আড়ালে কে পর্ব-০৩

0
151

. #আড়ালে_কে [ #পর্ব- ৩ ] ( ১৮+ এলার্ট )
লেখক – #সালাহউদ্দিন_তারিক

নাজমুল সাহেব স্ত্রীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেন “তোর এত্তো দেমাগ কেনরে মা**গী !”
গা*লি শুনে চোখ উল্টে ওনার মুখের দিকে তাকাতে চাইল সোহানা। কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়তে পারল না সে। নাজমুল সাহেব আরো জোরে গলা টিপে বালিশের সাথে চেপে ধরল তাকে। সোহানার শ্বাসবন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। সাপের লেজের মতো পা মোচড়াতে শুরু করল সে। নাজমুল সাহেব সেদিকে একবারও খেয়াল করলেন না। এতোটাই নির্জীব ভাবে সোহানার গলা টিপে ধরে রাখল যেন খু*ন না করে থামবেন না আজ।

হঠাৎই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। নাজমুল সাহেবের যেন হুঁশ ফিরল। সোহানার গলা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলতে গেলেন তিনি। আর এদিকে ছাড়া পেয়ে কাশতে কাশতে হাঁপিয়ে উঠল সোহানা। সে এতো জোরে কাশতে ছিল, যে কেউ ভাববে তার গলা দিয়ে রক্ত বের হবে এখন। সোহানা লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার পরে দরজা খুললেন নাজমুল সাহেব। দরজার বাইরে ওনার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই বলতে শুরু করলেন, “তাড়াতাড়ি আয় বাইরে দেখ তোর মা কেমন যেন করছে।”

মুহূর্তেই যেন দম বন্ধ হয়ে আসল নাজমুল সাহেবের। দৌড়ে মায়ের রুমে গেলেন তিনি। বয়োবৃদ্ধ নারী আছিয়া খাতুন চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর ছটফট করছে। নাজমুল সাহেব দ্রুত পানির জগ থেকে আল্প পানি নিজের হাতের তালুতে নিয়ে মায়ের মাথায় দিল। ভিজা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আস্তে আস্তে। ওনার শরীর দ্রুত গরম হয়ে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে অজ্ঞানের মতো অবস্থা হয়ে গেল ওনার। নাজমুল সাহেব বুুঝতে পারলেন ওনার মায়ের প্রেশার আবারও বেড়ে গেছে। এতো রাতে এখন গাড়িও সাথে সাথে পাবেন না। আর চিকিৎসাও সব হাসপাতালে পাবেন না। কি করবেন ভেবে না পেয়ে অবশেষে একটা নতুন চকচকে সুঁইয়ের মাধ্যমে কানের লতিতে ছোট ছোট ফুটা করে দিলেন। আস্তে আস্তে গাঢ় লাল র*ক্তের ফোটা গুলো উপচে বেরুতে শুরু করল। বেশ কয়েক ফোঁটা র*ক্ত বেরিয়ে যেতেই একটু স্বাভাবিক হলেন নাজমুল সাহেবের ষাটোর্ধ বৃদ্ধা মা।

এতো রাতে আর হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভাবলেন না কেউ। মায়ের প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পন্ন কর ঘরে ফিরলেন তিনি। নিজ ঘরে ফিরে দেখলেন বিছানার উপরে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে সোহানা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ আর নাকের পানিতে পুরো বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছে সে। তিনি বিছানার উপরে একটা হাঁটু রাখতেই ভয়ে লাফিয়ে উঠে সোহানা। খাটের এক কোণে গিয়ে হাঁটু বুকে চেপে বসে থাকে ভয়ে। নাজমুল সাহেব একটু কাছে যেতেই ভয়ে আরো জড়োসড়ো হয়ে যায় সে। তার ঠোঁট, চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপতে থাকে।

নাজমুল সাহেব আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে দুইহাতে সোহানার গালদুটো চেপে ধরে। অতঃপর মুখে আফসোস সূচক শব্দ করে বলে “আহারে জানটা আমার, এ-কি অবস্থা হয়েছে তোমার! আহ্ বাবুটা কান্না করছ কেন!”

নাজমুল সাহেবের মুখে এসব আদুরে কথা বার্তায় সোহানার ভয় আরো বেড়ে যায়। ভয়ে দেয়ালের সাথে মিশে যেতে চায় সে। নাজমুল সাহেব ঠোঁট উল্টে আফসোসের শব্দ করে বলে, “আহ্ কি হয়েছে আমার বাচ্চাটার এতো ভয় কিসের আমি থাকতে!”

কথা শেষ হতেই সোহানার কোনো উত্তরের অপেক্ষা করে না সে। এক হাতে ধরে টান দিয়ে বিছানায় ফেলে তাকে। নিজেও তার পাশে শুয়ে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে স্ত্রীকে। সোহানা কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না। কি হচ্ছে এসব তার সাথে! নাজমুল সাহেব জোরে চেপে ধরে তাকে। সোহানা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই আরো জোরে চেপে ধরে তাকে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ” সোনামনি আমার বাহুর জোর তোর থেকে কম নয়।”

ফিসফিসানি কথাতে সোহানার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। শীত ও ভয়ে দাঁতের পাটি একে অপরের সাথে বাড়ি লাগতে থাকে।

.

চার…
রাত ১২ টার দিকে ঘরে ফিরেছে সিয়াম। চোখ দু’টো উত্তপ্ত লোহার মতো লাল হয়ে আছে। সাইফা কোনো কিছু জিজ্ঞেস করে না, দরজা খুলে এই অবস্থা দেখেই ভিতরে চলে যায় সে। সিয়াম দরজা লাগিয়ে ভিতরের ঘরে ঢুকে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে, “কিরে ভাত কই! ”

সাইফা কতক্ষণ চুপ করেই থাকে।
সিয়াম আবারও নেশা জড়ানো কন্ঠে বলে, “ভাত কোথায় জিজ্ঞেস করছি না?”

সাইফা নিচু গলায় উত্তর দেয়, “ঘরে কিছুই নেই। বাজার নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিলাম এজন্যই”।

সিয়াম চিৎকার করে বলে, “আমার কাছে টাকা নাই তুই শোনস নাই? ‘

সাইফা বলে, ” টাকা না থাকলেও চোখ ঠিকই লাল করতে পেরেছো। তুমি তো তাও ধুঁয়া হলেও খাইয়া আসছ। আমি সেটাও খাইনি।”

সিয়াম বসা থেকে উঠে পরে। সাইফার মুখের সামনে এসে বলে, “তোর বাপেরে ফোন দিয়া টাকা আন। ”

সাইফার চোখ বড় হয়ে যায়। সিয়াম এই কথাটা আগে কখনো বলেনি শেষ পর্যন্ত এটাও বুঝি বাকি থাকল না। মাথা নিচু করে উত্তর দেয়, “তুমি ভালো করেই জানো যে আমার সাথে বাড়ির কোনো প্রকার যোগাযোগ নাই। ”

‘ যোগাযোগ নাই তো কি হইছে! যোগাযোগ করবি।”

‘ এটা আমি পারব না। তোমার জন্যই সব কিছু ছেড়ে আসছিলাম আমি। তোমার তো এই সব কাহিনী অজানা না।’

‘ আমি কিছুই শুনতে চাই না। তুই ফোন ও দিবি, যোগাযোগ ও করবি, টাকাও আনবি।”

সাইফা চিৎকার করে বলে, ‘ আমি পারব না। তুুমি এসব ছেড়ে কাজ করতে পারলে কর। আর নয়তো না খেয়ে থাক।’

সিয়ামের মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই স্ব জোরে একটা থা*প্পড় মেরে দেয় সাইফার গালে। আকস্মিকতায় তাল সামলাতে পারে না সাইফা। বিছানা থেকে ফ্লোরে পরে যায় সে। সিয়াম সে অবস্থাতেই একের পর এক কি’ল ঘু’সি দিতে থাকে সাইফার পিঠে। একটু উঠার চেষ্টা করতেই একটা ঘু*সি সোজা সাইফার মুখে লাগে। ঠোঁট কেটে র*ক্ত পরতে থাকে তার মুখ থেকে।
অঝোরে কাঁদতে শুরু করে সাইফা। কান্নার শব্দ সিয়ামের কানে যেন ত্রিশূল এর মতো বিদ্ধ হতে থাকে। রাগে জোরে একটা লা*থি মারে সাইফার পেট বরাবর। উল্টে গিয়ে ঘরের এক কোণে শুয়ে পরে সাইফা। চিৎকার করে কাঁদতে চায় সে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুতে চায় না। পেট চেপে ধরে গোঙাতে গোঙাতে কাঁদতে থাকে।

সিয়াম আর সামনে বাড়ে না। সাইফাকে সেভাবে রেখেই ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। প্রায় বিশ মিনিট পর ঘরে ফিরে আসে। হাতে একটা ছোট্ট পলিথিন, তারমধ্যে দুইটা কেকের টুকরো আর একটা রুটি। সাইফা তখনও ঘরের কোণে পরে কাঁদছে।

সিয়াম পলিথিনটা ছুঁড়ে দেয় সাইফার উপরে। রাগে গজগজ করে বলে, ‘তাড়াতাড়ি আমার সামনে থেকে বিদায় হ। তোর কান্দা দেখে মাথায় র*ক্ত উঠতাছি। ‘

সাইফার কিছুই করার থাকে না। খিদায় পেট চোঁ-চোঁ করছে। তারমধ্যে এই খালি পেটেই আবার লা*থি লেগেছে। পেটের ব্যাথায় সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারে না সে। এক হাতে খাবারের পলিথিনটা নিয়ে অন্য হাতে পেট চেপে ধরে কুঁজো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে রান্না ঘরে চলে যায় সে। মেঝেতে বসে পলিথিন থেকে একটা কেকের একটা টুকরো বের করে। কাঁদতে কাঁদতে তার গলা শুকিয়ে গেছে। শুকনো গলা দিয়ে কেক নামতে চায় না। অল্প কেকের সাথে এক ঢোকর করে পানিও গিলতে হয় তাকে। পেটের ব্যাথায় চোখ দিয়ে গরম জল গড়িয়ে পরছে, তার সাথে সাথে নাকের পানিও সমানে বের হচ্ছে। নাক-চোখের পানি একসাথে হয়ে মুখে ঢুকে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে।

জামার হাতা দিয়ে নাক পরিষ্কার করে সাইফা। নিজের সাথে হওয়া ভয়ানক অত্যাচারের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কাঁদে আর অল্প অল্প খাবার মুখে দেয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, সব লজ্জার মাথা খেয়ে বাড়িতে কল দিবে সে। যেভাবেই হোক বাবা-মা অথবা বড় ভাইদের বুঝিয়ে কিছু টাকা আনতে হবে। আর নয়তো এই জাহান্নামের অংশ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলতে হবে।

খাওয়া শেষ করে ফ্রেশ হয়ে নেয় সাইফা। সিয়ামের পাশে শোয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই তার। তাই একটা পাতলা কাঁথা বিছিয়ে ফ্লোরেই শুয়ে পরে সে। বিষয়টা সিয়ামের নজরে আসতেই বলে, ‘মাটিতে শুয়ে ঠান্ডা লাগাইলে চিকিৎসা কি তোর বাপে এসে করবে? চুপচাপ উপরে আইসা ঘুমা।”

সিয়ামের মুখের উপরে কথা বলার সাহস হয় না তার। চুপচাপ বিছানায় উঠে তার পাশেই শুতে হয় তাকে।

পরদিন সকালে কাজে যায় না সিয়াম। সাইফা তাগাদা দেয়, ‘ঘরে রান্না করার কিছুই নাই। কাজে না গেলেও যেমনে পারো কিছু নিয়ে আসো রান্না তো করতে হবে।’

সিয়াম উত্তর দেয়, ‘পকেটে টাকা নাই, ঘরেও নাই। তোর বাপেরে ফোন দিয়া বল টাকা পাঠাইতে।’

সাইফা না না করতে থাকে। সিয়াম তার কোনো কথাই শুনতে চায় না। চুলের মুঠিতে ধরে সাইফার হাতে মোবাইল দিয়ে বলে, “এক্ষুনি কল দে।”

বাধ্য হয়ে বাবার নাম্বারে কল দিতে হয় তাকে। কয়েকবার রিং হতেই কল রিসিভ করে রফিক সাহেব। জিজ্ঞেস করে, ‘কে বলছেন?’

সাইফা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে, ‘আব্বু আমি সাইফা।’

– ‘ কোন সাইফা? আমি এই নামে কাউকে চিনি না।’

– ‘ আমি তোমার মেয়ে সাইফা। তুমি আমাকে না চেনার ভান করছ কেন আব্বু।’

ওপাশ থেকে কোনো কথা আসে না। রফিক সাহেব ফোন কেটে দিয়ে সাথে সাথেই মোবাইল বন্ধ করে দেয়। সাইফা বারবার কল দেয়। কিন্তু আর সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না।

সিয়াম তার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নেয়। তারপর কানের কাছে চিৎকার করে বলে, “তোর বাপেও তোকে চিনে না? তুই বাইচ্চা থাইকা কি করবি তবে?’

সাইফা চোখ উল্টে তাকায় সিয়ামের দিকে। জিজ্ঞেস করে, ‘কি বলছ এসব?’

সিয়াম উত্তর দেয়, ‘কি বলছি তুই বুঝস না? তুই আজকার ভিতরে টাকা আনবি, তোর ভাইয়েরে ফোন দে এক্ষুনি।’

সাইফা এবার সরাসরি না করে দেয়। সিয়ামের মাথায় যে রক্ত উঠে যায়। চুল মুঠি করে ধরে ঝাঁকাতে থাকে সাইফাকে। সাইফার মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে সে। শুরু হয়ে যায় দুজনের ধস্তাধস্তি।
ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সাইফার ঘাড় ধরে দেয়ালের দিকে ধাক্কা দেয় সিয়াম। সাইফা কোনো রকমে নিজেকে সামলে নেয়। সিয়াম আবারও এসে তার চুলে ধরতে চায়। সাইফা এবার উল্টো সিয়ামকে ধাক্কা মারে। সিয়ামের মেজাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, নেশা থেকে উৎপন্ন হওয়া বিষাক্ত পোকা গুলো মস্তিষ্কে কামড়াতে শুরু করে। ডান হাতে শরীরের সবটুকু শক্তিতে সাইফার বাম কানে থা*প্পড় দেয় সে। সাইফা নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। খাটের এক কোণে বাড়ি খায় তার মাথা। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায় সে।

সিয়াম তখনও একের পর এক লা*থি দিতে থাকে সাইফার পিঠে। একবারের জন্যও তার নজরে আসে না লাল র*ক্তের ফোয়ারা। র*ক্ত গড়িয়ে যখন মেঝের মাঝখানে চলে আসে তখন সেটা নজরে আসে তার। ভয়ে তার কলিজা শুকিয়ে যায়, ধপাস করে ফ্লোরে বসে পরে সে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে…..।

( চলবে ইন শা আল্লাহ….)