অবেলায় ভালোবাসি পর্ব-০৭

0
426

#অবেলায়_ভালোবাসি
#মারিয়া_আক্তার
#পর্ব_০৭

ক্বারীবাগানের পাশের বড় দীঘিটার পাড়ে বসে আছে তাহা। দৃষ্টি তার দীঘির স্বচ্ছ জলে নিবদ্ধ। চোখের পাতার নড়চড় নেই। আহির বাইকে বসে অনেক্ষণ ধরে তাহা’কে অবলোকন করছে। আহির এখানে এসেছে অনেক্ষণ। তাহা’কে এখানে বসে থাকতে দেখেই মূলত বাইকটা থামিয়েছে। তাহা এখানে কি করছে সেটাই আহির দেখতে চাচ্ছে। তাহা’র অবস্থার পরিবর্তন না দেখে আহির বাইক রেখে তাহা’র কাছে এগিয়ে যায়।

“তাহানিয়া”

কারো ডাকে তাহা জলের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে তাকায়। তাহা’র কিছুটা দূরেই আহির দাঁড়িয়ে। তাহা’র চোখগুলো দেখে আহির খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। তাহা’র চোখগুলো টকটকে লাল। তাহা কি কান্না করেছে? প্রশ্নটা আহিরের মনে জাগে।

“তুমি কি কান্না করছো?”

আহির প্রশ্নটা করলে তাহা চোখ বন্ধ করে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করে।

“কোথায় কাঁদছি? চোখে আজকাল একটু বেশি দেখছেন মনে হচ্ছে।”

আহির ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় তাহা’র দিকে। মেয়েটা কথা ঘুরাতে চাচ্ছে। হয়তো বুঝতে দিতে চাইছে না। যেহেতু চাইছেই না তাই আহির আর তাহা’কে ঘাটায়না। মেয়েটা হয়তো নিজের জীবনের ঘটনাগুলো স্মরণ করে কাঁদছে। মায়ের কাছ থেকে তাহা’র সম্পর্কে জানার পর আহিরের কেন যেন তাহা’র জন্য খুব খারাপ লাগে। তাহা’কে নিয়ে এখন ভাবে আহির। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে আহির উশখুশ করে তাহা’র পাশে কিছুটা দূরত্ব বঝায় রেখে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে। তাহা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় এটা দেখে। আহির কিছু বলবে ভাবছে কিন্তু বলতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর থাকতে না পেরে তাহা’র উদ্দেশ্যে বলে,

“এখানে এভাবে বসে আছো কেন?”

“আমার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন যে? প্রেমে ট্রেমে পড়লেন নাকি?”

আহির তাহা’র দিকে এমন করে তাকালো, যেন সে এ ধরনের কথা আগে কখনো শুনেনি।

“কি? প্রেমে পড়বো? তোমার? একটা মানুষের প্রেমে পড়ার জন্য যেই গুণগুলো থাকতে হয়, সেসব তোমার মধ্যে আছে?”

আহিরের প্রশ্নে তাহা শব্দ করে হেসে দেয়। আবারও সেই টোলদু’টো দৃশ্যমান হয়। আহিরের দৃষ্টি সেখানে থমকে যায়। আহিরের মনে হলো সে ভুল প্রশ্ন করেছে মেয়েটাকে। মেয়েটার প্রেমে পড়ার জন্য গুণের প্রয়োজন নেই। মেয়েটার এই মুগ্ধ করা হাসিতে মানুষ প্রেমে পড়তে বাধ্য।

“প্রেমে পড়ার জন্য গুণের প্রয়োজন হয় বুঝি? আচ্ছা ছাড়ুন সেসব। একটা কথা বলুনতো, আপনিতো আমায় পছন্দ করেন না। তাহলে হঠাৎ নিজে থেকে এসে আমার সাথে কথা বলছেন যে?”

আহির আমতাআমতা করে। আসল কারণটা সে নিজেও জানে না। তবে এখন মেয়েটার জন্য তার নিজের খুব খারাপ লাগে। সে কিছুটা উপলব্ধি করে মেয়েটার কষ্টগুলো।

“এমনিই আসলাম। মানুষতো মানবতা আছে আমার মধ্যে।”

“আমি জানি আপনি ভালো মানুষ। আমার মত একটা খারাপ মেয়ের সাথে আপনার এভাবে কথা বলাটা ঠিক নয়। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে। আপনি বাড়ি যান।”

“নিজেকে সবসময় খারাপ ভাবো কেন? হয়তো পরিস্থিতি তোমাকে এই অব্দি এনে দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু তুমি কেন নিজের সাজানো গোছানো জীবনটাকে নষ্ট করে দিচ্ছো নিজের হাতে? তোমার জীবনটা খুব সুন্দর করে তুলতে পারো তুমি নিজে। নিজেকে ভালোবাসতে শিখো, দেখবে পুরো পৃথিবীটাই তোমার ভালো লাগবে।”

তাহা না চাইতেও কিছুটা মনোযোগ দিয়ে আহিরের কথা শুনে। সত্যিই কি তাহা নিজেকে ভালোবাসে না? কার জন্য তাহা এমন হলো? নিজের জন্যইতো। বাবা নামক মানুষটাকে ঘৃণা কর‍তে করতে নিজের সত্তাকে সে ভুলে গেছে। সে যে নিজের মধ্যে আগের তাহা’কে খুঁজে পায় না।

“আজ হঠাৎ করে এসব বলছেন যে? আপনার ভাষায় আমিতো অসভ্য, বেয়াদব যার মধ্যে কোনো আদব-কায়দা নেই এমন মেয়ে। তাহলে আজ আমাকে এসব বলার মানে কি?”

“আমি জানতাম তোমার বাবা দু’টো বিয়ে করেছে। হ্যাঁ, যে সংসারে দু’জন স্ত্রী থাকে সেখানে একটু সমস্যা থাকবেই। কিন্তু বাহিরে থেকে বোঝা যায় না তোমাদের ভিতরকার ব্যাপারগুলো। আমি এতদিন ভাবতাম আর পাঁচটা পরিবারের মত তোমাদের পরিবারটাও। তোমাদের পরিবার সম্পর্কে মাথাও ঘামাইনি কখনও। আমি এতদিন ভিতরের ঘটনাগুলো জানতাম না। কাল আম্মুর কাছে শুনেছি। বিশ্বাস করো, আমার মনে হচ্ছে, এতদিন আমি ভুল ছিলাম। তোমায় চিনতে ভুল করেছি। তুমি সবসময় আমার সামনে খারাপ আচরণই কিন্তু করতে। সেখানে আমি তোমার সম্পর্কে ভালো ধারণা কিভাবে রাখি বলো?”

তাহা চুপ করে থাকে। কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকার পর বলে উঠে,

“আচ্ছা আপনি এখান থেকে যান।”

তাহা’র কথায় আহির প্রথমে অবাক হলেও পরে বলে,

“কেন? জায়গাটাকি তোমার নাকি?”

তাহা হেসে ফেলে আহিরের কথার ভঙ্গিমা দেখে। হাসতে হাসতে বলে,

“আপনিতো আমার মত কথা বলা শুরু করেছেন। ত্যাড়াভাবে।”

“তোমায় হাসলে খুব সুন্দর লাগে। একদম রুপকথার পরীর মত! তুমি সবসময় হাসো না কেন?”

আহিরের প্রশ্ন শুনে তাহা’র মুখের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। প্রশ্নটা করে আহির নিজেই থতমত খেয়ে যায়। কি বলে ফেললো সে? এখন তাহা’কে কি বলবে আহির?

“নাইস জোকস!”

অবাক হয় আহির। সেতো জোকস বলেনি। সত্যি-ই বলেছে। আসলেই মেয়েটার হাসি চমৎকার। মেয়েটাকি এটা বুঝে বললো নাকি না বুঝে?

“আচ্ছা তুমি আমার রুমে গিয়ে আমার বালিশে লাল পিঁপড়া কেন রেখেছিল? আর দেয়ালে টানানো আমার ছবিটার এই হাল কেন করেছো?”

আহিরের শান্ত কন্ঠে কথাটা তাহা’র কাছে কেন যেন হুমকি মনে হলো। এটার জন্য আহির এবার কি করবে তার সাথে? ওইদিন আহির রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর, কৌশলে পানির কথা বলে আফিয়াকে রুম থেকে বের করে সুযোগের সৎ ব্যবহার করে তাহা। বোতলে করে আনা লাল পিঁপড়াগুলো আহিরের বালিশের কভারের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে। আর দেয়ালে টানানো ছবিটার ওপর মার্কার দিয়ে আঁকিবুঁকি করে। অবশ্য মুছলে উঠে যাবে সেসব। তবুও ছবিটার ওপর নিজের রাগ ঝেড়েছে।

“মানে? কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?”

তাহা কোনোরকমে আমতাআমতা করে বলে। আহির মৃদু হাসে।

“সত্যি কিছু বুঝতে পারছো না? দ্য গ্রেট তাহানিয়া ফেরদৌসি কি আমাকে ভয় পাচ্ছে?”

“হ্যাঁ! আমি-ই আপনার ছবিতে আঁকিবুঁকি করেছি। আমি-ই আপনার বালিশে লাল পিঁপড়া রেখেছি। কি করবেন আপনি? আমি কাউকে ভয় পাইনা। দেখি আপনি কি করতে পারেন।”

তাহা একরোখাভাবে বলে। আহির শব্দ করে হেসে দেয়।

“দেখলেতো স্বীকার করলে। আজ কেন যেন নিজেকে খুব চালাক মনে হচ্ছে। আমার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দিলে তুমি। আমি জানতাম, এসব বললে তুমি স্বীকার করবেই। দেখলে তা-ই হলো।”

তাহা শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় আহিরের দিকে। এই আহিরকে ওর অচেনা লাগছে। ছেলেটা তার সাথে এত ভালো করে কথা বলছে কেন? তাহা যতদূর জানে, আহির তাকে পছন্দ করে না। আহিরের ব্যবহারও তা-ই বলে সবসময়। আজ এত ভালো করে কথা বলার কারণটা ঠিক কি?

“আপনি কি করবেন ভাবছেন? আমার মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করবেন?”

আহির হাসি থামিয়ে কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকে।

“এটার জন্য? আগেরবার তোমার মা’কে বলা হয়েছিল কারণ তখন তুমি অন্যায় করেছিলে। আর এখন যেটা করেছিলে এটা হলো বাচ্চামো। অবশ্য আগের বারও বাচ্চামোই করেছিলে। বয়স হলেও বাচ্চামো যায়নি তোমার।”

তাহা গাল ফুলিয়ে তাকায় আহিরের দিকে। আবারও আহিরের দৃষ্টি সেখানে আটকে যায়। মেয়েটাকে গাল ফুলালেও কি চমৎকার লাগে। আগে কখনো খেয়াল করেনি এসব। নতুন করে সব খেয়াল করছে আহির। আহিরের মনে হচ্ছে এই মেয়েকে দেখেই হয়তো সে সারাজীবন পার করে দিতে পারবে। আহির কিয়ৎক্ষণ বসে নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করার প্রয়াস চালায়।

“আচ্ছা চলো যাওয়া যাক। এখানে এভাবে বসে থাকার কোনো মানে হয়না।”

“আপনি যেতে চাইলে যেতে পারেন। আমি পরে যাবো।”

আহির কিছু বলে না বিপরীতে। পাশ থেকে ইটের টুকরো হাতে তুলে নিয়ে দীঘির পানির মধ্যে ছুঁড়ে মারে। তাহা নিঃশব্দে বসে আছে। আহিরের ছুঁড়ে মারা ইটের টুকরোর দিকে তাকিয়ে আছে।

“জানো তাহা আমি সর্বদা মেয়েদেরকে সম্মান করি। মেয়েরা হবে বিনয়ী, মেয়েদের পোষাক-আষাকে শালীনতা থাকবে। তবে তুমি আমার ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই আমি কখনোই তোমায় পছন্দ করতাম না। তবে এখন বুঝতে পেরেছি তুমি এমন হওনি। পরিস্থিতি তোমাকে এ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তবে একটা কথা জানো কি, পরিস্থিতি যেমনই হোক তাকে মোকাবেলা করা শিখতে হয়। তোমার বাবার কৃতকর্মের জন্য তুমি নিজের জীবনটা নষ্ট করতে পারো না। আশা করছি তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো?”

“জীবন নষ্ট করছি মানে? আমার জীবনতো বিন্দাস চলছে।”

তাহা হাসতে হাসতে বলে। তবে সে হাসিতে কোনো প্রাণ ছিল না।

“বিন্দাস? তোমার জীবন কেমন চলছে সেটা তুমি আমার চেয়ে ভালো জানো। আচ্ছা একটা কথা বলি?”

তাহা সায় জানালে আহির উঠে দাঁড়ায়। তাহা’কে ইশারায় উঠতে বলে। তাহা মুচকি হেসে দাঁড়ায়।

“তোমার এই বেপরোয়া জীবন থেকে যদি আমি তোমাকে বের করতে সাহায্য করি? তুমি কি অনুমতি দেবে আমায়?”

“আচ্ছা এসব আপনার চাল নয়তো? আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছেন হয়তো।”

তাহা’র কথার বিপরীতে আহির অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাহা’র দিকে তাকায়। হঠাৎ করে আওয়াজ করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে,

“আমাকে তুমি নিজের মত ছোটবাচ্চা ভাবো নাকি? এভাবে প্রতিশোধ? তবে কাল পর্যন্ত কিন্তু তোমার ওপর আমি রেগে ছিলাম। কেন যেন সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু এখন তেমনটা নয়। আর আমি কিন্তু সিরিয়াসলিই বলছি। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই।”

“আমার জীবন নিয়ে আমি বেশ আছি। আপনি এসবের মধ্যে ঢুকতে গিয়ে নিজের সময় অপচয় করবেন না।”

“তাহানিয়া। আমি নিজের সময় অপচয় করছি না। আমি শুধু তোমায় সাহায্য করতে চাই।”

তাহা আহিরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। একরোখাভাবে বলে,

“আচ্ছা আপনি কি সাহায্য করবেন শুনি?”

“তুমি আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত চলতে শেখো। আমি তোমার পথচলার সাথী হবো। ”

আহিরের অন্যকোনো কথা তাহা’র কানে ঢুকেছে কিনা তা তাহা জানে না। তবে শেষে বলা “আমি তোমার পথচলার সাথী হবো।” এই কথাটুকু তাহা’র ছোটমস্তিষ্কে ভালোভাবে ঢুকে গেছে।

“আচ্ছা। তুমি কি তোমার মায়ের কষ্টটা দেখতে পাচ্ছো না? উনি ঠিক কতটা কষ্টে আছেন? ওনার কথা ভেবেও তুমি ঠিক হয়ে যাও।”

“আপনি আমার কথা এত ভাবছেন যে?”

আহিরকে ভ্রুঁ নাঁচিয়ে প্রশ্ন করে তাহা। আহির মুচক হেসে বলে,

“জানিনা। তবে আমার কেন যেন তোমাকে একটু শান্ত, সুশীল আর পাঁচটা মেয়ের মত দেখতে ইচ্ছে করে।”

“আচ্ছা এসব করে আপনার লাভ?”

“লাভ ক্ষতির হিসাব নেই এখানে। আমি শুধু দেখতে চাই, আমাদের এলাকার মানুষ তোমাকে যে চোখে দেখে সে চোখে যেন আর না দেখে। এটুকুই।”

তাহা বিপরীতে কিছু বলেনা। চুপ করে থাকে।

“আচ্ছা তুমি এবার বাড়ি যাও। আমিও যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ!”

আহির তাহা’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইকে করে চলে যায়। তাহা একদৃষ্টিতে আহিরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন যেন আহিরকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে। আহির ছেলেটা খুব ভালো। এটা এই এলাকার মোটামুটি সব মানুষের মুখের কথা। আচ্ছা এই ছেলেটা তাহা’কে সাহায্য করতে চাইছে কেন? তাহা’কি ওকে বিশ্বাস করবে? তাহা’র খুব করে ইচ্ছা করছে ওকে বিশ্বাস করতে। কিন্তু না এত সহজে কাউকে তাহা বিশ্বাস করবে না। কাউকেই না।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ