আজ তার বিয়ে পর্ব-০৫

0
1833

আজ_তার_বিয়ে
# লেখিকা -নাইমা জাহান রিতু
# পর্ব -৫
অন্ধকার রাত। চারিদিকে গভীর নিরবতা।
মাঝে মাঝে রিকশার দু একটা টুংটাং শব্দ
কানে ভেসে আসছে। এই গভীর রাতে ছাদে
সিগারেট নিয়ে একা বসে আছে ইমতি। এর
মাঝে কয়টা সিগারেট শেষ করে ফেলেছে এর
সঠিক হিসেব তার জানা নেই। রাত পেরিয়ে
সকাল হলেই তার বিয়ে আখি নামের
মেয়েটার সাথে। আর তারপর থেকেই শুরু হবে
তার অদ্রি বিহীন এক নতুন জীবন। এই ছয় টা বছর
এক সাথে কাটানোর পর, তাদের বাকি জীবন
টা আলাদা হয়ে কাটাতে হবে ভাবতেই ইমতির
বুকের বাম পাশ টায় চিনচিন করে উঠছে। প্রতি
সকালে অদ্রির ফোনে আর ঘুম ভাঙবে না তার।
তখন কি আখিই তার ঘুম ভাঙাবে? কিন্তু অদ্রির
মতো করে ঘুম ভাঙাতে কি সে পারবে? হয়তো
পারবে বা পারবে না। কিন্তু অদ্রির জন্য
ইমতির নিজের মনে যে ভালোলাগা
ভালোবাসা টা রয়েছে সেটা কখনওই আখির
জন্য ফিল করতে পারবে না সে। এমনকি অদ্রির
জায়গায় বসাতেও পারবে না সে আখিকে।
হয়তো আখির রূপ দেখে তার পুরুষত্ব জেগে
উঠবে। রাতের পর রাত এই পুরুষত্বের কারণে
আখির সাথে এক বিছানায় রাতও কাটাবে
সে। কিন্তু ভালোবাসা টা কখনো কি তৈরি
হবে? যদি নাই বা হয় তাহলে আখি কে বিয়ে
করাটার অর্থ কি? যদি মেয়েটাকে
ভালোবাসতেই না পারে, আপন করে নিতেই
না পারে তাহলে শুধু শুধু বিয়ে নামক এক
বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে
না। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইমতি। ঠিক
তখনি তার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ফোনের স্ক্রিনের
দিকে তাকালো ইমতি। স্কিনে আখির নাম
ভেসে উঠেছে দেখে কিছু টা বিরক্ত হলো
ইমতি। এত রাতে মেয়েটা কেন ফোন দিচ্ছে!
দুই বার ইমতির ফোনে কল করলো আখি। কিন্তু
ওদিক থেকে ইমতির কোনো সাড়া না পেয়ে
তৃতীয় বার কল করবে কি না এটা নিয়ে কিছু
সময় চিন্তা করতে লাগলো আখি। ইমতি কি
ঘুমিয়ে পড়েছে? টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে
হয়তো। আচ্ছা, ইমতির ঘুমন্ত মুখ টা দেখতে কি
খুব মায়াবি? খুব বেশি দেখতে ইচ্ছে করছে
ঘুমন্ত ইমতি কে। অবশ্য কাল এই সময় তো ইমতির
বাহুডোরেই আবদ্ধ থাকবে। ইমতি কি কাল
রাতে তাকে এই সময় ঘুমুতে দিবে? দরকার নেই
ঘুম! ইমতি পাশে থাকলে আর কিচ্ছু চাই না
তার। ভেবেই নিজের আনমনে কিছুক্ষণ হাসলো
আখি। এরপর এক মুহূর্ত কল দেবার ইচ্ছা টা
দাবিয়ে রাখলেও পরমুহূর্তেই আবার কল দিল
সে ইমতির নাম্বারে।
আখির নাম্বার থেকে আবারো কল আসায়
ইমতি কিছুক্ষণ ইতঃস্তত করে ফোন রিসিভ
করলো
-“হ্যালো?”
-“ঘুমুচ্ছিলেন?”
-“না।”
-“তাহলে?”
-“তেমন কিছু না।”
-“আচ্ছা!”
-“আর কিছু বলবে?”
-“না,, এমনিই।”
-“তাহলে কি ফোন টা রেখে দিব?”
আখি ইমতির মুখ থেকে ফোন রাখার কথা
শুনতেই বলে উঠলো
-“না, না। ফোন রাখবেন কেন? রাখা যাবে না।”
-“তাহলে এত রাতে কি করা লাগবে?”
-“বিয়ের আগের রাতে হবু বৌ এর সাথে কথা
বলবেন।”
আখির মুখ থেকে বৌ কথাটা শুনতেই হলুদের
সাজে আখির চেহারাটা ভেসে উঠলো ইমতির।
কি অপূর্বই না দেখতে লাগছিল আখিকে! ইমতি
মিষ্টি গলায় বললো
-“কি কথা বলবো?”
-“নানান বিষয় নিয়েই কথা হতে পারে।”
-“তো শুরু করো।”
-“তাহলে কিন্তু আজ সারা রাত আমরা কথা
বলবো। বলুন, রাজি?”
সারারাত ফোনে কথা বলার প্রসঙ্গ আসতেই
ইমতির অদ্রির কথা মনে পড়ে গেল। প্রথম প্রথম
প্রেম শুরু করার পর তারা দুইজন ও রাত জেগে
ঘন্টার ঘন্টা কথা বলেছে। অদ্রির কথা মনে
হতেই ইমতি অস্বস্তি নিয়ে বলে উঠলো
-“আমার ফোনে আরেকটা কল আসছে। রাখছি।”
ইমতির এভাবে ফোন কেটে দেওয়া কিছুতেই
হজম করতে পারলো না আখি। একটু আগেই যে
এত সুন্দর ভাবে মিষ্টি গলায় কথা বলছিল তার
হঠাৎ করে কি হয়ে গেল এটাই কোনো ভাবে
মাথায় আসছে না আখির। কিছুক্ষণ অপেক্ষা
করে ইমতিকে আবার কল দিল আখি। কিন্তু
ইমতি আর ফোন রিসিভ করলো না। ইমতি কি
তাকে ইগনোর করছে? কিন্তু কেন? ভেবেই চোখ
টা ছলছল করে উঠলো আখির।
রাত ২ টা। সাজিদের চোখে ঘুম নেই। বিছানায়
শুয়ে বার বার এপাশ ওপাশ করতে করতে উঠে
বসলো সাজিদ। ঠিক এই মুহূর্তে তার অদ্রির
সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু অদ্রির
নাম্বার টা তো নেয়া হয় নি। আর এত রাতে কি
অদ্রি জেগে আছে? কিছুক্ষণ হেটে হেটে
আবার বিছানায় এসে বসলো সাজিদ। তারপর
ইমতির নাম্বারে কল দিল সাজিদ।
-“হ্যালো? জেগে ছিলি?”
-“জেগে না থাকলে ফোন রিসিভ করলাম
কিভাবে!”
সাজিদ হালকা হেসে বললো
-“সেটাও। আচ্ছা শোন, একটা দরকারে কল
করেছি তোকে।’
-“কী?”
-“অদ্রির নাম্বার টা দে।”
সাজিদের মুখ থেকে অদ্রির কথা শুনতেই ভ্রু
কুঁচকে ইমতি বললো
-“ওর নাম্বার দিয়ে তুই কি করবি?”
-“কথা বলবো।”
-“এত রাতে ওর সাথে তোর কি কথা!”
-“হবু বৌ এর সাথে রাতে কথা বলেই তো আসল
মজা।”
হবু বৌ শব্দ টা শুনেই ইমতির বুকের ভেতর টা
কেপে উঠলো। তার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কে
কার হবু বৌ? অদ্রি? অদ্রি কার হবু বৌ?
-“কি হলো, দে?”
ইমতি ব্যাপার টা বুঝতে সাজিদের কাছে
জানতে চাইলো
-“অদ্রি কার হবু বৌ?”
সাজিদ অবাক হয়ে বললো
-“কার আবার! আমার।”
-“মানে?”
-“অদ্রির সাথে যে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে
এটা জানতি না তুই?”
সাজিদের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ইমতি।
কি বলছে এগুলো সাজিদ? কিছুক্ষণ সময় নিয়ে
ইমতি বললো
-“অদ্রির সাথে তোর বিয়ে? অদ্রি রাজি
হয়েছে?”
-“তোর কি মনে হয়?”
সাজিদের কথা গুলো শুনে নিজের মাঝের
রাগকে কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারলো না
ইমতি। উচু গলায় বলতে লাগলো
-“ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে কথা বলিস না। যেটা বলছি
সেটার উত্তর দে।”
ইমতির হঠাৎ রাগী কন্ঠ শুনে সাজিদ অবাক
হয়ে বললো
-“চিৎকার করছিস কেন? নাম্বার টা দিয়ে তুই
ফোন রাখ।”
-“না।”
-“কীনা?”
-“তোকে অদ্রির নাম্বার দিব না। আর তোকে
যেন আর অদ্রির আশেপাশে না দেখি। তোর
সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। শালা
মিরজাফর একটা। আমার সামনে পড়লে তোর
খবর আছে।”
এক দমে কথা গুলো বলেই ফোন টা কেটে দিল
ইমতি। রাগে তার শরীর জ্বলছে। সাজিদের
স্পর্ধা হয় কি করে ওর অদ্রির দিকে চোখ তুলে
তাকানোর! শান্তশিষ্ট একজন মানুষ হিসেবেই
সবাই ইমতিকে জানে। কখনো কারোর উপরই
রেগে থাকতে পারে না সে। রাগ জিনিশ টার
সাথে তেমন একটা পরিচিত ও না সে। রাগ
হলেও সব সময় নিজের মাঝে দাবিয়ে রাখে
সে। কিন্তু আজ হঠাৎ সাজিদের কথা শুনে
নিজের মাঝে রাগ টা চেপে রাখতে পারলো
না সে। রাগের চোটে তার পুরো শরীর কাপতে
শুরু করেছে।ছাদে কিছুক্ষণ এদিক থেকে ওদিক
পায়চারি করলো ইমতি। কিন্তু নিজেকে
কিছুতেই শান্ত করতে পারলো না। অবশ্য
সাজিদের এখানে কোনো দোষ নেই। ছয় বছর
হলো সম্পর্ক অদ্রির সাথে তার। কিন্তু এর
মাঝে একবারো সাজিদ কে জানায় নি সে।
দেশ থেকে চলে যাবার পর প্রথম কয়েক বছর
ঠিক মতো সাজিদের সাথে যোগাযোগ হলেও
পরে ধীরেধীরে তা কমে এসেছিল। বলতে
গেলে দুই জনের ব্যস্ততায় তেমন একটা কথা
হতো না ইমতির সাথে সাজিদের। আর যাও বা
দু এক মাস পর একবার হতো তখন দেশ বাবা মা
বন্ধু বান্ধব নিয়েই কথা হত। কখনো অদ্রির আর
তার সম্পর্কের কথা বলার মত সুযোগ হয় নি।
কিন্তু আজ এই ভুল টাই যে কাল হয়ে আসবে
এটা জানলে অনেক আগেই সাজিদকে
জানিয়ে দিত ইমতি তার আর অদ্রির সম্পর্কের
কথা। কিন্তু এখানে সাজিদের বিষয় টা
অজানা থাকলেও অদ্রির তো অজানা নয়। আর
অদ্রি রাজি হলো কিভাবে? বয় ফ্রেন্ডের
বাহানা দিয়ে ইমতির সাথে সম্পর্ক শেষ
করলো অদ্রি। তাহলে সাজিদ কে বিয়ে করতে
রাজি হলো কেন সে? তাই এই মুহূর্তে
সাজিদের উপর রাগ টা কমলেও অদ্রির উপর
থেকে কোনো ভাবেই কমছে না। আরেকটা
সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ইমতি বললো
-“এই মেয়েটা চাচ্ছে টা কি? পাগল হয়ে গেছে
নাকি? নাহ, এভাবে আর পারছি না। আজ এর
একটা শেষ দেখেই ছাড়বো। হয় নিজে মরবো
না হয় অদ্রিকে মারবো।”
সিগারেট টা ফেলে আর এক মুহূর্তও ছাদে না
দাঁড়িয়ে ইমতি নিচে নেমে এল। নিচে নেমে
প্রথমে গেল ইতির ঘরে। ইতিকে ডেকে তুলে
বললো
-“আপু, অদ্রিকে একটু ডেকে দে।”
চোখ ডলতে ডলতে ইতি ইমতির দিকে তাকিয়ে
বললো
-“কি হয়েছে? এমন করছিস কেন? দেখি এদিকে
আয়।”
বলেই ইমতিকে হাত ধরে ডাইনিং এ নিয়ে এল
ইতি। তারপর এক গ্লাস পানি ইমতির দিকে
এগিয়ে দিয়ে বললো
-“পানি টা খা, আর শান্ত হ। কি হয়েছে
আমাকে বল।”
-“অদ্রিকে ডেকে তোল। ওর সাথে কথা আছে।”
-“সেটা তো তুই ও পারিস।”
-“আমি ডাকলে ও দরজা খুলবে না।”
ইতি ভাইয়ের মাথায় হাত রেখে বললো
-“তোর অবস্থা আমার ভালো লাগছে না। তুই
কি ড্রিংকস করেছিস?”
-“না।”
-“আগে বল এত রাতে অদ্রি কে তোর কি
দরকার?”
-“অদ্রি কে ডেকে দিবি কি দিবি না?”
ইমতির চোখ টা লাল টকটকে হয়ে আছে।
ভাইয়ের এই ভয়ংকর রূপকে কিছুতেই হজম করতে
পারছে না ইতি। ভাইয়ের এই চেহারাটা সম্পূর্ণ
তার অপরিচিত। ইমতির পাশে বসে ইতি বললো
-“দিব। কিন্তু কোন সিনক্রিয়েট করবি না তো
এতো রাতে?”
-“না।”
ভাইয়ের এই উত্তরে তেমন ভরসা পেল না ইতি।
তবুও সে এগুলো অদ্রির ঘরের দিকে।।
(চলবে)