আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-০২

0
314

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা

অবন্তী বাসায় ফেরার সময় দেখল, মোড়ের চায়ের দোকানটায় সাঙ্গপাঙ্গসহ জুনায়েদ বসে আছে। সে রিকশায় বসেও কিছুটা ভয় পেল, সাথে রাগও হলো। আগাগোড়া একটা বখাটে ছেলে, বহুদিন ধরেই অবন্তীকে বিরক্ত করছে। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলে বলে লোকে আড়ালে যাই বলুক, সামনাসামনি বেশ কদর করে। এই জঘন্য ছেলেটার জন্যই ওর স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে পরিবার থেকে। তাই রাগের পারদ ঊর্ধ মুখী।

“মামা, একটু দ্রুত চালান।”
রিকশাচালককে কথাটা বলে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। জুনায়েদ রিকশার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

“কেমন আছো অন্তি? ভালো?”

রিকশা ততক্ষণে থেমে গেছে। অবন্তীর উত্তর না পেয়ে আবার বলল, “আমি জানি তুমি আমারে পছন্দ করো না। আমি জিনিসটাও অবশ্য পছন্দ করার মতো না। কিন্তু তাই বইলা কার্টেসি মানবা না? কেউ কুশল জিজ্ঞেস করলে হেসে বলবা, ‘ভালো আছি, আপনে কেমন আছেন?’ বুঝছো?”

অবন্তীর রাগ মাথায় চড়ে বসেছে ততক্ষণে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আপনার কাছ থেকে আমাকে কার্টেসি শিখতে হবে না। আপনি নিজেই শিখেন সেটা। মামা, আপনি দাঁড়াইছেন কেন? যান না?”

জুনায়েদের ক্যাটক্যাটে হাসি আরও বিস্তৃত হলো, রিকশা চলতে শুরু করলেও তার গলার হুমকিটা স্পষ্টই শোনা গেল, “যতোই ডাট দেখাও, কোনো লাভ নাই। শেষমেশ আমিই তুমার ভরসা হমু, এইটা মাথায় রাইখো।”

অবন্তী বাসায় এসে বুঝল, আজ আবার একটা ছোটখাটো ঝড় আসবে বাসায়। বড়চাচা একটু পরপর হাঁক-ডাক ছাড়ছেন, “ওই লাফাঙ্গাটা কই? এখনো আসার সময় হয় নাই তার? ওর হাড্ডি-গুড্ডি যদি আজ না ভাঙছি। মাস্তান হইছেন সে। শোনো, তুমি একবারে আস্কারা দিবা না।”

ক্ষণেক বিরতি নিয়ে নিয়ে এভাবে এটা-সেটা বলেই যাচ্ছেন। বড়চাচী সুফিয়া তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। বাসার পরিবেশ অত্যন্ত উত্তপ্ত। সে বাইরের কাপড় বদলে মায়ের ঘরে গেল।

“অন্তি, আজ এত দেরি করলি যে?”

“এখন এত কথা বলার মুড নাই আম্মু। তুমি খাবার দাও। ক্ষুধা লেগেছে।”

“তোদের মুড আমি বুঝি না। আজকালকার পোলাপানের যে এত কী হয়, যখন তখন মুড বিগড়ে যায়!”

বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন রোকেয়া। মায়ের বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই শুনল, “অন্তি, আয়। খাবার দিয়েছি। ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

অবন্তীর এখন আর খেতে ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু এখন না গেলে প্রশ্নের তীর ছুটে আসবে বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে পা বাড়ালো। খাওয়া শেষ না হতেই অয়ন ফিরল। অবন্তী মনে মনে প্রমাদ গুনলো। রোকেয়া অয়নকেও খাবার দিলেন। বড়চাচা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন, বিকেলের দিকে তিনি কিছুটা ঘুমান।

অর্ধেক খাওয়া হতেই বড়চাচার আগমন। তিনি এসেই চিৎকার করে বললেন, “তোর জন্য আমি রাজভান্ডার খুলে বসি নাই। তোরে যদি আর কোনোদিন রাস্তাঘাটে বেয়াদবি করতে দেখছি, সেইদিন এই বাসায় তোর শেষ দিন। আমার বাড়িতে আর জায়গা হবে না।”

অয়ন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অবন্তীর দিকে তাকালে সে ইশারায় বোঝালো কিছু জানে না এ ব্যাপারে। অয়নের প্লেটের ভাত অল্প একটু বাকি ছিল, সেটা খেয়ে শেষ করে উঠল। একেবারে শান্ত দেখাচ্ছে ওকে। এরপর নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বড়চাচা আবার মুখ খুললেন,

“সবাই বুক ফুলায়ে নিজের ছেলেমেয়ের গল্প করে, আর আমার সেসব শোনা লাগে। মানুষ টিপ্পনী কেটে বলে, ‘আপনার ছেলে কই পড়ে, কী করে? রাস্তায় আজেবাজে পোলাপানের সাথে দেখি সবসময়?’ তোরে সুযোগ-সুবিধা কম দিছিলাম আমি? তোর জন্য আমার মাথা কাটা যায়।”

অয়ন থেমে গেছে। ঘুরে দাঁড়ালো, মুখে তাচ্ছিল্য ঝরছে।
“শুধু টাকা পয়সা দিয়ে, পড়াশোনা চাপিয়ে দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আমার কোনটা ভালো লাগে, কোনটা করতে চাই এইসব স্বাধীনতা আমার ছিল কোনোদিন? আমারে বেশি ঘাটায়েন না। আমি এখন আর ছোট নাই যে মারের ভয়ে সব ছেড়ে দেব। আমার জীবনে আর নাক গলায়েন না।”

কথা শেষ হতেই বড়চাচা ত্বরিত গতিতে এগিয়ে গিয়ে অয়নের গালে নিজের শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে চড় মেরে দিলেন। অবন্তী কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েও কেঁপে উঠল কিছুটা।
“বেয়াদব। শয়তান হইছিস তুই? আমার মুখের উপরে কথা বলার সাহস কই পাইছিস? আজ তোরে…”

এলোপাথাড়ি চড় মেরে যাচ্ছেন অয়নের গায়ে, অয়নের অভিব্যক্তিতে রাগের ছাপ থাকলেও একেবারে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল। বড়চাচী তাকে সামলাতে পারছেন না, অবন্তীও ছুটে গিয়ে আনোয়ার সাহেবকে থামানোর চেষ্টা করল। রোকেয়া এসে অয়নের হাত ধরে টেনে সরিয়ে নিলেন। অয়ন নিজের ঘরে গিয়ে দরজা সশব্দে বন্ধ করে দিল।

বড় চাচাকে সোফায় বসানো হলো, তিনি এখনো ফুঁসছেন, অসম্ভব রাগে তার গা কাঁপছে। অবন্তী এক গ্লাস পানি এনে তাকে দিলে তিনি কিছুটা সুস্থির হলেন।

বড় চাচী বললেন, “মাথা ঠান্ডা করো। তোমার হাই প্রেসার। এমন উত্তেজনা তোমার জন্য ঠিক না। আমি অয়নরে বোঝায়ে বলব। তুমি এগুলা ভাইবো না তো।”

কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলেও থমথমে পরিস্থিতি এখনো বিরাজমান। অবন্তীর অস্থির লাগছে ভীষণ। পরিবারটা কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। এভাবে কী জীবন চলতে পারে!

***
শাফিন হলে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল। হালকা তন্দ্রাভাব আসতেই ফোন বেজে উঠল। ওর বড় বোন শিউলি ফোন করেছে।

“শিউলি আপু, কী অবস্থা?”
“আমার অবস্থা জিজ্ঞেস করতেছিস কী জন্যে? সাগরে ভাসায়ে দেয়ার আগে খোঁজ নেস নাই। এখন আর নিয়ে কী হবে?”

“আবার কিছু হইছে? এইভাবে কথা বলতেছো কেন?”

“নতুন করে আর কী হবে? মাতাল লোকটার গলায় আমারে ঝুলায়ে তোরা তো বোঝা নামাইছিস ঘাড় থেকে।”

“আপু, এগুলা কী বলিস? আরে আমরা আগে বুঝছি নাকি এমন হবে! তুই বাড়িতে এসে কিছুদিন থেকে যা। আমার সামনে কিছুদিনের ছুটি আছে। সবাই বসি। দেখি সমাধান হয় কিনা।”

শিউলি আর কথা বাড়ায় না। ভাইয়ের পড়াশোনা থাকা, খাওয়ার খোঁজ নিয়ে শেষে বলল, “শোন, তোরে বললাম, তুই কিন্তু বাবা আর মা’রে বলিস না এসব। আমি ভাসছি বলে তোদের ভাসাইতে চাই না।”

বোনের সাথে কথা বলে মন খারাপ হয়ে গেল। কে বলবে এই মেয়ের মধ্যে একসময় অসম্ভব রসবোধ ছিল। গল্পের আসর মাতাতে জুড়ি মেলা ভার ছিল। শিউলির একেকটা কথায় কাজিনরা হেসে গড়াগড়ি দিত। এখন সব কোথায় হারিয়ে গেছে! জীবনে যখন কষ্ট এসে ভিড়ে, তখন হাসি-আনন্দ জোয়ারের টানে কোথায় যে ভেসে যায়! দীর্ঘশ্বাসের সারি লম্ব হয় কেবল।

***
রাতে অবন্তী ছাদে উঠে এলো, এটা ওর বহুদিনের অভ্যাস৷ পড়তে পড়তে অবসন্ন হলেই ছাদে এসে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে। আজ অয়নকে কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু অয়ন এতটাই অন্যমনস্ক ছিল যে, অবন্তীর পাশে দাঁড়ানো অনুভব করতে ব্যর্থ হলো।

অবন্তী পূর্ণ দৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকালো৷ কঠিন মুখটায় গাম্ভীর্য ভর করেছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। কিন্তু বড় বড় চোখ দুটোতে রাজ্যের বিষাদ জমে আছে। সারাক্ষণ ওর পিছে লেগে থাকা অয়নকেই দেখেছে বহুদিন। অয়নকে এভাবে ভাঙাচুরা অবস্থায় একবারই দেখেছিল, যেবার ওর ভালোবাসার ক্রিকেট চিরতরে ছাড়তে হয়েছিল। তারপর থেকেই কী এমন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে ছেলেটা? অবন্তীর ভেতরটায় টনটনে ব্যথা হলো, প্রগাঢ় ব্যথা!

অবন্তী কথা না বলে গলা খাঁকারি দিল। তাতেই অয়নের চমকে উঠা নজর এড়ালো না।

“খুন্তি রে, তুই এমন ভূতের মতো এসে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভয় পাইছি তো।”

“তুই ভূতে ভয় পাস কবে থেকে?”

“খুন্তির ভূতকে ভয় পাই শুধু। একটু শব্দ টব্দ করে আসতে পারিস না? কবে না জানি ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করে বসি!”

এই ছেলের মতো করে নিজের অনুভূতি লুকাতে আর কেউ পারে না বোধহয়! এত দ্রুত নিজে ফর্মে ফিরে এলো যে একটু আগেই ওর মনে কী চলছিল সেটা বোঝার উপায় নেই।

“তোর সবসময় বাজে কথা না বললে ভালো লাগে না?”

কিছুটা থেমে অবন্তী আবার বলল, “একটু নিজেকে নিয়ে ভাবলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয় তোর?”

চারপাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠল অয়ন, “একটা প্রবাদ আছে জানিস না, ‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না?’ আমার মনে তেমন কয়লা, ময়লা যাই বলিস জমে জমে পাহাড় হয়ে গেছে। সেটাকে হটানো আমার মতো অধমের পক্ষে সম্ভব নয়।”

সেই হাসিতে অদ্ভুত একটা বিষাদ মিশে আছে, নিজেকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট মিশে আছে। কারোর হাসি যে অবন্তীর মন খারাপ করে দিতে পারে আজকের আগে কোনোদিন বুঝতে পারেনি।

অবন্তীর খুব করে বলতে ইচ্ছে করল, “তোর সাথে আমি সবসময় থাকতে চাই অয়ন। তোর মনের সব ক্লেদ আমার মুছে দিতে ইচ্ছে করে। তোর পক্ষে কয়লা ধুয়ে পরিষ্কার করা সম্ভব না হলেও, আমি সেটা ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে দেব। তুই শুধু একটু সুযোগ দে।”

কিন্তু মনের কথাটা মুখে আসে না, অবন্তী অয়নকে কিছুতেই পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না। সব বললে হয়তো তাচ্ছিল্য ভরে হুহু করে হেসে বলবে,
“খুন্তি, তুই পাগল হয়ে গেছিস? প্রপার ট্রিটমেন্ট করা। তোর মাথা ভালো বলেই এই বাড়িতে তোর এত কদর, আমার মতো ভবঘুরে হলে, তোর কপালের সুখ সব হাওয়া যাবে।”

এই কটাক্ষ সে কীভাবে সহ্য করবে! যার জন্য ওর এত মায়া হয়, সে তো এসব ভাবে না। নিজেকে নিয়েই সে ভালো আছে। অবন্তীর চোখ ভিজে আসছে, এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। একবার অয়ন দেখে ফেলল সর্বনাশ! এটা নিয়েই ওকে খোঁচা দেবার নতুন রসদ পাবে। নিজের অনুভূতির দাম আছে, সেটাকে এমন মানুষের সামনে প্রকাশ করে সহজলভ্য করতে চায় না অবন্তী।

অয়নের পিছু ডাক উপেক্ষা করে দ্রুত পা চালিয়ে নেমে এলো, অবন্তীর চোখে ততক্ষণে শ্রাবণের সব মেঘ বৃষ্টি হয়ে নামতে শুরু করেছে!
………..
চলবে।