আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-১৩

0
183

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ১৩)
নুসরাত জাহান লিজা

অয়ন মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। সে জুনায়েদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। কী একটা কারণে নাকি ওকে ডেকেছে, রনির মাধ্যমে জরুরি তলব করা হয়েছে জেনে এখানে এসেছে৷ অয়নের সাথে তার সম্পর্ক কখনো মাখো-মাখো হয়নি আবার কোনো শত্রুতাও নেই। এটা তাদের আড্ডাখানা, তারা অবশ্য এটাকে ক্লাবঘরই বলে। বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ভেতরে ঢুকল।

“আরে, অয়ন। আসো, আসো। কী খবর তোমার?” মহিউদ্দিন হেসে প্রশ্ন করল।

“এই তো ভাই, চলতেছে ঠিকঠাক।”

“বসো। কী খাবা বলো।”

“ভাই, একটা জরুরি কথা বলবেন বলছিলেন।”

অয়নের এখন কেন যেন বাড়তি কথা ভালো লাগে না, তবে বলেই বুঝল কথাটা হয়তো খুব বেশি রূঢ় হয়ে গেছে৷ তাই সামলে নিয়ে বলল, “আসলে আমার একটু তাড়া ছিল, ভাই।”

মহিউদ্দিন তবুও চা আনানোর ব্যবস্থা করল, চা এলে তাতে চুমুক দিয়ে মুখ খুলল,
“দ্যাখো অয়ন, তোমারে আমি নিজের লোক মনে করি। নিজের লোকের বিপদ বুইঝা তো আর লেজ গুটায়ে বইসা থাকবার পারি না। তাই ভাবলাম তোমারে একটু সাবধান করি।”

অয়ন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালে মহিউদ্দিন আবারও বলল, “জুনায়েদ হারামজাদা তোমার পিছে পড়ছে শুনলাম৷ ওইটা একটা গোখরা সাপ। কহন ছোবল দিব বুঝবারই পারবা না৷ তাই সবসময় সাবধান থাকবা।”

মহিউদ্দিনের এমন দরদ মাখা কথায় অয়ন প্রথমে কিছুটা অবাক হয়েছিল, তবে এবার আসল ঘটনা বুঝতে পারল। অয়ন কারোর ধার ধারে না তেমন, নিজের মর্জি মতো চলে। একজনের সাথে যেহেতু দ্বন্দ্ব, তাই প্রতিপক্ষ হয়তো ভেবেছে ওকে সহজেই দলে টানা যাবে। টুকটাক ভালো সম্পর্ক তো আছেই।

অয়ন উত্তরে শুধু বলল, “আচ্ছা ভাই সাবধান থাকব।”

মুখে বলল বটে, তবে অয়ন মনে মনে জানে ওর জীবনে আর ভালো কিছু হবার নেই। অন্যের ইচ্ছের পুতুল হবার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে অতল স্রোতে। এই যে আর নতুন করে কিছু হারাবার নেই, এই ভাবনাটাই বোধহয় অয়নকে আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। ভয়ংকর স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে একদিন হয়তো মাঝ সমুদ্রে ডুবে মরব, হারিয়ে যাবে অতলে। গন্তব্যে আর কখনো পৌঁছাতে পারবে না, নিজের নীড়েও ফেরা হবে না। এটা সে বেশ ভালো করে জানে।

“মুখে মুখে সাবধানে থাকলে কী হবে ব্যাটা। দাঁড়া, তোরে আসল জিনিস দেই।”

মহিউদ্দিনের কথায় সম্বিতে ফিরল অয়ন। প্যান্টের পেছনে গুঁজে রাখা কিছু একটা বের করল, সামনে আনতেই অয়ন কিছুটা কেঁপে উঠল। পিস্তল!

“এইটা রাখ। এইটা হইতেছে শক্তি৷ বুঝলি ব্যাটা৷ সাথে থাকলে মনে বল পাবি।”

অয়ন দেখল মহিউদ্দিন ‘তুই’তে নেমে এসেছে। ভেবেই নিয়েছে অয়ন গদগদ হয়ে তার দলে ভিড়ে যাবে।

“ভাই, এইটা আমি এখন নিতে পারব না। যদি কোনোদিন দরকার হয় তখন নিবোনে।”

“আরে ব্যাটা, বিপদ কী তরে বইলা আসব নাকি৷ তখন বিপদরে কইবি একটু দাঁড়া আমি তোরে ভাগানোর ব্যবস্থা করি, তারপর আসিস? এমনে কিছু হয় রে?”

অয়ন তবুও কিছু বলল না, মহিউদ্দিন নিজেই আবার বলল, “জলে নেমে কুমিরের সাথে খালি হাতে যুদ্ধে নামলে কুমিরের পেটে যাওন ছাড়া আর কোনো লাভ হইত না। বরং কুমির শিকারের হাতিয়ার সাথে রাখলে বাঁচবার পারবি। আমি তোর ভালো চাইতেছি।”

মহিউদ্দিনের মতো লোক বিনা স্বার্থে কিছু করবে এটা শুনে অয়নের কিছুটা হাসি পেয়ে গেল। বরং অয়নকে দলে টানটে পারলে তার ভালো লাভ আছে। জুনায়েদের প্রভাব তার থেকে অনেক বেশি, এভাবে যদি ওকে উস্কে দেয়া যায় তাহলে শত্রুকে চাপে রাখা যাবে। অয়ন বোকা নয় যে এটুকু বুঝবে না। মানুষের এই কপটতা ওকে সবচাইতে বেশি কষ্ট দেয়।

কপট লোকেরা মনে করে তাদের এই ভণ্ডামি কেউ ধরতে পারছে না, তাই ইচ্ছেমতো নিজেকে জাহির করার খেলায় মত্ত হয়ে যায়। অথচ খুব বেশি বোকা না হলে তাদের এই ভাণ ধরে ফেলা কঠিন কিছুই নয়। তবুও মানুষ মিছেই কেন এই অপচেষ্টায় মেতে নিজেকে প্রতিনিয়ত ছোট করে ভেবে পায় না অয়ন!

এমন মেকি ভালোবাসার কোনো প্রয়োজন তার নেই। অয়নের এমন ভালোবাসা দরকার যা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ওর বুভুক্ষু হৃদয়ে প্রশান্তি ঢালবে। সেই ভালোবাসা কখনো অয়নের জীবনে আসবে না, সে জানে। বালুচরে ঘর বেঁধে কী লাভ, যদি ভেঙেই যায়, এক পলকা ঢেউয়ে যে জিনিসের অস্তিত্ব হারিয়ে যায়, সেই জিনিস চেয়ে মাথা কুটে মরার কোনো মানে হয়!

অয়ন বেরিয়ে এলো, রনির পিছুডাকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“তুই এইভাবে আইসা পড়লি কেন? ভাই কিন্তু মাইন্ড করছে।”

“রনি, কেউ মাইন্ড করল না কী করল না, এইটা ভাবা বহু আগেই বাদ দিছি আমি। যা মন চাইছে সেইটাই করছি। অন্যের ইচ্ছে পূরণ করা আমার দ্বারা আর হয় না রে। আর স্বার্থের জন্য মাথায় হাত দেয়া মানুষগুলারে দেখলে আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। তুই আর কিছু বলবি না আমারে।”

রনি আর ঘাটানোর সাহস পায় না, অয়ন বন্ধু হলেও সে মাঝেমধ্যে বেশ ভয় পায়। এই চেনা এই অচেনা। ছেলেটার মনের থৈ পাওয়া রনির কর্ম নয়। অয়ন একবার রনির দিকে তাকিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। জীবনের চোরা স্রোতে গা ভাসাতে এখন আর কষ্ট হয় না খুব একটা, কষ্টগুলো গা সওয়া হয়ে গেছে বলেই বোধহয়।

***
রোকেয়ার মন কেমন অস্থির হয়ে আছে কিছুদিন থেকে। মেয়ের সাথে কথা বললেই এমন করে তাকায় যেন তিনি কোনো আজগুবি কথা বলে ফেলেছেন, এখনই তার গর্দান যাওয়া উচিত। অথচ মেয়ের মনে কী আছে সেটা তো অনেক আগেই তিনি বুঝে বসে আছেন। আর ওইদিকে মেয়ের এমন আচরণ তার বাবার চোখেই পড়ছে না, উল্টো নাচুনে মেয়ের নাচের সাথে ঢোলের বাড়ি দিচ্ছেন। সব দায় যেন তিনি একা কাঁধে নিয়ে বসে আছেন।

অবন্তীর বাবা আজহার সাহেব ঘরে ঢুকতেই রোকেয়া বললেন, “শোনো, তুমি মেয়েরে সারাজীবন ঘরে রাখতে চাইলেও আমার কিন্তু তেমন ইচ্ছা নাই। তাহেরা ভাবির মেয়েটার বিয়ে হইল কিছুদিন আগে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। ওই মেয়ে তো থার্ড ইয়ারে পড়ে। তোমার মেয়ের অনার্স শেষই প্রায়। বেশি বয়স হইলে বিয়ে দিতে যে কী ভোগান্তি হবে সেইটা তুমি কেমনে বুঝবা?”

“তোমার আজ হঠাৎ এমন মনে হইল কেন? তাছাড়া কী এমন বয়স হইসে যে বিয়ে দেয়া যাব না? কী বলতেছো এগুলা?” স্ত্রীর দিকে একবার বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বাথরুমে চলে গেলেন।

“যত চিন্তা সব আমার। তোমার তো কিছু না। কোনো দায়িত্বের বেলায় ছিল না, মেয়ে বড় হইসে তার সিদ্ধান্ত নেবার বেলায় উনার পিতৃত্ব জাগছে।”
নিজের মনেই গজগজ করতে করতে কথাগুলো বললেন রোকেয়া।

আজহার বেরুতেই রোকেয়া বললেন, “অন্তির জন্য আরেকটা ভালো প্রস্তাব পাইছি। এইবার তুমি মেয়ের কান্নায় গলে যাবা না এই আমি বলে দিলাম।”

আজহার গামছা দিয়ে ভেজা মুখ মুছতে মুছতেই বললেন, “আমারে এক গ্লাস লেবুর শরবত দিও তো রোকেয়া। যা গরম পড়ছে, পুরা আগুন হয়ে আছে বাইরে।”

হতভম্ব হয়ে রোকেয়া জানতে চাইলেন, “আমি এতক্ষণ কী বললাম তুমি শোনো নাই?”

“শুনছি। কিন্তু আমি মেয়েরে একটা কথা দিছি, ওর জীবন, সুখ-দুঃখও ওর। নিজের ভালো-মন্দ নিজেই বুঝতে শিখছে। এখন কিছু জোর করে চাপায়ে দিতে গেলে ফল ভালো হবো না। মেয়ে যদি কোনো ভুল করত তখন নাহয় শাসন করতাম। এই সাধারণ জিনিসটা কীসের জন্য বুঝতে চাইতেছো না? তুমি তো এত অবুঝ না।”

রোকেয়া তবুও স্বস্তি পান না, একদিকে বোকা মেয়েটা অয়নের মতো বোহেমিয়ান একজনকে চায়, অন্যদিকে জুনায়েদ ইদানিং খুব ঝামেলা করছে। মেয়েকে নিয়ে যে তার বড্ড ভয়, তিনি স্বামীর মতো মেয়ের পাগলামিতে সামিল হতে পারেন না। অমঙ্গল আশঙ্কায় তার বুক কেঁপে উঠে!

নিজের মেয়ের সাথে সাথে অয়নের উপরেও খুব রাগ হয় তার।

***
শাফিন এখনো ক্যাম্পাসে ফিরে আসেনি। নতুন সেমিস্টারের প্রথম ক্লাস ছিল আজ। দুই দিন পরে আসার কথা। ক্লাস শেষে কেআর এর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল রিকশার জন্য, তখনই মিলিকে দেখল। অবন্তীকে দেখে হেসে এগিয়ে এলো সে।

“কী খবর রে অন্তি?”

“ভালো। অনেকদিন পরে দেখলাম তোরে।”

“হ্যাঁ। আমি আরও ভাবছিলাম তোর বাসায় যাব, কিন্তু সময় পাচ্ছিলাম না। ভাগ্যিস দেখা হলো।”

কৌতূহলী হয়ে অবন্তী জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ আমার সাথে কী কথা? বল তো?”

ম্লান হেসে ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে বলল, “আমার বিয়ে। এই মাসের ঊনিশ তারিখ। অবশ্যই আসবি কিন্তু। তুই আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড মনে রাখিস।”

অবন্তী কিছুটা যেন ধাক্কার মতো খেলো। শাফিনের জন্য মন খারাপ হলো, ছেলেটা সঠিক মানুষ চিনতে পারল না। মিলিকে প্রশ্ন করে বসল,
“কিন্তু তুই তো শাফিনকে…”

অবন্তীকে থামিয়ে মিলি বলল, “আমি জানি তুই কী বলবি। শাফিনের প্রতি আমার যেই ফিলিংস সেটা পুরাপুরি একতরফা। ও হয়তো অন্য কাউকে ভালোও বাসে! ওদিকে আমার বাসায় বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। ওই প্রান্তের মানুষটার তো আমাকে নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই। শুধু শুধু কীসের ভিত্তিতে আমি সেটা ধরে বসে থাকব বলতে পারিস?”

মিলির দিকে চোখ তুলে তাকালো অবন্তী, ওর মধ্যে যেন নিজেকেই খুঁজে পেল। এই ভাঙা মন নিয়ে সে-ও তো অয়নের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু উপহাস আর কটাক্ষ ছাড়া প্রাপ্তির খাতায় বিশাল শূন্য জুটেছে। দিনশেষে অয়ন আর শাফিন কেউ ভালোবাসাটা বুঝতে পারল না! নাকি চাইল না! জানে না অবন্তী।

দীর্ঘশ্বাস চেপে রিকশায় উঠে পড়ল। বিয়ের কার্ডটাতে যেন বিষাদী সমুদ্র। অবন্তী আর মিলির বিষাদ কেমন এক সুতোয় বাঁধা পড়েছে!

***
বিকেলে শিউলি শাফিনের সাথে বেরিয়েছিল, এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। দুদিন পরেই তুহিনের সাথে চূড়ান্ত ছেদ ঘটবে। দুই কদম দূরের কাগুজে মুক্তির সুবাস এখনই যেন ওকে কিছুটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। দুঃসহ সময়টা প্রাণপণে ভুলতে চেষ্টা করছে, অনেকটা কাটিয়েও উঠছে। পথে শাফিনের এক এলাকার বন্ধুর সাথে দেখা হলে সে জানায় বহুদিন আড্ডা দেয় না, আজ রাতে আরও কয়েকজন পুরোনো বন্ধু আসবে বলে শাফিনকেও যোগ দিতে বলে।

শাফিন প্রথমে আপত্তি করলে শিউলি বুঝতে পারে ওকে একা ছাড়তে চাইছে না বলেই দ্বিধা করছে। তাই সে আস্বস্ত করে বলল, “আরে যা তো। ওরা কত করে বলছে, তাছাড়া আমি একা চলে যেতে পারব। কী এমন রাত এটা!”

শাফিন তবুও কিছুটা ইতস্তত করে রিকশা থেকে নেমে গেল। বাকি জীবনটা যখন একাই চলতে হবে তখন শুধু শুধু কাছের মানুষদেরকে বিড়ম্বনায় ফেলে মনোকষ্টের কারণ হয়ে লাভটা কী! তাদের নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করাই বরং ভালো।

ঘোর থেকে বেরিয়ে পিলে চমকে গেল। রিকশা কখন গলিতে ঢুকেছে বুঝতেই পারেনি। রিকশাটা থেমেও গেছে ততক্ষণে, ক্যাটকেটিয়ে হেসে সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং তুহিন। নির্জন গলিটা সন্ধ্যার কতক্ষণ পরেই যেন ভূতুড়ে হয়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই সাদা রঙের কিছু একটা ওর নাকের উপরে চেপে ধরা হলো, সব অন্ধকার হয়ে আসার আগে আগে তুহিনের বুনো উল্লাসে ফেটে পড়া মুখাবয়ব নজরে পড়ল। রিকশাচালক মামা কিছুটা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি বয়স্ক মানুষ, তুহিনের সাথে পেরে উঠার কথা নয়। এরপর চৈতন্য লোপ পেতে থাকে ধীরে ধীরে।
………
(ক্রমশ)