আজকে শহর তোমার আমার পর্ব-১১

0
576

#গল্পঃআজকে_শহর_তোমার_আমার
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১১

দুপুরের খাবার খেয়ে উঠতে না উঠতেই রুপ্সিতা ওয়াশরুমে গিয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছে।ওর অবস্থা দেখে ইরিন পিছু পিছু এসে পেছন থেকে রুপ্সিতার কপাল চেপে ধরে।বমি শেষে ভালো করে কুলি করে চোখেমুখে পানি দিয়ে ক্ষান্ত হয় রুপ্সিতা।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ইরিন তীক্ষ্ণ চোখে রুপ্সিতাকে পরোখ করে চলেছে।যা রুপ্সিতার নজর এড়ায় নি।
রুপ্সিতা ভ্রু কুচকে বলল,কি?
ইরিন ভাবুক হয়ে বলল,বমি বমি ভাব,সেদিন আবার মাথা ঘুরানো।হুম হুম হুম!

রুপ্সিতা ইরিনের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে কপাল কুচকে বলল,ভাবি তুমিও না।
সেদিন রোদে কিছুক্ষণ থাকার কারণে মাথা ঘুরে উঠেছে।আর আজ একবার বমি হতে না হতেই তুমি বুঝাতে চাইছো আমি প্রেগন্যান্ট?
শোনো এরকম কিচ্ছু না।

ইরিন এক ভ্রু উঁচু করে বলল,তাহলে কিরকম কিছু?

রুপ্সিতা বলে,আজকে বমি হওয়ার কারন ওই মরিচের ভর্তাটা।মা বাসায় বানাতো শুকনো মরিচ,রসুন,পেঁয়াজ,লবন এই চারটি উপাদান দিয়ে।যদিও ঝাল তবুও আমার খেতে ভাল্লাগে।আজ মন চাইলো তাই বানালাম।ঝালটা একটু বেশিই হয়েছে কি-না তাই বমি হয়েছে।

ইরিন কপাল চাপড়ে বলে,আর আমি ভেবেছি কিনা আমাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসতে চলেছে।তবে যাই হোক খুব তাড়াতাড়ি যেন আমাদের পরিবারে একটা ফুটফুটে বাবু আসে।
ইরিনের কথায় রুপ্সিতা লজ্জা পেয়ে যায়।

রুপ্সিতাকে রেস্ট নিতে বলে ইরিন ডাইনিং এ চলে আসে।বউ শাশুড়ী তিনজনে মিলে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলো।বাড়ির পুরুষরা একজনও বাড়িতে নেই।আলিফ আর আরিফ অফিসে।ওদের বাবাও আজ কোনো একটা কাজে বাড়িতে নেই।
ডাইনিং এ আসতেই আলিফের মা ইরিনকে বলে,রুপা হঠাৎ বমি করছে কেন?

ইরিন খাবারের প্লেট হাতে নিতে নিতে বলল,ওই অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার কারণে এরকম হয়েছে।
আলিফের মা বলল,আমি ভাবলাম ছোট ছেলের ঘরে নাতিপুতির মুখ দেখতে চলেছি।এরপর দুজনের একজনও কোন কথা বলেনি নিশ্চুপভাবে খাবার শেষ করে উঠেছে।

বিকালে সানিকে নিয়ে বাসার বাইরে গেলো রুপ্সিতা।বাসার সামনের খোলা জায়গায় সানির সাথে বল খেলছে।সানি একবার রুপ্সিতার দিকে বল ছুড়ে মারে আবার রুপ্সিতা সানির দিকে ছুড়ে মারে।
সানির সাথে খেলছে আর রুপ্সিতা ভাবছে এরকম একটা বাবু যদি ওর থাকতো তাহলে রুপ্সিতা রোজ তার বাবুর সাথে খেলা করতো।বিয়ের প্রায় দেড়মাস হতে চললো অথচ আলিফ আর ওর মধ্যে তেমন কিছুই হয়নি।রুপ্সিতা যতটুকু কাছে ঘেঁষেছে ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ।আলিফ কখনো নিজ থেকে রুপ্সিতার কাছে ঘেঁষেনি।আবার রুপ্সিতাকেও কখনো না করেনি।

রুপ্সিতা ভাবনায় পড়ে গেলো আচ্ছা উনার কি আমাকে পছন্দ হয়নি?বিয়ের দেড়মাসেও চেনাজানা হয়নি?একটা মানুষকে কাছ থেকে চিনতে হলে কতদিন সময় লাগে?আমিতো অনেক আগেই উনার মায়ায় নিজেকে আবদ্ধ করে নিয়েছি।ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে।আজ আলিফকে প্রশ্ন করবে আর কতদিন এভাবে থাকবে তারা।

রুপ্সিতা ভাবনায় ব্যস্ত।এদিকে সানি বল গড়িয়ে অনেকদূর চলে যাওয়ায় সেটা আনতে ব্যস্ত।সামনে তাকিয়ে সানিকে না দেখে রুপ্সিতা চিন্তিত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই একটু সামনের দিকে সানিকে দেখলো।তারপর ওকে নিয়ে বাসার ভেতরে চলো এসেছে।

বিকালে অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে আলিফ শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিলো।ঘুম থেকে উঠলো সন্ধ্যা সাতটায়।আজকে অফিস থেকে ফেরার পর একবারো রুপ্সিতাকে দেখেনি।মেয়েটাকে দেখার জন্য মনটা কেমন হাসফাস করছে।এতোদিনে রুপ্সিতার সাথে অনেকটা জড়িয়ে গেছে।বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো রুপ্সিতা একমনে আকাশ দেখে চলেছে।আলিফ পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।রুপ্সিতার কোনো ভাবাবেগ হলোনা।একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলো।আলিফ তীক্ষ্ণ চোখে রুপ্সিতাকে পর্যবেক্ষণ করে হালকা গলা ঝেড়ে বলল,মন খারাপ?

রুপ্সিতা আরো কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে আলিফের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো।অতঃপর দৃঢ় কন্ঠে আলিফকে জিজ্ঞেস করলো,আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়নি?আমি দেখতে খারাপ?

আলিফ অবাক হয়ে বলল,হঠাৎ এসব প্রশ্ন কেন করছো?
রুপ্সিতা জিব দিয়ে হালকা ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,হঠাৎ নয় এই প্রশ্ন আরো আগে থেকেই আমার মাথায় ঘুরছে।শুধু আপনাকে জিজ্ঞেস করার মতো সুযোগ পাইনি।

আলিফ বলল,তোমাকে আমার অপছন্দ নয় আর না তুমি দেখতে খারাপ।তাহলে এসব প্রশ্ন কেন উঠছে?
রুপ্সিতা পাল্টা প্রশ্ন করে বলে,তাহলে আমাদের মাঝে এই দূরত্বটা কিসের?বিয়ের দেড়মাস হয়ে যাওয়ার পরেও আমার মনে হচ্ছে আমরা ভাইবোনের মতো জীবনযাপন করছি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে নয়।

এবার আলিফ দমে গেলো।চোখ নামিয়ে নিয়ে সেটা ফ্লোরে নিবদ্ধ করলো।
রুপ্সিতা আবারো বলল,কি হলো আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন?

আলিফ এখনো কিছু বলছেনা।যতবারই রুপ্সিতাকে ছুতে চায় ততবার মায়ার কথা মনে পড়ে।কিন্তু মায়াতো এখন দিব্যি আছে।তাহলে মায়ার কথা ভেবে এই মেয়েটাকে কেন কষ্ট দিবে?
আলিফের নিরবতায় রুপ্সিতার চোখ পানিতে টইটম্বুর।ও বুঝে গেছে আলিফের মনে ও কখনো নিজের জায়গা করতে পারবেনা।

আলিফের ভাবনার মাঝে রুপ্সিতা নিজের কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলল,আপনাকে আর উত্তর দিতে হবেনা।আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি।আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে চলে যাবো আপনার জীবন থেকে।পেছন ঘুরে চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই হাতে টান পড়ে রুপ্সিতার।রুপ্সিতা থমকে যায়।
আলিফ রুপ্সিতার হাত পেছন থেকে টেনে রুপ্সিতাকে নিজের সামনে নিয়ে কপালে নিজের ঠোঁটের উষ্ণ ছোয়া দিয়ে বলে কোথাও যাবে না তুমি।সারাজীবন আমার সাথেই তোমাকে থাকতে হবে।
এরপর রুপ্সিতার হাত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করে।

রুপ্সিতা এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে।মুহূর্তেই কি হয়ে গেলো।আলিফ ওকে ভালোবেসে ছুয়ে দিয়েছে?নাকি রুপ্সিতার কথায় বাধ্য হয়ে ছুয়েছে।সে যাই হোক এটা আলিফের নিজ থেকে দেওয়া প্রথম স্পর্শ।এর আগেও হাত ধরেছে কিন্তু সেটাতে কোনো অনুভূতি জড়ানো ছিলো না।রুপ্সিতার হাতটা কপালে চলে যায় যেখানে আলিফ ঠোঁটের স্পর্শ দিয়েছিলো।ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখাটা ধীরে ধীরে প্রসারিত হতে থাকলো।লজ্জায় আর রুমে যাওয়ার সাহস পেলোনা।অথচ কিছুক্ষণ আগে এই মেয়েটাই আলিফকে এতগুলো কথা শুনালো কেন ওদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক না।

রাতে সবাই একসাথে খেতে বসেছে।রুপ্সিতা নিচের দিকে তাকিয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছে সামনে তাকাচ্ছেনা।তাকালেই বুঝতে পারতো আলিফ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
আলিফ ভাবছে সামান্য কপালে চুমু দিয়েছি বলে লজ্জায় মাথা তুলছে না।অথচ এই মেয়েটা নাকি আমার কাছে আর দশটা কাপলের মধ্যে যেরকম সম্পর্ক সেরকমটা দাবি করে।

আলিফের আগে খাওয়া শেষ করে রুপ্সিতা রুমে গিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে।আলিফ আস্তে ধীরে খাওয়া শেষ করে রুমে এসে দেখে রুপ্সিতা আজকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েছে।এতদিন নিজেকে কাঁথা দিয়ে পেঁচিয়ে রাখলেও মুড়ি দিতোনা আজকে একেবারে সম্পূর্ণ নিজেকে ঢেকে ফেলেছে।আলিফ ওয়াশরুম থেকে এসে রুপ্সিতার পাশে শুয়ে পড়েছে।রুপ্সিতার দিকে তাকিয়ে শুয়ে রুপ্সিতাকে দেখে চলেছে যদিও রুপ্সিতার একটা চুলও দেখা যাচ্ছে না।
হুট করে আলিফ রুপ্সিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।আচমকা এরকম হওয়াতে রুপ্সিতা হকচকিয়ে যায়।কাঁথার ভেতর থেকেই মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দেয়।আলিফ ছাড়ছেনা কিন্তু রুপ্সিতার ছটফটানি বেড়েই চলেছে।এবার আলিফ এক ঝটকায় রুপ্সিতার গা থেকে কাঁথা সরিয়ে নিজেও সেই কাঁথার নিচে ঢুকে পড়ে পূনরায় রুপ্সিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুজে দেয়।
রুপ্সিতার শরীরে হিম ধরে গেছে।আলিফের খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে গলায় শুড়শুড়ি লাগছে।একটু পরেই মনে হয় কাঁপুনি ধরে যাবে শরীরে।

রুপ্সিতা মুখ দিয়ে আওয়াজ করছেনা কিন্তু নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আলিফকে সরানোর চেষ্টা করছে।আলিফ ফিসফিস করে রুপ্সিতার কানের কাছে গিয়ে বলল,বেশি ছটফট করোনা।আমি চাইনা আজকে এর চেয়ে বেশি কিছু হয়ে যাক।

আলিফের কথা শুনে রুপ্সিতার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে শ্বাস উঠানামা করছে।
আলিফ আবারো ফিসফিস করে বলল,নিজেকে স্বাভাবিক করো তা নাহলে এখানে বেশি কিছু হয়ে যাবে।
রুপ্সিতা একেবারে শান্ত হয়ে গেছে।চোখমুখ খিঁচে মনে মনে বলছে

ব্যাটা বজ্জাত!এতোদিন প্রেমের প খুজে পাইনি আজ সব প্রেম একসাথে উতলাইয়া পড়তেছে।প্রেমের চাপে একদিনেই আমাকে মেরে ফেলবে।

রাত সাড়ে বারোটা কি একটা রিতার জানা নেই।হয়তো ঘড়ি দেখলে বলতে পারবে।ঘুম ভেঙে বরাবরের মতো আজো শোভনকে পাশে পেলোনা।খাটে হেলান দিয়ে বসে রইলো শোভনের জন্য।
অনেক্ষণ অপেক্ষার পর শোভন চুপিচুপি রুমে ঢুকলো।লাইট অন করতেই চমকে উঠলো।রিতা শোভনের দিকে তাকিয়ে আছে।
শোভন আমতা আমতা করে বলল,তুমি ঘুমাও নি?

রিতা লম্বা শ্বাস টেনে শান্ত স্বরে বলল,ঘুমিয়েছি।কিন্তু জেগে দেখি তুমি নেই।কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
শোভন এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করে বলল,কাজ ছিলো তাই ফিরতে দেরি হয়েছে।
রিতা আবারো শান্ত স্বরে বলল,কোন অফিসে রাত একটা পর্যন্ত কাজ থাকে?সেটা আবার একদিন নয় প্রতিদিন।

শোভন চমকে উঠে বলল,কি বলতে চাইছো তুমি?প্রতিদিন মানে?আমিতো আজ…..

হাতের ইশারায় শোভনকে থামিয়ে দিয়ে রিতা বলল,আর বলতে হবেনা তোমায়।তুমি কখন বাসায় ফিরো না ফিরো সেটা আমি জানি।এখন থেকে নয় আরো অনেক আগে থেকেই তোমাকে আমি ফলো করেছি।কখনো রাত করে বাড়িতে ফিরো কখনো তাড়াতাড়ি ফিরে মাঝরাতে উঠে চলে যাও।

এবার আর শোভনের সহ্য হলোনা।রেগে গিয়ে বলল,আমি কখন কি করবো না করবো তার কৈফিয়ত তোমাকে দেবোনা।বউ বউয়ের মতো থাকো।রিতাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লো শোভন।রিতার চোখে পানি টলমল করছে।শোভন পাল্টে যাচ্ছে দিনদিন।বিয়ের প্রথম প্রথম ওদের সম্পর্ক একরকম ছিলো এখন অন্যরকম।দুদিন আগে রিতা নিজের প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছে।রেজাল্ট পজেটিভ।এই খুশির খবরটা শুনানোর জন্য শোভনকে কাছে পায়নি।তিনমাসের প্রেগন্যান্ট রিতা।পেটে হাত দিয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে অথচ শোভনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেনা।মানুষটাকে বড্ড ভালোবাসে কি-না।
#চলবে…….।

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।হ্যাপি রিডিং।)