অপ্রিয় শহরে আপনিটাই প্রিয় পর্ব-০৪

0
222

#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি

৪.

জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। তার জীবনে কি হচ্ছে সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কেমন অগোছালো নিয়মে এগিয়ে চলছে জীবন। এ জীবনের কোন মানে হয়? হতাশ চোখে বাইরে দৃষ্টি ফেলল সে। পাশের বাড়ির ছাদে ছোট বাচ্চারা খেলছে। তুলিও আছে সেখানে। লাল ফ্রকে তুলিকে সুন্দর লাগছে। চুলগুলো বেনুনি করা। ভিষণ মিষ্টি লাগছে দেখতে। নানু মারা যাওয়ার পর পৃথিবীতে এই একমাত্র মানুষ যে তার কথা ভাবে। তাকে আপন মনে করে। বুকের ভেতর একধরনের সূক্ষ ব্যথা অনুভব হল। এ পৃথিবীতে সত্যিই তার কেউ নেই!

খাবার প্লেট সামনে নিয়ে বসে আছে প্রিয়তা। তার মন এখন অন্য কোথাও বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ পূর্বে মামি এসে জানিয়েছে তাকে বিয়ে করতে হবে না। এটা শুনে প্রিযতা খুশি হলেও চিন্তার কারণ মামির বলা দ্বিতীয় কথাটা। কেউ একজন মামিকে শাসিয়েছে প্রিয়তার বিয়ে না দিতে এমনটাই বলেছে মামি। এখন কথা হচ্ছে এই কেউ একজন টা কে? আবার কোন বিপদের সম্মুখীন হতে হবে তাকে? সে যতই বিপদ থেকে দূরে যেতে চায় না কেন বিপদ যেন তাকে ছাড়তেই চায় না। সব সময় আগে পেছনে লেগেই আছে।
___________

লাল পাড় বিশিষ্ট সাদা রঙের শাড়িতে প্রিয়তাকে অপ্সরির মতো লাগছে। চুলগুলো খোপা করে ক্লিপ এটে নিলো। কিছু একটা মনে করে চোখে অল্প কাজল ও লাগালো। তেমন একটা সাজগোজ করা হয়না তার। জীবনেই যেখানে কোনো রঙ নেই সেখানি শরীরে রঙ মেখে ঘোরার কোনো প্রশ্নই আসে না। আয়নায় আরো একবার নিজেকে দেখে নিয়ে ব্যাগ হাতে রুম থেকে বের হলো। বের হতেই মামার সাথে দেখা হলো। প্রিয়তার মামা জাহিদ বেশিরভাগ সময়ই শহরের বাইরে থাকেন। আজ ভোরেই ফিরেছেন তিনি। প্রিয়তাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

‘কেমন আছিস মা? চাকরি কেমন চলছে?’

বিনিময়ে প্রিয়তা শুকনো হাসলো। ছোট করে জবাব দিলো,

‘হুম ভালো।’

জাহিদ বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না। সে জানে মেয়েটার সাথে কতটা অন্যায় অত্যাচার হয় এ পরিবারে। কিন্তু সে নিরুপায়। মেয়েটাকে কেবল আশ্রয় দেওয়া ছাড়া আর কোনো ভাবে সে সাহায্য করতে পারলো না। সে প্রতিবাদ করলে হয়তো মেয়েটার বেঁচে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়াত। তার থেকে যেভাবে চলছে চলুক। প্রাণটা বেঁচে থাকুক। জাহেদ অপলক চোখে প্রিয়তার দিকে তাকালো। মেয়েটা ঠিক ওর মায়ের রূপ পেয়েছে। এত সুন্দর ফুলের মতো মেয়েটাকে টোকা দিতেও কলিজা কাঁপে সেখানে সুজলা কিভাবে পারে এত অত্যাচার করতে? ওর কি হৃদয় নেই? জাহিদের গলা ধরে আসে। চোখ জ্বালা করছে। নিজের ব্যর্থতা গুলো পানি হয়ে ঝরতে চাইছে।

‘মা টাকা পয়সা কিছু লাগলে বলিস।’

‘হুম বলবো।’

প্রিয়তা বের হয়ে গেলো। পেছন থেকে জাহিদ ডাকল।

‘নাস্তাটা করে যা।’

প্রিয়তা শুনতে পেয়েও জবাব দিলো না। আর কিছুক্ষণ সে মামার সামনে থাকলে কেঁদে ফেলবে। কিন্তু সে তার দুঃখ কাউকে দেখাতে চায় না। তার দুঃখগুলো নাহয় একান্তই তার হয়েই থাক।

গলি থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো প্রিয়তা। আজ যেন কোনো রিকশা এদিকটায় না আসার পণ করেছে। বিরক্তিতে মুখ থেকে ‘চ’ বেরিয়ে এলো। হাত ঘড়িতে সময় দেখে কপালের মাঝে সূক্ষ ভাঁজ ফেলল।

‘আজ লেট কেন করলেন প্রিয়? অপেক্ষা করছিলাম।’

প্রিয়তা ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো আয়াজের পানে। চোখের দৃষ্টিতে বোঝালো আর একটাও কথা বললে চিবিয়ে খাবো। কিন্তু এতে আয়াজের ভাবের পরিবর্তন হলো না। দুহাত চুলে চালান করে অগোছালো চুলগুলো গুছিয়ে আর একটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো প্রিয়তার।

‘আপনাকে ভিষণ সুন্দর লাগছে। বিয়ের পর এভাবেই সবসময় শাড়ি পড়বেন।’

আর সহ্য হলো না প্রিয়তার। আয়াজের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘তুমি অতিরিক্ত মাত্রায় অসভ্য। একজন সিনিয়রকে কিভাবে সম্মান দিতে হয় তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তোমার।’

জবাবে মুচকি হাসলো আয়াজ। প্রিয়তা ফুঁসে উঠলো। ভাবনার চাইতেও অনেক বেশি অভদ্র ছেলেটা।

রিকশা পাওয়ার সাথে সাথে উঠে পড়লো প্রিয়তা। রোজকার মতো চোখের আড়াল না হওয়া অবদি অপেক্ষা করলো আয়াজ। সে শুধু তার এই অপেক্ষার সুমিষ্ট ফল উপভোগ করার অপেক্ষায় আছে। তার এই অপেক্ষার অবসান হয়তো খুব শীঘ্রই ঘটতে চলেছে। প্রিয়তা চোখের আড়াল হতেই বাড়ির পথে পা বাড়ালো সে। আজ তাকে বাবার সাথে অফিসে যেতে হবে। তার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে এখনো দু বছর বাকি। কিন্তু সে চায় গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই অফিসিয়াল সব কাজে পারদর্শী হতে। তাকে নিজেকে প্রিয়তার যোগ্য করে তুলতে হবে। প্রিয়তা পর্যন্ত পৌছাতে তাকে যা যা করতে হবে সে তার সবটা করতে রাজি।
প্রিয়তার প্রতি তার এই অনুভূতি আজকের নয়। এর শুরু আরো চার বছর পূর্বে। আয়াজ তখন সবে ক্লাস নাইনে। সে চট্টগ্রামে নানা বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করত। তার বাবার রাজনীতি জনিত কিছু কারণে তাকে সবকিছু থেকে দূরে রাখা হয়েছিলো। সেবছর আয়াজ প্রথম ঢাকার মাটিতে পা রাখে। শুরু হয় নতুনভাবে জীবন জাপন। নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু সবকিছুর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তার বেশ কষ্ট হয়েছিলো। একদিন বিকেলে কাছের পার্কে ঘুরতে গেলে সে দেখতে পায় কোনার এক বেঞ্চিতে একটা মেয়ে বসে কেঁদে কেঁদে কাউকে অভিযোগ করছে। এতবড় মেয়ের এমন বাচ্চা স্বভাব দেখে আয়াজ সেদিন ভিষণ হেসেছিল। এরপর থেকে আয়াজ প্রায়ই মেয়েটাকে দেখতো। মেয়েটার বড় বড় চোখ করে তাকানো। গাল ফুলিয়ে একা পার্কে বসে থাকা সব তার ভিষণ ভালো লাগতো। আয়াজ যখন বুঝতে পারে সে এই মেয়েটার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে তখন সে গোপনে প্রিয়তার সকল খোঁজ নেয়। প্রিয়তা তার থেকে পাঁচ বছরের বড় জানতে পেরে সে নিজেও শক হয়েছিলো। প্রিয়তাকে দেখে তার কখনো মনে হয়নি মেয়েটা তার থেকে এত বড় হতে পারে। আয়াজ নিজেকে বন্দি বানিয়ে ফেলল। পড়াশোনা ছাড়া আর কোনো কিছুই যেন ছিলনা তার জীবনে। নিজেকে অনেকটা সামলে নেয় সে এক বছরে। কিন্তু সমস্যা হয় তার কিছুদিন পর। সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। আজকের মতো করেই সেদিন প্রিয়তা লাল সাদা শাড়িতে নিজেকে সাজিয়েছিল। আয়াজ তার পরিচিত কিছু ফ্রেন্ডের সাথে রমনায় গিয়েছিলো ঘুরতে। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা চলছিলো ঠিক তখন তার পেছনে রিনরিনে কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,

‘মামা চার প্লেট ফুচকা। ঝাল একটু বেশি হবে।’

কন্ঠস্বর অনুসরণ করে তাকাতেই তার হার্ট বিট মিস করেছিল যেন। সর্গ থেকে যেন কোনো এন্জেল নেমে এসেছে। মন্ত্রে বশিভুত হওয়ার মত করেই সে নিশ্পলক তাকিয়ে ছিল প্রিয়তার পানে। সেদিনের পর থেকে আয়াজের এক রোগ হলো। রোগের নাম প্রিয়তা। লক্ষণ গুলো এমন ছিল, রোজ নিয়ম করে যেমন মানুষ খাবার খায় ঠিক সেভাবেই নিয়ম করে তাকে প্রিয়তার মুখ দর্শন করতে হতো। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তার ভিষণ প্রিয়তাকে দেখতে ইচ্ছা করত। এই ইচ্ছাবোধের ফল তার বাকি রাতটুকু নির্ঘুম কাটাতে হতো। তার ভিষণ জ্বর হলে ঘোরের মাঝে সে বারবার প্রিয়তার নাম নিত। অস্পষ্ট স্বরে বলা তার এ নাম কেউ বুঝতে না পারলেও সবাই এটুকু বুঝত ছেলে কারো নাম বলছে। এ নিয়ে তার মায়ের চিন্তার অন্ত ছিলো না। এভাবেই সময় যেতে যেতে পরিস্থিতি আজ এ পর্যায়ে।
____________

‘তুমি কি কখনোই পাংচুয়াল হবে না?’

বাবার গম্ভীর কথায় আয়াজ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তরিকুল সাহেব গম্ভীর মুখ করে তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে। অফিসের প্রথম দিন এক ঘন্টা লেইট! তার গোছাল ছেলেটা দিন দিন অগোছালো আনপাংচুয়াল হয়ে পড়ছে। সে বাবা হয়ে ছেলের এই অধঃপতন কিভাবে সহ্য করবে? করা কি উচিত?

চলবে……….