আজ তার বিয়ে পর্ব-০৬

0
2402

# আজ_তার_বিয়ে
# লেখিকা -নাইমা জাহান রিতু
# পর্ব -৬
অদ্রি বিছানায় এসেছে তাও ঘন্টা খানেক
হলো। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। ঘুম টা থাকারও
কথা না। কাল তার খুব কাছের একটা মানুষ তার
থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। যা আর ইচ্ছে
করলেও নাগাল পাওয়া সম্ভব না। অবশ্য অদ্রি
নাগাল পেতেও চায় না। অন্যের জিনিশ নিয়ে
টানা হেচড়া করা তার ধাঁচে নেই। কারণ
কালকের পর থেকে ইমতি নামের তার সবচেয়ে
কাছের মানুষ টা আখির হয়ে যাবে। আখির
সাথে মানিয়ে নিয়ে ইমতি চলতে পারবে কি?
পারবে হয়তো। আজ যেভাবে হেসে হেসে কথা
বলছিল দুজন, যেভাবে মুগ্ধ দৃষ্টি তে ইমতি
তাকিয়ে ছিল আখির দিকে সেটা দেখেই
বোঝা যায়, একটু কষ্ট হলেও ইমতি মানিয়ে
নিতে পারবে আখির সাথে। পুরুষ মানুষ, কয়দিন
আর বৌ কে কাছে না টেনে থাকতে পারবে!
আখি মেয়েটাও অসুন্দর না। বরং একটু বেশিই
সুন্দর। এই রূপের মোহে হলেও ইমতি আখিকে
কাছে টানবে। এক সাথে থাকতে থাকতে
ভালোলাগা টাও এসে যাবে হয়তো, কিন্তু
ভালোবাসতে কি পারবে আখিকে? ইমতি যে
অদ্রিকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, এ নিয়ে কোনো
সংশয় নেই অদ্রির মাঝে। কিন্তু সময়ের সাথে
সাথে যে ইমতি সব ভুলে আখিকে মেনে নিয়ে
নতুন জীবনে অগ্রসর হবে এটাই তো সত্য। আর
অদ্রি নিজেও চায় ইমতি ভালো থাকুক, সুখে
থাকুক। সেই ভালো থাকা আর সুখে থাকাটা
অন্য কোনো মেয়ের সাথে হলেও ক্ষতি কি!
ক্ষতি তো নেই। কিন্তু অন্য একজনের বুকে
মাথা রেখে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে
ঘুমোবে, তার হৃদস্পন্দন শুনতে পাবে ইমতি এটা
ভাবতেই বুকের মাঝে একটা হাহাকার শুরু হয়।
কেমন যেন বুক টা খালি খালি লাগে।
অদ্রি কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ
করে উঠে বসলো। তারপর ফোন টা হাতে নিয়ে
ইমতির নাম্বার বের করলো। একটা বার খুব করে
কথা বলতে ইচ্ছে করছে ইমতির সাথে। কল
দিবে কিনা এটা নিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধায়
ভুগলো অদ্রি। শেষমুহুর্তে ঠিক হলো কল করবে
না সে ইমতিকে। ইমতিকে কল করে তার
নিজের কষ্ট টাকে আর বাড়াতে চায় না সে।
এই দুই মাসে অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত
করেছে সে। এখন আবার ইমতিকে কল দিয়ে
সেই কষ্টটাকে মাথাচাড়া করার কি দরকার!
দুই মাস আগেই তো ইমতি নামের একজন কে
কোরবানি করেছে সে তার মন থেকে। এখন সে
শুধুই অদ্রির জীবনের অতীত। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস
ফেললো অদ্রি। হাজার বার চেষ্টা করার পরও
সেই দিন টার কথোপকথন গুলো বারবারই তার
কানে ভাসে। কেন ওই দিন টি এসেছিল
তাদের জীবনে! আর কিছু না ভেবে আবারো
বিছানায় শুয়ে পড়লো অদ্রি। চোখ টা বন্ধ
করতেই তার সামনে ভেসে উঠলো সেই
অভিশপ্ত দিনটির চিত্র।
অদ্রির পরীক্ষা চলছিল তখন। মাত্র একটা
পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বাদবাকি গুলোর জন্য
প্রস্তুতি নিতে একদম হিমশিম খেতে হচ্ছে
তাকে। সারাবছর পড়াশোনা না করলে
পরীক্ষার আগে যা হয়! তখন পরীক্ষার আগের
প্রত্যেকটা সময় সব ছাত্রছাত্রির কাছে খুব
বেশি মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায়। দম ফেলিয়েও সময়
নষ্ট করতে চায় না তারা। অদ্রির ও আজকাল
সেই করুণ অবস্থা। আদাজল খেয়ে নেমেছে
সে। এমনকি এই পরীক্ষার জন্য ইমতির সাথেও
কথা বলা টা কমিয়ে দিয়েছে সে। মনোযোগ
দিয়ে পড়া ছাড়া আর কিছু নিয়ে আপাতত
মোটেও সে চিন্তিত নয়। আজকের দিনটাও
অদ্রির সেভাবেই শুরু হয়েছিল। সারারাত
জেগে পড়ে ভোরের দিকে হালকা ঘুমিয়ে
নিয়েছিল সে। তারপর সকাল ১০ টার দিক উঠে
হালকা নাস্তা করে আবার বই এর মাঝে মুখ
গুজলো অদ্রি। ঠিক তখনি তার ফোন টা বেজে
উঠলো। পড়ার মাঝে বাধা পেয়ে কিছুটা
বিরক্ত হয়ে ফোন টা খুঁজতে লাগলো সে। কে
এই সময় ফোন করলো? বাবা? নাকি ইমতি?
বাবাই হবে হয়তো। কারণ এই সময় ইমতির একটা
মিটিং এ থাকার কথা। কাল রাতেই তো ইমতি
বললো তাকে। ভাবতে ভাবতেই ফোন টা
বালিশের নিচে থেকে উঠিয়ে হাতে নিয়ে
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চোখ টা ছানাবড়া
করে ফেললো অদ্রি। আরে! ফুপার নাম্বার
থেকে কল এসেছে! সে কি ঠিক দেখছে? হ্যাঁ।
ফুপার নামই তো লেখা। কিন্তু কখনো তো ফুপা
কল করে না তাকে। তাহলে আজ কি এমন হলো!
এদিকে ফোন বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল।
অদ্রি নিজেকে এখনো ধাতস্থ করতে পারছে
না। ইমতি আর তাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা
হলো নাকি! কারণ অদ্রির নিজের সাথে তার
ফুপা আফজাল সাহেবের সম্পর্ক আন্তরিকতার
নয়। ইমতির মতই তার বাবা ও খুব কম কথা বলে।
তাই কখনো ফুপার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে
ওঠে নি অদ্রির। অদ্রি কলব্যাক করবে কিনা
ভাবতে ভাবতেই আফজাল সাহেবের নাম্বার
থেকে আবার কল এলো অদ্রির ফোনে। এই বার
আর কিছু না ভেবেই চট করে কল টা রিসিভ
করে অদ্রি বললো
-“আসসালামু আলাইকুম, ফুপা। কেমন আছেন?”
গম্ভীর গলায় আফজাল সাহেব বললো
-“ওয়ালাইকুম সালাম।”
অদ্রি আর কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে
রইলো। অদ্রির কোনো কথা না শুনতে পেয়ে
আফজাল সাহেব বললো
-“তোমার সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট কি?”
-“জ্বি, ফার্স্ট ক্লাস।”
-“হুম, ভালো হয়েছে।”
-“হুম, দোয়া করবেন।”
গলা টা আগের থেকেও বেশি গম্ভীর করে
আফজাল সাহেব বললো
-“তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।”
আফজাল সাহেবের এই কথা টি শুনে অদ্রি
আত্মা শুকিয়ে যাবার জোগাড় হলো। ঢোক
গিলতে গিলতে অদ্রি বললো
-“জ্বি, বলুন।”
-“তোমার সাথে ইমতির কিছু চলছে?”
ইমতির নাম আফজাল সাহেবের মুখ থেকে
শুনতেই অদ্রির হার্ট বিট বেড়ে গেল। এই
প্রশ্নের কি উত্তর দিবে সে?
-“তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না?”
আফজাল সাহেবের ধমকে কেপে উঠলো অদ্রি।
তারপর আমতা আমতা করে বললো
-“না,, মা…মানে তেমন কিছু না।”
-“তাহলে কেমন কিছু?”
অদ্রি তার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো।
অদ্রির কোনো উত্তর না পেয়ে আফজাল
সাহেব বললো
-“তোমার স্পর্ধা দেখে আমি হতভম্ব! নিজের
দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছো কখনো?”
কথা টা শুনতেই অদ্রির চোখ দিয়ে টপটপ করে
কয়েক ফোটা পানি পড়তে শুরু হলো। এদিকে
আফজাল সাহেব বলার উপরেই আছে
-“অবশ্য ছোট লোকদের কাছে এর চেয়ে ভালো
কিছু আশা করাটাও ঠিক না। কোটিপতি
দেখলেই ঝুলে পড়ে তার গলায়। তুমিও আমার
টাকা পয়সা দেখে লোভ সামলাতে না পেড়ে
ইমতির গলায় ঝুলে পড়েছো। তুমি কি ভাবো
এগুলো কিছু আমার চোখে পড়ে না? এর আগে
ইফতেখার এর সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে
কোনো লাভ তো তোমার হয় নি। যেই দেখলে
ইফতেখার কে পটানো সম্ভব না, কারণ আমি
তার বিয়ে টা দিয়ে দিয়েছি তখন আবার
ইমতির পেছনে লাগলে। ইমতিকে পটাতে শুরু
করলে। তোমার মতো এত নিচ মেয়ে আমি
আমার জীবনেও দেখি নি।”
বলেই কিছুটা থামলেন আফিজাল সাহেব।
ওপাশ থেকে অদ্রির নাক টেনে টেনে কাঁদার
আওয়াজ ও তার মন টা নরম করে দিতে পারলো
না। কিছুক্ষণ দম নিয়ে আবার আফজাল সাহেব
বলতে লাগলো
-“এই যে তুমি নিত্য নতুন জামা পড়ে ঘোরো
ফেরো, একটা উন্নত লাইফ লিড করো, একটা
ভালো যায়গায় লেখাপড়া করো এগুলোর খরচ
কে দেয়? তোমার বাবা? নো,, একজন সাধারণ
প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করে আর যাই করা
যাক না কেন এত জাঁকজমক পূর্ন একটা লাইফ
লিড করা যায় না। প্রত্যেক মাসে আমি টাকা
না পাঠালে আজ তোমাকে নিয়ে তোমার
বাবা মার পথে বসতে হতো। যাদের নুন আনতে
পানতা ফুঁড়োই তাদের অন্যের টাকায় এত রঙ
ঢঙ করে চলাফেরা করতে বাধে না? তোমার
ফকির বাপ টা তো বাপের ভিটেমাটি
জমিজমা সব বিক্রি করে দেউলিয়া হতে
বসেছিল, আমি যদি তাকে আশ্রয় না দিতাম
তাহলে আজ তোমাদের জায়গা হতো
গাছতলায়। এমনকি তোমাকে ঢাকায় কোচিং
করানোতে যা খরচ হয়েছে সব আমিই দিয়েছে।
অবশ্য এতে আমার কোনো আফসোস নেই। কারণ
ওই কয়েকটা টাকা আমার হাতের ময়লা। প্রতি
রোযায় যেমন আমি ফকির মিসকিন দের
যাকাত দেই, ঠিক তোমাদেরও দান করি আমি
সেই হিসেবেই।”
অদ্রিদের সংসারে অনেক টাকা দিয়েই
সাহায্য করে আফজাল সাহেব। কথা টি অদ্রি
জানলেও কখনো এটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি
সে। কারণ তার জানামতে, বিপদের সময়
আপনরাই তো আপনদের কাজে আসে, পর কেউ
না। কিন্তু আজ তার ফুপার মুখ থেকে এমন কথা
শুনে কিছুতেই নিজের কান্নাকে থামাতে
পারলো না অদ্রি। ইচ্ছে করছে ফোন টা কেটে
দিয়ে কিছুক্ষণ জোরে চিৎকার করে কাঁদতে
কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না। আফজাল সাহেব
থেমে যেতেই অদ্রি ফোঁপাতে ফোঁপাতে
বললো
-“আজ আপনি এই কথা গুলো কেন শোনাচ্ছেন?”
-“কেন গায়ে লাগছে? জীবনে অনেক ছোটলোক
দেখেছি কিন্তু তোমাদের মতো ছোট লোক
দেখি নি। কান্নার ন্যাকামি টা বন্ধ করো।
আমার ইমতির বিয়ে আসে কোন কোন
ফ্যামিলি থেকে এটা জানো? ডাক্তার,
ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পপতি, মন্ত্রিদের ফ্যামিলি
থেকে বিয়ে আসে আমার ছেলের জন্য।
ইফতেখার এর শ্বশুর বাড়িটাই দেখো। কিসের
অভাব আছে তাদের?”
অদ্রির দম বন্ধ হয়ে আসছিল আফজাল
সাহেবের কথায়। এই মানুষ টাই যখন তাদের
গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসে তখন অদ্রির
বাবা মায়ের যেন খুশির হিসেব থাকে না।
কোথায় কোন জিনিশ টা ভালো পাওয়া
যাবে, কোন মাছ টা খেতে পছন্দ করে সে, কি
খেতে ভালোবাসে সে, এটা নিয়েই দিন রাত
পড়ে থাকে তার বাবা মা। যত্নআত্তির কোনো
কমতি রাখে না। সারাক্ষণ দুলাভাই দুলাভাই
করে পড়ে থাকে। অথচ এই লোকের কাছে
অদ্রির বাবা মার এই আদর, ভক্তি, শ্রদ্ধার
কোনো দাম নেই। আছে শুধু তাদের নিয়ে মনে
একরাশ লুকোনো ক্ষোভ! ভাবতেই অদ্রির বুকটা
ফেটে যাচ্ছে।
-“কিছুদিন হলো ইমতির বিয়ের কথা হচ্ছে এক
মন্ত্রীর মেয়ের সাথে। আর তোমার বাবা
গ্রামের সামান্য একজন মাস্টার। তাহলে তুমিই
বলো আমার কি করা উচিৎ? তোমার মতো
কারো সাথে আমার সোনার টুকরো ছেলের
বিয়ে দেয়া? নাকি মন্ত্রীর মেয়ের সাথে?
তোমাদের স্ট্যাটাস এর সাথে আমাদের
স্ট্যাটাস কোনো ভাবেই যায় না। আর আসল
কথা হলো তোমার বাবার সাথে আত্মীয়তার
সম্পর্ক করে আমি কোনো লাভ পাবো না।
যেটা মন্ত্রীর সাথে করে পাবো। আমরা
বিজনেসম্যান রা আবার এই দিক টা বেশি
চিন্তা করি। যাই হোক আমি ভদ্র ভাষা
প্রয়োগ করে এতোক্ষণ তোমার সাথে কথা
বললাম। আশা করি তুমিও ভদ্র ভাবেই আমার
কাজ টা করবে। কোনো রকম ঝামেলা না করে
ইমতির সাথে তুমি ব্রেকাপ করবে। ইস ইট
ক্লিয়ার?”
অদ্রির কোনো জবাব না পেয়ে আফজাল
সাহেব বললো
-“তোমার মাঝে যদি কোনো আত্মোসম্মান
বোধ থাকে তাহলে আমার মনে হয় না আমার
ছেলের সাথে কোনো রকম যোগাযোগ রাখবে
তুমি। রাখছি এখন, টেক কেয়ার।”
বলেই আফজাল সাহেব ফোন টা কেটে দিল।
অদ্রি ওই অবস্থায়ই বিছানায় কিছুক্ষণ বসে
বসে কাঁদলো। ফুপার এই নতুন রূপ কিছুতেই হজম
করতে পারছে না সে।
অদ্রির রুমমেট শেফা ক্যাম্পাসে গিয়েছিল
কিছু নোট আনতে। রুমে ঢুকে অদ্রির এই অবস্থা
দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। কি হয়েছে কিছুই
সে বুঝতে পারছে না। কি হলো মেয়েটার এই
অল্প সময়ে! মাত্রই তো ওকে ঘুম থেকে ডেকে
দিয়ে শেফা ক্যাম্পাসে গেল। এই কিছু
মুহূর্তের মাঝে কি এমন ঘটলো যে মেয়েটা
বিছানায় পরে পাগলের মতো কাঁদছে!
অনেকবার শেফা অদ্রির কাছে বিষয় টা
জানতে চাইলো। কিন্তু অদ্রির ফোঁপানির
কারণে অদ্রি কি বলল কিছুই বুঝতে পারলো না
শেফা। অদ্রিকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নিজের
বুকের মাঝে রেখে শান্ত করলো শেফা।
তারপর বিষয় টা কি জানতে চাইতেই অদ্রি
একে একে সব তাকে খুলে বললো। সব শুনে
শেফা অদ্রির দিকে তাকিয়ে রাগত্ব স্বরে
বললো
-“এই কারণে তুই কাঁদছিস? তোর মাথায় কি গবর
আছে? এতোদিন তোকে বুদ্ধিমতী হিসেবেই
জানতাম কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তোর মাথায়
আন্ডা ছাড়া কোনো বালই নেই। তুই এক্ষণি
ইমতি ভাইয়া কে ফোন করে সব জানা। এ টু
জেড বলবি তাকে। কিছুই বাদ দিবি না।
লোকটা নিজেই ছোটলোক, যার কারণে
ব্যবসার লাভের জন্য নিজের ছেলে কে
বিক্রি করে দিচ্ছে সে। হারামজাদা এক
নম্বরের। সামনে পাইলে এত ফালতু কথা বলার
জন্য জুতা মারতাম। শালা খারাপ ভাষা ইউস
কইড়া পরে আবার কয় ভদ্র ভাবে কথা বলছে!
আর তুই ও চুপচাপ সব শুনছোস! কিছু বলতে
পারিস নাই?”
শেফার কথা মতো ইমতিকে কল দিল অদ্রি।
কিন্তু ইমতি ফোন রিসিভ করার পরিবর্তে
একটা ম্যাসেজ পাঠালো।
Emtiaaz- I’m busy now. call u back latter .
ম্যাসেজ টা দেখে শেফা অদ্রিকে সান্তনা
দিয়ে বললো
-আচ্ছা! সমস্যা নেই। ভাইয়া ফ্রি হয়ে কল
ব্যাক করবে।”
এই পরিস্থিতি তে অদ্রির পড়াশোনা সব লাটে
উঠলো। বই নিয়ে বসে থাকলেও পড়াশোনায়
মনোযোগ দিতে পারলো না একদম সে। বারবার
শুধু ফোনের কথাগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
শেফা তাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে শান্ত
করলেও অদ্রির মন টা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না।
এসব ভাবতে ভাবতেই তার ফোন টা বেজে
উঠলো। শেফা ফোনের রিংটোন পেয়েই
চেঁচিয়ে উঠে বললো
-“ভাইয়া কে কিন্তু সব বলবি। শাবানার মতো
কোনো কিছু লুকিয়ে মহান হতে যাবি না
একদম।”
ফোন টা হাতে নিতেই বুক টা কেপে উঠলো
অদ্রির। না, ইমতি ফোন করে নি। ফোন করেছে
ইমতির মা। অদ্রি ভয়ার্ত চোখে তাকালো
শেফার দিকে। তারপর ঢোক গিলে বললো
-“ফুপু ফোন করেছে।”
-“তো কি হয়েছে? ধর। আর কোনো খারাপ কথা
শুনালেই তাকেও উলটো শুনিয়ে দিবি। ধর।”
শেফার কথায় কাপা কাপা হাতে ফোন টা
রিসিভ করলো অদ্রি।
-“মা, ভালো আছিস?”
ফুপুর এই নরম সুরে কথা বলা কিছুটা হলেও
চমকে দিল তাকে। অদ্রি ধীরেধীরে বললো
-“হ্যাঁ।”
-“মা, আমি কখনো তোর কাছে কিছু চাই নি।
আজ তোর মা হিসেবে তোর কাছে কিছু চাই
আমি।”
অদ্রি কাতর কন্ঠে বললো
-“কি বলছেন ফুপু এগুলো?”
-“আমার পরিবারের শান্তি আমি তোর কাছে
ভিক্ষা চাচ্ছি। আমাকে দে, মা।”
বলেই আয়েশা বেগম কাঁদতে শুরু করলো। হঠাৎ
অদ্রি তার ফুপুর কান্না শুনে নিজের কান্না
টাও আর চেপে রাখতে পারলো না। এই
মানুষটি তাকে আসলেই খুব ভালোবাসে।
মায়ের চেয়ে কোনো অংশেই কম না। ছোট
বেলা থেকেই প্রতি ঈদ বা অন্যকোন অনুষ্ঠানে
ঢাকা থেকে কাপড়চোপড় কিনে কিনে
পাঠিয়েছে অদ্রিকে। আবার স্কুল কলেজের
রেজাল্ট ভালো করার পরও খুশি হয়ে এটা ওটা
কিনে পাঠিয়েছে। অথচ আজ সেই মানুষটিই
কান্না কাটি করে তার কাছে একটা জিনিশ
চাচ্ছে। আর সে দিতে পারবে না?
-“আপনি আমাকে ইমতির কাছ থেকে সরে
যেতে বলছেন, এটাইতো?”
আয়েশা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এমন
একটা দিন যে আসবে এটা মোটেও ভাবতে
পারে নি সে। তার নিজের ভাইঝির জীবন
থেকে সে নিজে সব সুখ, আনন্দ কেড়ে নিতে
চলেছে। ভাবতেই দম টা বন্ধ হয়ে আসছে তার।
অদ্রিকে কম ভালোবাসে না সে। বরং নিজের
মেয়ে ইতির চেয়ে বেশিই ভালোবাসে। সব
সময় শপিং এ গেলেই এটা ওটা কেনে সে
অদ্রির জন্য। ভালোবাসে বলেই শপিং এ
গিয়ে হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও একটা সুন্দর
ড্রেস দেখলেই তার অদ্রির কথা মনে পড়ে
যায়। কিন্তু আজ যখন অদ্রির তার সাপোর্ট এর
খুব প্রয়োজন তখনই সে তার সাপোর্ট দিতে
পারছে না। ভালোবাসা টা প্রকাশ করতে
পারছে না। তার নিজের স্বামীর জন্য মুখ বুজে
সব সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। সবাই বলাবলি করে
আফজাল নামের লোকটি তার জীবনে নাকি
এক আআশীর্বাদ হয়ে এসেছে! কিন্তু কেউ তো
এটা জানে না যে আশীর্বাদ না বরং
অভিশাপ হয়ে এসেছে আফজাল তার জীবনে।
অভাব না থাকলেও, টাকা পয়সার কমতি না
থাকলেও সুখ নামক জিনিশ টি তাদের মাঝে
নেই। বিয়ের পর থেকেই লোকটার আসল রূপ
তার সামনে এলেও বাবা মা হীন দরিদ্র
ভাইয়ের পরিবারে ফিরে যাওয়ার সাহস হয় নি
তার। তার ছেলেমেয়ে হলে তাদের কথা ভেবে
এতবছর সব চুপচাপ সহ্য করে নিয়েছে।
মেয়েদের নিয়ে আড্ডা, কিছু বলতে গেলেই
অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা, মারধোর
করা এটা যেন নিত্যদিনের সঙি তার। এখন যে
বুড়ো হয়ে গিয়েছে, এক পা কবরে দিয়ে
বসবাস করছে তাও আফজালের মধ্যে কোনো
ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করেনি আয়েশা বেগম।
শুধু এই লোকটার একটাই গুণ সেটা হলো
ছেলেমেয়েদের সামনে চুপচাপ হয়ে থাকা। এই
বিশেষ কারণে ছেলেমেয়েদের চোখে
ফেরেস্তা সে।
-“হ্যাঁ, তুই সরে যা। তোদের কাছে কখনো মুখ
ফুটে বলি নি কিছু। সুখে আছি ভালো আছি
এটাই বুঝিয়েছি তোদের। কিন্তু আমি মোটেও
সুখে নেই রে। আমার আর তোর নিজের জীবন
টা নরক বানাতে না চাইলে তুই দূরে চলে যা।
যোগাযোগ করিস না ইমতির সাথে। আমি
তোকে সব সময় নিজের মেয়ের মতো দেখেছি
অদ্রি। আমার হাতে কিছু থাকলে কখনওই
নিজের মেয়েকে এভাবে কষ্ট পেতে দিতাম
না।”
অদ্রি ফুপুর কথা শুনে কান্না টা কমিয়ে খুব
শান্ত হয়ে বললো
-“আমি আপনাকে অনেক শ্রদ্ধা করি ফুপু। আর
আপনি আমাদের বিপদে সব সময় আমাদের
পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর আজ আপনার বিপদে
আমি আপনার কাছে দাঁড়াবো না এতোবড়
নিষ্ঠুর আমি এখনো হতে পারি নি। আমি কথা
দিচ্ছি, আমি ইমতির সাথে আর যোগাযোগ
করবো না।”
(চলবে)