অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-০৫

0
439

#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_০৫

তাহা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আহিরদের বাড়িতে। সে বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটি দোতলা বিশিষ্ট। তবে একতালার ভিতরটা খুব বড়। দোতলায় শুধু তিনটে রুম রয়েছে। বাড়ির ড্রয়িংরুমটা মোটামুটি ছোটখাট একটা মাঠের মত। ড্রয়িংরুমের ভিতরে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। তাহা ভিতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। এখন সকাল আটটা। সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। আহিরদের যৌথ ফ্যামিলি। আহিরের কাকারা তিনভাই। আহিরের বাবা বাড়ির কর্তা, তিনি ভাইদের মধ্যে বড়। ওনার নাম আজমল পাটওয়ারি, তিনি ব্যাংকের ম্যানেজার। অবসর পেতে বেশিদিন নেই। ওনার দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে আনিসার বিয়ে দিয়েছেন বহু আগে। নারায়ণগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে থাকে। মেয়ে আছে তার দু’টো। ছোটমেয়ে আফিয়া। সে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে তাহা’র সঙ্গে। আজমল পাটওয়ারির একমাত্র ছেলে আহির পাটওয়ারি। পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরির অপেক্ষায়। তাহা’দের কোচিং সেন্টারে পড়াচ্ছে কিছুদিনের জন্য। বাবার মত ব্যাংকার হতে চায় আহির। আর আহিরের বড় কাকা আকরাম পাটওয়ারি, তিনি কলেজের প্রিন্সিপাল। ওনার দুই ছেলে। বড়জন আমির, সে একজন হার্ট সার্জন। বিয়ে করেনি এখনো। পাত্রী খোঁজা হচ্ছে তার জন্য। আর ছোটজন আরহাম। মাস্টার্সে পড়ছে সে, তা নামেমাত্র। বাড়ির কোনোকিছুর সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। নেশাও করে সে। ছেলেটাকে মানুষ করতে পারেননি আকরাম পাটওয়ারি। ভীষণ বেয়াদব ওনার ছোট ছেলেটা। আর আহিরের ছোটকাকা আজিম পাটওয়ারি, উনি এন.আই.সিতে চাকরি করেন। তাই বউ বাচ্চা নিয়ে চাকরিস্থলেই থাকেন তিনি। মোটকথা, আহিরদের পরিবারের আলাদা একটা জায়গা আছে এই এলাকায়। আহিরের দাদা সেনাবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। আর তাহা’র দাদার এক ছেলে। তাহা’র বাবার কোনো ভাই নেই। উনি তাহা’দের এলাকার চেয়ারম্যান। ওনার স্ত্রী দু’জন। বড়স্ত্রী সোনিয়া। তার একটাই মেয়ে তাহা। আর ছোটস্ত্রী আফসানা। তারও একটা মেয়ে সাথী। তবে মেয়েটা আফসানার আগের পক্ষের।

“তাহা তুই?”

আফিয়া কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিল তাহা তাদের বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। আফিয়া এগিয়ে আসে তাহা’র কাছে। আফিয়া তাহা’কে ডাকতেই সকলের দৃষ্টি তাহা’র দিকে নিক্ষিপ্ত হয়। তা দেখে তাহা মেকি হাসে। হাসতে হাসতে ভিতরে প্রবেশ করে। আফিয়াকে ফিসফিস করে বলে,

“তোদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি।”

কথাটা শুনে আফিয়ার ভ্রুঁ কুঁচকে যায়। কি বলে এ মেয়ে? এ নাকি বেড়াতে এসেছে? মাথা গেছে নাকি তাহা’র? কথাটা আপনমনে ভেবে আফিয়া তাহা’র দিকে পূর্ণদৃষ্টি স্থাপন করে। সেও তাহা’র মত ফিসফিসিয়ে বলে,

“মশকরা করছিস আমার সাথে?”

“তাহা? তুমি এখানে?”

রান্নাঘরে রুটি ভেলছিলেন ফাতেমা বেগম। উনি আহিরের মা। ওনাকে দেখে তাহা মিষ্টি করে হাসে। সে হাসিতে মুগ্ধ হতে বাধ্য সব মানুষ। তেমনি তাহা’র হাসি দেখে ফাতেমা বেগমও মুচকি হাসলেন। ডানহাতে আটা বিধায় বা’হাতে আগলে নিলেন তাহা’কে। মেয়েটাকে তিনি খুব পছন্দ করেন। আহিরের সঙ্গে তাহা’র সম্পর্কটা ভালো না হলেও ফাতেমা বেগমের সঙ্গে তাহা’র সম্পর্ক খুব ভালো। মাঝেমধ্যে রাস্তায় দেখা হয় তাদের। দেখা হলে তাদের সেকি কথা! ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেবে দু’জনে মিলে।

“তুমি কেমন আছো মিষ্টি মা?”

তাহা’র প্রশ্নে ফাতেমা বেগম মিষ্টি করে বলেন,

“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আমার মিষ্টি মেয়েটা কেমন আছে শুনি? আর সূর্য কোনদিকে উঠলো? তাহাপরী আজা আমার দুয়ারে!”

“তোমার মিষ্টি মেয়ে খুব ভালো আছে। আর আজকে সূর্য পূর্ব দিকেই উঠেছে। কেয়ামত এখনো আসেনি যে সূর্য পশ্চিমদিকে উঠবে?”

তাহা’র কথা শুনে ফাতেমা বেগম হেসে ফেললেন।

“হয়েছে পাঁজি মেয়ে। তা বললে না যে, আজ আমার বাড়িতে কেন? অন্যসময়তো জোর করেও আনতে পারি না?”

তাহা মাথা চুলকে হাসে।

“আসলে কি বলোতো মিষ্টি মা। আমার তোমার সাথে অনেকদিন হয়েছে দেখা হয়নি। তাই ভাবলাম একটু দেখা করি। আর আরেকটা দরকার আছে।”

ফাতেমা বেগম ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলেন,

“আর কি দরকার?”

তাহা সবার দিকে একবার তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দেয়। ইনিয়েবিনিয়ে বলে,

“আসলে তোমার ছেলেতো আমাদের কোচিং সেন্টারে পড়ায়। শুনেছো নিশ্চয়ই? আমি একটা পড়া বুঝছি না। সেজন্য একটু বুঝতে এসেছি।”

তাহা’র কথা শুনে আফিয়ার চোখ রসগোল্লার ন্যায় হয়ে যায়। এই মেয়ে তার ভাইয়ের কাছে পড়ার জন্য এসেছে। যেই মেয়ের সাথে তার ভাইয়ের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। সে কিনা তার ভাইয়ের কাছে পড়া শিখতে এসেছে। এই মেয়ের মাথায় নিশ্চয়ই অন্যকোথায় মতলব আছে। তাহা কি করে দেখতে হচ্ছেতো। কথাটা মনে মনে ভেবে কিঞ্চিৎ হাসে আফিয়া।

“বিকালে কোচিংয়ে গেলেইতো পড়া জিজ্ঞেস করে নিতে পারবে। এখন পড়া জিজ্ঞেস করতে আসার কি দরকার?”

তাহা ঘাড় ফিরিয়ে ডান দিকে তাকায়। কথাটা বলেছেন আরহামের মা মার্জিয়া বেগম। তিনি আহিরের বড় কাকি। উনি কথাটা বলে তাহা’র দিকে তাকিয়ে আছে।

“আসলে কোচিংয়ে গেলেতো পড়া দিতেই হবে। এখন তাই একটু পড়াটা বুঝিয়ে দিলে আমার বুঝতে একটু সুবিধা হবে। মিষ্টি মা, ওনাকে একটি ডেকে দাও না।”

ফাতেমা বেগম আফিয়াকে ইশারা করে দেখান।

“আফিয়া, যাও তাহা’কে আহিরের রুমে নিয়ে যাও। আহির এখন রুমেই আছে। যাও তাহা তুমি আফিয়ার সঙ্গে যাও।”

ফাতেমা বেগমের কথায় তাহা মিষ্টি করে হাসে। আফিয়ার পিছুপিছু সে যেতে লাগলো। দোতলার একদম শেষ দিকের রুমটা আহিরের। আফিয়ার সাথে গুটিঁগুঁটি পায়ে তাহা আহিরের ঘরে পা রাখে। আহিরের রুমটা বেশি বড়ও না আবার একেবারে ছোটও না। রুমে বিদ্যমান জিনিসপত্রের মধ্যে রয়েছে একটা বেড, একটা ড্রেসিং টেবিল, বেডের সাথে লাগোয়া একটা স্টাডি টেবিল। আহিরের রুমের সামনে বারান্দা দেখা যাচ্ছে। এখানে দাঁড়ালে তাহা’র রুমটা দেখা যায়। কারণ তাহা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বারান্দায় একবার উঁকিও মেরে ফেলেছে। আহিরের দরজার পশ্চিম পাশে ওয়াশরুমের দরজা দেখা যাচ্ছে। ওয়াশরুমের দরজার পাশেই একটা ওয়ারড্রব আছে। এই আছে আহিরের রুমে। আহিরের রুমটা গোছালো, পরিপাটি। অবশ্য আহিরকে দেখলেই বুঝা যায় সে অনেক গোছালো একটা মানুষ।

“ভাইয়া আসবো?”

শুয়ে শুয়ে ফোন স্ক্রল করছিল আহির। এ সময়ে বোনের ডাক পেয়ে তার ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে যায়। আফিয়া এ সময়ে রুমে? এ সময়ে কখনও আফিয়া তার রুমে আসেনি। আহির মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। তার দরজায় দণ্ডায়মান তাহা’কে দেখে তৎক্ষণাৎ শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসে আহির।

“তুমি? তুমি আমার বাড়িতে কি করছো? আবার আমার রুমেও এসেছো?”

আহির প্রশ্নটা করে কাল বিলম্ব করে না। সাথে সাথে তাহা’দের সামনে এসে দাঁড়ায়।

“আসসালামুআলাইকুম।”

তাহা’র মুখ থেকে সালাম শুনে আহির যেন সপ্তম আসমান থেকে মাটিতে পড়লো। এই মেয়ে সালামও দিতে জানে? কবে কবে এত ভালো হলো তাহানিয়া? অন্তরালে প্রশ্নগুলো জাগলেও মুখে কিছু বলেনি আহির। স্বাভাবিকভাবেই তাহা’র সালামের জবাব দিলো সে।

“ভাইয়া, তাহা তোমার কাছে একটু দরকারে এসেছিল। আমরা কি ভিতরে যাবো?”

আফিয়ার কথায় সায় জানায় আহির। আহিরের অনুমতি পেয়ে তাহা আর আফিয়া ছোটছোট কদম পেলে রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। আহিরের স্টাডি টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চেয়ার টেনে সেখানে বসে পড়ে।

“তোমার কি দরকার আমার কাছে?”

আহিরের প্রশ্নে তাহা মুচকি হাসে। হেসে ব্যাগ থেকে বই আর খাতাটা বের করে সামনে রাখে।

“আমি এই চ্যাপ্টারের এই অংশটা বুঝছি না। আপনিতো কালকে এটা পড়া দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন আজকে যাতে সবাই পড়াটা দেয়। আমি আসলে ইংরেজিতে খুব দুর্বল। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না বিষয়টা। আপনি আমায় একটু বুঝিয়ে দেবেন?”

আহির ভ্রুঁযুগলকে দু’দিকে প্রসারিত করে তাহা’র দিকে তাকায়। এ যেন নতুন এক তাহা। মেয়েটা কি মিষ্টি কন্ঠে, নম্র ভাষায় কথাগুলো বলছে। মেয়েটার হঠাৎ হলো কি? কালকে কি আতিক ভাইয়ের কথাগুলো সিরিয়াসলি নিলো? যাক, এমন হলে ভালোই হবে। কথাগুলো অন্তরালে ঘুরপাক খেলেও বাহিরে প্রকাশ করলো না।

“তুমিতো কোচিংয়ে গিয়েও দেখাতে পারতে তোমার সমস্যাটা।”

আহিরের কথায় তাহা সাবলীলভাবে জবাব দেয়।

“আসলে কোচিংয়ে যদি সময় না পান, তাই এখন এসেছি। আচ্ছা আপনার যদি সমস্যা হয় তাহলে লাগবে না। আমি চলে যাচ্ছি।”

“না। আমার কোনোটা সমস্যা হচ্ছে না। আমি এমনিই বলেছি। তুমি দেখো পড়া।”

বেশ অনেক্ষণ ধরে আহির তাহা’কে পড়াটা বোঝায়। তাহা কিছুতেই ভালো করে বুঝতে পারছে না। আহির তাও ধৈর্যসহকারে পড়াচ্ছে। আহিরের বিছানার এককোণে বসে আছে আফিয়া। সে মূলত দেখতে চাচ্ছে তাহা আসলে কি করবে। তাহা’কে তার সুবিধার লাগছে না। মেয়েটা রাতারাতি এত ভালো কি করে হয়ে গেল? মনে প্রশ্ন জাগছে আফিয়ার।

“তুমি এটা একটু সলভ করো। আমি একটু আসছি।”

কথাটা বলে আহির মোবাইলটা বের করে রুমের বাহিরে যায়। হয়তো কাউকে কল করতে যাচ্ছে। আহির চলে যেতেই আফিয়া তাড়াহুড়ো করে তাহা’র কাছে এসে দাঁড়ায়।

“এই তাহা! বলতো তুই কি করতে চাচ্ছিস? তোর মতলবটা কি?”

আফিয়ার প্রশ্নে তাহা অবাক হওয়ার ভান করে বলে,

“কি বলছিস তুই এসব? আমি কি করবো? শুননা আফিয়া! আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারবি?”

আফিয়া আহিরের রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে জগে পানি নেই। তাই সে তাহা’র দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায় পানি আনতে। আহিরের রুমে একা বসে আছে তাহা। মুখে ঝুলে আছে তার চমৎকার হাসি।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ