অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-০৩

0
476

#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_০৩

কোচিং সেন্টারে এখনো তাহা’দের ব্যাচের স্টুডেন্ট আসেনি। আগের ব্যাচের পড়া এখনো শেষ হয়নি। তাহা কোচিং সেন্টারের পাশে টং দোকানটায় বসে বসে চা খাচ্ছে। আজকে লিসার জন্য অপেক্ষা করেনি। আগেই চলে এসেছে সে। আজ তার অনেক কাজ। আগেভাগেই সব ঠিকঠাক করে রাখতে হবে। ব্যাগে তার যাবতীয় জিনিস আছে।

“কিরে তাহা, তুই আজ এত তাড়াতাড়ি? কখনোতো এত তাড়াতাড়ি আসতে দেখিনি তোকে।”

আহিরের বোন আফিয়া কথাটা বলে তাহা’র পাশে এসে দাঁড়ায়। ভাইয়ের সাথে সে আগে চলে এসেছে। তাহা চা’টা হাতে নিয়ে আফিয়ার দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। এর সাথে কথা বলার ইচ্ছা আপাতত নেই। কারণ মেয়েটা আহিরের বোন। তাও না চাইতে আফিয়ার দিকে ফিরে বসে। ইশারা করে তাহা’র আরো কাছে এসে দাঁড়ানোর জন্য। আফিয়া তা-ই করে। তাহা চা’য়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বলে,

“শুনতে চাস কেন তাড়াতাড়ি এসেছি?”

আফিয়া মাথা উপর নিচ করে। যার অর্থ হ্যাঁ।

“তোর ভাইটা আছে না? আমাদের এলাকার পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা, আমাদের এলাকার গর্ব দ্য আহির পাটওয়ারি। তার জন্যই আজ এত তাড়াতাড়ি আসা।”

আফিয়া ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় তাহা’র দিকে। তাহা তার ভাইয়ার জন্য কেন এত তাড়াতাড়ি আসবে? কি কারণ থাকতে পারে। তাহা আহিরকে পছন্দ করে না এটা আফিয়া জানে কিন্তু আহিরের জন্য তাহা’র এত তাড়াতাড়ি আসার কারণটা ঠিক বোধগম্য হলো না আফিয়ার।

“মানে? তুই ভাইয়ার জন্য কেন তাড়াতাড়ি আসবি? কি দরকার ভাইয়ার সাথে?”

“ভাবতেছি তোকে ননদ বানাবো। কেমনে হবেরে?”

তাহা’র কথায় আফিয়া আঁৎকে উঠে।

“বইন মাফ কর। দয়া করে এসব মুখেও আনিস না। ভাইয়া এসব শুনলে তোর পিণ্ডি ছটকে দেবে।”

আফিয়ার কথার বিপরীতে তাহা অট্টহাসিতে মেতে উঠে। হাসতে হাসতে বলে,

“তোর ওই পেঁচামুখো ভাইকে আমি বিয়ে করবো? আমার এত খারাপ দিনও আসেনি। আমিতো এমনি বলে দেখলাম তোর রিয়েকশনটা কেমন হয়। যাইহোক, এবার ভিতরে যা। তোরা ভালো ফ্যামিলির ভালো মেয়ে এভাবে রাস্তায় টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যা।”

“তুইওতো আছিস?”

“আমার সাথে তুই নিজেকে মিলাচ্ছিস? আমি উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে। আমাকে এভাবে দেখলে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু তোকে দেখলে বলবে। আফটার অল তোরা হলি ভালো মেয়ে।”

“তুই নিজেকে কেন এত ছোট ভাবিস তাহা?”

“এই যাতো। জ্ঞান দিস না। তোর ভাই তোকে এখানে দেখলে সমস্যা হবে। যা এখন।”

“তাহা! আমাকে তোর বন্ধু বানাবি?”

আফিয়া কথাটা বলে উত্তরের আশায় তাহা’র দিকে তাকিয়ে থাকে। তাহা চা’টা শেষ করে দোকানদারের বিল মিটিয়ে রাস্তায় হাঁটা ধরে। হাঁটতে হাঁটতে বলে,

“আমি কাউকে বন্ধু বানাই না।”

আফিয়া দৌঁড়ে তাহার পাশাপাশি হাঁটে।

“তাহলে লিসাকে কেন বানিয়েছিস?”

“ও আমার ছোটবেলার খেলার সাথী। বন্ধু নয়। আর আমি কাউকে বন্ধু বানাতে চাই না। আর শোন, আজকে ধামাকা হবে কোচিং সেন্টারে। অপেক্ষা করিস। ধা..ম্মাকা দেখার জন্য। গুড বায় বেইবি।”

কথাটা শেষ করে তাহা কোচিং সেন্টারের ভিতরে চলে যায়। আফিয়া মুখটাকে হা করে তাহা’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আবার কি করবে কে জানে? কি হতে চলেছে কোচিং সেন্টারে আজকে?

___________

“তাহা, এই তাহা। তুই না বলেছিস আজকে ধামাকা হবে? তাহলে এখনো কিছু হলো না কেন?”

তাহা কোচিং সেন্টারের পাশের ছোট মাঠটায় নিজের সাইকেলটার ওপর উঠে বসে আছে। এক পা তার মাটিতে আরেকপা সাইকেলে। সব স্টুডেন্টরা বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হচ্ছে। তাহা আগেই বের হয়েছে। কারো অপেক্ষা করছে সে। আফিয়া তাহা’কে প্রশ্নটা করে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তাহা আফিয়াকে হাত দিয়ে ইশারা করে ওর থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়াতে। আফিয়া নিঃশব্দে তা করে। লিসা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাহা’কে ইশারায় কিছু করতে না করছে। বারেবারে মাথা নাড়িয়ে বুঝাচ্ছে। তাহা সেদিকে তাকিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না। তাহা তার ডানদিকে তাকায়। কাউকে আসতে দেখে তার মুখে বাঁকা হাসি ফুঁটে উঠে। আহির ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। হাসতে হাসতে বারান্দা থেকে নামে। হাঁটতে হাঁটতে যখন ঠিক মাঠের মাঝামাঝি জায়গায় আসে। তখনই সে তার মুখে ঠিক কপাল বরাবর তরল কিছু অনুভব করে। আহির মোবাইলটা কানে ধরেই মাঠের দক্ষিণ দিকটায় তাকায়। যেখানে সাইকেলের ওপর বসে আছে তাহা। তার হাতে কিছু পঁচা টমেটো দেখা যাচ্ছে। যেগুলো থেকেই সে আহিরের মুখে ছুঁড়ে মেরেছে। মুখে তার বিশ্বজয় করা হাসি। আহির রেগে কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই আরেকটা পঁচা টমেটো ছুঁড়ে মারে তাহা। এবারের টমেটোটা আহিরের ঠিক নাকের ওপর পড়ে। সব স্টুডেন্টরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আর আফিয়া আর লিসা মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আফিয়া তার ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে খুব ভালো করে জানে। আহির সচারচর রাগে না কিন্তু একবার রাগলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়ে। তাহা’র এই কাজের জন্য আহির তাহা’র যে ঠিক হাল করবে, এটা ভেবে আফিয়ার গলা শুকিয়ে আসে। আহিরের চোখগুলো দেখে আফিয়া আর লিসা ভয় পেয়ে যায়। অনেক লাল হয়ে আছে। আহির এমনভাবে তাহা’র দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে তার দৃষ্টি দিয়ে তাহা’কে ভষ্ম করে দেবে। তাহা সেসব দেখে বিদ্রুপাত্মক হাসে।

“মিস্টার আহির পাটওয়ারি, আপনার নামটা না অনেক জোশ। আপনি মানুষটা আমার অপছন্দের হলেও আপনার নামটা আমার খুব পছন্দের। আচ্ছা যা বলতে চাচ্ছিলাম, আমার সাথে আজ অব্দি কেউ এমন কিছু করতে পারেনি যা আপনি করেছেন। আপনি আমায় মেরেছেন। তার শোধতো তুলতামই। কিন্তু তারপর আবার কি করলেন। টমেটো নিয়ে ঢং। আমার আম্মুর কাছে আমার নামে নালিশ করেছেন। আপনার জন্য আমার আম্মু আমার গায়ে হাত তুলেছে। যে টমেটোর জন্য এসব হলো সে টমেটো দিয়েই আপনাকে মাত করলাম। তবে আমার টমেটোগুলো একটু স্পেশাল। পঁচা টমেটো। জানেন, এই পঁচা টমেটো জোগার করতে আমায় কত কষ্ট করতে হয়েছে? এগুলোও চুরি করে এনেছি। যাক আমি আমার শোধ তুলে নিলাম। আশা করছি এর পরে আর আমার পিছনে লাগতে আসবেন না। আর হ্যাঁ আমি তাহানিয়া ফেরদৌসি। নামটা কি আবার বলবো? নাকি মনে থাকবে?”

তাহা কথাগুলো বলে সাইকেল চালিয়ে চলে যায় কোচিং সেন্টার থেকে। সব স্টুডেন্টরা আহিরের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসতে হাসতে চলে যায় নিজেদের গন্তব্যে। কিন্তু মাঠের মাঝখানে ওই জায়গাটাতে এখনো দাঁড়িয়ে আহির। মুখে হাত দিয়ে পঁচা টমেটো পড়া জায়গায় হাত দেয়। পঁচা টমেটোর গন্ধে তার গা গুলিয়ে আসে। সে এখনো তাহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তার এখনো কঠোর। মনে মনে সে খুব কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তাহলে কি তাহার জন্য বড় কিছু অপেক্ষা করছে?

_____________

“দুঃখিত আন্টি। আমাদের কোচিং সেন্টার তাহানিয়াকে আর গ্রহণ করতে রাজি নয়। ও নিজের টিচারের মুখে পঁচা টমেটো ছুঁড়ে মেরেছে। আহির বলছে, আজ ওকে তাহানিয়া পঁচা টমেটো ছুঁড়ে মেরেছে। কাল ওর দেখাদেখি অন্য কেউও মারতে পারে। আর আহিরের সম্পর্কে আপনি খুব ভালো করে জানেন। ওকে আমরা আমাদের কোচিং সেন্টারে পাবো আশা করিনি। এখন ওকে আমরা আমাদের ভাগ্যজোরে পেয়েছি কিন্তু শুধুমাত্র তাহানিয়ার জন্য ও কোচিং সেন্টারে আর থাকতে রাজি নয়। আহির বলছে যদি তাহানিয়া এখানে থাকে তাহলে ও থাকবে না। এখন আপনি বলুন আমরা কি করতে পারি?”

সোনিয়া বেগম মাথা নিচু করে বসে আছেন। সামনে কোচিং সেন্টারের পরিচালক আতিক মাহবুব বসে আছে। তার পাশের একটা চেয়ারে আহির বসে আছে। আতিক আহিরের দুই বছরের সিনিয়র।

“তাহা, এখানে আয়।”

তাহা দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। মায়ের ডাকে গুঁটিগুঁটি পায়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায়।

“আমি তোমার কাছে অনুরোধ করছি আহির। তুমি এখান থেকে যেও না। শুধুমাত্র আমার মেয়ের কৃতকর্মের জন্য তুমি এখানে থেকে যেও না। দরকার হলে তাহা’র এই কর্মের জন্য তুমি ওকে শাস্তি দিতে পারো। তোমাকে যেমন সকলের সামনে অপদস্থ করেছে, তুমিও ওকে সকলের সামনে শাস্তি দিতে পারো। আহির!এই যে তাহা! তুমি ওকে যা ইচ্ছে শাস্তি দিতে পারো। সেই অনুমতি আমি তোমায় দিলাম।”

এতক্ষণ পর আহির মুখে খুলে।

“আপনার মেয়েকে আমি শাস্তি দিতে পারি না। এটা ক্লাসরুম নয় যে ও পড়া পারেনি, তাই মারবো। এখানে ওকে মারার অধিকার আমার নেই। আর যদি ওকে মারি তাহলে ওর আমার মধ্যে তফাৎ কোথায় থাকলো? স্যরি আন্টি একটা কথা না বলে পারছি না। তাহানিয়াকে কোচিংয়ে পড়ানোর আগে ভালো করে শিক্ষা দেওয়া দরকার। যাতে ও বড়দের সম্মান করতে শেখে। ওর মধ্যে নূন্যতম আদব-কায়দা নেই। আর আতিক ভাইয়া আপনি ওকে এখানে পড়াতেই পারেন তবে আমি আবারও বলছি ও এখানে থাকলে কিন্তু আমি থাকবো না।”

তাহা নিরব দর্শকের মত সব অবলোকন করছে। ভালোই হবে কোচিং সেন্টার থেকে বের করে দিলে। রোজ রোজ ভালো লাগে না আসতে। আতিক কিছু বলবে তার সোনিয়া বেগম বলে উঠেন,

“তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও বাবা। ওর মা হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমার মেয়েটাকে দয়া করে এখানে পড়তে দাও।”

“আপন এসব কি বলছেন আন্টি? আমাকে আমার নিজের কাছে কেন ছোট করছেন? গুরুজন হয়ে আপনি আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন এটা আমার জন্য খুব লজ্জাজনক ব্যাপার।”

“তাহা, ক্ষমা চা আহিরের কাছে। এক্ষুণি ক্ষমা চাইবি তুই।”

“আন্টি সেসবের প্রয়োজন নেই।”

“না, প্রয়োজন আছে। ও অপরাধ করেছে ও ক্ষমা চাইবে। বল স্যার আমি ভুল করেছি আমায় ক্ষমা করে দিন।”

তাহা একরোখাভাবে বলে,

“এসব আমি পারবো না। বের করে দেবেতো কোচিং সেন্টার থেকে। দেক বের করে। আমার এখানে পড়ারও ইচ্ছা নেই।”

“তাহা। (সোনিয়া বেগম খুব জোরে ধমকে উঠেন তাহা’কে) তুমি এক্ষুণি ক্ষমা চাইবে। এ কথার যেন কোনো নড়চড় না হয়।”

তাহা একপলক তাকায় আহিরের দিকে। তারপর মাথা নিচু করে বলে,

“আমায় ক্ষমা করে দেবেন স্যার। এমন ভুল আর কখনো হবে না। আমি কখনো আপনার সাথে বেয়াদবি করবো না।(বেয়াদবি না? আপনার এই শোধ আমি তুলবো। তবে সরাসরি এভাবে নয়। একটু আলাদা স্টাইলে।)”

শেষের কথাটুকু মনে মনে বলে তাহা বিটকেলি হাসি দেয়।

“ওকে যেতে পারো এখন এখান থেকে। নেক্সট টাইম এমন ভুল যেন না হয়। এটা ভালো করে মনে রেখো।”

আহিরের কথায় তাহা চলে যেতে নিলে আতিক ডাক দেয় তাহাকে।

“এসব কিছু মাথায় রেখো তাহা। পরবর্তীতে এসব করলে কিন্তু কোনো ক্ষমা হবে না। আর হ্যাঁ, তোমার কাজের জন্য কিন্তু তোমার মায়ের মাথা নিচু হচ্ছে। সেসব ভাবো তুমি? বয়সতো নেহাৎ কম হলো না? এখনো একটু বুঝো এসব। আজেবাজে কাজ করার আগে পারলে নিজের মায়ের কথাটা মাথায় রেখো।”

তাহা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। মাঠে দাঁড়িয়ে একবার অফিসকক্ষের দিকে তাকায়। ওর মা গুটিঁগুঁটি পায়ে আসছে। আহির ওনার সাথে কি যেন বলতে বলতে বাহির হচ্ছে। তাহা সেদিকে তাকিয়ে একটা শয়তানি হাসি দেয়। আহিরের জন্য অন্তর্ভাগে পুষে রাখা ক্ষোভ থেকে বলে ওঠে,

“আহির পাটওয়ারি, আজ আপনার কাছে আমায় ক্ষমা চাইতে হলো। আমি তাহানিয়া ফেরদৌসি আজ অব্দি কারো কাছে ক্ষমা চাইনি। এই প্রথম আপনার কাছে চাইতে হল। এর শোধতো আমি শুধে আসলে উশুল করবোই।”

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ