আমরা ভালোবেসেছিলাম পর্ব-০৫

0
97

#ধারাবাহিক গল্প
#আমরা ভালোবেসেছিলাম
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

পরীবানুর কঠোর মনোভাবের কারণে নুরবানু কিছুটা দমে গেল। এছাড়াও সামনে টেস্ট পরীক্ষা। তারপর মেট্রিক পরীক্ষা। ওকে অবশ্যই ভালো রেজাল্ট করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তা,না হলে মেহরাবকে পাওয়া সম্ভব নয়। খুব মনোযোগ দিয়ে নুরবানু লেখাপড়া করতে লাগলো। এখন মেহরাব রেগুলার আসে না। ওর সামনে পরীক্ষা। তার প্রস্তুতি চলছে। তবে মাঝে মাঝে এসে পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার নাম করে পরীবানুর চোখ এড়িয়ে ওদের মাঝে চিঠির আদান প্রদান হতে থাকে। এর মাঝে পরীবানু কনসিভ করে। কিন্তু দু,মাসের মাথায় হঠাৎ বাচ্চাটা অ্যাবরশন হয়ে যায়। পরীবানু তখন মানসিক ও শারীরিকভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে।
নুরবানুর টেস্ট পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষা খুব ভালো হলো। ভালো রেজাল্ট করে নুরবানু টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো। মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্টও অনেক ভালো হলো। নুরবানু সে সময় চারটা লেটার সহ স্টার মার্কস পেয়ে মেট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। বাড়ির সবাই খুব খুশী। রেজাল্ট ভালো হওয়াতে নুরবানুর পরিবারের লোকজন মেহরাবের উপর খুব খুশী। কামরান চৌধুরী মেয়ের এতো ভালো রেজাল্টে মেহরাবের উপর প্রচন্ড খুশী হয়ে একসেট নতুন জামা প্যান্ট উপহার দেয়। নুরবানু কলেজে উঠার পর মেহরাবকে আবারও পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরীবানু যদিও মেহরাবকে ছাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু বাড়ীর সবার আপত্তির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।
কলেজে উঠার পর নুরবানুর নিজেকে বেশ স্বাধীন ও মুক্ত মনে হলো। মাঝে মাঝে কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে টিফিন পিরিয়ডে কার্জন হলের সামনে গিয়ে মেহরাবের সাথে সময় কাটায়। ওদের প্রেমের পালে আবার নতুন করে হাওয়া লাগে। প্রেমের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। এর মাঝে পরীবানু আবারও কনসিভ করে। ডাক্তার বলেছে, পুরো বেড রেস্টে থাকতে। নুরবানুর দিকে খেয়াল রাখা ওর পক্ষেও আর সম্ভব হয়নি। ফার্স্ট ইয়ার পেরিয়ে নুরবানু সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে।
এর মাঝে ঘটে যায় আর এক ঘটনা। শেহজাদ একদিন ঢাকা ভার্সিটির ওদিক দিয়ে যাওয়ার সময় মেহরাবের সাথে দেখা হয়ে যায়। কলেজ ড্রেস পড়া নুরবানু তখন মেহরাবের সাথে বসেছিলো। ভাইকে দেখে বইয়ের আড়ালে নুরবানু নিজের মুখ লুকিয়ে ফেলে। কিন্তু নুরবানু যেহেতু বোরকা পড়ে কলেজ যেত তাই বোরকাবিহীন নুরবানুকে শেহজাদ চিনতে পারেনি। শেহজাদের মেয়েটাকে খুব চেনা মনে হচ্ছে। বিশেষ করে বসার ধরণটা শেহজাদের খুব চেনা। কিন্তু রাস্তায় কোনো মেয়ের দিকে উঁকি ঝুঁকি মারাটা অসভ্যতা দেখায়। তাই মেহরাবের সাথে একটু হাই হ্যালো করে ওখান থেকে সরে আসে।
বাসায় এসে পরীবানুকে মেহরাবের বিষয়টা জানায়। শেহজাদের মুখে এ ঘটনা শোনার সাথে সাথে পরীবানুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। শেহজাদের দৃষ্টি এড়ায়না। পরীবানুর যেহেতু একবার অ্যাবরশন হয়েছে শেহজাদ এইজন্য ওর দিকে খুব খেয়াল রাখে। পরীবানুকে জড়িয়ে ধরে শেহজাদ বলে,
—–হঠাৎ মুখটা এমন ফ্যাকাশে হলো কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
নিজের ভিতরের দুশ্চিন্তা ঢাকতে পরীবানু বললো,
—–মাথাটা একটু কেমন করে যেন উঠলো।
—–ঠিক আছে তুমি শুয়ে পড়।
পরীবানু মনে মনে নুরবানুর উপর বিরক্ত হয়। এতো নিষেধ করা সত্বেও মেয়েটা কেন ঐ পথে আবারও পা বাড়িয়ে দিলো। এটা নিয়ে লড়াই করার শক্তি এই মুহুর্তে পরীবানুর নেই। ও নুরবানুর ভাগ্য ভবিতব্যের উপর ছেড়ে দিলো।
এসব নানা কাহিনী থাকা সত্বেও নুরবানু ভালো রেজাল্ট করে সেকেন্ডইয়ারে উঠে। রাত জেগে ও পড়াশোনা করে। এর মাঝে একদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাওয়ার সময় নুরবানুর রুমের লাইট জ্বলতে দেখে শেহজাদ। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে দেখে নুরবানু টেবিলে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাকতে গিয়ে দেখে নুরবানুর মাথার নীচে একটা প্রেমপত্র। যদিও চিঠি দাতা ব্যক্তির নাম সেখানে লেখা ছিলো না। ঘুমন্ত নুরবানুর গালে কষে থাপ্পর মেরে জিজ্ঞাসা করে,
—–বল, এই চিঠি তোকে কে দিয়েছে?
প্রথমে ঘুমের ঘোরে থাপ্পর খেয়ে নুরবানু থতমত খায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে সমূহ ঘোরতর বিপদ বুঝতে পেরে মেহরাবের নাম আর বলে না। ওকে চুপ থাকতে দেখে শেহজাদ আবারও বলে,
—–নাম বলছিস না কেন?
চড়ের ধাক্কাটা সামলে বলে,
—–ভাইয়া আমি জানি না। কে এই চিঠি দিয়েছে?
—–হুম,চিঠির গায়ে তো পাখনা লাগানো আছে তাই উড়ে উড়ে তোমার কাছে চলে এসেছে? ভালো চাস তো বল এই চিঠি কে দিয়েছে। চিঠি দেওয়ার সাধ চিরজীবনের মতো মিটিয়ে দিবো।
দাঁত কিড়মিড় করে শেহজাদ আবারও বলে,
—–এখনও চুপ করে আাছিস কেন?
—–আমার এই বইটা ক্লাসের একটা মেয়ে দু,দিনের জন্য ধার নিয়েছিলো। আজ ও ফেরত দিয়েছে। বইটা খুলে দেখি এই চিঠিটা বইয়ের ভিতর রয়েছে। চিঠিটা কেউ আমাকে দিয়েছে নাকি ওকে কেউ দিয়েছে আমি তো জানি না। তা ছাড়া আমাকে চিঠি দেওয়ার মতো কেউ তো নেই।
শেহজাদ চিঠিটার দিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো। সেখানে প্রেরক এবং প্রাপক দুজনের নামই অনুপস্থিত। প্রিয় আর প্রিয়তমা এই সম্বোধনে চিঠিটা লেখা হয়েছে। এরপর শেহজাদ নুরবানুর দিকে তাকিয়ে বলে,
——এভাবে প্রেম করে বিয়ে করার স্বপ্ন কোনোদিন দেখো না। তোমাকে আমাদের পছন্দেই বিয়ে করতে হবে। নতুবা আজীবন আইবুড়ো হয়ে বাপের বাড়িতে থাকতে হবে।
এ কথা বলে শেহজাদ নিজের রুমে চলে যায়। ঘুমন্ত অবস্থায় বোনটাকে মারার জন্য ওর কষ্ট হতে থাকে। বাকি রাতে শেহজাদের আর ঘুম আসে না। তবে নুরবানুর দিকে লক্ষ্য রাখার চেষ্ঠা করে। ওর অফিসের এক এমপ্লয়িকে নুরবানুর দিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব দেয়।
সেদিনের শেহজাদের আচরণ দেখে এদিকে নুরবানুও সাহসী হয়ে উঠে। ইতিমধ্যে মেহরাবের গ্রাজুয়েশন ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়। নুরবানু তখন মেহরাবকে বলে,
—– আমার ফ্যামেলি কোনোদিন তোমার সাথে আমার বিয়েটা মেনে নিবে না। তুমি তোমার পরিবারকে আমার কথা জানাতে পারো। তারা অন্তত আমাদের সাথে থাকুক।
——আমার বাবা মা কখনও তোমাকে বিয়ের ব্যাপারে আপত্তি করবেন না।
নুরবানুর কথা জানালে মেহরাবের বাবা, মা, হা বা না কিছুই বলে না। তবে ওর বাবা ওকে বুঝিয়ে বলে,
—–যা করবি বুঝে শুনে করিস। নুরবানু কি আমাদের পরিবারে মানিয়ে নিতে পারবে কিনা সেটাও তোর ভেবে দেখা উচিত। ছোটে ছোটো ভাইবোনের প্রতি তোর দায়িত্ব আছে সেজন্য এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিস না যার কারনে তোকে যেন সারাজীবন পস্তাতে না হয়।
মেহরাব পড়াতে এসে একথা নুরবানুকে জানালে ও বলে,
—–আমার পরিবার যেহেতু কেনোদিন তোমাকে মেনে নিবে না। সেজন্য তোমার হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই।
মেহরাব একথা শোনার পর অনেক ভেবেচিন্তে নুরবানুর সাথে একই মত পোষণ করে। এদিকে পরীবানুর শারীরিক অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে। ডেলিভারী ডেটের আগেই ডাক্তার সিজার করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরীবানুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেহরাব এই সময়টাকে কাজে লাগাতে চায়। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক মেহরাব কলেজে নুরবানুর সাথে দেখা করে ওকে বলে,
——ভাবি তো এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে।আমাদের পালিয়ে যাওয়ার এটা একটা বড় সুযোগ।
কিন্তু নুরবানু বলে,
—–তুমি আমাকে বিয়ে না করলে আমি তোমার সাথে পালিয়ে যেতে পারবো না। এছাড়া আগামীকাল ভাবীর সিজার হবে। বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসুক। ওকে না দেখে আমি এ বাড়ি থেকে বের হবো না। এরপর ওর সাথে আমার আর দেখা হবে কিনা আমি জানি না।
—–আমরা যেদিন পালিয়ে যাবো সেদিনই কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলবো। ঠিক আছে তোমার মতই আমার মত। আমি তোমাকে মিনারার মাধ্যমে চিঠি দিয়ে সব বৃত্তান্ত জানিয়ে দিবো।
এদিকে শেহজাদের লোক নুরবানুকে কলেজে মেহরাবের সাথে কথা বলতে দেখে। সে কথা শেহজাদকে জানিয়ে দেয়। যারফলে নুরবানুর পাশাপাশি ওরা এখন মেহরাবের গতিবিধির দিকে লক্ষ রাখে।
পরের দিন সিজার করে আয়ানের জন্ম হয়। নুরবানুর পরিবার আনন্দে মেতে উঠে। তবে নুরবানুর মনটা আনন্দের মাঝেও বিষাদে ঢেকে যায়। ও জানে এ বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গালে আর কোনোদিন এ বাড়িতে ফিরে আসতে পারবে না। তারপর ও নিজের ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেতে এ ধরণের সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে ওর জীবনে কি ঝড় নেমে আসতে পারে সেটা নিয়ে ভাবার মতো বয়স ওর ছিলো না। আবেগের বশবর্তী হয়ে নুরবানুর মতো অল্প বয়সী মেয়েরা অনেক সময় মারাত্মক ভুল করে।
এর মাঝে শেহজাদের লোক মেহরাবকে একদিন মিনারাদের বাসায় যেতে দেখে। ও মিনারার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে চলে আসে। মিনারা সে চিঠি নিয়ে এসে নুরবানুর হাতে পৌঁছে দেয়। এইসব খবর শেহজাদের কাছে সাথে সাথে চলে যায়। ও বুঝতে পারে নুরবানুর সাথে মেহরাবের সম্পর্ক আছে। তবে এ বিষয়টা নিয়ে ও এই মুহুর্তে জল ঘোলা করতে চায় না। ও বরং পরীবানুর বাসায় ফেরার অপেক্ষা করে।
আয়ানের জন্মের পর কামরান চৌধুরী জুলেখা বিবি আর নুরবানু হাসপাতালে বাবুটাকে দেখতে আসে।শেহজাদও ঐ দিনটাকে কাজে লাগায়। নুরবানুর রুম সার্চ করে মেহরাবের চিঠি উদ্ধার করে। ওখান থেকে নুরবানু আর মেহরাবের সমস্ত প্লান জেনে নেয়।পরীবানু এক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকার পর যেদিন বাড়ি ফিরে আসে সেদিনই নুরবানু আর মেহরাব পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কামরান চৌধুরীর নিকট হাসপাতাল থেকে পরীবানু আর আয়ানকে নিয়ে আসার দায়িত্ব দিয়ে শেহজাদ কাজের কথা বলে গাবতলী বাসস্টেশনে দু,জন লোক নিয়ে অপেক্ষা করে। সময়টা ছিলো হেমন্তকাল। যথাসম্ভব নভেম্বর মাস পড়েছে। ভালো করে শীত নামেনি। রাত ন,টার দিকে আমিন বাজারের ব্রিজের উপর দিয়ে শেহজাদ মেহরাবকে হেঁটে আসতে দেখে। নুরবানুরও গাবতলী যাওয়ার কথা। শেহজাদের কথামতো একজন লোক মেহরাবের কাছে গিয়ে বলে,
—–ভাই আমার খুব বিপদ,
মেহরাব একটু অবাক হয়। হঠাৎএখানে বিপদের কথা বলে লোক কেন উদয় হলো? তারপরও ভাবে মানুষের বিপদ তো হতেই পারে। তাই জিজ্ঞাসা করে,
—–কি বিপদ জানতে পারি?
—–আমার স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠেছে। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।
—–আপনার স্ত্রী কোথায়?
—–ব্রিজের নীচে বসে আছে। আপনি একটু আসলে ওকে ধরাধরি করে রিকশায় উঠাতে পারবো।
এ কথা শুনে সরল বিশ্বাসে মেহরাব ব্রিজের নীচে যাওয়া মাত্রই ওকে আর একজন টেনে নিয়ে নিরিবিলি স্থানে নিয়ে যায়। তারপর মুখে কাপড় বেঁধে ওকে পিটিয়ে আধমরা করে তুরাগের পাড়ে ফেলে রেখে চলে যায়। সেসময় নুরবানু বাসস্টেশনে পৌঁছালে শেহজাদ ওকে ধরে বেঁধে বাড়ি নিয়ে আসে। কামরান চৌধুরী নুরবানুকে এ অবস্থায় দেখার সাথে সাথে প্যান্টের বেল্ড দিয়ে ওর শরীরে আঘাত করে। পুরে শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়।
একথা মনে হলে আজও নুরবানুর চোখ জলে ভরে উঠে। ও ঝরঝর করে নিজের চোখের পানি ছেড়ে দেয়। এমন সময় দরজায় কে যেন নক করে।

চলবে