আমরা ভালোবেসেছিলাম পর্ব-০৪

0
79

#ধারাবাহিক গল্প
#আমরা ভালোবেসেছিলাম
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

শেহজাদ বাড়ির গেটে আসা মাত্রই দেখে নুরবানু আর মিনারা হেঁটে হেঁটে আসতেছে। শেহজাদ একটু অবাক হয়ে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করলো,
—–তোমরা কোথা থেকে আসছো?
নুরবানু থতমত খেয়ে বললো,
—–স্কুল থেকে আসছি,
——আমি তো স্কুলে গিয়েছিলাম,কাউকে তো দেখতে পেলাম না।
নুরবানু কিছু বলার আগেই মিনারা বলে উঠলো,
—–স্কুলের অনুষ্টান অনেক আগেই শেষ হয়েছে। আমরা হেঁটে আসছি বলে এতোটা সময় লেগেছে।
শেহজাদ নুরবানুর দিকে তাকিয়ে অবাক হচ্ছে ও কেন যেন শেহজাদের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। বাড়ির ভিতর থেকে পরীবানু সবটাই শুনতে পেলো। মিনারা নুরবানুকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই নুরবানু বললো,
——বাসার ভিতরে চল।
—–না,আজকে না অন্য আর একদিন আসবো।
আসলে মিনারা পরীবানুর সামনে পড়তে চায় না। পরীবানু তো জানে মিনারা পরীক্ষা শেষ করে দেড়টার সময় বাসায় চলে আসছে। নুরবানু এতো দেরী করে বাসায় ফিরে আসাতে সবাই অসন্তষ্ট।
নুরবানুকে দেখে কামরান আর জুলেখা বিবি বললো,
——আজ তো অনেক আনন্দ করেছো। এরপর আর এধরণের আবদার করবে না। এখন হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বস।
এদিকে পরীবানুর মন কু ডাকছে। নুরবানু আজ কোথায় গিয়েছে এটা তাকে জানতে হবে। নুরবানু ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে নিলো। আসলে কে কি ভাবছে এটা ওর মাথায় কাজ করছে না। ও এই মুহুর্তে মেহরাবের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো অনুভব করছে। শাওয়ার নিয়ে ঘরে এসে বিছানায় বসে টাওয়েল দিয়ে আস্তে আস্তে চুলগুলো মুছতে লাগলো। মাগরিবের আযান শোনা যায়। নুরবানুর একটু ভয়ভয় করছে। বাড়ির পরিবেশটা একটু গুমোট হয়ে আছে। ওজু করে নামাজ পড়ে নিলো।বাড়ির সবাই মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিলো।নুরবানুর পরিবারের সবাই নামাজের ক্ষেত্রে খুব সিরিয়াস। আযানের সাথে সাথে সবাই নামাজ পড়ে নেয়। মাগরিবের নামাজ শেষ করে পরীবানু কিচেনে গিয়ে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিলো। দুটো দারচিনি আর এলাচ কেটলিতে দিয়ে দিলো। এরপর দুধ চিনি মিশিয়ে ডাইনিং টেবিলে চা দিয়ে শ্বশুর শাশুড়ীকে ডেকে দিলো। শেহজাদ আজ আর টেবিলে খাবে না। ওর চা,টা রুমে দিয়ে আসতে বললো। নুরবানুর চা,টা ওর রুমে এসে দিয়ে বললো,
——-তোমার সাথে আমার কথা আছে। হাতের কাজগুলো সেরে আসছি।
নুরবানু একটু ঘাবড়ে গেল। পরীবানু শুনলে কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে সেটা ভেবে ওর খুব টেনশন হচ্ছে। এরপর পরীবানু নিজের বেডরুমে দু,কাপ চা নিয়ে এসে এক কাপ শেহজাদের হাতে দিয়ে আর এক কাপ নিজের হাতে তুলে নিলো। পরীবানু খেয়াল করলো শেহজাদের চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ রয়েছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শেহজাদকে জিজ্ঞাসা করলো,
—–তোমার মন কি কোনো কারণে খুব খারাপ?
——না, তেমন কিছু না, তবে একটা বিষয় নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।
——অফিসিয়াল কোনো ঝামেলা?
——না,নুরবানুকে নিয়ে টেনশনে আছি। আমাদের পরিবারে বহুবছর পর মেয়ে অর্থাৎ নুরবানুর জন্ম হলো। ওর জন্মে মনে মনে আমরা সবাই খুশী হয়েছি তবে এর পাশাপাশি দুশ্চিন্তাও আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে। কারণ আমাদের পরিবারের মেয়েরা কোনো না কোনো কাহিনী ঘটায়।
——এটা কেমন কথা বললে?
—–একথা বলার পিছনে নিশ্চয় আমার কারণ আছে। বিনা কারণে তো বলিনি। তোমাকে একটা কাহিনী বলি। আমাদের পূর্বপুরুষ মানে আমার আব্বার ফুফুর কথা বলছি। তখন আমাদের নিবাস ছিলো জলপাইগুড়ি। জমিদারীও ছিলো। আব্বার ঐ ফুফু দেখতে খুব সুন্দরী ছিলো। বেশ লেখাপড়াও জানতো। শুনেছি সে আমলে উনি এন্ট্রাস পাশ ছিলেন। লেখালেখিও করতেন। ঐ একই গ্রামে আর একজন কবি ছিলেন। উনি খুব সাধারণ প্রজা ছিলেন। দিনে তো উনাদের দেখা হওয়া খুব মুশকিল ছিলো। তাই রাতের আঁধারে উনারা দেখা সাক্ষাত করতেন। এটা যতসম্ভব আব্বার দাদা আঁচ করেছিলেন। উনিও খুব নিবিড়ভাবে মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। একরাতে উনারা বাগানে দেখা করতে গিয়ে প্রহরীদের হাতে ধরা পড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে গেলে জমিদার কন্যার হয়তো তেমন ক্ষতি হবে না কিন্তু ঐ সাধারণ প্রজা তো জানে বেঁচে ফিরতে পারবেন না। তাই আব্বার ফুফু তার প্রেমিককে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে যান। তারপর ঐ প্রেমিককে নিজের রুমের সিন্দুকের ভিতর লুকিয়ে রাখেন। উনি রুমে ঢুকেই বুঝতে পারেন সিন্দুকের ভিতরেই ঐ ছেলে লুকিয়ে আছে। কারণ সিন্দুকের ডালাটা তখন ঠিকমতো লাগানো ছিলো না। তবে মেয়েকে খুব আদর করে জিজ্ঞাসা করেন,
——এতো রাত অবধি জেগে আছো কেন মা? তোমার শরীর তো খারাপ করবে?
মেয়ে ভাবে বাবা হয়তো কিছুই বোঝেনি। কিন্তু উনি বুঝেও না বুঝার ভাণ করে হাততালি দিয়ে দাসীকে ডেকে মেয়েকে শরবত দিতে বলেন। শরবত খেয়ে মেয়ে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লো। কারণ শরবতে ঘুমের ওষুধ মিশানো ছিলো। এরপর সেই সিন্দুকটা বের করে প্রহরীদের আগুন জ্বালিয়ে দিতে বলেন। রাতের নির্জনতায় এক প্রেমিকের বিসর্জন দেওয়া হলো। সকালে ঘুম ভেঙ্গে মেয়ে যখন জানতে পারে বাবা তার প্রেমিককে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে সাথে সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তবে এই পাপের ফল উনাকে ভোগ করতে হয়েছে। কিছুদিন পর জমিদারী চলে যায়। এরপর হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাঁধে। রাতের আঁধারে দুস্কৃতিকারীরা ঐ বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। সবাই জানে বাঁচলেও আব্বার দাদা আগুনে পুড়ে মরে যায়।এরফলে ঐ দেশ ছেড়ে প্রথমে আব্বুরা টাঙ্গাইলে চলে আসে। দাদা ওখানে বেশ জমিজমা কিনে বসবাস শুরু করে। দাদার মৃত্যুর পর আব্বার ব্যবসা প্রসারিত হলে আমরা এখানে চলে আসি। আব্বা জমি কিনে এখানে বাড়ি তৈরী করে।
——কি ভয়ঙ্কর কথা!একটা মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারলো? উনি কি খুব অত্যাচারী কিংবা নিষ্ঠুর ছিলেন?
—-শুনেছি জমিদার হিসাবে বেশ ভালোই ছিলেন।
—–তাহলে এ কাজটা উনি কিভাবে করলেন?
——হয়তো নিজের মেয়ের একজন সাধারণ প্রজার সাথে প্রেম উনি মেনে নিতে পারেননি?
—–এরপর আব্বার ঐ ফুফুর কি হলো?
—–উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। তারপর মাত্র তিরিশ বছর বয়সে উনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। এরপর আমাদের পরিবারে আর মেয়ে হয়নি। বহুবছর পর নুরবানুর জন্ম হলো। এখন তুমি একটু নুরবানুর দিকে খেয়াল রেখো। মা তো ইবাদত বন্দেগী নিয়ে বেশী ব্যস্ত থাকেন। আমার নুরবানুকে নিয়ে চিন্তা হয়। ও যদি কোনো ভুল করে বসে তাহলে এর মাশুল কিভাবে গুনতে হবে কে জানে? মেহরাবকে টিউশনি থেকে ছাড়ার কথা বলতে পরীবানুর একবার ইচ্ছা হলো। আবার ভাবলো মেট্রিক পরীক্ষার আগে ওকে ছাড়িয়ে দিলে যদি নুরবানুর রেজাল্ট খারাপ হয়? এসব নানা ভাবনায় পরীবানু নুরবানুর রুমে চলে আসলো। নুরবানু গভীর মনযোগের সাথে তখন অংক করছিলো। পরীবানু রুমে এসে নুরবানুর রুমের দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—–তুমি আজ সারাদিন কোথায় ছিলে?
—–ওমা, কোথায় আবার? স্কুলেই তো ছিলাম।
——মিথ্যা বলবে না। আজ তোমার স্কুলে কোনো প্রোগ্রাম ছিলো না। বরং তুমি মেহরাবের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছো তাই না?
নুরবানু মনে মনে ভাবলো নিজের ভালোবাসার মানুষের কথা ভাবিকে বলে দেওয়াই ভালো। বরং গোপন করলে অনেক সমস্যা হতে পারে। তাই বুকে একটু সাহস নিয়ে বললো,
—–হ্যা, আমি মেহরাবের সাথে বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরতে গিয়েছিলাম।
—–প্রচন্ড সাহসের পরিচয় দিয়েছে তুমি। জানে বাঁচতে চাইলে এ পথ থেকে ফিরে আসো।
——ভাবি, ওতো ছেলে হিসাবে খারাপ নয়। লেখাপড়ায় বেশ ভালো ও মেধাবী।
—–কিন্তু তোমাদের স্ট্যাটাস? তোমার বাবা মা ভাই কি এই সম্পর্ক মেনে নিবে?কোনোদিন মানবে না। মাঝখানে তোমাদের দু,জনের জীবনটা নষ্ট হবে। একটু আগে তোমার ভাইয়ের কাছে এক ভয়ঙ্কর কাহিনী শুনে আমার গা শিঁউড়ে উঠলো।
এরপর পরীবানু নুরবানুকে ঐ কাহিনী শুনালো। কিন্তু পরীবানুর মনে হলো ঐ ভয়ঙ্কর ঘটনা যেন নুরবানুকে স্পর্শ করলো না। এটা বুঝতে পেরে পরীবানু একটু কঠোর হয়ে নুরবানুকে বললো,
—–তুমি যদি এরপর আর মেহরাবের সাথে কখনও বাইরে ঘুরতে গিয়েছো তাহলে বাসায় সবাইকে জানিয়ে দিবো। আর মেহরাবকে ও ছাড়িয়ে দিবো।
একথা বলে নুরবানুর জবাবের অপেক্ষা না করে পরীবানু ওর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চলবে