আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-১১+১২

0
200

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ১১)
নুসরাত জাহান লিজা

“এই ছেলেটার যে কী হবে জীবনে কে জানে? কোনো লক্ষ্য নাই, উদ্দেশ্য নাই, হাল ছাড়া নৌকা নিয়ে সমুদ্রে নেমে কী লাভ? কোন ফ্যামিলি এই ছেলের কাছে নিজেদের মেয়ে দিব? আমি হইলে তো কোনোদিনও দিতাম না।”

অবন্তী নিজের রুমে বসে বসে প্র‍্যাকটিকেল খাতা ঠিক করছিল। মা পাশে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু কথা বলে অয়নের প্রসঙ্গ তুললেন। অবন্তী কাজ থামিয়ে শার্পনার দিয়ে পেন্সিল কাটতে কাটতে মায়ের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো। এরপর মুখ খুলল,

“আম্মু, তুমি এসব কথা আমাকে শোনাচ্ছ কেন হঠাৎ? তোমাকে কেউ তোমার মেয়েকে ওই ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে বলে নাই!”

“আমার মেয়ের এতটাও খারাপ দিন আসে নাই যে ওমন ছন্নছাড়া, বোহেমিয়ান ছেলের সাথে তারে বিয়ে দেব।”

অবন্তী খেয়াল করেছে মা ইদানিং সুযোগ পেলেই অয়নকে কটাক্ষ করতে ছাড়েন না। আগে সেভাবে গা না করলেও আজ কিছুটা ভাবতেই কারণটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হলো। মা ওর ভেতরটা কিছুটা হলেও পড়ে ফেলেছেন। আজ ধরা পড়েও অবন্তী মনকে শান্ত রাখতে পারল। তবে ভেতরে ভেতরে একটা রোখ চেপে গেল।

“আম্মু, তোমাকে এসব কিছুই বলতে হবে না। তোমার এসব ভণিতা ভালো লাগছে না। যা বলার সরাসরি বলো।”

“তুই বিয়েটা আসলে কী জন্যে ভেঙেছিস আমি জানি না ভেবেছিস? তুই আমার পেট থেকে বেরিয়েছিস, তোর সব নাড়ি নক্ষত্র আমার চেনা আছে।”

মায়ের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে বুকে অদ্ভুত একটা জ্বালা ধরে যায়, সাথে অয়নের প্রত্যাখ্যানের ব্যথা টনটনিয়ে ওঠে।

“অয়নকে নিয়ে আমার মধ্যে কিছু নেই আম্মু। তুমি তোমার এই ঘ্যানঘ্যানানি বন্ধ করো। আমার এখন ফালতু বকবক শুনে নষ্ট করার মতো সময় নেই।”

“তুই ওর মতো চরম বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস অন্তি। মায়ের সাথে কথা বলছিস সেটা ভুলে যাস না।” কাটাকাটা গলায় রোকেয়া বলে উঠলেন।

অবন্তী এবার আর পাত্তা দিল না, মনে বয়ে যাওয়া প্রলয় সামলে নিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করল। রোকেয়া আবারও মেয়েকে তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে বললেন,

“তেমন না হলেই ভালো। কথাটা সবসময় মাথায় রাখিস।”

কথা শেষ করে রোকেয়া হনহনিয়ে বেরিয়ে যান। অবন্তী মায়ের যাওয়ার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল। নিজের মাকে কেমন অচেনা মনে হচ্ছে। মানুষ এভাবে আচমকা বদলে যায় কেন?

প্র‍্যাকটিকেল খাতার এ-ফোর কাগজের ওপরেই মাথা গুঁজে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। না চাইতেই চোখ বেয়ে বান ডাকল। ভালোবাসায় এমন যন্ত্রণা কেন? হৃদয় পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। অথচ বাইরে থেকে কেউ তার বিন্দুমাত্র আঁচ পাচ্ছে না! হু হু বিষাদের সাথে অবন্তীর মনে এক পৃথিবী অভিমান জমা হলো!

***
“খুন্তি, এই রাত দুপুরে ছাদে আসার অভ্যাস তোর আর গেল না।”

অবন্তী অয়নের দিকে একবার চোখ তুলে চাইল, কোনো উত্তর দিল না। সেমিস্টার ফাইনাল চলছে, রাত জেগে পড়তে হচ্ছে, মাথা ঝিম ধরে গেছে বলে ছাদে এসেছে। আজ আকাশে ঘুটঘুটে কালো মেঘ ঘিরে আছে, কেমন ভ্যাপসা গরমে প্রাণ জেরবার। সেভাবে বাতাস নেই, এমন গোমট রাত অবন্তীর একদম ভালো লাগে না। শূন্যতা বেড়ে যেন কয়েকগুণ হয়ে যায়!

“অভ্যাস তো অভ্যাসই। তুই কি কোনো অভ্যাস বদলেছিস জীবনে?”

“আমি তো নিজেই বদলে গেছি রে খুন্তি। অভ্যাস আমার কাছে খুবই ঠুনকো।” অয়নের মুখে অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু বর্ণচোরা ছেলেটা সেটা মুহূর্তেই লুকিয়ে ফেলেছে।

“অবশ্য বাপ মায়ের সোনার টুকরা মেয়ের একটু আহ্লাদ না করলে মানায় না। আছিস তো ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ডে, বাস্তবতা কেমনে বুঝবি? তাই কথায় কথায় ইমোশন চুয়ে চুয়ে পড়ে।” অয়ন কটাক্ষ হেনে বলল কথাটা।

অবন্তীর খুব রাগ হলো, সে যথেষ্ট প্র‍্যাকটিকেল। অয়ন যে ওর ভালোবাসা নিয়ে খোঁচা দেবে সেটা সে সেদিনই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তাই বলে কথায় কথায় সেটাকে স্মরণ করিয়ে গভীর ক্ষতে বারবার আঘাত করবে এতটাও অমানবিক ভাবেতে পারেনি। তাই পাল্টা আক্রমণ করে বসে সে।

“আমার ইমোশন চুয়ে চুয়ে পড়ে আর তোরটা কী? অন্যকে ঠিকই বলা যায়, নিজে করতে গেলে তখন সেটা বোঝা যায়। এত যদি বুঝতি তাহলে চাচাকে একটু স্বস্তি দিতি। বাসার সবাইকে এমন অশান্তির মধ্যে রাখতি না।”

“আমি সবাইকে অশান্তির মধ্যে রাখছি?”

“তা নয়তো কী? প্রত্যেকদিন তুই অশান্তি করিস। এই বাসায় যত সমস্যা হয় সব তোর জন্য। তুই যত নষ্টের গোঁড়া। নিজের রাগ, জেদ বজায় রাখার জন্য তুই এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিস। মানুষের ইমোশন তোর হাসি-ঠাট্টার জিনিস। তুই…”

অবন্তী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কেবল বলেই গেল, অয়নের দিকে চোখ পড়তেই সহসা থমকে গেল। ছেলেটার চোখে আজ যেন অবর্ণনীয় বিষাদ ফুটে উঠেছে। কিন্তু কথা ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো সিস্টেম ওর জানা নেই। নিজের রাগটাকে যে কেন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না!

অয়ন আচমকা সশব্দে হেসে উঠল, হাসির দমকে যেন চারপাশ কেঁপে কেঁপে উঠছে! কী অপ্রকৃতস্থ সেই হাসি! কৃষ্ণপক্ষের মরে আসা আলোয় কেমন অদ্ভুত একটা আবহ তৈরি হয়েছে!

অয়নের হাসিটা যেভাবে শুরু হয়েছিল তেমন আচমকা ভাবেই থেমে গেল, নিমিষেই অয়ন নিজেকে গাম্ভীর্যের খোলসে ঢেকে ফেলল।

“ঠিকই বলেছিস বোধহয়! আমি খুব খারাপ। আমার অনুভূতি নাই, কষ্ট নাই, দুঃখ নাই৷ হেসে খেলে আমি নিজের জীবন নষ্ট করেছি।”

আবারও সেই অপ্রকৃতস্থ হাসি হাসতে থাকল। অবন্তীর ভারি অনুশোচনা হলো, মরমে মরে গেল। কেন এসব বলতে গেল! সব তো সত্যি নয়! এক পৃথিবী মায়া আবারও টানতে লাগল এই ছন্নছাড়া ছেলেটার দিকে। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, মায়া প্রতিস্থাপিত হলো ভয়ংকর রাগে!

“আর তুই কী? তুই একটা চরম বদরাগী, জেদি, বিরক্তিকর একটা মেয়ে। আমি এত খারাপ জেনেও যেচে পড়ে কেন আমাকে প্রপোজ করেছিলি? তখনও আমি যা ছিলাম এখনো তাই আছি। আসলে তুই একটা চরম স্বার্থপর। তোকে ফিরিয়ে দিয়েছি বলে তোর আঁতে ঘা লেগেছে, সেই জন্য এখন নিজের প্রত্যাখ্যাত হবার জ্বালা জোড়াতে এসব বলতেছিস। তোকে আমি চিনি না ভেবেছিস?”

অয়নের এসব কথা সহ্য করার মতো ধৈর্য অবন্তীর নেই। ওর ভালোবাসাকে এতটা ছোট করার, নিচে নামানোর স্পর্ধা কেউ দেখাবে আর সে চেয়ে চেয়ে সেটা হজম করবে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

ভয়াবহ রাগে প্রবল শক্তিতে নিজের হাতটা অয়নের গালে নামিয়ে আনল। রাগে থরথর করে কাঁপছে অবন্তী। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল,

“তুই আর কোনোদিন আমার সাথে কথা বলতে আসবি না। আমার এখন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে, কেন তোর মতো একটা ইতর প্রজাতির ছেলেকে আমি ভালোবেসেছিলাম! সেটা আবার বড় গলা করে তোকে জানিয়েওছিলাম। ছি! নিজেকে এতটা ছোট করেছি ভাবতেই…”

গলা ভেঙে আসছে বলে আর কথা বাড়ায় না অবন্তী। দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে গেল। আজ যেন আলোর গতিতে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো। দরজার ছিটকিনি টেনে দিয়ে সেখানেই বসে রইল। নিজের আবেগ আর কোনোদিন কাউকে দেখাবে না! যথেষ্ট হয়েছে নিজেকে ছোট করা। অয়নকে মাথা থেকে চিরতরে ঝেড়ে ফেলবে সে! মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে বসল ভেঙে পড়া অবন্তী!

***
অয়ন এখনো গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে এই কৃষ্ণপক্ষ রাতের সাথে নিজের মিল খুঁজতে ব্যস্ত। আজকের আকাশে একটা দুটো দলছুট তারার মতো সে নিজেও বড্ড একা। জীবনের সাথে লড়াই করতে করতে সে এখন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত।

একটু শান্তির খুঁজে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। যেখানে জীবনের কোনো জঞ্জাল, জটিলতা কিছুই থাকবে না। কেবল স্বপ্নে দেখা এক টুকরো শান্তি থাকবে, বহুদিন ঘুমাতে পারে না, একটু নির্ঝঞ্ঝাট ঘুম কত আকাঙ্ক্ষিত! কার্নিশের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে চোখ বন্ধ করল।

ভেতরটা কেমন চূড়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে, অয়ন না চাইতেই সেই ভাঙ্গনের শব্দ শুনছে! প্রাণপণে চেষ্টা করছে সেটা বন্ধ করার, কিন্তু মনের ভাঙ্গা গড়ার উপরে কি কারোর নিয়ন্ত্রণ থাকে! নীল নীল বিষাদ ওর হৃদপিণ্ডে বিষদাঁত দিয়ে যেন কামড় বসাচ্ছে প্রতিনিয়ত!
………
(ক্রমশ)

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ১২)
নুসরাত জাহান লিজা

সকালে এমদাদ সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে বের হচ্ছিলেন এই সময় হটাৎ করে শরীরটা দুলে উঠল। শিউলি বাবাকে নিরস্ত করে নিজেই বাজারে চলে এসেছে। খুব বেশি দূরে না হওয়ায় হেঁটেই যাবার সিদ্ধান্ত নিল। অনেকদিন থেকে ঘরে বসে থাকতে থাকতে হাঁপ ধরে গেছে। সকালে খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বাতাসে হাঁটতে খুব একটা মন্দ লাগবে না ভেবেছিল। কিন্তু পথে পরিচিত একজন প্রতিবেশির সাথে দেখা হলো, তিনি সকালের হাঁটা শেষে বাসায় ফিরছিলেন। তাকে দেখে সৌজন্যতাবশত শিউলিকে দাঁড়াতে হলো। শিউলিকে দেখে তিনি বললেন,

“আরে শিউলি যে, শেফালি ভাবিরে তো এখন দেখাই যায় না। আগে প্রায়ই আসত। কিছু হইসে তোমাদের বাসায়?”

“না আন্টি, কিছু হয় নাই তো। এমনিই শরীর একটু খারাপ।”

“তা তো একটু স্বাভাবিক। এমনিতেই বয়স বাড়তেছে, কিছুটা টেনশন তো থাকবই।”

মেকি সহানুভূতির ছাপ সরে গিয়ে কৌতূহলী হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো মনে হয় মাস খানেক হইল আসছো তাই না? তা আর কতদিন আছো গো মা?”

শিউলি জানে প্রশ্নটা শুধু ওকে একটা খোঁচা দিতেই করা, এটা প্রায় পুরো পাড়ার মানুষই জানে এখন। তবুও মানুষের পরশ্রীকাতরতার এই স্বভাব কেন যে যায় না! নিজের ঘরের কত ভালো-মন্দ হিসেব নিকেশ মিলিয়ে শেষ করা যায় না, আর এদিকে কত মানুষ অন্যের হাঁড়ির খবর নিতে ব্যস্ত! এত সময় মানুষের! অথচ ভালো কোনো খবর বাড়ি বয়ে দিয়ে আসলেও তাদের চোখ কান বন্ধ থাকে। কী বিচিত্র মানসিকতা!

শিউলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্বিকার গলায় বলল,
“আন্টি, আমি এখানেই আছি। চলে আসছি একবারে। আর যাব না।”

তিনি মুখ দিয়ে সহানুভূতিসূচক শব্দ করলেন, এরপর বললেন,
“আহারে, তুমি কষ্ট পাইয়ো না মা। জীবন আর কয়দিন! তবে আমার ভাল্লাগলো যে তুমি শোক কাটায়ে উঠছো। যার মায়া যত কম, সে দুনিয়ায় সবচেয়ে সুখী মানুষ।”
তার কথাগুলোর সাথে শিউলি পুরোপুরি একমত না হলেও, একেবারে ফেলেও দিতে পারল না।

“যার সাথে মনের কোনো টান নাই, তার জন্য দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে ঘুরার তো কিছু নাই আন্টি। অপাত্রে মায়া করলে শুধু শুধু মায়ার অপচয়! তাতে করে লাভটা কী? খালি খালি নিজের অপমান ছাড়া?”

“তুমি অনেক শক্ত মা। এরকম করে কয়জন চিন্তা করে! অনেক দোয়া থাকল মা। ভালো থাইকো। তোমার মায়েরে আমার বাসায় যাইতে বইলো।”

আন্টি বিদায় নিলেও শিউলির মনে তার রেশ রইল বেশ কিছুক্ষণ। শেষের দোয়াটা তিনি মন থেকেই করেছেন! শুধুমাত্র শেষটুকুর জন্যই তার প্রথমদিকের অযাচিত আলাপ মাফ করে দিল শিউলি। দিনশেষে ভালো মন্দের মিশেলেই তো মানুষ।

বাজার করে ফেরার সময় সাজিদের সাথে দেখা হলো। একই স্কুলে এসএসসি পর্যন্ত পড়েছে। মানুষটাকে বিশেষভাবে মনে রাখার একটা কারণ অবশ্য আছে, এই ছেলেটা যে ওর দিকে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকাত তা বিদায়ী বছরে বেশ ভালো করে বুঝতে পেরেছিল। ইন্টারমিডিয়েটে গার্লস কলেজে ভর্তি হয়েছিল বলে সেভাবে জমিয়ে ওঠতে পারেনি। তবুও কলেজের মোড়ে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত সাজিদকে। কখনো চোখে চোখ পড়ে গেলেই টুপ করে পালিয়ে যেত।

আচ্ছা, সাজিদ যদি একটু সাহসী হয়ে ওকে কিছু বলতো, তাহলে কি ওর জীবনটা অন্যরকম হতো! নাকি সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা বিবর্ণ হয়ে যেত! নিজের ভাবনায় শিউলি নিজেই বিরক্ত হলো। সেই কবেকার কোন সাজিদ, সে কি এখনো কৈশোরের একটা না হওয়া ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করবে? শিউলি নিজেই যে বড্ড ফিঁকে, তার জীবনে আর কিছু হবার নেই।

সাজিদ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আরে শিউলি না? তোমারে কতদিন পরে দেখলাম! আমারে চিনছো?”

“চিনব না কেন? কী অবস্থা এখন তোমার?”

“আল্লাহ ভালোই রাখছে। আম্মা বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতেছে। ভাবতেছি এইবার বিয়েটা করেই ফেলব।”

“তাইলে তো ভালোই চলছে মনে হয়!”

“তা চলতেছে। তোমার সংসারের খবর বলো।”

শিউলির স্মিত হাসিমুখ সহসাই মিইয়ে গেল, নিজেকে সামলে নিয়ে পাশ কাটিয়ে বলল, “তোমার বিয়েতে দাওয়াত দিও। আজ আসি, পরে কথা হবে।”

কথা শেষ করে দ্রুত পা চালিয়ে চলে এলো, অপ্রিয় কথা বলতে একদমই ভালো লাগে না। ভাবনায় বুঁদ হয়ে হাঁটছিল, আচমকা কোত্থেকে তুহিনের উদয় হলো সামনে। আজ যেন প্রকৃতি শিউলির সাথে আঁড়ি নিয়েছে। সারি বেঁধে পরিচিত মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। তবে কথা শুনে বুঝতে পারল বাকিদের সাথে দেখা হওয়া কাকতালীয় হলেও তুহিন তাকে অনুসরণ করছিল।

“ভালো ভালো! এইজন্য তোমার ডিভোর্স নেওয়ার এত তাড়া? আইজ আমি হাতেনাতে ধরছি। কয়টা নাগর লাগে তোর?”

কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল, ইচ্ছে হলো ঠাটিয়ে চড় মেরে দিতে। কিন্তু বাজারে লোক সমাগম ভালোই। তাই এই মুহূর্তে নিজেকে দমিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তবে মুখকে থামাতে পারল না, শিউলি বিরস মুখে বলল,

“সবাইকে নিজের মতো ভাবা বন্ধ করো। অবশ্য তোমারে এইসব বলে ফায়দা নাই, কুত্তার লেজ সারাজীবন বাঁকাই থাকে।”

“তুমি আমারে ইন্ডিরেক্টিলি কুত্তা বললা? তোমার সাহস…”

বাকিটা বলার আগেই শিউলি বলল, “এই তো বুঝতে পারছো। ভালো। আমার পরিশ্রম কমছে।”

একটা রিকশা পেয়ে তাতে উঠে বসল, এভাবে আর কার সাথে না কার সাথে আবার দেখা হয়ে যায় কে জানে! কিন্তু শিউলির আজ কারো প্রশ্নের উত্তর দেবার ইচ্ছে নেই। কেবল ডুব দিতে ইচ্ছে করছে নিজের অন্তঃপুরে!

***
আজ বড়চাচা সকাল সকাল বেরিয়ে গেছেন। খাবার টেবিলের অশান্তি হীন সুন্দরভাবে শুরু হওয়া একটা দিন। অয়নকে আজ অনেকদিন পরে দেখছে অবন্তী। সেই ঘটনার পরে এই দেড় মাসে কখনো সামনে পরে গেলে দু’জনেই প্রাণপণে এড়িয়ে গেছে সচেতনভাবে। আজ অবন্তী মা আর চাচীর সাথে খাচ্ছিল, তখন অয়ন এসে বসল। খেতে খেতে হঠাৎ করে বলল,

“মা, আমারে কিছু টাকা দিও তো, দরকার ছিল।”

“কত?”

“তিনশো হলেই হবে। মাসের এই কয়দিন আর জ্বালাব না।”

“কী করবি?”

“দিতে হবে না, এত কৈফিয়ত দিতে ভালো লাগে না।”

অয়ন হাত ধুয়ে উঠে পড়ল। অবন্তীর মনের উপরে চেপে বসা বোঝাটা আরও ভার হলো। অয়ন তাহলে ওর সাথে সবরকম সম্পর্ক চুকিয়েই দিয়েছে। আগে এমন করে টাকার আবদারগুলো নিয়ে ওর কাছেই আসত। অবন্তী শুধু অয়নের জন্য টাকা জমাত, যাতে নিরাশ না করতে হয়। এই মাসেও জমিয়েছে। কিন্তু সেসবের বুঝি আর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য পাওয়া হলো না। সব তবে চুকে বুকেই যাক একেবারে, চিরতরে!

অবন্তী খেয়ে উঠে গেল, তাকেও ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। আজকে শেষ প্র‍্যাকটিকেল পরীক্ষা।

***
অয়ন সব ঠিকঠাক নিয়েছে কিনা চেক করে বাইরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অয়নের মা এসে দাঁড়ালেন। হাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট। ছেলেটা বাবার সাথে সাথে তার সাথেও একটা অলিখিত দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে। তবুও ছেলেকে তিনি সবসময় বোঝার চেষ্টা করেন। ক’দিন ধরে যে অয়নের চলাফেরার স্বাভাবিক ছন্দ ব্যাহত হয়েছে এটা তিনি ভালোই উপলব্ধি করেন।

তার ছেলের কী এত দুঃখ! আজ তার মনে হলো তার হয়তো ছেলেকে আরও বোঝার চেষ্টা করা উচিত ছিল, আরেকটু আগলে রাখা উচিত ছিল। অভিমানে ছেলে দূরে যেতে চাইলেই কী তাকে সরিয়ে দিতে হবে? আরও কেন আগলে রাখলেন না, বহুদিন পরে মা হিসেবে নিজেকে কেন যেন ব্যর্থ মনে হলো তার।

“তোর কী হয়েছে বাবা? কেমন যেন উদাসীন মনে হচ্ছে কয়েকদিন থেকে?”

“সিরিয়াসলি কয়েকদিন থেকে? তোমাদের কাছে তো আমারে সারাজীবনই উদাসীন মনে হইছে!”

“মাকে বলা যায় না? কষ্ট মনে চেপে রাখলে দেখবি, বুকে পাহাড় চেপে বসবে। একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নে বাবা।”

অয়নের চোখে কীসের এক অদ্ভুত শূন্যতা যেন, কিন্তু মুখে কটাক্ষ মাখা হাসি। একটু বুঝি চমকে উঠল, তারপর সামলে নিয়ে বলল,

“এতদিন পরে এটা তোমার কেন মনে হলো মা? বুকে চেপে বসা হিমালয় এখন আমি কী করে ঠেলে ফেলব, মা? এত শক্তি তো আমার নেই। চোরাবালিতে গলা পর্যন্ত তলিয়ে গেলে সেখান থেকে ক’জন আর বাঁচে? আমার সব তো শেষ হয়ে গেছে। সব সবুজ হারিয়ে গেছে। এখন মরা ডালপালা ছাড়া আমার আর কিছু নেই।”

সুফিয়ার খুব ইচ্ছে হলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে স্নেহের পরশ ছুঁইয়ে দিতে, কিন্তু দীর্ঘ দিনের অনভ্যস্ততায় সেটা তিনি পারলেন না। নিজের কাছে অপরাধবোধের বোঝাটা বড্ড ভারী ঠেকল! অয়ন একবার মা’য়ের দিকে তাকিয়ে টাকাটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।

সুফিয়ার মনে হলো, তার ছেলেটা এমন দূরের মানুষ কেন হয়ে গেল! সেই ছোট্ট অয়নের একটু কষ্ট হলেই একসময় মনে হতো তিনি বোধহয় মরে যাচ্ছেন। সেই অয়ন এত বড় হয়ে গেল, ওর এতটা কষ্ট গেল। কই, তিনি তো ছেলের মাথায় হাত বুলাতে পারেননি। আজ তার ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে! বেশিই কঠোর হয়েছিলেন বোধহয়! তারা তো ভালোই চেয়েছিলেন, সব এভাবে উল্টে গেল কেন তবে? বুক নিংড়ে হাহাকার বেরিয়ে এলো।

***
শাফিন আর অবন্তী ভাইভা শেষ হতেই হাঁটতে হাঁটতে জব্বারের মোড়ে এলো। রেললাইন বসে মালাই চায়ের অর্ডার দিল।

“দোস্ত, তুই তাইলে বাসায় যাবি কাল?”

“হ্যাঁ, পরীক্ষা তো শেষ। ফোর-টু’র ক্লাস শুরু হইলেই চলে আসব। বাসার কী অবস্থা বুঝিসই তো।”

“হুম।” কেমন উদাস হয়ে যায় অবন্তী, ওকে আজকাল ভীষণ অচেনা লাগে শাফিনের কাছে। কখনো খুব বেশি অকারণ উচ্ছ্বাস দেখায়, তো কখনো গুম মেরে বসে থাকে। কেমন যেন একটা অস্বাভাবিকতা, একটা গুমোট মেঘে ঘেরা থাকে অবন্তীর মনটা। কী হয়েছে ওর?

ভাবে যত দ্রুত সম্ভব মনের কথাটা বলে দিতে হবে, এই মেয়েটাকে ছাড়া কেমন যেন দম বন্ধ লাগে। অবন্তী মাঝে দু’দিন আসেনি, তখন অনুভূতিটা আরও ভালো করে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এবার ফিরেই নিজের ভেতরে বন্দী থাকা অনুভূতির ছিপি খুলে দেবে অতল চোখের মেয়েটার কাছে, ভাবল শাফিন। ফলাফল কী হবে সে জানে না! ভয়টা প্রগাঢ় হয়, অবন্তীকে হারানোর ভয়!
…….
(ক্রমশ)