অপ্রিয় শহরে আপনিটাই প্রিয় পর্ব-৫+৬

0
245

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

৫.

আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। যখনতখন ঝুপ করে বৃষ্টি নেমে যাবে। বর্ষা কালের এই এক সমস্যা। সময় অসময় বৃষ্টি নামবে। এই দেখা যাবে আকাশের বুক উজ্জল করে সূর্য উঠেছে আবার মুহূর্তেই নিজের রূপ বদলে ছেয়ে পড়বে আঁধারে। কুঁচকানো কপাল আরো কিছুটা কুঁচকে এলো আয়াজের। প্রকৃতির উপর ভিষণ রকম বিরক্ত সে। বড় দেয়াল ঘড়িতে নজর দিতেই বুঝলো প্রিয়তার বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে। এতক্ষণে তার মুখে মুচকি হাসির সরল রেখা দেখা গেল। নিজের ডেস্ক থেকে বেরিয়ে যেতেই তার সহকর্মী মেয়েরা তাকে চোখ দিয়ে গিলে খেতে লাগলো যেন। কেউ কেউবা ফিসফিস করে কিছু বলছে। কিন্তু সে এতে পাত্তা দিল না। এ ধরনের ছেঁচড়া টাইপের মেয়ে তার একদম পছন্দ না। বিরবির করে বলল,’ শ্যামলেস!’

আজ ভিষণ মন খারাপ প্রিয়তার। মন খারাপের দিনগুলোতে তার মায়ের কথা ভিষণ মনে পড়ে। আজ ও মনে পড়ছে। মায়ের চেহারাটাও তার স্পষ্ট মনে পড়ে না। কেমন ঘোলাটে স্মৃতি। প্রিয়তার চোখ ভিজে ভিজে উঠছে। আজ বাস আসতে লেইট করছে। আকাশের অবস্থা ভালো না। দোকানপাটের অধিকাংশ শাটার টেনে দেওয়া হয়েছে। প্রিয়তা ঠিক করেছে সে আর লাল সাদা রঙের শাড়ি পড়বে না। এই শাড়ি পড়লে সেদিন ভিষণ রকম বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি আর তার শাড়ির অদ্ভুত কোন এক কানেকশন আছে। ঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছে। এখন বিকেল হলেও দেখে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে প্রিয়তা যাত্রী ছাউনীর নিচে পদাড়ালো। এই লাইনের বাসটার কোনো ঠিক নেই। আজ না আসলেও পারে। বিরক্ত চোখে আসপাশে তাকালো প্রিয়তা। ফাঁকা কোনো ট্যাক্সি পেলেও চলে। ভাড়াটা যদিও একটু বেশি চাইবে। বাট ইটস্ ওকে।

‘বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। এখন কোনো ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না।’

বৃষ্টির জলে কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ। চুল থেকে টুপটাপ করে পানি পড়ছে। সাদা রঙের শার্টটা ভিজে গায়ের সাথে লেগে আছে। প্রিয়তা আয়াজের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল। শান্ত গলায় শুধাল,

‘এখানে কি করছ তুমি? আর এতটা ভিজলে কিভাবে?’

জবাবে গা দুলিয়ে হাসলো আয়াজ। ভেজা চুলগুলো ঝাঁকিয়ে পানি ছিটালো প্রিয়তার দিকে। ছিটা ছিটা পানি এসে পড়লো প্রিয়তার মুখমন্ডলে। গরম চোখে আয়াজের দিকে তাকাতে সে আবারো হাসলো। প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে চোখ সরিয়ে নিল।

‘আপনার কি আমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে প্রিয়?’

‘একদম না। তুমি মরে গেলেও তোমাকে নিয়ে চিন্তখ করার মতো তুচ্ছ কাজ আমি করবো না।’

প্রিয়তা ভেবেছিলো তার এমধ কঠিন বাক্য আয়াজকে আহত করবে। আত্মসম্মানে আঘাত করবে কথাটা। আয়াজ তখন প্রতিউত্তরে বলবে,

‘আপনি ভিষণ জাদরেল টাইপ মেয়ে। এমন মেয়েকে আমি কখনোই আমার মূল্যবান প্রেম সমার্পন করবো না। যতটা করেছি তা সহিসালামতে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। আল্লাহ হাফেজ।’

প্রিয়তা তখন ভিষণ দুঃখ পাওয়ার অভিনয় করে বলবে,

‘কেবল এতটুকুতেই তোমখর প্রেম ফুরিয়ে এলো?’

কিন্তু আয়াজ কোনো উত্তর দিবে না। তার গম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলবে,

‘আমায় ট্রিক করার চেষ্টা করবেন না। আপনার ভোলাভালা মুখ দেখে আমি আর ফাঁসছি না।’

প্রিয়তার এতসব জল্পনা কল্পনাকে জলে ফেলে দিয়ে আয়াজ সুন্দর হেসে বলল,

‘আমি জানি। আর এজন্যই আমি মরতে চাই না। আমার তো এখনো আপনাকে ভালোবাসা বাকি। সংসার করা বাকি। বচ্চার মুখে বাবা ডাক শোনা বাকি। এত অপূর্ণতা নিয়ে মারতে পারি বলেন?’

প্রিয়তা জবাব দিলো না। তার এই ছাব্বিশ বছরের জীবনে সে অনেক প্রেমের প্রোপোজাল পেয়েছে। কিন্তু তার কেউই এক সপ্তাহের বেশি প্রিয়তার পেছনে ছুটতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ প্রিয়তার কঠিণতা। কিন্তু এই ছেলে তেমন নয়। তার কঠিণতা আয়াজকে তার স্থান থেকে এক চুল পরিমান নড়াতে পারেনি। প্রিয়তা হতাশ চোখে বাইরে তাকায়। বৃষ্টি এখনো তেজ নিয়ে ঝড়ছে। এর শেষ কখন বলা যাচ্ছে‌ না।

‘এদিকে সরে দাঁড়ান প্রিয়তা। ভিঁজে যাচ্ছেন।’

ছিটা ছিটা পানিতে প্রিয়তার শাড়ি অনেকটা ভিঁজে গিয়েছে যা লক্ষ করেনি প্রিয়তা। আয়াজের গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করা তার নাম শুনে সে কেঁপে উঠলো কিছুটা। দিরুক্তি না করে বাধ্য মেয়ের মতো কিছুটা আয়াজের দিকে সরে দাঁড়ালো। এটাই হয়তো প্রথম আয়াজ তার পূর্ণ নাম ধরে ডেকেছে।
___________

‘রাত হয়েছে প্রিয়। চলুন আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।’

প্রিয়তা কোনো কথা বলল না। জেদ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়। আয়াজ প্রিয়তার এই অবাধ্যতা দেখে চোয়াল শক্ত করে নিলো। কঠিন গলখয় বলল,

‘আপনার এ ধরণের অবাধ্যতা আমি সহ্য করবো ভাবলে ভুল ভাবছেন।’

প্রিয়তা কোনো রিয়্যাকশন ছাড়া ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট দশেক একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে একটা ট্যাক্সি পেতে চড়া ভাড়ায় তাতেই চেপে বসলো প্রিয়তা। আয়াজ শুকনো গম্ভীর মুখ করে কেবল তাকিয়ে রইল। মেয়েটার অবাধ্যতা সীমা লঙ্ঘন করছে। অতি শীঘ্রই এর একটা ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

দরজায় কড়া নাড়তে সুজলা এসে দরজা খুলল। মামিকে দরজা খুলতে দেখেই প্রিয়তা বুঝতে পেরেছে আজ বড় কিছু ঘটতে চলছে। কিন্তু তার ভয় লাগলো না। এসবে সে ঐখন অভ্যস্ত।

‘এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি?’

‘বৃষ্টিতে আটকা পড়েছিলাম।’

প্রিয়তার সহজ জবাব সুজলার পছন্দ হলো না। প্রিয়তার কোনো কিছুই তার পছন্দ হয় না। তার মতে তার সংসারের অশান্তির মূল কারণ প্রিয়তা। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন একদিন এই মেয়ের কারণেই তাদের পথে বসতে হবে। লোকে দুটাকা দিলে দুমুঠো খেতে পাবে নয়তো নেই। সুজলা চোখ বাঁকা করে তাকালো প্রিয়তার দিকে। মুখ ঝামটা মেরে বলল,

‘আমার বাড়িতে থাকতে গেলে এসব নষ্টামি চলবে না। আমি কিছু বুঝিনা তাই ভাবছো? বাপের রক্ত বইছে শরীরে। বাপের মতো নষ্ট হতে সযয় লাগবে না।’

‘সব কথার মাঝে আমার বাপকে না টানলেই কি নয় মামি?’

‘আহা! খুব গায়ে লাগছে দেখছি!’

প্রিয়তা আর জবাব দিলো না। সে জানে মামি এখন তাকে রাগাতে চখিছে এসব বলে। সে কোনো উত্তর দিলেই মামর কাছে বিচার বসাবে। এরপর এই সূত্র ধরে বিশাল ঝামেলা। কিন্তু সে কোনো ঝামেলা চায় না। রুমে ঢুকে ভেজা কাপড় বদলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সারাদিন পর নরম বিছানায় পিঠ লাগাতেই ঘুম এসে ধরা দিলো চোখে। সকল হতাশা চিন্তা ভুলে ঘুমের দেশে গা ভাসিয়ে দিলো সে। একটা লম্বা ঘুম দরকার।

মাঝরাতের দিকে প্রচন্ড ক্ষুদায় ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রিয়তার। এপাশ ওপাশ করেও কোনো লাভ হয় না। রান্নাঘরে ঢুকে কোথাও কোনো খাবার খুঁজে পেল না। অবশিষ্ট কোনো খাবার রাখা নেই। শেষে এক কাপ চা আর দুটো বেকারি বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পরতে হলো। আপাতত এটুকুতেই রাতটুকু চলবে।

__________

পরপর দুদিন আয়াজের কোনোরকম খোঁজ পাওয়া গেল না। প্রিয়তা বেশ অবাক হলো। সাথে কিছুটা চিন্তিত ও। আয়াজকে সে যতটুকু চেনে‌ এভাবে হারিয়ে যাওয়ার পাত্র সে না। তাহলে? একটা সূক্ষ্ম চিন্তায় কপালের মাঝে ভাঁজ পড়লো। পরক্ষণেই চিন্তাগুলোকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। আয়াজ আসছে না এতে তো তার স্বস্থি পাওয়ার কথা চিন্তা নয়?

রিকশা‌ এসে বাস স্ট্যান্ড এ থামতেই প্রিয়তা ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলো। বাস এখনো আসেনি। প্রিয়তা ব্যস্ত নজরে আশপাশে তাকালো। কপালে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলো কানের ভাঁজে গুজে দিয়ে সময় দেখলো। মাথা থেকে আয়াজ নামটা সরছে না। ছেলেটা আশপাশে থেকেও তাকে বিরক্ত করে না থেকেও সেম। প্রিয়তা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার থেকে এত ছোট একটা ছেলেকে নিয়ে ভাবনা তাকে মানায় না। আয়াজ বাচ্চা ছেলে! পাগলামি করছে কিন্তু সে তো বুঝে! প্রিয়তার মন খারাপ হয়ে এলো। ছোট ছোট করে বলল,

‘তুমি কেন আমার আগে জন্ম নিলেনা? আমি একটা আপন মানুষ পেতাম। ভরসার একটা হাত পেতাম। কিন্তু আমি যে বড্ড অভাগী!’

চলবে……….

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

৬.

বাসের জানালা থেকে বাইরে তাকিয়ে ব্যস্ত শহর আর একের পর এক ফেলে যাওয়া বিশাল দালান দেখছিলো খুব মনোযোগ দিয়ে প্রিয়তা। এই জিনিসটা তার খুব ভালো লাগে। মনে হয় একেরপর এক বিল্ডিং পেছনের দিকে ছুটছে। তখনি পাশ থেকে কাতর স্বরের আওয়াজ এলো,

‘আপনি আমার খোঁজ নিলেন না কেন প্রিয়? আমি ভিষণ অসুস্থ। একবার ছুঁয়ে দেখুন।’

কথাটা বলে নিজের কপাল এগিয়ে আনলো আয়াজ। প্রিয়তা হকচকালো। চকিত দৃষ্টিতে আয়াজের পানে চাইল। আয়াজ কখন বাসে উঠে তার পাশের সিট দখল করে বসেছে তা তার খেয়ালে নেই। আয়াজের মুখটা ভিষণ শুকনো লাগছে। চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। চুলগুলো অযত্নে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। সুন্দর ওষ্ঠজোড়া নিলচে বর্ণ ধারণ করেছে। প্রিয়তা ব্যস্ত হাতে আয়াজের কপাল ছুঁয়ে দিলো। শরীরের তাপ অনেক বেশি। প্রিয়তা প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘অসুস্থতা নিয়ে এখানে কি করছ? বাসায় ফিরে যাও।’

‘আপনাকে দেখতে এসেছি।’

আয়াজের উত্তরে প্রিয়তা মুখ গম্ভীর করে নিল। শাসনের স্বরে বলল,

‘তোমার পাগলামি মাত্রা অতিক্রম করছে আয়াজ।’

এ প্রসঙ্গ আয়াজের ভালো লাগলো না। সে নিভু গলায় বলল,

‘এভাবে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। আপনার কাঁধে একটু মাথা রাখি?’

প্রিয়তা সাথে সাথে উত্তর দিলো,

‘একদম না।’

প্রিয়তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়াজ তার মাথা এলিয়ে দিল প্রিয়তার কাঁধে। প্রিয়তা মানা করলো না আর। থম মেরে বসে রইল। আয়াজ মুচকি হাসলো। একরাশ ভালোলাগা নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। শুধাল,

‘আপনার চোখে কি আমার সুদর্শন রূপ স্কান করতে পারে না? আপনি কখনো মুগ্ধতা নিয়ে আমায় দেখেন না কেন প্রিয়? অফিসের প্রত্যেকটা মেয়ে আমার দিকে কেমন করে তাকায়। এই দেখুন সামনের সিটে বসা মেয়ে দুটোও বারবার মাথা ঘুরিয়ে আমায় দেখছে। আপনার খারাপ লাগছে না?’

আয়াজের কথা অনুসারণ করে সামনে তাকাতে দেখল সত্যিই দুটো মেয়ে বারবার আয়াজের দিকে তাকাচ্ছে। মুচকি মুচকি হাসছে। প্রিয়তার গায়ে যেন আগুন ধরে উঠলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল,

‘এই মুহূর্তে তুমি বাস থেকে নেমে যাবে। নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।’

আয়াজ মাথা উঁচু করে প্রিয়তার দিকে চাইল। প্রিয়তার লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগায় আঙ্গুল ছুঁয়ে বলল,

‘কিন্তু আমি আরো কিছু সময় আপনার সাথে থাকতে চাই।’

প্রিয়তা রেগে যেয়ে কিছু বলতে নিতেই ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে তার কথা বন্ধ করে দিল আয়াজ। মুচকি হেসে বলল,

‘আপনি ভিষণ হিংসুটে প্রিয়। তারা আমায় আপনার থেকে নিতে পারবে না। কেবল দূর থেকে দেখতে পাবে। এতটুকুও আপনি মেনে নিচ্ছেন না। ভেরি ব্যাড!’

অকপটে বলা এমন সত্যকথা হজম করা কঠিন হলো প্রিয়তার কাছে। যতনে লুকিয়ে রাখা সত্য এভাবে প্রকাশ পাক তা সে কখনোই চায়নি। মুখ জানালার দিকে ঘুরিয়ে চুপ করে বসে রইল সে। আয়াজ হাসলো। নিঃশব্দ সেই হাসিতে শরীর দুলে উঠলো। প্রিয়তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

‘আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? আপনাকে ভীষণ আদুরে লাগছে। একটু ছুঁয়ে দেই?’

আয়াজের লাগামহীন কথায় শীরায় শীরায় রক্ত জমে গেল যেন। জোর গলায় বাস থামাতে বলতেই বাস থেমে গেলো। কোনো কথা ছাড়াই বাস থেকে নেমে গেল প্রিয়তা। আয়াজ বাঁধা দিল না। সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখল। শরীরের তাপ বাড়ছে। সে কি মরে যাচ্ছে? আগামী কালের গরম সংবাদ হবে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে শহীদ হয়েছেন একুশ বছর বয়সের এক তাগড়া জুবক। কথাটা ভাবতেই হাসি পেলো। এমনটা হলে খারাপ হয়না। সে মারা গেলে প্রিয়তা ভিষণ দুঃখ পাবে সে জানে। তার জন্য প্রিয়তাকে কাঁদতে দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগবে। এসব ভাবতে ভাবতে বাসের সিটেই ঘুমিয়ে পড়লো আয়াজ।

____________

সূর্যের আলোতে উজ্জল এক ঝকঝকে সকাল। বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙলো প্রিয়তার। মামা বাড়িতে থাকলে তাকে রান্নাঘরে খুব একটা যেতে হয়না। কাজের মেয়ে আর মামি দুজন মিলেই সামলে নেয় সবটা। ঘড়িতে বেলা দশটা বেজে পাঁচ মিনিট। আজ শুক্রবার তার ছুটির দিন। প্রিয়তা সময় নিয়ে বেড থেকে উঠল। বালিশের তলা থেকে ফোন বের করতেই দেখলো বাইশটা মিসডকল। ফোন সাইলেন্ট থাকায় সে টের পায়নি। প্রিয়তা ফোন হাতে অপেক্ষা করলো। ওপারের ব্যক্তি আবারো তাকে কল করবে। মিনিটের মাথায় পরিবেশ কাঁপিয়ো ফোন ভাইভ্রেট হলো। প্রিয়তা অলস ভঙ্গিতে ফোন কানে ধরলো।

‘মরার মতো ঘুমাও তুমি প্রিয়তা? আমি শিওর মৃত ব্যক্তিও এতবার কল করলে বিরক্ত হয়ে জেগে উঠবে কল রিসিভ করতে।’

‘এটাই মৃত আর জীবিত ব্যক্তির মধ্যে তফাৎ।’

‘আচ্ছা সে কথা থাকলো। বিগত দশ মিনিট জাবত আমি তোমাকে টুয়েন্টি প্লাস কল দিয়েছি। আমার জীবন থেকে অমথা টেন মিনিট মাইনাস হলো যার ঋণ পরিশোধ হওয়ার নয়। আজ আমাদের ক্যাম্পাসে দেখা করার কথা মনে আছে তো? ভুলে গেলেও প্রবলেম নেই আমি মাত্রই মনে করিয়ে দিয়েছি। আর হ্যাঁ মনে করে প্লিজ আমার ফোনো সাতটাকা পঁচিশ পয়সা লোড করে দিও। এই টাকাটা তোমার জন্য অযথা নষ্ট হলো। আমি অপচয় একদম পছন্দ করিনা ইউ নো! টাটা।’

টুট টুট করে ফোন কেটে গেল। এতকিছুর মাঝে প্রিয়তা একটা কথা বলার সুযোগ মাত্র পেল না। এই মাত্র যে ফোনে কথা বলল এটা টিয়া। টিয়ার মতোই প্রচুর কথা বলে মেয়েটা। ভিষণ পড়ুয়া স্বভাবের মেয়ে হলেও রিটেক না দিয়ে কোনো সেমিস্টার পাশ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এবং কৃপনতায় সেরা। ক্যান্টিনের মামার কাছে দু টাকা বাকি ছিল। তিনদিন ঘুরে দু টাকা আদায় করেছিল। তা নিয়ে বন্ধুমহলে হাসাহাসি হলে সে মুখ গোমড়া করে বলেছিল,

‘এই দু টাকার সাথে আর দুটাকা যোগ করলে একটা সমুচা হয়ে যাবে। তাহলে অযথা টাকাটা অন্যকে কেন দেব? মামাকে দু টাকা দিলেকি সে বাকি দুটাকা মাফ করে একটা সমুচা দিবে?’

প্রিয়তা ফোন রেখে সময় নিয়ে তৈরি হলো। আকাশি রঙের কুর্তির সাদে সাদা প্যান্ট সাদা ওড়না। পুরো একটা আকাশ যেন নিজের শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে সে। রুম থেকে বের হতেই সুজলা মুখ বাঁকিয়ে বললো,

‘এত রঙঢঙ করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আজ যে ছুটির দিন দুটো কাজ করলেও তো হয়। তা নয় মহারাণী গায়ে হাওয়া লাগাতে বের হচ্ছেন। আমার হয়েছে যত জালা।’

রত্না সবজি কাটতে কাটতে বলল,

‘কি কইলেন খালা? আপাই তো সব কাজকাম করে। খালু আসলেই সে একটু ছুটি পায়। আপনে হুদাই আপাকে দূষমন সাজান কেন?’

সুজলা গরম চোখে তাকাল। ধমক দিয়ে বলল,

‘ছোট মুখে বড় কথা বলবি না। নিজের কাজ কর। আসছে সাফাই গাইতে।’

প্রিয়তা মুচকি হেসে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে এলো। আজকের পরিবেশ ভিষণ সুন্দর। একদম তার মনের মতো। কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখলো মোরে চায়ের দোকানে বসে দু ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট গুঁজে আয়েশ করে ফুক দিচ্ছে আয়াজ। সুন্দর মুডটা মুহূর্তেই বিরাস হয়ে গেলো। চোখ কুঁচকে তাকালো আয়াজের পানে। আয়াজের সিগারেট খাওয়ার স্টাইলটা ভালো লাগলো প্রিয়তার। মানুষ বুঝি সিগারেটেও এত সুন্দর করে টান দিতে পারে?
আয়াজের নজর প্রিয়তার দিকে পরতেই সে দ্রুত হাতে সিগারেট ফেলে দিয়ে দাঁড়াল। প্রিয়তার দিকে এগিয়ে আসতেই প্রিয়তা প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘তুমি নেশা কর?’

‘যাস্ট মাঝেসাঝে সিগারেট। এটাকে নেশা বলে না।’

প্রিয়তা নাক কুচু করলো। আয়াজের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলল,

‘দু হাত দূরে সরে দাঁড়াও। ভিষণ বাজে গন্ধ। এসব ছাইপাশ খেয়ে আমার ত্রিসিমানায় আসার চেষ্টা করবে না।’

আয়াজ সরল না। বরং আরো একপা এগিয়ে দাঁড়াল।প্রিয়তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘আপনি একবার আমার হয়ে যান। এসব ছাইপাশ ছেড়ে দিব ফর সিওর। কেবল এবং কেবল আপনাতে মত্ত হব।’

প্রিয়তা বড় চোখ করে তাকাল। কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। নিজেকে শান্ত রেখে শক্ত কন্ঠ বলল,

‘তুমি দিনদিন বেশরম হচ্ছ আয়াজ।’

চলবে………..