আজকে শহর তোমার আমার পর্ব-০২

0
806

#গল্পঃআজকে_শহর_তোমার_আমার
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০২

ড্রইংরুমে সোফায় বসে আছে কয়েকজন লোক।তাদের মাঝখানে রুপ্সিতাকে শাড়ী পরিয়ে বসিয়ে রেখেছে।রুপ্সিতার দৃষ্টি নিচের দিকে।একবারো চোখ তুলে কাউকে দেখার প্রয়োজনবোধ করেনি।

ছেলের বাবা বললেন,আলহামদুলিল্লাহ মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে।এখন আপনাদের পছন্দ হলেই বিয়ের কথা পাকা করা যাবে।

রুপ্সিতার বাবা গলা ঝেড়ে বললেন,আমাদের আর দেখার কিছুই নেই।ছেলে আমাদের পছন্দ হয়েছে আপনারা চাইলে আজই বিয়েটা সেরে ফেলতে পারেন।

পাত্রের বাবা উনার সাথে আসা সবার সাথে কিছু একটা ইশারা করে রুপ্সিতার বাবাকে জানালেন উনাদের যেহেতু সমস্যা নেই তাই আজই বিয়ের কাজ সেরে নিতে।

রুপ্সিতার বাবা আর ছেলের বাবা কোলাকুলি করে নিলেন।কাজিকে খবর দিয়ে।সবাই মিষ্টি মুখ করতে ব্যস্ত।
রুপ্সিতার মা রান্নাঘরে কাজ সামলাচ্ছেন।রিতা উনাকে সঙ্গ দিচ্ছে।ড্রইংরুমে সবার সাথে শোভন ও আছে।রুপ্সিতা নিচের দিকে দৃষ্টি নত রাখায় শোভনের ভাব ভঙ্গি বুঝতে পারছেনা।

অবশেষে কাজি এসে বিয়ের কার্যক্রম শুরু করলো।ছেলেকে কবুল বলতে বললে
ক্ষীণস্বরে তিনবার কবুল বলে থামে।এবার রুপ্সিতার পালা।ও সিক্ত চোখে একবার পুরো বাড়িটা পরোখ করে নিলো।বাবার মুখের দিকে তাকাতেই উনার তীক্ষ্ণ নজর চোখে পড়লো রুপ্সিতার।উনার চোখেও হালকা পানির রেশ।রুপ্সিতা তাকিয়ে আছে দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছেন।
আর কোনোদিকে না তাকিয়ে রুপ্সিতা কবুল বলে অন্যের অধীন হয়ে গেলো।

বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এক অচেনা রাজ্যে পাড়ি জমালো।
গাড়ি এসে থামলো একটা দোতলা বাড়ির সামনে।রুপ্সিতার শশুর গাড়ি থেকে নেমে ওকে নিয়ে ঘরের ভেতরে গেলো।বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দুজন নারীকে চোখে পড়লো।হাসি মুখে এগিয়ে আসছে।একজন মাঝবয়সী,অন্যজন ২৭/২৮ বয়সের হবে।

রুপ্সিতাকে হাসিমুখে এগিয়ে এসে অল্পবয়সী নারী সোফায় বসালো।
আমি হলাম আলিফের বড় ভাবি,আর উনি আলিফের মা মানে আমাদের শাশুড়ী।
উনার কথা শুনে রুপ্সিতা বুঝলো ওর যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার নাম আলিফ।
রুপ্সিতা ওর শাশুড়ীকে পা ধরে সালাম করতে গেলে উনি বাধা দিয়ে বলেন,মুখে বললেই হবে মা।পায়ে হাত দিতে হবেনা।

ইরিন ছোটবউ মাকে ঘরে নিয়ে যাও।ফ্রেশ হয়ে পড়ার জন্য আমি শাড়ি দিচ্ছি।

আলিফের ভাবি রুপ্সিতাকে একটা রুমে নিয়ে বলে,আজ থেকে এটা তোমার রুম।ওহ তোমার নামটাই আমার জানা হলোনা।

রুপ্সিতা মুচকি হেসে জবাব দেয় আমার নাম রুপ্সিতা।সবাই রুপা বলে ডাকে।
ইরিন হেসে দিয়ে বলে তাহলে আমিও রুপা বলেই ডাকবো।রুপ্সিতাকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিয়ে ইরিন বলল আমি মায়ের কাছ থেকে শাড়ী নিয়ে আসি।
রুপ্সিতা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে খাটের উপর একটা শাড়ী দেখতে পায় সাথে ব্লাউজ,পেটিকোট দুটোই আছে।রুপ্সিতা গায়ের শাড়ীটা খুলে এই শাড়ীটা পড়ে নেয়।ব্লাউজ একটু ঢিলা।আঁচল ঘাড়ের উপর দিয়ে টেনে মাথায় ঘোমটা দেওয়ার কারনে ব্লাউজের ঢিলা চোখে পড়ছেনা।
আলিফের ভাবি এসে রুপ্সিতাকে খাবার খাইয়ে চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিপ দিয়ে দিলেন।

রুপ্সিতা একা একা বসে আছে।বুকটা দুরুদুরু করছে।না জানি মানুষটা কেমন হয়।আচ্ছা আগে কি একে অপরকে জানবে?নাকি ঝাপিয়ে পড়বে নিজের চাহিদা মেটাতে।এসব ভাবতে ভাবতেই দরজায় খট করে আওয়াজ হয়।আলিফ রুমে ঢুকেছে।রুপ্সিতা খাট থেকে নেমে আলিফের পায়ে সালাম করে।
আলিফ কিছু না বলে কাবার্ড থেকে বাসায় পরার টি-শার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
রুপ্সিতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
আলিফ ফ্রেশ হয়ে রুপ্সিতাকে আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,এরকম হা করে দাঁড়িয়ে না থেকে একজায়গায় গিয়ে বসো।নয়তো মুখে মশা ঢুকবে।

রুপ্সিতা থতমত খেয়ে গেল।মুখটা মিলিয়ে খাটে বসে।

তোমার নাম কি?

রুপ্সিতা বলে,জ্বি?

তোমার নাম কি?কানে শুনো না?

রুপ্সিতার রাগ লাগলো।কিন্তু কিছু বললোনা।মুখ ফুলিয়ে রেখে জবাব দিলো আমার নাম রুপ্সিতা।

আলিফ ভ্রু কুচকে বলল,রুপ্সিতা?
রুপ্সিতা উপর নিচ মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।
আলিফ ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,ওকে আমি রুপ্সি বলে ডাকবো।
রুপ্সিতা ও মাথা নাড়ে।
আলিফ হাতের তোয়ালে বারান্দায় মেলে দিতে যাওয়ার সময় রুপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল,এখন শুয়ে পড়ো।তোমার আর আমার বিয়েটা তাড়াহুড়ো করেই হয়েছে।একজন আরেক জনকে ঠিকভাবে চিনিও না।
আমি কিছুদিন নিজেকে সময় দিয়ে চিনতে চাই তোমাকে।

রুপ্সিতার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।সে তো এটাই চেয়েছিলো।
আলিফ তোয়ালে মেলে দিয়ে রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে আবার বারান্দায় চলে গেল।

রুপ্সিতা মাথা না ঘামিয়ে গুটিশুটি মেরে খাটের এক কোনে শুয়ে পড়লো।বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো।কিভাবে তারা আমাকে বিশ্বাস না করে পর ছেলেকে বিশ্বাস করলো?আসলে আমারই উচিত ছিল চিৎকার করে সবাইকে ঢেকে আনা।তাহলে আমার জীবনটা এরকম হতো না।বাবা মা আমাকে অবিশ্বাস করতো না।
চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা নোনাজল বালিশে গড়িয়ে পড়তেই চোখ মুছে নিল রুপ্সিতা।এখনই যদি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পারে তাহলে কান্নার প্রকোপ আরো বেড়ে যাবে।আলিফ যখন কান্না করার কারণ জিজ্ঞেস করবে তখন কি বলবে?
কাঁথা গায়ে জড়িয়ে চুপটি করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ৬৬৯

বারান্দার রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে রুমের দিকে মুখ করে বসে আছে আলিফ।এখান থেকে খাট পুরোটা দেখা যায় না।হালকা একটু কাঁথা দেখা যাচ্ছে।মুঠোফোন বের করে স্ক্রিনে একটা ছবি বের করে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে

তুমি চেয়েছো আমি বিয়ে করে সংসার করি।দেখো বিয়েটা করে নিয়েছি।মেয়েটা এখন আমার খাটে ঘুমিয়ে আছে যেই খাটে তোমার ঘুমানোর কথা ছিলো।কিন্তু আমাদের ভাগ্য হয়তো তার বিপরীত।আল্লাহ চায়নি বলে তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেলে কিন্তু মন থেকে কি আদৌও তুমি যেতে পারবে?সময়ের ব্যবধানে মেয়েটার সাথে থাকতে থাকতে হয়তো তাকে মেনে নেবো,ভালোও বাসবো কিন্তু তোমাকে কি ভুলতে পারবো?প্রথম ভালোবাসা কি ভোলা যায়?
এভাবে বারান্দায় কিছুক্ষণ থেকে মুঠোফোন পকেটে পুরে রুমে আসে।

খাটের দিকে নজর দিয়ে দেখে
রুপ্সিতা খাটের এককোনে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে আছে।শাড়ি দিয়ে নিজেকে পেছিয়ে রেখেছে।পায়ের উপর দিয়ে কাঁথা দিয়ে সেটা হাত দিয়ে মুঠো করে ধরে রেখেছে যাতে শাড়ি উপরে উঠে গেলেও পায়ের দিকটা দেখা না যায়।
মেয়েটার বুদ্ধি দেখে আলিফ ক্ষীণ হাসলো।
টেবিলের উপর ফোন রেখে অন্যপাশে নিজেও শুয়ে পড়লো।

সকালে রুপ্সিতার তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায়।ঘড়িতে সময় দেখে এখনো নামাযের সময় আছে।ফ্রেশ হয়ে এসে নামায পড়ে নেয়।এখন ঘুম আসবে না।তাই বারান্দায় পা বাড়ালো।চারদিকে আলো ফুটেছে তবে রোদের আলো নয় ভোরের স্নিগ্ধ আলো।বারান্দায় এসেই রুপ্সিতার মনটা ভালো হয়ে গেলো।রাস্তা একেবারে ফাঁকা।এই সময়ে ঢাকা শহরে মানুষ জন দেখা যায় না।আরো পরে সবার আনাগোনা বাড়বে।এই ব্যস্ত শহরে সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
বারান্দায় কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে রুমে আসে রুপ্সিতা।
আলিফ এখনো ঘুমিয়ে আছে।রুপ্সিতা দরজা খুলে নিচে নেমে এলো।রান্নাঘরে উঁকি দিতেই দেখলো ইরিন ভাবি নাস্তা বানাচ্ছেন।রুপ্সিতা পাশে গিয়ে দাঁড়িতেই ইরিন বলল,এত সকালে উঠলে যে?ঘুম হলো?

রুপ্সিতা মুচকি হেসে বলল,হুম।
ইরিন রুপ্সিতার গায়ের শাড়ির দিকে তাকিয়ে জিবে কামড় দিয়ে বলল,দেখলে আমার একটু ও মনে নেই তোমাকে শাড়ি দিয়ে আসতে।তুমিতো মনে হয় এখনো গোসল করোনি।দাঁড়াও আমি তোমাকে শাড়ি দিচ্ছি।

রুপ্সিতা তাড়াহুড়ো করে বলল,না না ভাবি!আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছু হয়নি।আমার এখন শাড়ী লাগবেনা বলেই মাথা নিচু করে নিলো।
ইরিন রুপ্সিতাকে কোনোরকম লজ্জা না দিয়ে বলল,তোমার এখন এখানে কাজ নেই তুমি ঘরে যাও।
রুপ্সিতা বলল,আমিও তোমার সাথে কাজে হাত লাগাই।

সবাই সকালের নাস্তা করে নিয়েছে।খাবার টেবিলে আলিফের বড় ভাইয়ার সাথেও পরিচয় হয়েছে।উনাদের একটা চার বছরের ছেলে আছে।কাল রুপ্সিতা বাচ্চাটাকে দেখেনি।

আলিফ অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।বিয়েটা হুট করে হয়ে যাওয়ায় অফিস থেকে ছুটি নেয়নি।এটাতো আর নিজের অফিস না যে মন চাইলো কয়েকদিন বাড়িতে কাটালাম।
আলিফ রেডি হতে হতেই রুপ্সিতাকে জিজ্ঞেস করলো

তুমি কি আরো পড়তে চাও?
রুপ্সিতা খুশি হয়ে গেলো আলিফের কথায়।খুশিতে গদগদ হয়ে মাথা নাড়াতেই আলিফ একটা ধমক দিলো।
তুমি কি কথা বলতে পারো না?সব কথায় মাথা নাড়াতে হবে?মুখে বলতে পারোনা।

রুপ্সিতা মুখটা পাংশু করে রাখলো।আলিফ আবারো বলল,কোন ক্লাসে পড়ো?

রুপ্সিতা এবার চট করে উত্তর দিলো অনার্স থার্ড ইয়ার।
আলিফ চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলল,ঠিক আছে।পড়তে পারবে কিন্তু ইম্পরট্যান্ট ক্লাস ছাড়া ভার্সিটিতে যেতে পারবেনা।বাড়িতে বসেই প্রচুর পড়তে হবে তোমাকে।এই শর্তে রাজি থাকলে তুমি পড়তে পারবে।অথবা পড়ালেখার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দাও।মা কখনো বাড়ির বউকে এভাবে বাইরে যেতে দিবেনা।

রুপ্সিতা মুখ খুলে বলল,পড়তে পারবো এটাই অনেক।
আলিফের ফোন বেজে ওঠায় রুপ্সিতাকে বলল,আমার ফোনটা এগিয়ে দাও তো?

রুপ্সিতা ধপাধপ পা ফেলে ফোন হাতে নিয়েছে।আলিফের দৃষ্টি রুপ্সিতার পায়ের দিকে ধপধপ করে হাটায় শাড়ি টাকনুর অনেক উপরে উঠে গেছে।রুপ্সিতা আলিফের দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের পায়ের দিকে তাকাতেই চমকে উঠে।শাড়ী হাত দিয়ে টেনে নিচে নামিয়ে দেয়।আলিফ নিজের দৃষ্টি সংযত করে ফোন কানে দেয়।
রুপ্সিতা শাড়ী নিচের দিকে টানছে আর আলিফের দিকে তাকাতে তাকাতে হাটছে।শাড়ী নিচের দিকে এতটাই নেমে গেছে যে এবার রুপ্সিতা হোচট খেয়ে ফ্লোরে ধপাস করে পড়ে গেলো।

রুপ্সিতাকে পড়তে দেখে আলিফ ফোন কেটে দিয়ে হু হা করে হাসতে লাগলো।

আর রুপ্সিতা কোমরে ব্যাথা পেয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে।
#চলবে……..।

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)