আনন্দধারা বহিছে ভুবনে পর্ব-০৪

0
226

#আনন্দধারা_বহিছে_ভুবনে (পর্ব ৪)
নুসরাত জাহান লিজা

অয়ন চোখ দুটো চেপে ধরে সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে, জ্বলছে প্রবলভাবে। প্রচণ্ড রাগে মাথা ফেটে যাবার যোগাড়। কিন্তু ওর ভেতরে থাকা অসম্ভব জেদি সত্তা অয়নকে যেন পুরোপুরি গ্রাস করেছে। এই মেয়ে সবসময়ই এমন, রেগে গেলে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়।

বহুদিন আগের একটা কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। এইটে বৃত্তি পরীক্ষার পরে দুজনেরই কিছুটা অবসর ছিল তখন। অয়ন বরাবরই দস্যি ছেলে। অবন্তীর সেসময় বেশ বড় বড় চুল ছিল। লম্বা দুটো বিনুনি বেঁধে ঘুরত। বিকেলে সেদিন মায়ের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অয়ন চাচীকে ডাকতে সেখানে এসেই অবন্তীকে দেখতে পায়। আর ওকে দেখেই অয়নের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এসে ভর করে। ড্রয়ার হাতড়ে একটা কাঁচি খুঁজে নিয়ে এসে প্রায় হাত-খানেক চুল বিনুনি সমেত ঘ্যাঁচ করে কেটে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এরপর ভালো ছেলেটি হয়ে নিজের ঘরে বসে অপেক্ষা করতে থাকে অবন্তীর ঘুম ভাঙার, তারপর কী মজা হবে সেটা দেখার জন্য। অপেক্ষার সময় যে কেন এত দেরিতে যায়! অয়নের মনে হচ্ছে ওকে ঘুম থেকে টেনে তুলে দিতে। কিন্তু সেটা না করে ধৈর্য ধরাটাই সমীচীন মনে হলো।

খানিক বাদে অবন্তীর কান্না শোনা গেল, রীতিমতো আহাজারি করে কান্না। সবাই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। ভাগ্যিস এই সময় বাবা, চাচা কেউ বাসায় নেই! সে যত কাঁদছে ততই যেন শান্তি পাচ্ছে অয়ন, কী ভালো যে লাগছে! মায়ের প্রবল হুঙ্কারে দেওয়া ডাকে সেদিকে ছুটে গেল। মায়ের কয়েকটা চড়-থাপ্পড় ওর খুশিকে ম্লান করতে পারল না। তবে বাবা জানলে যে খবর আছে সেটা সে জানে৷

অবন্তী কেন যেন কথাটা বাবা-চাচাকে জানায় না৷ চুল সমান করে কেটে ফেলে, লম্বা চুলের অবন্তীর চুল তখন ঘাড়ের কিছুটা নিচ পর্যন্ত। ওর সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দিল। এটা দেখে কিছুটা খারাপ লেগেছিল। নিজের অনুশোচনাবোধ সঙ্গী করে গিয়েছিল একবার ‘স্যরি’ বলতে। কিন্তু তাতেই অনর্থটা ঘটল৷ তখন সকাল এগারোটা বাজে প্রায়। অবন্তী তখন কিছু একটা আঁকছিল বোধহয়। অয়ন গিয়ে বলল,

“শোন না খুন্তি, স্যরি রে। আমি বুঝতে পারিনি তুই এতটা কষ্ট পাবি।”

“তুই এখন এখান থেকে যা, অয়ন।” ক্রুদ্ধ গলা অবন্তীর।

“সামান্য একটু চুলই তো কেটেছি, তাতেই এমন করার কী আছে। আর কী এমন…”

বাকি কথা শেষ করতে পারল না, নিজের হাতে কিছু একটা সেঁধিয়ে গেল, তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে গেল, তাকিয়ে দেখল কম্পাসের তীক্ষ্ণ মাথাটা প্রায় গেঁথে দিয়েছে ওর কনুইয়ের আধ-হাত নিচে, রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। অবন্তী সেটা তখনও চেপে ধরে ছিল। অয়নের চিৎকারে সেটা বের করে মেঝেতে ছুঁড়ে বলল,
“আমার এত কষ্টে বড় করা চুল তোর কাছে সামান্য জিনিস মনে হলো?”

এরপর নির্বিকার মুখে বেরিয়ে গেল। এমন আরও বহুবার হয়েছে। শুরুটা অয়ন করলেও শেষটা সবসময় অবন্তী করেছে, এবং ভয়াবহভাবেই করেছে!

***
নিজের ঘরে এসেই অবন্তী যেন সম্বিতে ফিরল, বুঝল কী করে ফলেছে! কেন যে নিজের পাগুলে রাগটাকে সামলাতে পারে না। এই পোকাটা মাথা চাড়া দিলেই সে কেমন যেন অন্য মানুষে পরিণত হয়ে যায়। অয়নের ব্যথাতুর চেহারাটা মনে পড়তেই এখন ভীষণ খারাপ লাগছে। কান্না পাচ্ছে খুব করে। কিন্তু কান্নাটা গিলে ফেলে আর একমুহূর্ত দেরি না করে সেখানে ছুটে গেল।

এসে দেখল যা ভেবেছে তাই, এই ছেলেটা রেগে গেলে নিজের উপরেই অত্যাচার করে। বড়চাচার সাথে রাগ করে জীবনটাই ভাসিয়ে দিয়েছে, আর এখন…

“তুই এখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী করিস? চোখে পানি দিতে পারিস না? তোর পা কী কেটে ফেলছিস? হাঁটতে পারিস না?” তীব্র ঝাঁঝ অবন্তীর গলায়।

অয়ন কিছুই বলল না, সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে, কেবল দাঁতে দাঁত চাপল। অবন্তী আবার বলল, “একদম ঢং করবি না আমার সাথে। তোর ঢং আমি ছোটাব।”

অয়নের হাত ধরে টেনে নিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড় করিয়ে চোখে অনেকবার পানির ঝাপটা দিয়ে দিল। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। অয়ন নিজের ঘরে চলে গেল। অবন্তী দুই কাপ চা নিয়ে অয়নের ঘরে এলো।

“চা নিয়ে আমাকে উদ্ধার কর।”

“তোর চা তুই খা। আমার রাগ বাড়াবি না, যা এখন।” তেঁতে উঠে বলল অয়ন।

“আরেকবার বল তো কথাটা? শুনি। তখন হালকা গরম লবন-পানি ছুঁড়েছিলাম, বেশি ভাব নিলে এই গরম চা আমি তোর মাথায় ঢালব বলে দিলাম।”

এটা যে শুধুশুধু হুমকি নয় এটা অয়ন জানে, এই অকালেই ওর পুড়ে মরার শখ নেই। অবন্তী ওর সাথে আগে কী কী করেছে সব মনে পড়তেই সুড়সুড় করে কাপটা হাতে নিল।

“নিয়েছি, এখন তো যা।”

“আগে শেষ কর, তারপর যাব।”

অয়ন কাঁচুমাচু মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিল, অবন্তীর হঠাৎ করে হাসি পেয়ে গেল। এই প্রথমবার অয়ন তাকে কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছে! তবে বড়সড় কোনো অঘটন ঘটেনি, এটাই অবন্তীকে ভীষণ স্বস্তি দিল।

আগামীকাল অ্যাসাইনমেন্টের প্যারা না থাকলে দু’জনে ছাদে একটা দারুণ আড্ডা দেয়া যেত। কেন যে আগে কাজটা শেষ করে রাখল না! সবসময় সব কাজ ‘ইলেভেন্থ আওয়ারে’র জন্য জমা রাখাটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো অবন্তীর জন্য। ধূর! ভালো লাগে না!

***
সকাল হতেই শিউলি ব্যাগ গুছিয়ে বাবার বাড়িতে রওনা দিল। শাশুড়ি আটকানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেটা অযাচিত আবদার মনে হয়েছে। তবে বেশি চেষ্টা করেছে তুহিন নিজেই। এবং সেটা নিজের ঔদ্ধত্য বজায় রেখেই।

শিউলি যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল তখন সে এসে বলল, “তুমি বাপের বাড়ি যাইতেছো ভালো কথা। এখনো ভাইবা চিন্তা দ্যাখো, পরে কিন্তু আবার আমার বাড়িতেই আইসা উঠতে হইব। তখন কিন্তু আমি বাসায় তুলব না। কয়দিন আর বাপে খাওয়াবো?”

“কথা বলার আগে তুমি নিজে একটু ভেবেচিন্তে বলার অভ্যাসটা কইরো। এইখানে থাকলেও তো সেই আমার বাপের টাকায়ই খাইতেছি, তোমার তো মুরোদ নাই। তারচাইতে বাড়িতে বইসাই বাপেরটা খাব।”

এটুকু বলে থেমে তুহিনের পুরো কথাটা মনে করে আবার বলতে শুরু করল, “আমার যাওয়ার জায়গার অভাব হবে না। কোথাও যাওয়ার না থাকলে রেললাইনের নিচে মাথা দেবো, গলায় দড়ি দিবো, দরকার হইলে গলায় কলসি বাঁইধা নদীতে ঝাঁপ দিবো। তাও তোমার মতো একটা ছ্যাচড়া চামারের কাছে আসব না।”

“এইসব বড় বড় কথা সবাই কয়।”

একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন বেরিয়ে আসছে তখন তুহিন শেষবার হুমকি দিল, “তোর সাহস অতিরিক্ত বাড়ছে। তেল কমা নাইলে খবর আছে।”

শিউলি উত্তর না দিয়ে দরজা খুলতে যাবে, পেছন থেকে তুহিন হাত টেনে ধরেছে। আরেক হাত দিয়ে থাপ্পড় দিতে যাবে, তখনই শিউলি গর্জে উঠল, “খবরদার, যদি আজ তুমি আরেকবার হাত তুলো, তাইলে আমি আর চুপ থাকব না। মামলা করব তোমার নামে, নারী নির্যাতনের মামলা। আমার কিছু হইলে আমার বাপ-ভাই তোমারে ছাড়ব না। তারা তোমার সুন্দর ব্যবহার সম্পর্কে সবই জানে।”

এবার তুহিন হাতটা ছেড়ে দিল, তাকে নতুন করে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শিউলি পা দ্রুত চালিয়ে বেড়িয়ে এলো। বাইরে এসে রিকশায় বসতেই একটা ফুরফুরে বাতাস গায়ে এসে লাগলো। আহ্! কী আনন্দ হচ্ছে! মুক্তির আনন্দ বুঝি এমনই বাঁধনহারা হয়!

তবে বাবা-মায়ের চিন্তিত মুখায়বটা ভেসে উঠল, তারা কীভাবে নেবে বিষয়টাকে! দেখতে দেখতে বাসস্ট্যান্ডে চলে এলো। বাস ছাড়তেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, জীবনের তীব্র অনিশ্চয়তা মুক্তির আনন্দের গলা চেপে ধরল। চোখ বেয়ে কষ্ট ঝরে পড়ল। একটা চাকরি থাকলে পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত হলে নিশ্চয়ই এমন অনিশ্চয়তা আসন গেঁড়ে বসত না! আশ্রয়ের খোঁজে কারোর মুখাপেক্ষী থাকতে হতো না। নতুন করে কী নিজের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া যায়!

***
অবন্তী ক্যাম্পাসে এসে দেখল আজ শাফিন আসেনি। ফোন করল দুইবার, কিন্তু রিসিভ হলো না। রাজিবের সাথে দেখা হলো, সেও শাফিনের সাথে ঈসা খাঁ হলে থাকে, ওর দুই রুম পরেই।

“শাফিন তো ওদের বাড়িতে চলে গেছে আজ। হুট করে সকালে বাসা থেকে ফোন আসল, আর অস্থির হয়ে বের হলো। বাস ধরার জন্য তাড়াহুড়া করল।”

“কী সমস্যা কিছু বলছে তোরে?”

“না, জিজ্ঞেস করছিলাম, বলল, কী একটা পারিবারিক সমস্যা নাকি। ক্লিয়ার করল না।”

অবন্তী চিন্তিত হলো, ক্লাসে ঢুকল। প্রথম ক্লাস শেষ হবার পরে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল শাফিন কল দিয়েছিল। দ্রুত হাতে ডায়েল করতেই শাফিন ফোন ধরল,

“কী রে? হঠাৎ এভাবে বাড়িতে যাচ্ছিস যে? খারাপ কিছু?”

“কিছুটা। ফোনে সব বলা যাবে না। এসে বলব তোকে। তুই কল দিছিলি। তখন আমি বাস ধরার তাড়ায় ছিলাম, বুঝতে পারিনি।”

“সমস্যা নেই, তুই সাবধানে যা।”

“শোন অন্তি, শিট গুলো ফটোকপি করে রাখিস, আর আমি ফিরলে তোর ক্লাস খাতাটা দিস।”

“এটা আবার বলতে হবে তোকে? আমি আমার জন্য করব, তোরটা বাদ দিয়ে?”

“রাগ করিস না রে। ভালো থাকিস।”

কথা শেষ হতে না হতেই পরের ক্লাসের স্যার চলে এলেন। অবন্তী তখন মনোযোগী ছাত্রী বনে গেল।

***
সন্ধ্যার পরেপরে অবন্তীর বাবা আজহার, বড় ভাই আনোয়ারের ঘরে এলেন। জরুরি কথা আছে।

আনোয়ার সাহেব বারান্দায় বসে পেপার পড়ছিলেন। দিনে সেভাবে সময় হয় না বলে এই সময়ই পেপার পড়েন। খবরগুলো তখন প্রায় বাসি হবার পথে। পেপার নামিয়ে রেখে বললেন,
“কিছু বলবি?”
“হ্যাঁ, ভাইজান। জরুরি কথা আছে আপনের সাথে।”

ভাইয়ের সম্মতি পেয়ে পাশের চেয়ারে বসে বলল, “আপনি তো মাহমুদ ভাইরে চিনেন! ওই যে অন্তীর মায়ের মামাতো ভাই।”

“হ্যাঁ, কী হইসে তার?”

“তার বড় ছেলে ডাক্তার। এক দেড় বছর হইলো পাশ করে বের হইসে। অন্তির জন্য ধরছে ওরা। কেমন হবে বুঝতেছি না।”

“কেমন হবে মানে, ভালোই হবে। ছেলে ডাক্তার, তুই চোখ বন্ধ করে আলাপ কর।”

“এইবার একটু সাহস পাইলাম। আগে বাসায় আসবে মনে হয় অন্তিরে দেখতে। পছন্দ হইলে কথাবার্তা আগানো যাবে।”

“তুই তাদের আসতে বল। অন্তিরে পছন্দ না হওয়ার তো কিছু নাই। বিদ্যাতে, বুদ্ধিতে তো কমতি নাই। গায়ের রঙটা একটু চাপা হইলেও দেখতে শুনতেও খুবই ভালো।”

ভাইয়ের সাথে আলাপ করে স্বস্তিবোধ করলেন। কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দুই ভাই আলোচনা করেন সবসময়, ফলাফল কখনো খারাপ হয়নি। এইবারও নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে। তাছাড়া এমন পাত্র হাতছাড়া করা ঠিক না। এখন মেয়েকে কীভাবে রাজি করাবেন সেদিকে মনোযোগ দিলেন।
………
(ক্রমশ)