অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-০৪

0
453

#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_০৪

“মন বলেছে আমার, আজ সঙ্গে যাবে তোর।
মরবে আরাম করে, আর বাঁচবে বড়জোর।
বেবি! কাম অন, কাম অন বেবি।
মন বলেছে আমার, আজ সঙ্গে যাবে তোর। মরবে আরাম করে, আর বাঁঁচবে বড়জোর।
সবকিছু পেরিয়ে হবে রাত ছাড়িয়ে ভো…র।”

শুনশান রাস্তায় সাইকেলে চালাচ্ছে তাহা। আর জোরে জোরে গানটা গাইছে। আবার মাঝেমধ্যে মুখ দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দও করছে। এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা হবে সম্ভবত। এ রাস্তায় জনমানব নেই। দূর থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। তাতে তাহা’র কি? সেতো এখন সাইকেল চালানো আর গান গাইতে ব্যস্ত। তাহা’র বাড়ি পৌঁছাতে আর একটা গলি বাকি। শেষ গলিটা পার হওয়ার সময় তাহা’র সঙ্গে ঘটে এক অঘটন। হ্যাঁ তাহার সাইকেলের সাথে ধাক্কা খেয়ে কেউ একজন রাস্তায় চিৎপটাং। তাহা সঙ্গে সঙ্গে সাইকেল থামিয়ে নিচে নেমে পড়ে। সাইকেলটা সাইড করে রেখে তাড়াতাড়ি রাস্তায় পরে থাকা লোকটার কাছে আসে। কাছাকাছি আসার পর বুঝতে পারে লোকটা আর কেউ নয়, আহিরের বন্ধু তামিম। সে আহিরের মামাতো ভাইও বটে। ছোটবেলায় মা বাপ হারানো ছেলেটা ফুফুর বাড়ি থেকে মানুষ হয়েছে।

“আরে তামিম ব্রো, তুমি? দেখি হাতটা দাওতো।”

তাহা কথাটা বলে তামিমের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তার আগেই কেউ তামিমকে টেনে উঠিয়ে নেয়। তাহা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় সেদিকে। তাহা সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় তার ঠিক দু’হাত সামনে নেভিব্লু টি-শার্ট এবং কালো ট্রাউজার পরিহিত আহিরকে। তাহা’রা এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ঠিক মাঝখানে। রাস্তার বামপাশে তাহা’র বাড়ি আর ডানপাশে আহিরের বাড়ি।

“তোমার কোনো কমনসেন্স নেই, তাই না? মেয়ে হয়ে রাস্তার মধ্যে এখন এই সময়ে সাইকেল চালাচ্ছো? যাইহোক, সেসব তোমার ব্যাপার। কিন্তু সাইকেল যে চালাচ্ছো, সামনে ভালো করে খেয়াল করে দেখবেতো। অবশ্য আমি তোমার সম্পর্কে যতটুকু জানি, তুমি অত্যন্ত অসভ্য, বেয়াদব একটা মেয়ে। যার মধ্যে নূন্যতম ভদ্রতা-শিষ্টতা বলে কিছু নেই।”

তাহা ডো’ন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে আহিরের দিকে। তাকে যে এতকিছু বলছে তাতে তাহা’র কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এসব তাকে প্রতিনিয়ত শুনতে হয়। তাই এখন আর এসবে তার কিছু যায় আসে না।

“ব্রো, তোমার কি লেগেছে খুব?”

তাহা ভদ্রতার সাথে তামিমকে জিজ্ঞেস করে। আহির গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। এ যেন অন্য কোনো তাহা’কে দেখছে। আহির ভাবছে, তাহা’র মত উগ্র মেয়ে কারো সাথে এমন মিষ্টি করে কথা বলতে পারে?

“না তাহা। তেমন লাগেনি। তবে তোর আরেকটু সাবধান হয়ে সাইকেল চালানো উচিৎ ছিল। যদি আমার বড়সড় কিছু হয়ে যেত? তখন আমায় কে বিয়ে করতো?”

তামিম কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে। তামিমের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে তাহা জোরে হেসে দেয়। হাসির শব্দ পেয়ে আহির তাহা’র দিকে তাকায়। এই প্রথম তাহা’কে এভাবে প্রাণোচ্ছলভাবে হাসতে দেখলো আহির। এ হাসির মধ্যে নেই কোনো কৃত্রিমতা। হাসিটা একদম বিশুদ্ধ। নেই কোনো দুষ্টুমির লেশ। মেয়েটাকে হাসলে খুব সুন্দর লাগে। হাসলে দু’গালে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। অন্য সময় টোলদু’টো অদৃশ্যমান থাকে। মেয়েটা হাসে না। সবসময় মুখটাকে গম্ভীর করে রাখে। মেয়েটাকি জানে তাকে হাসলে ঠিক কতটা মনোহর লাগে? তার একটু হাসিতে যে অন্যজনের হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। সেটাকি এই মেয়ে জানে? মেয়েটার হাসিটা ভয়ঙ্কর। এই হাসিতে যে কারো হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হতে বাধ্য। তাহা’র হাসির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো এতক্ষণ মনে মনে ভাবছিল আহির। সম্ভিত ফিরে পেতেই নিজেকে শ’খানেক গালি দেয়। তাহা’কে নিয়ে এতক্ষণ এসব ভাবছিল? ছিঃ।

“ওই ব্রো? আইসক্রিম খাবে?”

“এখন? আচ্ছা ঠিক আছে। এই আহির চল আইসক্রিম খাই।”

আহির বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকায় তাহা আর তামিমের দিকে। তাহা তামিমকে ব্রো বলে আবার তুমি করেও ডাকছে। তাহার সাথেকি তামিমের আগে থেকেই আলাপ ছিল? এমনটাইতো মনে হচ্ছে।

“তোর আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই না? এখন আইসক্রিম খাবো? চল বাসায় চল। আর এই বেয়াদব মেয়েটার সাথে তোর এত কিসের কথা?”

তামিম অবাক হয়ে বলে,

“মানে? কি বলতে চাচ্ছিস তুই?”

“আমি বলতে চাচ্ছি তুই এই অসভ্য মেয়েটার সাথে কথা বলছিস কেন? আর এমনভাবে কথা বলছিস যেন দু’জন দু’জনকে অনেক ভালো করে চিনিস?”

তামিম মুচকি হেসে বলে,

“হুম। আমরাতো ফ্রেন্ড। শুধু ফ্রেন্ড না ও আমার ছোটবোন আর আমি ব্রো। বুঝতে পেরেছিস?”

আহির ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকায় তামিমের পানে।

“মানে? সিরিয়াসলি? এই মেয়েটা তোর ফ্রেন্ড? আবার ছোটবোন? ওএমজি! তোর ছোটবোনের অভাব আছে? আমাদের বোনতো কতগুলো আছে। যদি তোর আরো প্রয়োজন ছিল তাহলে আমায় বলতে পারতিস, ভাড়া করে এনে দিতাম। অন্তত এই মেয়েটাকে তোর বোন বানাতে হতো না। এর কীর্তির কথাতো তোর অজানা নয়। আর তুই জানিস এই মেয়েটাকে আমি বিন্দুমাত্র পছন্দ করি না। সেখানে তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে ওর মত একটা মেয়েকে বোন বানাচ্ছিস?”

তাহা বুকে হাতে গুঁজে একধ্যানে তাকিয়ে আছে আহিরের দিকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আহিরের লেকচার শুনছে। তামিম কিছু বলতে নিলে তার আগেই তাহা বলে,

“আমিতো আপনাকে ভাই বানাইনি মিস্টার। তাহলে আপনার সমস্যাটা কোথায়? নিজের রাস্তা মাপুন না। আমার রাস্তায় বারবার কাঁটা হয়ে আসেন কেন? আর এইযে ব্রো! আইসক্রিম খেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার এই সো কোল্ড ফুফাতো ভাইকে দেখে খাওয়ার ইচ্ছা মরে গেছে আমার। কাল কলেজ থেকে ফেরার পর খাবো। কাল বারোটার সময় এখানে থেকো। আমার তরফ থেকে আইসক্রিম পার্টি হবে কালকে। কালকে লিসাও থাকবে। তোমার বোন আফিয়াকেও বলে দিবে। আইসক্রিম পার্টির কথা।”

“আমার বোন তোমার সাথে মিশবে না। তুমি অত্যন্ত বেয়াদব একটা মেয়ে। যার নেই কোনো আদব-কায়দা, নেই কোনো কিছুর পরোয়া। তোমার মত একটা মেয়ের সাথে আমার বোন কখনো মিশবে না। আর তামিম, তুই এই মেয়েটার সাথে ফ্রেন্ডশীপ করছিস? কি বলবো আর?”

“হইছে ভাই থাম এবার। অনেক বক্তব্য উপস্থাপন করেছিস। এবার অফ যা। তাহা কেমন তা আমি ভালো করেই জানি। নতুন করে তোর কিছু বলতে হবে না। আমি জানি ও একটু বেপরোয়া তবে খুব ভালো মনের একটা মেয়ে।”

“কি তামিম ভাই আপনি তাহা’র সম্পর্কে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করে এসেছেন নাকি?”

কথাটা শুনে সবাই রাস্তার বামদিকে তাকায়। সেখানে আরহাম দাঁড়িয়ে আছে। সম্পর্কে সে আহিরের চাচাতো ভাই।

“হ্যাঁ এসেছি। তোর কোনো সমস্যা?”

তামিমের কথা শুনে আরহাম বাঁকা হাসে। একপা একপা করে সামনে এগিয়ে আসে।

“অবশ্যই সমস্যা। আপনি আমার হবু বউয়ের ব্যাপারে কেন পি.এইচ.ডি করবেন?”

“মানে কি? তোর হবু বউ দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছিস তুই? তোর সাথে এই মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো কখন?”

আহির গম্ভীরমুখে কথাটা বলে আরহামের দিকে তাকায়। আরহাম মুচকি হেসে বলে,

“এই মেয়ে কি ভাই? তোমার ছোট ভাইয়ের বউ হবে। ভাবি করে বলো।”

“শাট আপ। এই বেয়াদব মেয়েকে আমি ভাবি বলে ডাকবো? ওর মত মেয়ে আমাদের পাটওয়ারি বাড়ির বউ কখনো হবে না। ওর সেই যোগ্যতাই নেই।”

আহিরের কথা শুনে আরহাম নিজের ভ্রুঁটা চুলকায়। তারপর মৃদু হেসে বলে,

“ভাইয়া। আমি ওকেই বিয়ে করবো। ও আমাদের বাড়ির যোগ্য কি যোগ্য না সেসব দেখার বিষয় না। মূলবিষয় হলো আমি তাহা’কে ভালোবাসি। এটা তুমি মাথায় ভালো করে ঢুকিয়ে রাখো। তাহলেই সেটা তোমার জন্য ভালো হবে।”

“এই চুপ করতো। তুই কেরে? আমি যোগ্য কি যোগ্য না, সেসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। আর তোর মত চাল চুলোহীন ছেলেকে এই তাহানিয়া ফেরদৌসি বিয়ে করবে না। তোকে না আমি ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম, আমার রাস্তায় না আসার জন্য?”

আহির ভ্রুঁযুগল কুঁচকে তাকায় তাহা’র দিকে। মেয়েটা তার ভাইকে তুই তুকারি করছে। ব্যাপারটা ভালো লাগেনি আহিরের কাছে।

“এই মেয়ে! তুমি আরহামকে তুই তুকারি করছো কেন?”

“সেসব আপনাকে ভাবতে হবে না মিস্টার আহির। আমার ব্যাপার আমি বুঝে নিবো। যে সম্মান পাওয়ার তাকে অবশ্যই আমি সম্মান দিই। আর ওর মত বখাটে ছেলেকে আমি কিসের সম্মান করবো?”

তাহা কিছুটা উচ্চশব্দে বলে।

“তুমি ওকে বখাটে বলছো? ও বখাটে! আচ্ছা আমায় একটা কথা বলোতো, ও বখাটে হলে তুমি ঠিক কি?”

তাহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আহিরের দিকে। তারপর তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

“হ্যাঁ আপনার কথামতো আমিও বখাটে। তবে আমার আপনার ভাইয়ের মত আমার চরিত্রে সমস্যা নেই।”

“তাহানিয়া!”

খুব জোরে বলে উঠে বলে উঠে আহির। ভাইবোনদের খুব ভালোবাসে সে। আর এখানে অন্য একটা মেয়ে তার ভাইকে এসব বলছে, এটা আহির সহ্য করতে পারেনি। তাহা কিছু বলবে তার আগে আরহাম বলে ওঠে,

“তাহা আমায় যা-ই বলুক। সেসবে তোমার না ঢুকলেও চলবে ভাইয়া। এসব আমাদের বিষয়। তুমি এসবে জড়িয়ো না।”

আহির অবাক হয়ে আরহামের দিকে তাকায়। যার জন্য চুরি করে, সে-ই বলে চোর। হায়রে মানুষ! মনে মনে কথাটা ভেবে তাচ্ছিল্য হাসে আহির।

“তুই কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি। নাকি আমার সঙ্গে যাবি?”

আহির তামিমের উদ্দেশ্যে খানিকটা শক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে। তামিমও আমতাআমতা করে বলে,

“আসছি দোস্ত! এমন করছিস কেন?”

তামিম আহিরের সাথে পা মেলানো শুরু করে দেয়। উদ্দেশ্য বাড়ির ভিতরে যাওয়া। যাওয়ার সময় তামিম তাহা’কে ইশারায় কিছু বোঝায়। মানে কালকে আইসক্রিম পার্টিতে সে থাকছে। তাহা বিষয়টা বুঝতে পেরে মুচকি হাসে। আহির ভিতরে যাওয়ার আগে একবার তাহা’র দিকে তাকায়। তার দৃষ্টিতে ছিল তাহা’র জন্য একরাশ ঘৃণা। কেন যেন মেয়েটাকে তার সহ্যই হয়না। মেয়েরা হবে বিনয়ী, নম্র কিন্তু এই মেয়ে সম্পূর্ণ উল্টো। যে বেচারার ঘাড়ে এই মেয়ে পড়বে, তার জীবন পানি করে দেবে। কথাটা ভেবে আহির তাহা’র ভবিষ্যৎ স্বামীর জন্য খানিকটা আফসোস করে। আর আরহাম যত যাই বলুক না কেন? এই মেয়েকে সে পাটওয়ারি বাড়ির বৌ হতে দেবে না। আরহাম নিজে যেমনই হোক, সে এই মেয়েকে ডিজার্ব করে না। মেয়েটা কোনো বাড়িরই বউ হওয়ার যোগ্য না।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ