অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-০৬

0
420

#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_০৬

“আম্মু”

সর্বশক্তি দিয়ে মা’কে ডাকে আহির। আহিরের ডাকে হুড়োহুড়ি করে উপরে উঠে আসেন ফাতেমা বেগম।

“কি হয়েছে আহির? এভাবে ডাকছিস কেন?”

ফাতেমা বেগম কথাটা বলে আহিরের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। আহির বিছানার ওপর বসে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব রেগে আছে। ফাতেমা বেগম বুঝলেন না ছেলের এত রেগে যাওয়ার কারণ। তিনি আস্তে করে আহিরের কাঁধে হাত রেখে বলেন,

“কি হয়েছে বাবা? এমন করছিস কেন?”

আহির হাত দিয়ে তার মুখ ইশারা করে কিছু দেখায় মাকে। আহিরের ইশারা অনুযায়ী তিনি আহিরের মুখের দিকে তাকান। আহিরের সারা মুখ লাল লাল হয়ে ফুলে আছে। তা দেখে ফাতেমা বেগম ব্যতিব্যস্ত হয়ে আহিরের মুখটা দেখেন।

“এগুলো কি হয়েছে মুখে? এমন হয়ে লাল হয়ে আছে কেন? মনে হচ্ছে কোনো পোকা কামড়িয়েছে।”

আহির শক্ত মুখে তার বিছানার ওপরে রাখা বালিশটা ইশারা করে দেখায়। বালিশের ওপর লাল লাল কিছু দেখা যাচ্ছে। ফাতেমা বেগম বিছানার কাছে এগিয়ে বালিশটা হাতে নেন। সুক্ষ্মভাবে প্রত্যক্ষ করে বুঝতে পারলেন এগুলো লাল পিঁপড়া। এগুলোর কামড় খেয়েই কি আহিরের মুখের এই অবস্থা?

“এগুলোতো লাল পিঁপড়া। তোর বিছানায় কিভাবে আসল?”

আহির আবার ইশারা করে দেয়ালের দিকে কিছু দেখায়। ফাতেমা বেগম বিছানার ওপরে দেয়ালের দিকে তাকান। তাকিয়ে ওনার চোখ রসগোল্লা আকৃতির হয়ে যায়। দেয়ালের ওপর আহিরের একটা ছবি বড় করে ঝুলানো। সেই ছবিটাকে কেউ মার্কার দিয়ে আঁকিবুঁকি করে আকৃতি পরিবর্তন করে দিয়েছে। ইয়া বড় বড় গোঁফদাড়ি, চোখে কাজল একে দেওয়া। দেখতে এখন আহিরকে পুরো জোকারের মত লাগছে। ফাতেমা বেগম হঠাৎ করে অনুভব করলেন ওনার হাসি পাচ্ছে। কিন্তু এখন ছেলের সামনে হাসা যাবে না। ছেলে এমনিতেই রেগে আছে। এখন হাসলে বাড়িঘর আস্তো রাখবে না।

“কে করেছে এসব?”

হাসি নিয়ন্ত্রণ করে আহিরকে প্রশ্ন করেন ফাতেমা বেগম। আহির রাগে গজগজ করতে বলে,

“জানো না এসব কার কাজ? আর আমাদের বাড়ির কে এসব করার সাহস দেখাবে? এসব ওই অসভ্য মেয়েটারই কাজ। মেয়েটাকে দেখে প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, পরে ভাবলাম হয়তো ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু না ওই মেয়ে জীবনেও ভালো হবে না।”

ফাতেমা বেগম শুকনো ঢোক গিলেন। সর্বনাশ করেছে। তাহা নিশ্চয়ই এসব করেছে। আর তাহা এমন করতে গেল কেন? এখন আহির ওকে আস্ত রাখবে না।

“কোন মেয়ের কথা বলছিস আহির?”

বুঝতে পেরেও আহিরকে প্রশ্ন করেন ফাতেমা বেগম। আহির শান্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়।

“বুঝতে পারছো না কার কথা বলছি? নাকি জেনেও না বুঝার ভান করছো? চেয়ারম্যান কাকার ওই পাঁজি মেয়ের কথা বলছি। আজ সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে ওই পাঁজি মেয়েটা।আমার মুখটার কি হাল করেছে পিঁপড়াগুলোয় দেখো।”

“তুই কিভাবে জানিস ও-ই এসব করেছে? ওতো তোর কাছে পড়া শিখতে এসেছে। শুধু শুধু ওকে দোষারোপ করার কোনো মানে নেই আহির।”

“মা! আমি জানি ওই মেয়ের সাথে তোমার খুব ভাব। তাই ওর হয়ে কোনো কিছু আমাকে বলার প্রয়োজন নেই। ওই মেয়ে অনেক বাড় বেড়েছে। আমাকে পিঁপড়াগুলো কামড়িয়ে কি হাল করেছে দেখতে পাচ্ছো না? মুখটা এখন জ্বালাও করছে। ওর ব্যবস্থাতো আমি করবোই।”

“থাক, আহির বাবা ছেড়ে দে না। ছোট মানুষতো। আর করবে না। আচ্ছা আমি তোর জন্য বরফ নিয়ে আসছি। বরফ মুখে ঘষলে অনেকটা জ্বালা কমে যাবে। আর শোন ওকে কিছু করিস না। আর এমন করবে না তাহা। কোচিংয়ে গিয়ে আর পঁচা টমেটোও ছুঁড়বে না। আমি তোকে বলছি।”

আহির সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে মা’য়ের দিকে তাকায়।

“তোমাকে কোচিংয়ের টমেটো ছোঁড়ার কথা কে বলেছে? আফিয়া?”

“না। তাহাই তো বলে..”

কথাটুকু বলে থেমে যান ফাতেমা বেগম।

“তারমানে ওই পাঁজি মেয়েটা তোমাকে এসব বলেছে? হুম বলবেই না কেন? ওর সাথে তোমার যা ভাব! এতকিছু জেনেও তুমি ওই মেয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলছো আম্মু?”

ফাতেমা বেগম ক্যাবলামার্কা হেসে মাথা চুলকান কিছুক্ষণ।

“ও কিন্তু খুব ভালো মনের মানুষ আহির। একটু বোঝার চেষ্টা করলেই বোঝা যায়। হ্যাঁ একটু দুষ্টু তবে মনটা খুব ভালো।”

“ওকে বোঝার কোনো দরকার নেই আমার। আর শুধু দুষ্টু? তুমি জানোনা ও ঠিক কতটা বেয়াদব। ওইদিন আফসানা আন্টির সঙ্গে কিভাবে কথা বলেছে আমি দেখেছি। বড়দের সঙ্গে কি করে কথা বলতে হয় সেটাই এ মেয়ে জানে না।”

ফাতেমা বেগম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়েন।

“কারো ব্যাপারে সম্পূর্ণ না জেনে তার সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক নয় আহির। আফসানা আর তাহা’র সম্পর্কটা কেমন তুইতো জানিস?”

“হুম আম্মু আমি জানি। আফসানা আন্টি তাহা’র বাবার দ্বিতীয় পক্ষ। তাহা’র বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে সেখানে সমস্যা তাহা’র মায়ের সমস্যা থাকার কথা। সেখানে উনি কিছু বলেন না। ওনার সাথেতো আফসানা আন্টির কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। তাহলে তাহা’র এত সমস্যা কোথায়? মায়ের বয়সী একজন মহিলাকে ও কিভাবে ট্রিট করে? আবার কালকে আরহামকে দেখলাম তুই তুকারি করছে। ওর মত এমন মেয়ে আমি আমার জীবনেও দেখিনি।”

ফাতেমা বেগম ম্লান হাসেন। ছেলের মাথায় হাত রেখে বলেন,

“সবার জীবনটা একরকম হয়না আহির। তুই যেমন আদর স্নেহ পেয়ে বড় হয়েছিস। বাবা-মাকে সবসময় পাশে পেয়েছিস, এমনটাতো ওই পাঁজি মেয়েটা পায়নিরে। আর আরহাম তোর ভাই তাই তোর ওর জন্য খারাপ লাগছে কিন্তু সত্যি হলো আরহাম ছেলেটা ভালো নয়। সর্বক্ষণ তাহা’র পিছনে আঠার মত লেগে থাকবে। ওকে নাকি বিয়ে করবে। জানিস তাহা কি বলেছে আমাকে। ও বলেছে “শোনো মিষ্টি মা, ওই আরহাম পাটওয়ারি যদি আমাকে বিয়ের কথা আবার বলে তাহলে ওকে মেরে হাত পা ভেঙে প্যাকেট করে পাটওয়ারি বাড়িতে পার্সেল করে দিবো।” আচ্ছা একটা কথা বলতো আমায়, তাহা কি একদিনও তোকে তুই তুকারি করেছে?”

” না। ও আমায় আপনি বলে সম্বোধন করে।”

“এবার ভাব। ও তোর সাথে যা-ই করুক। তোকে কিন্তু সম্মান করে। তুই সম্মানটা ডিজার্ব করিস বলে তোকে সম্মান করে। আর আরহাম সেটা ডিজার্ব করে না বলে ও সম্মানটা পায়না। আর আরো একটা কথা তাহা কিন্তু তার বাবাকে খুব ভালোবাসতো। খুব সুখের সংসার ছিল তাদের। বাবা-মাকে নিয়ে আনন্দেই ছিল সবসময়। হঠাৎ এক ঝড় এসে ওদের সংসারটাকে ভাগ করে দিল। যে বাবার দুনিয়া ছিল ও। সেই বাবাই ওকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। সোনিয়ার চাচাতো বোন আফসানার রূপে মজে গিয়ে প্রথম স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ওকে বিয়ে করে আনে। সোনিয়া প্রতিবাদ করলে ওকে ঘরে দরজা বন্ধ করে মারতো। এসবের প্রত্যক্ষদর্শী ছিল তাহা। তখন থেকেই মেয়েটা কেমন যেন হয়ে যায়। আবার আফসানার আগের পক্ষের মেয়ে সাথী। ও তাহা’র বাবার আদরের দুলালী হয়ে উঠলো এক সময়। তাহা সাথীকে কিছু বললে, সাথী তাহা’র বাবার কাছে সত্যমিথ্যার সংমিশ্রণ করে তাহা’র নামে নালিশ করতো। অন্ধের মত সেসব বিশ্বাসও করতো তাহা’র বাবা। তারপর উনি তাহা’কে বকাঝকা করতেন। তখন থেকেই তাহা বেপরোয়া হয়ে উঠলো। কারো কোনো পরোয়া করে না। কারো কথা শুনে না।”

“তাহলে আম্মু বড়কাকিতো বলে তাহা’র মা বিয়েতে আপত্তি করেন নি। আফসানা আন্টি নাকি তাহা’কে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসেন কিন্তু তাহা’ই ওনাকে পছন্দ করেন না। ইভেন আমি এটা নিজের চোখে দেখেছি।”

“তোর বড়কাকির বোন আফসানা। ও এসব বলবেই। আর রইলো আফসানার তাহা’কে ভালোবাসার কথা, হ্যাঁ সত্যিই আফসানা তাহা’কে ভালোবাসে। কিন্তু তাহা ওনাকে পছন্দ করেন না। কেন পছন্দ করে না সেটা একটু ভাবলেই বুঝতে পারবি। যার জন্য তাহা’র সুখের পরিবারটার এই হাল, তাকে কি আদৌ পছন্দ করা যায়? আর তাহা’র জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে ভাবিস। বুঝতে পারবি মেয়েটার এমন হওয়ার কারণটা। আচ্ছা আমি এখন যাই। তোর জন্য বরফ নিয়ে আসি আগে। এতক্ষণ কথায় কথায় মনেই ছিল না।”

ফাতেমা বেগম রুম থেকে প্রস্থান করলে আহির গভীর ভাবনায় মনোনিবেশ করে। সত্যিইতো এমন একটা পরিবারে মেয়েটা বড় হয়েছে। সেখানে মেয়েটার এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এতদিন আহির সব না জেনে মেয়েটাকে ভুল ভেবে এসেছে। কারো প্রকৃত অবস্থা না জেনে তার সম্পর্কে আজেবাজে মন্তব্য বা সেই মানুষটাকে বিচার করা একেবারে অনুচিত। এটা আহির আজ উপলব্ধি করছে। মেয়েটার সম্পর্কে না জেনে তার সাথে এরূপ ব্যবহার করা আহিরের একদম উচিৎ হয়নি।
______________

ডাইনিং টেবিলে বসে সবাই দুপুরের খাবার খাচ্ছে। সাথীকে খাইয়ে দিচ্ছেন আফসানা বেগম। তাহা’র মা তাহা’র বাবাকে পরিবেশন করছেন। তাহা নিজের হাতে খাচ্ছে। খেতে খেতে তাহা’র বাবা তাহা’কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“তুমি কখনো ভালো হবে না তাই না? রাস্তায় বেরোলেই শুনি চেয়ারম্যানের মেয়ে এটা করেছে, ওটা করেছে। কেন তোমায় নিয়ে সবসময় চর্চা হবে? তোমার কোনো কিছুর কমতিতো রাখিনি আমি। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছি তোমাকে। আচ্ছা আমি কি কখনো এটা শুনতে পাবো না যে চেয়ারম্যান ইব্রাহীম খলিলের মেয়েটা ভালো?”

“না। আপনার সে ইচ্ছেটা হয়তো কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কারণ আমি ভালো হবো না। আমি ভালো কি করে হবো? আমিতো ভালো মানুষের ঘরে জন্ম নিই নি।”

“তাহানিয়া”

ইব্রাহীম সাহেব বেশ জোরে ধমকে ওঠেন তাহা’কে। তাহা এতে কিছু বললো না। বরঞ্চ একটা ডো’ন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে শুরু করে। তাহা’র এই ডো’ন্ট কেয়ার ভাবটা ইব্রাহীম সাহেবের পছন্দ হলো না। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে উনি তাহা’র হাত থেকে জগটা টেনে নিজের হাতে নিয়ে ফ্লোরে সর্বশক্তি দিয়ে আঁচাড় মারেন। এক মুহূর্তের জন্য তাহা ভয় পেয়ে যায়। রাগে গজগজ করতে করতে ডাইনিং রুম প্রস্থান করেন ইব্রাহিম খলিল। তাহা’র মা মাথানিচু করে বসে আছেন। তাহা নিঃশব্দে খাচ্ছে।

“তুই কি বাবাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিবি না? একটু খেতেও পারল না তোর জন্য।”

সাথীর কথায় তাহা খাওয়া বন্ধ করে তার দিকে চোখ ছোটছোট করে তাকায়।

“মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি। এই কথাটা আজ প্রমাণ হলো। আচ্ছা তোর লজ্জা করে না অন্যকারো বাবাকে বাবা বলে ডাকতে? উনিতো তোর বাবা নয়। নিজের বাবাকে বাবা ডাক না।”

“তাহা। তুই এসব কি বলছিস?”

তাহা মায়ের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকায়।

“তুমি একটু চুপ করে থাকোতো আম্মু। পরের মেয়ের জন্য এত দরদ ভালো নয়। ভুলে যেওনা ওদের জন্যই তোমার সংসারের এই অবস্থা। উনি তোমার কাছ থেকে তোমার স্বামীকে আর এই মেয়ে আমার কাছ থেকে আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে। তোমার কি মনে হয় এসব কিছুর পরও আমি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করি? ও যা ডিজার্ব করে ওর সাথে আমি তা করি না। সেটাই ওর ভাগ্য।”

আফসানা বেগম ছলছল চোখে তাকান। ভাগ্যের নির্মম খেলার স্বীকারতো উনি নিজেও। সাথীর বাবা ছিল মদখোর। সেই সংসারে শান্তি পাননি তিনি। সেখান থেকে আরো একজনের সংসারের আসলো। বিয়ে করলো এমন একজনকে, যার সংসারে আরো একজন স্ত্রী আছে। একটা ফুটফুটে মেয়েও আছে। একটু সুখের আশায় এ সংসারে এসেছিল। সুখতো তার মিলেছে, মেয়েরও মিলেছে কিন্তু অন্য এককারো জীবনটা যে দুর্বিষহ হয়ে গেল ওনার জন্য। নিজের সুখের জন্য তিনি এত স্বার্থপর হয়ে গেলেন যে অন্যকারো সুখটা যে তিনি ছিনিয়ে নিয়েছেন সেসব তিনি দেখেও দেখেননি। তাহা আর তাহা’র মায়ের কাছে তিনি সারাজীবন দোষী হয়ে থাকবেন। এ দোষের ক্ষমা যে কখনও হবে না। কখনও না।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ