমি নিশ্চিন্ত আর তুমি নির্দ্বিধায় তোমার পড়াশোনা আর ক্যারিয়ারে ফোকাস করতে পারো। আর তোমাকে সবধরনের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য আমি তো আছিই। কাল আমি চলে যাচ্ছি।

–কিইই! কাইল আপনে চইলা যাইবেন? আমারে ফালাইয়া?

–কে বললো ফেলে যাচ্ছি। বললাম না আপু, দুলাভাই এর মতো গার্ডিয়ান থাকতে তোমাকে কোনো চিন্তা করতে হবে না।

–কই যাইবেন আপনি?

–কাজের জায়গায়। আমার পোস্টিং তো অন্য এলাকায়। আমাকে সেখানেই চলে যেতে হবে।

–এইহানে আর আইবেন না?

–দেখা যাক, সময় সুযোগ হয় কিনা। আচ্ছা অনেক রাত হয়েছে। কাল আমায় সকাল সকাল উঠতে হবে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। একা ঘুমাতে অসুবিধা হবে না তো?

রূপসী মাথা নেড়ে না বলে। তার চোখ ছলছল করছে। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে কিন্তু পারছে না।

–ঠিকাছে দরজা লাগিয়ে দাও। আমি আসি।

রূপসী পিছু ডাকে।

–ম্যাজিস্ট্রেট স্যার!

–হুম! বলো। কিছু বলবে?

–আপনে আমার লগে যোগাযোগ রাইখেন? বিয়া করা বউরে ফালাইয়া চইলা যাইতেছেন।

ইফাদ বুঝতে পারে রূপসীর মনের ভাষা, তার কথার সুর। এমনকি এও বুঝতে পারে তার প্রতি রূপসীর মনে অনুভূতি কাজ করে। এই বয়সে যা সাধারণত হয়ে থাকে। ইফাদ নিজেকে শক্ত করে কঠোর স্বরে বলে,

–তুমি অনেজ ছোট রূপসী। আমার চেয়ে মিনিমাম বারো বছরের ছোট তুমি। কিভাবে আমি তোমাকে বউ বলে স্বীকৃতি দিব? আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা কিভাবে হবে? কিভাবেই বা চলবে তুমি আমার সাথে? তাহলে কিভাবে টেনে নিয়ে যাব এই সম্পর্ককে? তাছাড়া বিয়ের জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকা জরুরি। সারাজীবনের ব্যপার। সেই মানসিক প্রস্তুতিটাই আমার ছিল না ইনফ্যাক্ট এখনো নেই। বিয়ে মানে রেস্পন্সিবিলিটি। সেসব রেস্পন্সিবিলিটি পালন করার মতো এ্যাবিলিটি এই মুহুর্তে নেই আমার। তাই এসব বিয়ে, বউ, ভুলে যাও প্লিজ। জাস্ট ভুলে যাও। তোমার মাধ্যমিকের রেজাল্ট পাবলিশড হলেই দুলাভাই তোমাকে ভালো একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করো জাস্ট। বাকি সব ভুলে যাও।

ইফাদ আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। হনহনিয়ে চলে গেলো। রূপসী ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যার এইভাবে তাকে এতো কঠিন কঠিন কথা বলে গেলো।। সে কি এতোই খারাপ? তার কি সত্যিই তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের বউ হওয়ার যোগ্যতা নেই? রূপসী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

ইফাদ জানে সে মেয়েটাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেললো। কিন্তু এ ছাড়া তার আর কোনো উপায়ও ছিল না। রূপসী যদি নিজের পড়াশোনা ছেড়ে ধ্যান জ্ঞান ইফাদের দিকে দিতে থাকে তবে এতে তারই ক্ষতি। এখন সে সেটা না বুঝলেও ইফাদ তো বোঝে। ভবিষ্যতের ভালো কিছুর জন্য বর্তমানের কিছু কাঠিন্যতা হজম করে নেওয়া প্রয়োজন।

সকালের শুভ্র আবহাওয়া বিরাজমান প্রকৃতি ভিষণ স্নিগ্ধতায় ছেয়ে আছে। মৃদু বাতাসে দোল খেতে থাকে গাছের পাতা থেকে শুরু করে মাটিতে গজানো ঘাস, লতা-পাতাও। পূব আকাশে সূর্যের দেখা মিলতে শুরু করেছে সেই সাথে ইফাদের যাওয়ার আয়োজনও শুরু হয়েছে। যাওয়ার আগে মারিয়া জোরজবরদস্তি করে একগাদা খাবার ঠেসেঠেসে খাওয়াতে থাকে তাকে। যেন সে আর কখনোই ফিরবে না, কখনোই খাওয়ানো সম্ভব না। ইফাদ আর না পেরে এবার উঠে দাঁড়ায়,

–অনেক হয়েছে আপু প্লিজ আর না। এবার আমাকে যেতে হবে।

–এটা কোনো খাওয়া হলো। এটুকু খেলি। আর একটু খা, শরীর খারাপ করবে।

–ব্যস, ব্যস! অনেক খেয়েছি। আর সম্ভব না।দুলাভাই আর ওয়াহাবের সাথে দেখা করেই এসেছি। রূপসীকে দেখে এলাম ও ঘুমোচ্ছে। ও উঠলে জানিয়ে দিও। আর খেয়াল রেখো ওর। একটু দেখেশুনে রেখো প্লিজ।

–বাপরে বাপ! এতো চিন্তা করতে হবে না তোকে। আমি সামলে নিব। তুই নিশ্চিন্ত থাক।

–থ্যাংকস আপু!

–হয়ছে এতো ফর্মালিটি দেখাতে হবে না। চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।

–তার কোনো প্রয়োজন নেই আপু। গাড়ি আছে তো আমার। চলে যাব। তুমি ভালো থেকো। আসি। আল্লাহ হাফেজ।

–ঠিকাছে। তুইও সাবধানে থাকিস। আল্লাহ হাফেজ।

ইফাদ চলে যায়। যাওয়ার মুহূর্তে দৃষ্টি একবার রূপসীর ঘরের দিকে চলে যায়। খুব ইচ্ছে করছে তার সাথে একটু কথা বলে যেতে। কিন্তু সম্ভব নয়।
গাড়ির কাছে এসে লক খুলে গাড়িতে উঠে বসতে গেলেই হঠাৎই কানে ভেসে আসে একটি ডাক।

–ম্যাজিস্ট্রেট স্যাআআররর!

ইফাদ যেন এই ডাকেরই অপেক্ষায় ছিল। ছুটে আসে। দেখে রূপসী দাঁড়িয়ে আছে গেটের কাছে। ইফাদকে দেখে এগিয়ে এসে বলে,

–আমার লগে দেখা না কইরাই চইলা যাইতেছেন?

–আসলে তুমি ঘুমিয়ে ছিলে তাই আর ডিস্টার্ব করিনি।

–আপনে সাবধানে থাইকেন। রাগ একটু কম কইরেন। মারামারি কইরেন না। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো কইরেন। আর…. ভালো থাইকেন।

রূপসীর কেয়ারিং কথাগুলো ইফাদকে আবার দূর্বল করে দিচ্ছে। হুট করেই এক অদ্ভুত ইচ্ছে খেলে গেলো তার মনে। রূপসীকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরার ইচ্ছে। তবে ইচ্ছে ইচ্ছের জায়গায় রয়ে যায়। পূর্ণতা পায় না। হুট করে রূপসী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। ইফাদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। মেয়েটা এতো আবেগি কেন? অল্পতেই কেঁদে দেয়। ইফাদ মৃদু হেসে আলতো করে রূপসীর দুচোখের জল মুছে দেয়। ইফাদের ছোঁয়া পেয়ে রূপসীর কান্না থেমে যায়। তার ইচ্ছে করে সময়টাকে এখানেই থামিয়ে দিতে। তবে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ইফাদ কোমল স্বরে বলে,

–পাগলী মেয়ে একটা। কেঁদো না। আমি একেবারে হারিয়ে যাচ্ছি না। তোমাকে আমি যা যা বলেছি তাই তাই করবে। বেশি এদিক ওদিক ছটফটিয়ে বেড়াবে না একদম। এখানে হারিয়ে গেলে খোঁজার জন্য কিন্তু আমি থাকব না। একটু সাবধানে থেকো আর নিজের খেয়াল রেখো। আসি।

ইফাদ গাড়িতে উঠে বসে। রূপসীর সামনে গাড়ি এনে জানালা দিয়ে তাকায় রূপসীর কান্না মিশ্রিত শুভ্র মুখখানার দিকে। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে,

–যদি ভাগ্য চায় তো আবার দেখা হবে। হয়তো সেই দেখা তোমার আমার দুজনের জন্যই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

ইফাদ গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে চলে গেলো দৃষ্টির আড়ালে। আর পিছনে রেখে গেলো সেই মায়াবী মুখের অধিকারীনীকে যে এখন অঝোরে অশ্রু বিসর্জনে ব্যস্ত।

চলবে…..

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_১৩
#এম_এ_নিশী

ইফাদ চলে গিয়েছে। ভাবতেই রূপসীর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে বারবার। কিন্তু করণীয় কিছুই নেই সবটা মেনে নেওয়া ছাড়া। রূপসী চোখ-মুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। ধীর পায়ে বাসায় ঢুকে পড়ে। ঠিক এর পরপরই আরো একটি গাড়ি এসে থামে গেটের কাছে। আওয়াজ শুনে রূপসী ভাবে হয়তো ইফাদ ফিরে এসেছে। সে ছুটে গেটের কাছে যেতেই দেখতে পায় তারই সমবয়সী একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নামছে। ড্রাইভার তার ব্যগপত্র ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা বেশ সুন্দর দেখতে। শহুরে ছাপে নিজেকে ফিটফাট করে রেখেছে। বোঝায় যাচ্ছে যথেষ্ট স্মার্ট। রূপসীকে দেখেই চোখ মুখ কুঁচকে চেনার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়ে শেষে প্রশ্নই করে বসে,

–তোমাকে ঠিক চিনলাম না। এই বিল্ডিং এ কি নতুন?

রূপসী মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে। মেয়েটা যেন খুশি হয়ে গেলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বলতে থাকে,

–আমার নাম ওহি তালুকদার। দো তোলার ৫ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকি। বড় ভাইয়ার বাসা এটা। আমি পড়াশোনার জন্যই আছি। আমাদের নিজস্ব বাড়ি অনেক দূরে। একটু গ্রামের দিকে। ওখানে আমার মা, বাবা, দাদা, দাদী আর চাচা চাচীরা থাকে। আমার পরীক্ষা শেষ বলেই বাড়িতে গিয়েছিলাম সবার সাথে দেখা করতে। এখন ফিরলাম। আমার বড় ভাইয়া এখানে জব করে। ভাবি আর দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে এখানে। ছোট ভাইয়া পাশের শহরে থাকে। ওর ভার্সিটি ওখানে। মাঝে মাঝে সে ও এসে এখানে থাকে। আমার সমবয়সী কোনো সঙ্গী ছিলো না এখানে। এখন তোমাকে পেলাম। আমার খুব খুব খুউউউব খুশি লাগছে। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার নামটাই তো জানা হলে না।

–আমি রূপসী। তুমিই মিষ্টি?

মেয়েটি বড় বড় চোখ করে তাকায় রূপসীর দিকে।

–এটা তো আমার ডাক নাম। তুমি কিভাবে জানলে?

–আমি তো তোমাগো বাসায়ই থাকি। কাইলই আইছি।

–কিহহহ! সত্যি। ওয়াও কি দারুণ।

মিষ্টি ছুটে এসে জাপটে ধরে রূপসীকে। যেন তার কত দিনের চেনা পরিচিত কাছের মানুষ সে। রূপসীরও বেশ ভালো লেগেছে। মিষ্টি রূপসীকে নিয়ে গল্প করতে করতে বাসায় ঢুকলো। মারিয়া দেখে বললো,

–কি রে! নতুন সঙ্গী পাওয়ায় ভাবি কি আউট?

–ভাবিইইইই!

মিষ্টি ছুটে গিয়ে ভাবিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলে,

–শুনলাম ছোট ভাইয়াও নাকি এসেছে।

–হ্যা ৩-৪ দিন হলো ওয়াহাবের আসা। সম্ভবত আর ২ দিন থেকেই চলে যাবে।

–বড় ভাইয়া ঘুমাচ্ছে?

–হ্যা রে একটু পরেই উঠে যাবে। তুই যা ফ্রেশ হয়ে নে। রূপসী তুমিও এসো। খেয়ে নাও। আর শোন মিষ্টি রূপসীকে তোর ঘরটায় থাকতে দিয়েছি কিন্তু।

–বেশ করেছো ভাবি। আমি তো ভিষওওণ খুশি হয়েছি ওকে পেয়েই।

–আচ্ছা আচ্ছা যা এবার।

নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার উল্টো দিকে ফিরে আসে মিষ্টি। ভাবির দিকে তাকিয়ে বলে,

–শোনো না ভাবি, শুনলাম কাল নাকি ইফাদ ভাইয়া এসেছিলো?

–হ্যা এসেছিলো তো। তাতে কি হয়েছে?

–কোথায় গো উনি? ঘুমাচ্ছেন নাকি?

–জি না। তুই আসার একটু আগেই চলে গেলো?

–কিইইই! ইফাদ ভাইয়া চলে গিয়েছে। আমার সাথে দেখা না করেই?

–কেন তুই কোন দেশের মন্ত্রী যে তোর সাথে দেখা করেই যেতে হবে?

–এভাবে তুমি আমাকে আন্ডারেস্টিমেট করতে পারো না ভাবি। আমার মধ্যে যথেষ্ট ট্যালেন্ট রয়েছে। চাইলে ওসব মন্ত্রী মিনিস্টার হয়ে যাওয়া আমার পক্ষে কোনো ব্যপারই না। বাট ইউ নো, আই হেভ নো ইন্টারেস্ট।

মিষ্টির অভিনয় করে বলা কথাগুলো শুনে রূপসী খিলখিল করে হেসে ওঠে। মারিয়াও হাসতে হাসতে রান্নাঘরে চলে যায়। যেতে যেতে বলে,

–ড্রামা বন্ধ করে ফ্রেশ হয়ে আয় জলদি, খাবার দিচ্ছি।

ভাবির কাছ থেকে বিশেষ পাত্তা না পেয়ে মিষ্টি রূপসীর দিকে ফিরে বলে,

–এই রূপসী কাল ইফাদ ভাইয়া কি সারারাত ছিলো?

–হ ছিলো তো।

–ইশ! এই সুযোগটা আমি কিভাবে মিস করে গেলাম।

–ক্যান কি হইতো?

–আরেএএ জানো না? ইফাদ ভাইয়া হচ্ছে আমার ক্রাশ।

–হেইডা কি?

–ক্রাশ মানে হচ্ছে ভালো লাগা। যাকে আমাদের খুব ভালো লাগে। ইফাদ ভাইয়া কেমন হিরোর মতো ফাইট করে অলটাইম এজন্যই তো উনাকে আমার খুব ভালো লাগে।

–শুধু নাইওকের মতোন মাইরপিট করার লাইগায় ভাল্লাগে?

–হ্যা আর নইতো কি। আচ্ছা তুমি বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

মিষ্টি চলে যায় নিজের ঘরে। রূপসী হাসতে থাকে মিষ্টির এমন বাচ্চামো দেখে। নিজের প্রতিচ্ছবিই যেন দেখতে পাচ্ছে সে মিষ্টির মধ্যে।
রূপসী সোফার ওপর বসে পড়ে। বাবা, মা, মৌটুসী কোথায় আছে? কি করছে? বড্ড বেশি জানতে ইচ্ছে করছে তার। কিভাবে খুঁজে পাবে তাদেরকে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে সে যেভাবেই হোক তার বাবা, মা আর বোনকে সে খুঁজে বের করবেই করবে।

রুমে ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করতে না করতেই ফোন বেজে ওঠে ইফাদের। তার মা আফিয়ার কল,

–মাই ডিয়ার আম্মাজান, আমি পৌঁছে গিয়েছি। চিন্তা করো না।

–এটা কি তুই ঠিক করলি? বাড়ি না ফিরে সোজা ওখানে চলে গেলি?

–মা, জানোই তো কতো ব্যস্ত থাকি।

–জানি জানি। তোদের সবার শুধু ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। এই ব্যস্ততা যেন শেষ হয় না। আজ আমি অপেক্ষায় আছি তো তাই তোদের ব্যস্ততা শেষ হয়না। যেদিন ব্যস্ততা শেষ হবে সেদিন অপেক্ষা করার জন্য এই আমিই থাকব না দেখিস।

–এতো অভিমান! বাব্বাহ! কেন এভাবে বলছো মা? তুমি জানো না তুমি এভাবে বললে আমার কষ্ট হয়? তুমি যদি চাও আমি এই মুহুর্তে তোমার কাছে ফিরে যাচ্ছি। কাজকর্ম সব চুলোয় যাক। তোমার চেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট আমার কাছে আর কিছুই না মা কিছুই না।

–হয়েছে হয়েছে থাক আর এতো আহ্লাদ করতে হবে না। একটা যদি বিয়ে করিস তাও তো ভালো লাগে। ওখানে একা একা থাকিস। কি খাস না খাস কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। একটা বউ থাকলে সে অন্তত তোর খেয়াল রাখতো। আমি এতেই শান্তি পেতাম।

মায়ের কথা শুনে ইফাদের চোখের সামনে রূপসীর মায়াবী মুখখানা ভেসে ওঠে। মনে মনে বলে, “বিয়ে তো করেই ফেলেছি মা, বউ আছে তবে থেকেও নেই। কিছু জিনিস পেয়েও যে পাওয়া হয় না।”

–কিরে চুপ করে আছিস কেন কিছু বল। আচ্ছা শোন না তোর বাবাকে কোন মন্ত্রী নাকি প্রস্তাব দিয়েছে। তার মেয়ের জন্য তোকে জামাই হিসেবে চায়ছে। তুই রাজি থাকলেই কথা আগাবে। এবার বল তোর কি মত?

–মাআআ! কতবার বলব এই ব্যপারে প্লিজ আমাকে কিছু বলিও না। আমি এসব নিয়ে এখন ভাবতে চাইনা।

–আর কতোদিন বল? এবার রাজি হয়ে যা না বাবা। তোর বাবার কিন্তু এই প্রস্তাবে ভিষণ আগ্রহ। তুই রাজি হলে খুব খুশি হবে তোর বাবা।

–আর আমার খুশি?

–তোর কি কোনো পছন্দ আছে?

–থাকতেও তো পারে?

–কে সে বল না মাকে?

–সময় হলেই জানতে পারবে মা। আমি এখন রাখি। পরে ফোন করব।

আফিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন রেখে দেয় ইফাদ। তপ্ত শ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে দৃষ্টি বাইরে নিক্ষেপ করে। আনমনেই বিরবির করে বলতে থাকে, “রূপসী!”

মকবুল কাকার দেওয়া সেই পুটলিটা বের করে রূপসী ভিতরে বেশ কিছু কাগজপত্র দেখতে পায়। এসব কিছু তার কলেজে ভর্তির জন্য দরকারি কাগজপত্র। রূপসী সেগুলো বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। তার বাবা বিশ্বাস রেখেছিলো সে ফিরবে আর তাই তার ভবিষ্যৎ আর তার স্বপ্ন পূরণের পথটা যতটা সম্ভব সহজ করে দেওয়ার শেষ চেষ্টা করে গিয়েছে।

রূপসীর মাধ্যমিক ফলাফল প্রকাশিত হয়। আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করে মিষ্টির সাথে নতুন কলেজে ভর্তি হয়ে যায় সে। জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় তার। গ্রামের মেয়ে থেকে শহুরে মেয়ে হয়ে ওঠার যাত্রাটাও বেশ যত্নের সহিত আরম্ভ করে সে। তবে এই যাত্রায় প্রতিটি পদে পদে প্রতি মুহূর্তে বাবা মাকে স্মরণ করে গেছে সে। আরো একজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে, খুব করে, সে হলো তার “ম্যাজিস্ট্রেট স্যার!”

দেখতে দেখতে কেটে যায় দু’টি বছর।
রূপসীর উচ্চ মাধ্যমিকও সম্পন্ন হয়ে যায়।
কথা ছিলো রূপসীর সম্পূর্ণ পড়াশোনা শেষ হলেই ইফাদ ধরা দেবে। তবে রূপসীর উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই রংধনুর সাত রং নিয়েই যেন হুট করে আগমন ঘটে ইফাদের, রূপসীর জীবনে।
বিদায়বেলায় ইফাদের বলা শেষ কথাটি সত্যি করতেই যেন ইফাদের আগমন।
“যদি ভাগ্য চায় তো আবার দেখা হবে। হয়তো সেই দেখা তোমার আমার দুজনের জন্যই এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।”

চলবে……