অপরিচিত প্রিয়জন পর্ব-৬+৭

0
306

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_৬
#এম_এ_নিশী

একজন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী যার আচরণে সর্বদা কঠোরতা দৃশ্যমান। সবকিছু হিসেব কষে চলা যার ধাত। জটিল কেসে মস্তিষ্ক ডুবিয়ে আর আসামিদের দৌড় করিয়ে রাখা যার প্রিয় কাজ, উপরন্তু যাকে বরাবরই সকলে ভয় করে চলেছে। সেই মানুষ ‘খন্দকার ইফাদ আহমেদ’ কে নাকানি চুবানি খাইয়ে চলেছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের এক পুঁচকে মেয়ে। ব্যাপারটা হাস্যকর হিসেবে দেখবে নাকি কঠোরতার সাথে? দ্বিধাদ্বন্দে ভোগার মতোই বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। তবে এবার বুঝি এই মানুষটির প্রতি ওই পুঁচকে মেয়ের একটু দয়া হলো। খুব বেশি দৌড় করালোনা। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলতে মুহুর্তেই চোখে ভেসে ওঠে সেই চঞ্চলা, দুরন্ত কিশোরী যার পদযুগল যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহরের এই দূষিত রাস্তায়।
মেলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপসী। কিছু একটা খুঁজে চলেছে। ইফাদ তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। রাগ সংবরণ জরুরি হয়ে পড়েছে তার। পরপর কয়েকবার শ্বাস নিয়ে ছেড়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করলো সে। তারপর দ্রুত এগিয়ে গেলো।

–তোমাকে আমি কোথাও একটা দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলাম?

রূপসী চমকে উঠে। কখন তার পাশে এসে ইফাদ দাড়িয়েছে খেয়াল করেনি। সে ওই আতশবাজি ফাটানোর উৎস খুঁজতে এসেছিলো। এতোটাই মনোযোগ ছিল সেদিকে যে ইফাদ যে তাকে দাঁড়াতে বলে গাড়ি আনতে গিয়েছিলো সেটাই ভুলে বসেছে। শুকনো ঢোক গিলে একটু হাসার চেষ্টা করলো সে। আমতা আমতা করে বললো,

–আ-আ-আমি ওইগুলান দেখতে…

হুট করেই রূপসীর হাতের দিকে নজর যেতেই ভ্রু কুঁচকে ওঠে ইফাদের।

–তোমার হাওয়ায় মিঠাই তো প্রায় হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার পথে। খেয়েছো বলে তো মনে হয় না।

এতোক্ষণে যেন রূপসীর হুশ ফিরলো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে তার টুকটুকি ফুল বেশিরভাগটাই গায়েব। সে তো খেতেও পারেনি ভালো করেনি। ইফাদ ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে, মেয়েটি চোখগুলো প্রথমে গোল গোল করে তাকায়, তারপর কপাল কুঁচকে কিছু ভাবে, হুট করে ঠোঁট উল্টে আসে। অতঃপর ইফাদকে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়। ইফাদকে যেন আজ কেউ বাঁশের কঞ্চি দিয়ে যত্ন করে পেছনপানে ছুঁয়ে দিচ্ছে। ওইতো, সে স্পষ্ট সপাংসপাং আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। এই পুঁচকে মেয়ে তাকে আজ কোন জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে এই ব্যপারে সে আর এক বিন্দুও ভাবতে।চায় না।

–আমার টুকটুকি ফুউউউউললল।

রূপসীর কান্নার আওয়াজ তীব্র হতেই ইফাদ বিব্রতকর দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। না জানি তাকে বখাটে ভেবে আজ পাবলিক প্লেসে মার না খেতে হয়। সে তড়িৎ গতিতে রূপসীকে কান্না থামাতে বলে ছুটে যায় হাওয়ায় মিঠাই বিক্রেতার কাছে। আরো একটি মিঠাই এনে রূপসীর হাতে দিতেই সে চুপ করে যায়। আশেপাশের সকলের তীর্যক দৃষ্টি তাকে ভয়াবহ অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এবার সে রূপসীকে কিছু না বলেই গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রূপসী এগিয়ে এসে গাড়িতে উঠতেই ইফাদ যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি ছুটানোর ব্যবস্থা করে। রূপসী মনে মনে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। মূলত সে ইফাদের রাগ থেকে বাঁচতে চাইছিলো। হাওয়ায় মিঠাই এর জন্য কান্না! সে তো একটি অযুহাত ছিলো মাত্র। তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারের ঘূর্ণিঝড় হতে বাঁচার অযুহাত।

______________

আধাপাকা ইটের রাস্তার ধার ঘেঁষে এক গোডাউন ঘর। সেমিপাকা ঘরটির উপরে টিনের ছাউনি। আশেপাশে বাড়িঘর খুব একটা নেই। নিস্তব্ধ পরিবেশ। গোডাউন ঘরের ভিতরে হাতল ভাঙা একটি কাঠের চেয়ারে এক পা তুলে বসে আরাম করে সিগারেট ফুঁকছে মনসুর আলী। তার সামনে মাদুর বিছানো মেঝেতে বসে রয়েছে কাশেমসহ আরো তিনজন। সকলের মুখেই ভয়ের ছাপ। মনছুর আলী সময় নিয়ে সিগারেট খাওয়া শেষ করল। শেষ অংশটুকু চেয়ারের আরেক হাতলে পিষে আগুন নিভিয়ে তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কাশেমের দিকে তাকিয়ে বলে,

–আইজ আমার দুবাই যাওনের কথা আছিলো। মাইয়াগো লইয়্যা। কামডা কি ঠিক হইলো?

–গুরু আমরা তো কইবার পারতাম না ওই ম্যাজিস্টেরেট আইসা পড়বো।

মনছুর আলী প্রচন্ড ক্ষেপে যান। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে সজোরে লাথি মেরে ফেলে দেয় চেয়ারটি। তীক্ষ্ণ কন্ঠে চেঁচিয়ে বলে,

–তাইলে তোরা জানোস কি? তোগো মতো আকাইম্মা রাইখা আমার লাভ কী? যেই কোটি টেহার লোকসান আইজ হইলো হেইডার হিসাব বড় বসরে কেমনে দিমু ক?

কাশেম আলী সহ বাকি সবাই ভিষণ চিন্তায় ডুবে যায়। এই বড় বসকে তারা কোনোদিন দেখেনি। এই মানুষটার আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কি না তাও জানে না তারা। এমনকি কোনো পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট কেউই তার সম্পর্কে অবগত নয়। তবে আজ পর্যন্ত মনছুর আলীকে তারা গুরু মেনে সব কাজ করলেও উদ্দেশ্য থাকে বড় বসের সন্তুষ্টি।

_____________

রূপসীদের গ্রামের মাথায় গাড়ি ঢুকতেই রূপসী থামতে বলে। ইফাদ গাড়ি থামিয়ে ঘুরে তাকাতেই রূপসী বলে উঠে,

–এই রাস্তা ম্যালা ছোডো। আপনের এত্তো বড় গাড়িখান ঢুকবো না ম্যাজিস্ট্রেট স্যার। আমারে এইহানে নামায় দ্যান। আমি চইলা যামু।

–বেশ গাড়ি আমি এখানেই রাখছি। তবে তোমাকে তোমার বাড়ি অবধিই দিয়ে আসবো আমি।

ইফাদ গাড়ি থেকে নেমে রূপসীর দরজা খুলে দেয়। রূপসীও নেমে আসে। গাড়ি লক করে এসে রূপসীর সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকে সে। আবছা অন্ধকারে ঢাকা গ্রাম্য রাস্তায় এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে ইফাদের। এভাবে নিশুতি রাতে গ্রামীন রাস্তায় চলাচলের অভিজ্ঞতা হয়নি কখনোই। অবশ্য তার মন্দ লাগছে না। রূপসী বেশ লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। বোঝায় যাচ্ছে তার চেনা পরিচিত রাস্তা। তবে ইফাদের একটু অসুবিধাই হচ্ছে বৈকি। বেশ খানিকটা পথ হেঁটে অবশেষে রূপসীর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো দুজন। বাড়ির উঠোনে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো দেখে রূপসী অবাক হয়ে যায়। তাদের গ্রামে হাতে গোনা কয়েকজনের বাড়িতেই বিদ্যুৎ রয়েছে। যাদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো। কিন্তু রূপসীদের তো বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিলো না। তবে উঠোনে বাতি এলো কিভাবে? তবে কি তার বাবা লাগিয়েছে? দুটো দিন তো হলো সে ছিলো না। এই দুদিনই যেন তাদের বাড়ির আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। মূল ফটকের কাছে এগোতেই ইফাদ ডেকে ওঠে,

–রূপসী!

রূপসী পিছন ফিরে তাকায়।

–তুমি তো বাড়িতে এসেই পড়েছো। তবে তুমি যাও। আমাকে এখনি আবার শহরের দিকে ফিরতে হবে।

–এ কি কথা কন ম্যাজিস্ট্রেট স্যার। একবার আমাগো বাড়িত আসবেন না। একটু পানি তো খাইয়া যান।

–তা সম্ভব নয় রূপসী। তুমি যে বলেছো এর জন্য ধন্যবাদ। আমাকে কাল সকালেই অফিসে উপস্থিত থাকতে হবে। এটা জরুরী। তাই এখন না বেরোলে বেশ দেরি হয়ে যাবে। ভালো থেকো। আসি তাহলে।

–চইলা যাবেন? আইচ্ছা।

রূপসীর মনটা কেন জানি খারাপ খারাপ করছে। সে ইফাদকে বিদায় জানালো। ইফাদও বেশ তাড়া নিয়েই চলে গেলো। রূপসী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ইফাদের যাওয়ার পানে যতক্ষণ না ইফাদ অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই রূপসী খেয়াল করে মুরগীর খোঁয়াড় ফাঁকা। ছাগল গুলোও খুপরি ঘরটাতে নেই। রান্নাঘরের দরজা পুরোটাই খোলা। অথচ তার মা রাতে রান্নাঘরের দরজা ভালোভাবে লাগিয়ে যান। এসব দেখতে দেখতে যখন সে সদর দরজার দিকে আসে সেদিকে তাকিয়েই যেন মুহূর্তেই তার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। দরজায় তালা ঝোলানো। তার জানা মতে কাছে পিঠে তাদের এমন কোনো আত্মীয় স্বজন নেই যাদের বাড়িতে তারা যেতে পারেন। বহুদূরে তার এক খালার বাড়ি রয়েছে তবে তারা তো শহরে থাকে। গ্রামে খুব একটা আসে না বললেই চলে। তাহলে তার বাবা মা কোথায় গেলো? এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে?
গভীর রাত। জনমানবের কোনো শব্দ নেই হয়তো সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। আশপাশ থেকে ঝিঁঝিঁ ডাকার শব্দ আসছে। দূরে কোথাও খেঁকশিয়াল ডাকছে। রূপসীর ভিষণ ভয় হতে শুরু করে। সে মূল ফটকের কাছে এসে এদিক ওদিক তাকায়। নাহ! কাওকে দেখা যাচ্ছে না। রূপসীর কান্না পায়। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। হঠাৎ একটা পায়ের শব্দ শুনে তটস্থ হয়ে দাঁড়ায়। শব্দ অনুসরণ করে তাকাতেই দেখতে পায় দূর থেকে কেউ একজন টলমল পায়ে হেঁটে আসছে। অন্ধকারে মুখ চেনার উপায় নেই। হয়তো পরিচিত কেউ হতে পারে ভেবে রূপসী দাঁড়িয়ে তার আসার অপেক্ষা করতে থাকে। যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়। তার মা-বাবার খবর পাওয়া যায়। মানুষটি রূপসীর কাছাকাছি আসতেই তার আশার বাতি দপ করে নিভে গিয়ে একরাশ ভয়ের অনুভূতি সৃষ্টি করে। কারণ সেই মানুষটি ছিলো তাদের গ্রামের মাতব্বর কুদ্দুস মিঞার একমাত্র ছেলে দিদার। গ্রামের সবচেয়ে নষ্ট ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছেলে। তার কুনজর থেকে বাঁচতে পারেনি গ্রামের একটি মেয়েও। এমনকি রূপসীও নয়। দিদারকে দেখে রূপসী ধীর পায়ে পিছনে ফিরে আসে। দিদার যেন কোনোভাবেই তাকে দেখতে না পায়। ফটকের পাশে গাঢ় অন্ধকারে নিজেকে আড়ালে করার চেষ্টা করে। এই মুহুর্তে এর বেশি পিছতে গেলে দিদারের নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রূপসী নিজের সমস্ত নড়াচড়া বন্ধ করে নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। দিদার টলতে টলতে রূপসীদের বাড়ির ফটকের কাছে এসে পড়ে। গুনগুন করে গান গায়ছে সে। একবার রূপসীদের উঠোনের দিকে তাকায়। রূপসীর আত্মা যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। দু হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সে। যদি দিদার আরেকটু সরে আসে তবেই রূপসীকে দেখতে পেয়ে যাবে। কয়েক সেকেন্ড দিদার উঠোনের দিকে তাকিয়ে পুনরায় টলতে টলতে এগিয়ে যায়। রূপসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজার কাছে থাকা ছোটো বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে। তার শরীর চলছে না আর। এতো কঠিন পরিস্থিতি পার করে এসেও সে বাবা মায়ের কাছে পৌঁছাতে পারলো না এখনো। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। ভিষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। এক হাতে সে জল মুছতেই কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পায়। হৃৎপিণ্ড ধরাস করে লাফিয়ে উঠে তার। সারা শরীর শিরশির করে ওঠে। ভয়ে পাথর হয়ে যায় সে। কোনোরকমে খাপছাড়া ভাবে উচ্চারণ করে,

–দি-দি-দার, দিদার ভাইইই……

চলবে…..

#অপরিচিত_প্রিয়জন
#পর্ব_৭
#এম_এ_নিশী

–কি রে রূপসী সুন্দরী!

কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজে এই বাক্যটি শোনা মাত্র শরীরের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেলো রূপসীর। দিদার তার পাশে এসে এক হাত পিঠের কাছে রেখেছে। আরেক হাত তার মুখের ওপর দিয়ে নিয়ে আরেক পাশে রেখে তার দিকে ঝুঁকে আসে। তীব্র মদের গন্ধে রূপসীর দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে ধাক্কা মেরে দিদারকে সরিয়ে দিয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়ায়।

–দিদার ভাই আপনি এইহানে ক্যান? যান এইহান থেইকা।

–চইলাই তো গেছিলাম। মনে হইলো কেডা যেন আছে এইহানে তাই ঘুইরা আইসা দেহি রূপসী সুন্দরী।

বলেই এক হাত দিয়ে রূপসীর থুতনি ধরতেই রূপসী ছিটকে সরে যায়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাতে থাকে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সজাগ করছে। খারাপ কিছুর আভাস দিচ্ছে। রূপসী ছুটে পালাবে কি না ভাবতে থাকে। কিন্তু পালিয়েই বা কোথায় যাবে? বাবা মা ও তো নেই। এই মুহুর্তে তার ম্যাজিস্ট্রেট স্যারকে ভিষণ মনে পড়ছে।

সম্মুখে দৃষ্টি রেখে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত ইফাদ। কি মনে করে যেন বেখেয়ালে পাশ ফিরে তাকাতেই হুট করেই মনে পড়ে যায় রূপসীর কথা। ম্যাজিস্ট্রেট স্যার! ম্যাজিস্ট্রেট স্যার! করে করে কান ঝালাপালা করে দেওয়া, একটু গাড়ি থেকে নামার সুযোগ পেলেই এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানো, যা-ই দেখবে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকা, গাড়িতে বসে বোর হলে একাতে ওকাতে ছটফট করতে থাকা, সবকিছুই যেন চোখের সামনে ভাসতে থাকে তার। সে কি রূপসীকে মিস করছে? মাত্র একদিনের আলাপে কি সত্যিই কাওকে মিস করা যায়? কে জানে! ইফাদের তা বোধগম্য হয় না। আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। কয়েক সেকেন্ড সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে স্টিয়ারিং এ জোরে আঘাত করে হাত দিয়ে।

–শিটট! মেয়েটাকে বাড়ির গেটেই ছেড়ে দিয়ে আসলাম। অথচ সে তার বাবা মা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো কি না সেটাই খেয়াল করলাম না। শেইম অন ইউ! ইফাআআদদ! হাউ কুড ইউ বি সো ইররেসপন্সিপল!

নিশুতি রাতের এই নিস্তব্ধ পরিবেশে তীব্র শব্দে ধ্বনিত হয়ে ওঠে ইফাদের গাড়ি ঘোরানোর আওয়াজ!

রূপসী কোনো কিছু না ভেবেই ছুটে বাড়ির মূল ফটকের দিকে যায়। কিন্তু সুবিধা করতে পারে না। দিদার এক হাতে জাপটে ধরে তাকে।

–কই যাস, রূপসী সুন্দরী! এত্তো সুন্দর সুযোগ আইজ আমি হাতছাড়া করমু ভাবছস।

দিদার রূপসীকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে তাদের বাড়ির সদর দরজা অবধি নিয়ে আসে। রূপসী হাত ছড়ার চেষ্টা করতে করতে বলতে থাকে,

–আমারে ছাড়েন! ছাড়েএএনন আমারে দিদার ভাই!

এক হাতে রূপসীকে ধরে আরেক হাতে প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার তালা খোলে দিদার। রূপসী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

–আমাগো ঘরের চাবি আপনের কাছে ক্যান?

–হা হা! তোগো বাড়ি আর তোগো নাই। এই বাড়ির দখল এহন আমার আব্বার। দেখস না বাত্তি জ্বালাইয়া রাখছে আমার আব্বা।

–আমার আব্বা আম্মা কই?

–আইজ সক্কালেই গেরাম ছাইড়া চইলা গেছে।

তালা খোলা হলেই রূপসীকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের মেঝেতে ফেলে দেয় দিদার। রূপসীর বাবা মা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে এই ধাক্কাটাই সামলে উঠতে পারছে না সে। তাই তো মেঝেতে পড়ে গিয়ে তার হাত ছিলে যাওয়াতে কোনো হুশ হলো না তার। তখনো স্থির হয়ে রয়েছে সে। কিন্তু বেশিক্ষণ আর থাকতে পারলো না। দরজাটা হালকা ভেজিয়ে দিয়েই দিদার রূপসীকে টেনে নিয়ে যায় ঘরে পাতানো চৌকিটার দিকে। রূপসী মেঝেতে বসেই দিদারের পা আঁকড়ে ধরে। অবাধ ধারায় চোখের জল গড়াচ্ছে তার। দিদারের কাছে নিজের সম্মানের ভিক্ষে চাইছে সে।

–ছাইড়া দেন দিদার ভাই। আমার এত্তো বড় সর্বনাশ কইরেন না ভাই। আপনের পায়ে পড়ি।

দিদারের মনে বিন্দু পরিমাণ দয়ার সঞ্চার হলো না। সে রূপসীকে টেনে তুলে আছড়ে ফেলে দিলো চৌকিতে। উত্তেজনায় তার ধৈর্য্য কুলিয়ে উঠছে না। গায়ের শার্ট টা ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে রূপসীর দুহাত দুদিকে চেপে ধরে। রূপসীর করুণ আর্তনাদ, পাগলের মতো সম্ভ্রমের ভিক্ষে চাওয়া, তার কান্না কোনো কিছুই দিদারের মনে প্রভাব ফেলতে পারলো না। নিজের কুবাসনা চরিতার্থ করার প্রয়াসে মত্ত সে। রূপসীকে শক্তভাবে চেপে ধরে তার দিকে ঝুঁকে আসতেই বাইরে থেকে ভেসে আসে এক চেনা পরিচিত কন্ঠস্বর,

–রূপসীইই!

দিদার লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। রূপসী সুযোগ পেয়ে দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে আসে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার একমাত্র ও পরম ভরসা তার “ম্যাজিস্ট্রেট স্যার!” রূপসীর বিধস্ত চেহারা দেখে ইফাদ অবাক হয়ে যায়। বোঝায় যাচ্ছে মেয়েটা খুব কেঁদেছে। এখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আচমকা রূপসী তীব্র বেগে ঝাপিয়ে পড়ে তার বুকে। টাল সামলাতে না পেরে দু পা পিছিয়ে যায় ইফাদ। সে তখন অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। রূপসীর কান্নার বেগ তীব্র হয়। প্রচন্ড ভয় আর কষ্ট নিয়ে কাঁদছে সে। ইফাদ এক হাত আলতো করে রূপসীর বাহুতে রেখে আরেক হাতে মাথায় হাত বুলাতে থাকে।

–কি হয়েছে রূপসী? তুমি এতোটা ভয় পেয়ে আছো কেন? কেউ কি কিছু বলেছে? তোমার বাবা মা কোথায়? কাঁদছো কেন? বলো আমাকে?

রূপসীর কান্না ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ইফাদের প্রশ্নের উত্তর হয়েই যেন ধীরভাবে বেরিয়ে এলো দিদার। কন্ঠস্বর অপরিচিত ছিলো। বুঝতে পারেনি কে সে। তাই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। রূপসীকে জড়িয়ে থাকতে দেখে এটুকু বুঝলো রূপসীর পরিচিত কেউ হবে। আর কিছু না ভেবে রূপসীদের বাড়ির পিছনের দিকের রাস্তাটা দিয়ে ছুটে পালানোর উদ্দেশ্যে এগোতেই ইফাদ ধমকে উঠে,

–এই ছেলে, দাঁড়াও ওখানে।

ইফাদের ধমকে দিদার থমকে দাঁড়ায়। পা যেন কেউ আটকে দিয়েছে মাটির সাথে। ইফাদকে সে চেনে না। তবুও লোকটাকে দেখে তার ভয় হচ্ছে খুব। এই গ্রামে সে কাওকেই খুব একটা ভয় করে চলে না। গ্রামের মাতব্বরের ছেলে হওয়ার সুবাদেই তার এই ক্ষমতা। তবে এই অচেনা অজানা মানুষটার মধ্যে কিছু তো একটা আছে যা দিদারের ভিতরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।
ইফাদ রূপসীকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিদারের দিকে এগিয়ে আসতেই দিদার ছুট লাগায়। ইফাদ যা বোঝার বুঝে যায়। সে ও তার পা দুটোকে কাজে লাগিয়ে দেয়। দিদার জানে না কোন ব্যক্তির কাছ থেকে সে পালাতে চাইছে। কয়েক কদম যেতেই ইফাদ ধরে ফেলে দিদারকে। সজোরে দুটো থাপ্পড় লাগায় ইফাদ দিদারের দু গালে। শার্টের কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনে যেভাবে সে রূপসীকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো। টানতে টানতে রূপসীর পায়ের কাছে এনে ফেলে তাকে। রূপসীর দিকে তাকিয়ে বলে,

–রূপসী বলো আমাকে, এই ছেলে তোমার সাথে অসভ্যতামি করেছে?

রূপসী দিদারের দিকে তাকায়। ইফাদ পুনরায় বলে উঠে,

–ভয় পেও না রূপসী। আমি তো আছি।

ইফাদের কথায় রূপসী ভরসা পেয়ে উপরে নিচে মাথা ঝোঁকায়। সাথে সাথে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ইফাদের। চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ ধারণ করে। প্রচন্ড রাগে কপালের শিরাগুলো ফুলে ফুলে উঠছে। হাতের মুঠো শক্ত করে। দিদার কোনোরকমে নিজেকে দাঁড় করাতেই সজোরে মুষ্টাঘাত পড়ে তার গালে। মুহুর্তেই তার মাথা ভনভন করে ঘুরতে থাকে। ছিটকে পড়ে যায় সে। ইফাদ টেনে হিঁচড়ে আবার দাঁড় করিয়ে পরপর কয়েকবার আঘাত করে। নাক মুখ দিয়ে রক্ত ছুটতে শুরু করে দিদারের। এবার ইফাদ তাকে লাথি মেরে ফেলে দেয় মাটিতে। এলোপাতাড়ি ভাবে মারতে থাকে। যেন মেরেই ফেলবে তাকে। রাগে তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়ে যাচ্ছে। দিদার চিৎকার করে আর্তনাদ করে যাচ্ছে। তা শুনে রূপসীর ভয় বেড়ে গেলো। গ্রামের মানুষ যদি ছুটে চলে আসে তবে তারা ব্যপারটাকে কিভাবে দেখবে সেটা ভেবেই বুক কাঁপছে তার। এদিকে ইফাদ দিদারকে মেরেই চলেছে। দিদারের হাতের দিকে নজর যেতেই ইফাদ নিচু হয়ে বসে তার দুহাত শক্ত করে ধরে ভয়ংকরস্বরে বলে উঠে,

–এই নোংরা হাত দুটো দিয়ে তুই রূপসীকে ছুঁয়েছিস তাই না। তোর এই হাত দুটোই আমি আজীবনের জন্য অকেজো করে দিব আজ।

দিদারের দুহাত পেছনে টেনে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করতেই রূপসী ছুটে এসে ধরে ফেলে ইফাদের হাত। করুণ কন্ঠে বলে,

–ছাইড়া দেন ম্যাজিস্ট্রেট স্যার। মইরা যাইব।

ইফাদের রাগ কমছে না। ভয়ংকর রাগে ফুঁসছে সে। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে তার। ইফাদের এমন ভয়াবহ রূপ কখনো কল্পনা করেনি রূপসী। ইফাদকে এই রূপে দেখে তার ভয়টা আরো দ্বিগুণ হয়েছে। কোনোভাবেই ইফাদকে শান্ত করা যাচ্ছে না। রূপসী ইফাদকে টেনে সরিয়ে আনে। ততক্ষণে গ্রামের মানুষদের শোরগোল শোনা গেলো। দলবল বেঁধে হারিকেন নিয়ে এগিয়ে আসছে তারা। রূপসী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সেদিকে।
গ্রামের মানুষজন যে তার আর ইফাদের ফাঁসিকাঠে চড়ার মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে আসছে সে ব্যপারে তখনো অজ্ঞ দুজনেই।

চলবে…….