আজকে শহর তোমার আমার পর্ব-১২

0
593

#গল্পঃআজকে_শহর_তোমার_আমার
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১২

রুপ্সিতা নখে মেহেদী দিচ্ছে বসে বসে।ওর শাশুড়ী পাশের বাসা থেকে মেহেদী পাতা এনেছে চুলে দেওয়ার জন্য।রুপ্সিতা সেখান থেকে কিছু মেহেদী পাতা আলাদা নখে দেওয়ার জন্য বেটে নিয়েছে।এখন সেগুলোই সূক্ষ ভাবে নখে লাগাচ্ছে যেন নখের কিনারায় না লেগে যায়।

আলিফ ওয়াশরুম থেকে এসে রুপ্সিতার গা ঘেঁষে বসে পড়েছে।হাত নড়ে মেহেদী সব এবড়োথেবড়ো হয়ে নখের চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে।রুপ্সিতা অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আলিফের দিকে।আলিফ ক্যাবলার মতো বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে থাকে।রুপ্সিতা রেগে গিয়ে সব মেহেদী আলিফের টি-শার্টে মুছে দেয়।আলিফ অসহায়ের মতো তাকিয়ে থেকে বলে এটা কি করলে?আমার এতসুন্দর টি-শার্ট টা নষ্ট করে দিলে?

রুপ্সিতা দাঁত কিড়মিড় করে বলে আপনি যে আমার নখের চারিপাশ নষ্ট করে দিয়েছেন?তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে আসে।নখ গুলো কেমন লাল লাল হয়ে আছে সুন্দর করে কালার আসেনি।নখগুলোর দিকে তাকিয়ে রুপ্সিতার এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে।মন চায় আলিফকে বারান্দা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিই।
এরমাঝে আলিফ ও টিশার্ট চেঞ্জ করে নিয়েছে।রুপ্সিতা মেহেদীর বাটি নিয়ে আবার মেহেদী লাগাতে বসে পড়ে।আলিফ এগিয়ে আসতে নিলেই বলে,খবরদার এদিকে আসবেন না।প্রথমবারে টিশার্টে লাগিয়েছি এবার কিন্তু মুখে লাগিয়ে দেবো।নিজেকে নিজেই চিনতে
পারবেন না।আলিফ আর এক পাও বাড়ায়নি খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ে।

নখের মেহেদী উঠিয়ে রুমে আসতেই রুপ্সিতার ফোন বেজে উঠে।হাতে নিয়ে দেখে তিন্নির নাম্বার থেকে কল এসেছে।রিসিভ করতেই তিন্নি জানালো কাল নাকি ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে।মিস দিলে সমস্যা কাল যেভাবেই হোক যেন ভার্সিটিতে যায়।
রুপ্সিতা কল কেটে ধীরে ধীরে আলিফের দিকে এগোয়।আলিফ চোখের উপর ডান হাত দিয়ে শুয়ে আছে।রুপ্সিতা আলিফের কাছে গিয়ে মিহি কন্ঠে ডাক দেয়,শুনছেন?আপনি কি ঘুমিয়ে গেছেন?
আলিফ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে বলল,নাহ!কি হয়েছে কিছু বলবে?

রুপ্সিতা মুখটা পানশে করে বলল,কালকে ভার্সিটিতে ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে।যেতেই হবে।

আলিফ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,হুম তো যাও!আমি তো তোমাকে পড়ালেখা করতে না করিনি।

রুপ্সিতা হাত মুচড়া মুচড়ি করি বলল,আসলে মাকে কিভাবে বলব আমি কাল ভার্সিটিতে যাবো?মা যেতে দিবে তো?যদি না করে দেয়?
আলিফ শান্তনা দিয়ে বলল,মাকে আমি ম্যানেজ করবো।তুমি এখন শুয়ে পড়ো।
রুপ্সিতা খুশি হয়ে ওপাশ ঘুরে খাটে উঠতে গিয়ে পায়ে বাড়ি খেয়ে ব্যথা পেয়ে “আহ”করে উঠে।
আলিফ শোয়া থেকে উঠে রুপ্সিতার পা টেনে বলে,সব সময় তোমার লাফালাফি না করলে হয়না।এখন ব্যথা কে পেলো আমি?নাকি তুমি?স্টুপিড কোথাকার।
রুপ্সিতা কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

সকালে নাস্তা করে আলিফ অফিসে চলে যায়।ওর মাকে রুপ্সিতার ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা বলে মেনেজ করে নেয়।যাওয়ার সময় বলে গেছে আজ ফিরতে সন্ধ্যা হতে পারে।নাস্তা শেষে রুপ্সিতা আর ইরিন সব কিছু ঘুছিয়ে নেয়।রেডি হয়ে ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে পড়ে রুপ্সিতা।ক্লাস শেষে তিন্নির সাথে অনেক্ষণ আড্ডা দেয়।বেষ্টু বলে কথা আবার অনেকদিন পর দেখা।আড্ডা না দিলে কি চলে?

তিন্নি বলে,তোর বিয়ের এতদিন হলো অথচ দুলাভাইকে এখনো দেখলামনা।
রুপ্সিতা বলল,তোকে না ছবি পাঠালাম?
তিন্নি বলল,আরে আমি ছবির কথা বলিনি বাস্তবে দেখার কথা বলেছি।
রুপ্সিতা বলল,তাহলে একদিন তোকে আর উনাকে মিট করিয়ে দেবো।যেদিন উনার অফিস থাকবেনা।
তিন্নির সাথে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রুপ্সিতা বাসায় চলে আসে।

গোসল করে পড়ার জন্য জামা নিতে গিয়ে দেখে কাবার্ড এলোমেলো হয়ে আছে।রুপ্সিতা ভাবলো গোসল পরে করা যাবে আগে কাবার্ড গুছিয়ে নিই।জামাকাপড় সব গুছিয়ে এক কোনায় রুপ্সিতা একটি চাবি পায়।হাতে নিয়ে ভাবে এটা কিসের চাবি হতে পারে?পরোক্ষনে নজর পড়ে ভেতরে একটা ছোট ড্রয়ার আছে।রুপ্সিতা চাবি দিয়ে ঘুরাতেই ড্রয়ার খুলে গেলো।সেখানে কিছু ছবি আর একটা ডায়েরি ছিলো।ছবিগুলো ডায়েরির ভিতরে না বাইরেই একপাশে ছিলো।রুপ্সিতা ছবিগুলো হাতে নিয়ে দেখলো সবগুলোই একটা মেয়ের ছবি।নিঃসন্দেহে বলা চলে মেয়েটা সুন্দরী।কিন্তু এই মেয়ের ছবি আলিফের ড্রয়ারে কি করছে ভাবতেই একটা অজানা আতঙ্ক এসে রুপ্সিতার মনে গ্রাস করে।সেই আতঙ্কের তোড়ে রুপ্সিতা বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ডায়েরিটা খুলে ফেলে।ডায়েরির মলাটে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা”আলিফ আহসান”।কারো পারমিশন ছাড়া তার পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়া ব্যাড ম্যানার্স জেনেও রুপ্সিতা ডায়েরিটা খুলে ফেলে।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ভেতরে পৃষ্ঠা গুলো ফাঁকা আর ঝকঝকে।যেন কেউ একটা নতুন ডায়েরি এখানে এনে রেখে গেছে।রুপ্সিতার ডায়েরিটা রেখে দিতে গিয়েও কি মনে করে ডায়েরিটা আবার ভালো করে দেখলো।
মাঝখানের দুই তিনটা পৃষ্ঠায় কিছু লিখা আছে।রুপ্সিতা দেরি না করে পড়া শুরু করে।

“প্রেয়সী”

আমি কখনো ডায়েরি লিখিনি।বলতে গেলে এসব লেখালেখি আমার ভালো লাগেনা।কিন্তু আজ লিখছি তোমার জন্য লিখছি আমার ভালোবাসার মানুষের জন্য লিখছি।তুমি কি জানো?তোমার নামের মতো তোমার চোখে মুখেও অঢ়েল মায়া উপছে পড়ে।আমি প্রথম তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করেছি।আর সেটি হলো মায়া।পরে জানতে পারলাম তোমার নামটাই মায়া।তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা বর্ণনা করার সাধ্য আমার নাই।

এতটুকু পড়েই রুপ্সিতা ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলে।চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে।ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে।চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।আলিফ অন্যকাউকে ভালোবাসে কথাটা ভাবতেই রুপ্সিতার গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।ও বিশ্বাস করতে পারছেনা আলিফের জীবনে অন্যকেউ আছে।এজন্যই বুঝি আলিফ ওর কাছে ঘেঁষতো না।কিন্তু এ কদিন যাবত এসব কি ছিলো?কেন রুপ্সিতাকে বারবার ছুয়ে দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়েছে।আলিফ ওকে বলে দিলেই পারতো সে অন্যকাউকে ভালোবাসে।তাহলেতো রুপ্সিতা নিজের অনুভূতি গুলোকে চাপা দিয়ে রাখতো।কখনো আলিফের কাছে নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতো না।আলিফ কেন করলো এমন?
রুপ্সিতা দুহাতে মুখ চেপে কাঁদছে যেন আওয়াজ বের না হয়।
দরজা আটকিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ট্যাপ ছেড়ে নিচে বসে পড়ে।চিৎকার করে কাঁদছে রুপ্সিতা।

কেন?কেন আমার সাথেই এরকম হয়?আমি যাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তারাই আমাকে ছেড়ে দূরে চলে যায়।আমি মানুষটাই খারাপ যে কারণে কেউ আমাকে ভালোবাসেনা।
উপর দিয়ে পানি পড়ছে আর রুপ্সিতা নিচে গুটিসুটি মেরে বসে কাঁদছে।চোখমুখ ফুলে গেছে।চোখ দুটো ফুলে লাল টকটকে রক্ত জবার রং ধারন করেছে।যেন ঠোকা দিলেই রক্ত পড়বে।ঘন্টাখানেক ওভাবে থাকার পর আস্তে আস্তে উঠে ভেজা কাপড়ে রুমে এসে একটা জামা নিয়ে পড়ে নেয়।
কেমন রোবটের মতো হয়ে গেছে রুপ্সিতা।চুপচাপ কাবার্ড গুছিয়ে ডায়েরি আর ছবিগুলো জায়গা মতো রেখে দিয়েছে।

বাইরে থেকে ওর শাশুড়ী ডাকছে খাবার খাওয়ার জন্য।রুপ্সিতা মাথা ব্যথা বলে কাটিয়ে দিয়েছে।বলেছে পরে খেয়ে নেবে।এই মুহুর্তে খাবার গলা দিয়ে নামবেনা।তাছাড়া এখন চোখমুখ দেখলে সবাই নানা রকম প্রশ্ন করবে।রুপ্সিতা এই মুহুর্তে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে চাচ্ছে না।বিছানার সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আবারো কান্না শুরু করে দেয় রুপ্সিতা।ওর একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছে আলিফ অন্যকাউকে ভালোবাসে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো।রুপ্সিতা ওভাবেই বসে রইলো।এখন আর চিৎকার করে কান্না আসেনা।নিরবে চোখ দুটো দিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।
ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে রুপ্সিতা।ওর কি চেহারা খারাপ?নাকি ভাগ্যটাই খারাপ।কি করলে আলিফ মায়াকে নয় ওকে ভালোবাসবে।নিজের এই শরীরটাকে পাল্টে মায়ার মতো হয়ে গেলে মনে হয় আলিফ ওকে ভালোবাসবে।নিজেকে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে।চোখেমুখে আবারো পানি দিতে গিয়ে দেখে বেসিনের ট্যাপ থেকে পানি বের হচ্ছেনা।গোসলেরটা ছেড়ে দিয়ে চোখেমুখে পানি দেয়।এদিকে পানির ছিটায় অনেকটা ভিজে গেছে সেই খেয়াল রুপ্সিতার নেই।
শরীরটা কেমন অসাড় হয়ে আসছে।পানিতে অনেক্ষণ ভিজা তার উপর সকালর পর থেকে না খাওয়া,কান্নায় মাথা ব্যথা সব মিলিয়ে রুপ্সিতা নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারলোনা।চোখ দুটো ঝিমিয়ে আসছে।ধপ করে নিচে পড়ে গেলো রুপ্সিতা।ট্যাপের পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে রুপ্সিতার সমস্ত শরীর।

সন্ধ্যার আগেই আলিফ বাসায় ফেরে কাজ শেষ করে।রুমের সামনে এসে দরজা ধাক্কাচ্ছে কিন্তু দরজা ভেতর থেকে লক করা।আলিফ রুপ্সি বলে অনেকবার ডেকেছেও কিন্তু কোনো সাড়া পায়নি।ইরিনের রুমে গিয়ে বলল,ভাবি রুপ্সি কোথায়?আর রুমের দরজা দেখি ভেতর থেকে বন্ধ।

ইরিন বলল,ওর মাথা ব্যথা।দুপুরে না খেয়েই শুয়ে পড়েছে।তুমি ডাকো উঠে যাবে।
আলিফ কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল,ওতো আর এরকম দরজা নক করেনি।আর আমি অনেকবার ডেকেছি কিন্তু সাড়া দিচ্ছেনা।
ইরিন বলল,হয়তো শুনতে পায়নি।চলো আমি সহ যাচ্ছি।এরপর দুজন মিলে রুপ্সিতাকে অনেক ডাকাডাকি করলো কিন্তু কোনো সাড়া পেলো না।ওদের ডাকাডাকিতে আলিফের বাবা মা দুজনই বেরিয়ে এলেন।

আলিফের মা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই ইরিন সব খুলে বলে।চিন্তিত হয়ে উনিও কয়েকবার ডাকেন।এরপর আলিফের বাবা বলল,এতো ডাকার পরও শুনলোনা।আশ্চর্যের ব্যাপার!মেয়েটা ঠিক আছেতো?
উনার কথায় আলিফের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে।সামনে থেকে সবাইকে সরিয়ে কয়েকবার দরজায় লাথি দেয় উদ্দেশ্য দরজা ভাঙা।কিন্তু একার শক্তিতে পেরে উঠছেনা।এমন সময় আরিফ ও বাসায় আসে।সবাইকে একজায়গায় দেখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে?আলিফ বলল,সেসব পরে শুনবে আগে দরজাটা ভাঙো।

এরপর দুই ভাই মিলে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে।রুম খালি ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে দরজাটাও খোলা।আলিফ সেদিকে দৌঁড়ে গিয়ে রুপ্সিতাকে ওয়াশরুমে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে।সারা শরীর ভিজে চুপেচুপে হয়ে আছে।কাছে গিয়ে হাত স্পর্শ করতেই আরেক দফা চমকে যায়।হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে।আলিফ ট্যাপ অফ করে রুপ্সিতাকে কোলে তুলে নেয়।ভেজা কাপড়েই খাটে শুইয়ে দেয়।ইরিনকে ওর ড্রেস চেঞ্জ করতে বলে সবাই বেরিয়ে যায়।ড্রেস পাল্টে ইরিন সবাইকে ডাক দেয়।আরিফ ডাক্তারকে কল করে দিয়েছে।সবাই রুপ্সিতাকে নিয়ে চিন্তিত।আলিফ ওর পায়ের কাছে বসে পা দুটো অনবরত ঘষে চলেছে।ইরিন হাত ঘষছে।
#চলবে………।