আজকে শহর তোমার আমার পর্ব-০৩

0
711

#গল্পঃআজকে_শহর_তোমার_আমার
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৩

রুপ্সিতা উঠছেনা দেখে আলিফ হাসি থামিয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় উঠার জন্য।পড়ে যাওয়ার কারণে রুপ্সিতার মাথার ঘোমটা পড়ে যায় ঢিলা ব্লাউজটাও কাঁধের দিকে হালকা নেমে যায়।কনুইয়ের উপরের দিকে আর কাঁধে কয়েকটা দাগ দেখে আলিফের ভ্রু কুচকে এলো।ওভাবেই রুপ্সিতাকে জিজ্ঞেস করলো তোমার গায়ে এগুলো কিসের দাগ?

রুপ্সিতা তড়িঘড়ি করে আঁচল দিয়ে শরীর মুড়িয়ে নিয়ে বলল,সেটা আপনাকে জানতে হবেনা।কালরাতে আপনি বলেছেন আমাদের চেনা জানার প্রয়োজন আছে আর আজ আপনি আমার ঘাড়ের দিকে নজর দিচ্ছেন?

আলিফের মেজাজ চটে গেল।
লিসেন?আমি যাস্ট কৌতুহলের কারণে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি।আমার এত শখ নেই তোমার দিকে তাকানোর।রুপ্সিতাকে ওভাবে ফেলে রেখেই মুঠোফোন আর ওয়ালেট নিয়ে বেরিয়ে গেল আলিফ।

রুপ্সিতা আস্তে আস্তে উঠে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো।কোমরে ব্যথা পেয়েছে ভালো করে।এখন একটু জিরিয়ে নিয়ে নিচে যাবে।এখন কোমরের ব্যাথা নিয়ে নিচে নামতে পারবেনা।তারচেয়ে ব্যাথাটা একটু কমুক।

আলিফ অফিসে এসে মুখ গম্ভীর করে কাজ করছে।সকাল সকাল এভাবে মেজাজ খারাপ হবে ভাবেনি।
হঠাৎ ফোনকল পেয়ে হাতে নিয়ে রিসিভ করে।

হ্যালো!

কেমন আছো?

আলিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,আল্লাহ যেরকম চাইছেন ঠিক সেরকম।তুমি কেমন আছো?

অপরপাশের জন হালকা হেসে বলল,ভালোই।

এরপর দুজনেই চুপ করে থাকে।হয়তো দুজনেই কিছু বলতে চায় দুজনকে।তাই সময় নিচ্ছে।কিছুক্ষণ নিরবতার পর আলিফ আগে বলে উঠলো,
মায়া আমি বিয়ে করে নিয়েছি গতকাল।

আলিফের কথা শুনে মায়ার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে।বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলল,আলিফ বিয়ে করে নিয়েছে।

মায়াকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আলিফ বলল,তুমি খুশি হওনি?তুমিইতো চেয়েছিলে আমি যাতে বিয়ে করে নিই।

মায়া ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,ভালোইতো।বিয়ে করেছো,মেয়েটাকে কষ্ট দিও না।এখন তোমার উপর সম্পূর্ণ অধিকার তার।নিজেকে আর আমায় ভেবে কষ্ট দিও না।

আলিফ তপ্তশ্বাস ফেলে বলল,চেষ্টা করছি সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার।

মায়া আবারো বলল,আমি কেন কল দিয়েছি জিজ্ঞেস করবেনা?
আলিফ ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলো,কেন?

মায়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,বিয়ের এক বছর পূরণ হয়ে গেছে।এখনো বাচ্চকাচ্চার মুখ দেখছিনা।ডক্টরের কাছে গিয়েছি কিছু টেষ্ট দিয়েছে।রিপোর্টে এসেছে আমার মা না হওয়ার কারণ জরায়ুমুখে পাথর।এগুলো ঔষধে না গেলে অপারেশন লাগতে পারে।সুস্থ না হলে আমি কখনো মাহ হতে পারবোনা বলেই ঢুকরে কেঁদে ওঠে মায়া।

মায়ার কথা শুনে আলিফ থম মেরে রইলো।ওর এখন কি বলে মায়াকে শান্তনা দেওয়া উচিত ও বুঝতে পারছেনা।

মায়া আবারো বলল,আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।যদি আমার বিয়েটা তোমার সাথে হতো তাহলে আমার জন্য তোমাকেও ভুগতে হতো।
আলিফ এবার মায়াকে শান্তনা দিয়ে বলল,এই সমস্যাটা এখন প্রায় নারীর হয়।ঠিক মতো চিকিৎসা নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে তুমি কান্নাকাটি করোনা।

মায়া নাক টেনে বলল,আরাফাত ও আমাকে এই কথা বলেই শান্তনা দেয়।
আলিফ প্রশ্ন করলো,আরাফাত আমাদের অতীত সম্পর্কে জানে?

মায়া নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,নাহ!আমি বলিনি।আমি চাইনা আমাদের অতীতের সম্পর্কের কথা শুনে সে কষ্ট পাক।এখানেতো তার দোষ নেই।আর না আছে তোমার আর আমার।আসলে দোষ আমাদের ভাগ্যের।

আমার শাশুড়ী ডাকছে বলে মায়া লাইন কেটে দিলো।

আলিফ ফোন রেখে হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে দিলো।এখন কাজেও মন বসবেনা।তবুও কাজ করতে হবে। অন্যের অধীনে কাজ করলে নিজ ইচ্ছায় কিছু করা যায় না।

সব প্রাক্তন প্রতারক হয়না।কিছু কিছু ভালোবাসা হেরে যায় পরিস্থিতির কাছে।আলিফ আর মায়া একে অপরকে ভালোবাসতো।মায়ার বাবা ওদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি।উনি আগে থেকেই আরাফাতের সাথে মায়ার বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন।মায়া জানতোনা,জানলে আলিফের সাথে সম্পর্কে জড়াতো না।ওর বাবা বলে দিয়েছে আরাফাতকে বিয়ে না করলে উনার মরা মুখ দেখবে।তখন আলিফের হাতেও কিছু ছিলোনা।বাধ্য হয়ে আলিফ বলে দিলো মায়াকে বিয়ে করে নিতে।
এখন বর্তমানে মায়া অসুখী নয়।আরাফাত ছেলেটাও অনেক ভালো।শুধু শুধু নিজের জন্য অন্যকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।তাই মায়াও সব ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে আরাফাতকে মেনে নিলো।
মাঝে মাঝেই আলিফের সাথে ওর যোগাযোগ হয়।একমাস,দুমাস এরকম সময় পরপর কথা হয়।

রুপ্সিতা ঘন্টাখানেক পর নিচে নেমে এলো।ওর শাশুড়ী আর ইরিন রান্নার জোগার করছে।রুপ্সিতা রান্নাঘরে উনাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।রুপ্সিতার শাশুড়ী ওকে দেখে বলল,নতুন বউ রান্নাঘরে কি করছো?

ইরিন বলল,সকালে ও আমি না করা সত্বেও আমার সাথে নাস্তা বানিয়েছে মা।

রুপ্সিতার শাশুড়ী মুখে এ কথা বললেও ইরিনের কথা শুনে খুশি হলেন।মুখে হাসি রেখে রুপ্সিতাকে জিজ্ঞেস করলো,রান্না জানো তুমি?

রুপ্সিতা মাথা নিচু করে বলল,তেমন একটা পারিনা।বাসায় সবসময় মা রান্না করতো।আমরা দুবোন মাঝে মাঝে রান্নাঘরে গিয়ে যা পারতাম রান্না করতাম।
কিন্তু আপনি শিখিয়ে দিলে ইনশাআল্লাহ পারবো।
রুপ্সিতার কথায় ওর শাশুড়ী মুখে হাসি বজায় রেখেই বলল,অবশ্যই শেখাবো।প্রথম প্রথম ইরিন ও কিছু পারতো না।এখন আমার দেখতে দেখতে সব কিছু শিখে নিয়েছে।
দুপুরে গোসল করে কালকের শাড়ীটা পড়ে নিও।আমি আলিফকে ফোন করে বলে দেবো আসার সময় তোমার জন্য জামাকাপড় নিয়ে আসতে।
রুপ্সিতা মাথা দোলালো।

দুপুরের পর মায়ের মোবাইল থেকে কল আসতেই আলিফ রিসিভ করে সালাম দেয়।
ওর মা সালামের উত্তর দিয়ে আলিফকে বলে দিলো আসার সময় রুপ্সিতার জন্য শাড়ী নিয়ে আসতে সাথে পেটিকোট আর ব্লাউজ ও যেন নিয়ে আসে।
রুপ্সিতার কথা সারাদিনে একবারো মনে পড়েনি আলিফের।এখন মা ফোন করে বলায় মনে পড়লো ও বিবাহিত।তারপর সকালের কথা মনে পড়তেই মেয়েটার প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ জন্মে।মেয়েটা ওকে কি ভাবে?ক্যারেক্টারলেস?

রুপ্সিতা সারাদিন ইরিনের ছেলেকে নিয়েই কাটিয়েছে।বাচ্চাটা কি কিউট। কত্ত সুন্দর করে কথা বলে।ওর নাম সানি।বাচ্চা মানুষ খেলার সাথী হিসেবে কাউকে পেলে তার সাথে সহজে মিশে যায়।

রুপ্সিতার বাবা কাজ থেকে ফিরে নিজের ঘরে থম মেরে বসে আছেন।রুপ্সিতার মা উনার ঘাড়ে হাত দিয়ে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই উনি বলেন,
আমারা কি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি?একটাবার কি মেয়েটার কথা শোনা উচিত ছিলোনা?

রুপ্সিতার মা থমকে গেলেন।ঠিকইতো একটাবার নিজের মেয়ের কথাটা শোনার প্রয়োজনবোধ করলোনা?এক মেয়ের কান্নায় জর্জরিত চেহারা দেখে আরেক মেয়ের সাথে অন্যায় করে ফেলেন নিতো?হয়তো শোভন মিথ্যা বলছিলো?

রুপ্সিতার মা বললেন,তখন আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি এতটাই লোপ পেয়েছে যে নিজের মেয়েটার কথা একটাবার শুনলাম না।

রুপ্সিতার বাবা বলে,যদি রুপা নির্দোষ হয়ে থাকে তাহলে কিভাবে নিজের মেয়েকে মুখ দেখাবো?ও কি আমাদের ক্ষমা করতে পারবে?

রুপ্সিতার মা ওর বাবাকে বলল,আপনি শোভনের পেছনে লোক লাগিয়ে খোজ নেন ভালো করে।আমি যতদূর জানি শোভন ভালো ছেলে।আর আমাদের মেয়েও এসব করবেনা।

রুপ্সিতার বাবা বলল,এখন আর মেয়েকে বিশ্বাস করে কি হবে?সেদিন অন্তত একজনের মাথা ঠান্ডা রেখে ওর কথা শোনা উচিত ছিলো।আর এখন কিছু জিজ্ঞেস করলেও রুপা কিছুই বলবেনা।

আলিফ অফিস শেষ করে বাসায় আসার পথে শপিং মলে ঢুকে রুপ্সিতার জন্য দুটো শাড়ি কিনে নেয়।সাথে পেটিকোট আর ব্লাউজ কিনতে গিয়ে সমস্যা হলো।ও তো রুপ্সিতার মাপ জানেনা।তাই মায়ের মোবাইলে ফোন দিয়ে রুপ্সিতাকে দিতে বলল,
রুপ্সিতা ভাবছে একদিন যেতে না যেতেই ওর জন্য দরদ বেড়ে গেলো?এখন ফোনেও কথা বলতে চাইছে?

রুপ্সিতা গলা ঝেড়ে ভাব নিয়ে বলল,একদিনেই এত দরদ বেড়ে গেলো?কয়েক ঘন্টা যেতে না যেতেই কল দিলেন।

আলিফ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,তোমার সাথে প্রেমের প্রলাপ করার জন্য কল দিনাই।তোমার ব্লাউজের মাপ বলো।

আলিফের কথায় রুপ্সিতা লজ্জা পেয়ে গেল।কোনোরকম থতমত খেয়ে মাপটা বলেই লাইন কেটে দিলো।
#চলবে……।