আমরা ভালোবেসেছিলাম পর্ব-০৬

0
105

#ধারাবাহিক গল্প
#আমরা ভালোবেসেছিলাম
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

চোখের জল মুছে ফেলে নুরবানু। তারপর দরজা খুলে দেখে পরীবানু দাঁড়িয়ে আছে। হালকা নীল রঙের ডিম লাইটের মৃদু আলোতে পরীবানু বুঝতে পারছে নুরবানু এতোক্ষণ ধরে কেঁদেছে। চোখের পাপড়িগুলো তখনও ভেজা রয়েছে। পরীবানু রুমে এসে নুরবানুর হাত ধরে খাটে বসালো। নিজেও পাশে বসে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
——আবারো মেহরাবের কথা ভেবে চোখের পানি ফেলছো?
নুরবানু কথা ঘুরিয়ে বললো,
—–নক করলে কেন? কিছু বলবে আমায়?
—–ডিনার করবে না?
——না, আমার কিছু ভালো লাগছে না।
পরীবানু বুঝতে পারছে নুরবানুর মানসিক অবস্থা। মাঝে মাঝে ও এভাবে স্মৃতির অনলে পুড়তে থাকে।
—– আর কতদিন তুমি ওর জন্য চোখের পানি ঝরাবে বলতে পারো? আমার তো এখন মেহরাবের উপর রাগ হয়। ওর জন্য তোমার সংসার করা হলো না। ওতো তোমার খোঁজ নিতে পারতো?
—–শুধু শুধু ওকে কেন দুষছো ভাবি? আমার সাথে সংসার করতে চেয়েছিলো বলেই তো নিজের জীবনের এতো বড় রিস্ক নিতে পেরেছিলো? সেদিন যে মার ওকে মারা হয়েছে বেচারা বেঁচে আছে কি না তাও তো জানি না।
তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নুরবানু আবারো বললো,
——সংসার আমি করতে চাইনি বলে সংসার কি আমায় ছেড়েছে? এই যে তোমাদের নিয়ে আমার সংসার গড়ে উঠেছে। তবে তোমার কাছে আমার অনুরোধ, ওকে নিয়ে কিছু বলো না। আমি মেনে নিতে পারি না।
—–ঠিক আছে বলবো না। তবে তুমিও আর এভাবে মন খারাপ করে থাকতে পারবে না।
—–এ গ্যারান্টি তোমায় দিতে পারবো না। আমি আমার মন খারাপের অনুভবে ওকে খুঁজে পাই। ওর জন্য বুকের গভীরে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসে আমি আজও বেঁচে আছি। আমার শ্বাস প্রশ্বাসে ওর স্পন্দন পাই। ও তো আমার কাছেই আছে। তবে ছুঁয়ে দিতে ভয় হয়। মনে হয় স্পর্শ করলেই ও যদি হারিয়ে যায়? আজ পর্যন্ত আমি ওর জায়গায় কাউকে বসাতে পারিনি বলে আজীবন একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবই তো তুমি জানো ভাবি।
—–তুমি আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
——লাল শাড়িটা আমায় পড়তে হবে তাইতো?
——তোমার ভাইপো অনেক শখ করে তোমার জন্য শাড়িটা কিনেছে। পড়লে ও অনেক খুশি হবে।
—–তুমি না বললেও আমি পড়তাম। তুমি তো জানো আমি ওর কথা ফেলতে পারি না।
——শুনে খুব খুশী হলাম বোন। আমি তোমাকে নিজের হাতে সাজিয়ে দিবো।
—–আচ্ছা,ঠিক আছে। এখন যাও সবাইকে নিয়ে ডিনার করে ফেলো।
নুরবানু পরীবানুকে পাঠিয়ে দিয়ে আবার ভাবনার অতলে হারিয়ে গেল। সেদিন ও শুনেছিলো মেহরাবকে পিটিয়ে তুরাগের পারে শেহজাদ ফেলে রেখেছিলো। এরপর ওরা আর মিরপুরে বেশীদিন থাকেনি। মেহরাব আর নুরবানুর প্রেমের কথা গোপন থাকেনি। এলাকায় ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যাওয়াতে আড়ালে আবডালে নুরবানুকে নিয়ে অনেক রটনা রটতো। এলাকার মোটামুটি সবাই জানতো। লোকে বলতো এরকম মেয়ে আমাদের ঘরে জন্ম নিলে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিতাম। যে মেয়ে বাবা মায়ের মুখে এমন চুনকালি মাখাতে পারে সেই মেয়ে থাকার থেকে না থাকাই ভালো। কামরান চৌধুরী লোকের এসব কথায় খুব অপমানিত বোধ করতেন। ছ,মাসের মাথায় অর্থাৎ নুরবানু এইচএসসি পরীক্ষার পরপর ঐ এলাকা ছেড়ে ওরা বনানীর এই বাড়িটাতে শিফট করে। মেহরাবকে ভালোবাসার অপরাধে নুরবানুকে অনেক বড় মাশুল গুনতে হয়েছে। কামরান চৌধুরী যতদিন বেঁচে ছিলেন নুরবানুর সাথে ভালো করে কথা বলেননি। তবে নুরবানু এসব কলঙ্ক গায়ে মাখতো না। ভালোবেসে ও কোনো ভুল করেনি এ কথা চিৎকার করে সবাইকে বলতে ইচ্ছা হতো। ঐ সময় নুরবানু মানসিকভাবে প্রচন্ড বিপর্যস্ত ছিলো। আয়ান তখন নুরবানুর বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। আর পরীবানু ওকে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে গাইড করে। খাট থেকে নেমে নুরবানু জানালার ধারে এসে দাঁড়ালো। আকাশে চাঁদের জোৎস্না আর মেঘের লুকোচুরি খেলা চলছে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে নুরবানু ভাবছে মেহরাবকে ওর পুরোটা দিয়ে ভালোবেসেছে বলে ও স্বার্থপর হতে পারেনি। কামরান চৌধুরী মারা যাবার পর জুলেখা বিবি আর শেহজাদ নুরবানুকে বিয়ে দিতে বহু চেষ্টা করেছে। কিন্তু নুরবানু নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলো। নিজের জীবনটাকে আর কারো সাথে জড়াতে ইচ্ছে হয়নি। যদি কখনও মেহরাব ওর জীবনে ফিরে আসে? সেই কারণে মেহরাবের জায়গায় অন্য কাউকে বসাতে মন চায়নি। সেদিনের পর থেকে মেহরাবকে একটা মুহুর্তের জন্য ও ভুলতে পারেনি সেখানে পুরোটা জীবন পার করবে কিভাবে? এই ভাবনায় ও মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে উঠে। আবারও কে যেন দরজায় নক করছে।
—–কে?
——আমি আয়ান,ঘুমিয়ে পড়েছো?
——-না,এখনও ঘুমাইনি। ভিতরে আয়।
নুরবানু চেয়ার থেকে উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় এসে বসলো। আয়ান প্লেটে ভাত শুটকি ভর্তা, ইলিশ মাছ ভাজি আর পুটি মাছের চচ্চড়ি নিয়ে এসে বললো,
——সারাটা রাত উপোস থাকলে একটা চড়ুই পাখি সমান রক্ত শুকিয়ে যাবে। কথাটা অবশ্য আমার না। আসো,তোমায় খাইয়ে দেই।
——তোর মাকে তো বলেছিলাম,আমি খাবো না।
——আম্মু বলেছে। তারপরও আমি জোর করে তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। তোমাকে তো প্রেসারের ওষুধ খেতে হবে।
একথা বলে আয়ান নুরবানুর মুখে ভাত তুলে দিয়ে বললো,
—–সুবোধ বালিকার মতো ভাত গুলো খেয়ে নাও। এরপরে এরকম সুযোগ আর নাও পেতে পারো?
—–কেন তোর বউ দেখলে মন খারাপ করবে?
——প্রথমতো জুবাইদা সেরকম মেয়েই নয়। চারবছর ধরে ওকে চিনি। আর তুমি ও ওকে ভালোভাবেই জানো। তোমার ছাত্রী ছিলো। এখন তোমার অ্যাসিসটেন্ট। আমার থেকে তুমি ওকে আরো বেশী ভালো জানো।
—–তা,জানি। ওকে কখনও কষ্ট দিস না। মেয়েটা জীবনে অনেক স্ট্রাগল করেছে। তুই তো জানিস ওর বাবা সরকারী অফিসের করণিক ছিলেন। ঢাকায় ওদের নিজেদের বাড়ি নেই। ওরা দু,ভাই বোন। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়।
—–হুম, আমি ওকে হাতখরচ দিতে চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম ও যদি মাইন্ড করে তাই আর অফার করিনি।
—–ভালোই করেছিস। তাহলে হয়তো তোর সাথে সম্পর্কটা আর এগুতো না।
—-ম্যালা বকবক হলো। এবার ওষুধটা খেয়ে নাও। তবে আমার বিয়ের পর তুমি আর আমার হাতে খাবে না।
—-তোর একথা মনে হবার কারণ?
——সময় সব বলে দিবে।

অবশেষে বিয়ের দিন ঘণিয়ে এলো। গতকাল আয়ানের গায়ে হলুদ ছিলো। খুব ঘরোয়াভাবে হলুদ করা হয়েছে। আজ বিয়ের দিন। পুরো বাড়িটা তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ফুলের ঘ্রাণে পুরো বাড়িটা ভরে আছে। সানাইয়ের সুর বাজছে।এই সুরটা যেন নুরবানুর বুকে শেঁলের মতো বিঁধছে।ওর জীবনে কোনোদিন বিয়ের সানাই বাজবে না।একজীবনে হয়তো সবার সব কিছু হয় না। বাড়িটা আলোকসজ্জা করা হয়েছে। আয়ানের এতো বিদ্যুত অপচয় করার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু দাদী জুলেখা বিবির কথা রাখতেই আয়ানকে এই উদ্যেগ নিতে হয়েছে।
আজ সকালে শেহজাদ থাইল্যান্ড থেকে ফিরেছে। যদিও একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। কিন্তু শেহজাদের এই বিয়েতে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ব্যবসায়িক বন্ধু আজগরের মেয়েকে বউ করে আনার শেহজাদের খুব ইচ্ছা ছিলো। এতে ওর বিজন্যাসটা আরো প্রসারিত হতো। কিন্তু আয়ানকে কিছুতেই বশে আনতে পারলো না। নুরবানু ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠা আয়ানের মন মানসিকতাও নুরবানুর মতো।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধা হলো। আয়ান ওর বন্ধুদের সাথে পার্লারে যাওয়ার সময় নুরবানুর রুমে এসে বললো,
—–ফুফী তুমি কিন্তু অবশ্যই লালশাড়িটা পরে যাবে। যদি তোমার পরণে লালশাড়ি না দেখি তাহলে আমিও বিয়ের আসনে বসবো না। কথাটা যেন তোমার মনে থাকে।
—–তুই আমাকে নিয়ে পরে আছিস কেন? বিয়ে তো তোর।
—–না,তোমাকে পড়তেই হবে
একথা বলে আয়ান পার্লারে চলে গেল। নুরবানু মনে মনে হাসছে আর ভাবছে, আজকাল বরকে সাজানোর জন্য পার্লার ও আছে। নুরবানু মাগরিবের নামাজ পড়ে লালশাড়িটা হাতে নিয়ে বসে আছে। আয়ান যদিও ওর ভাইয়ের ছেলে তবুও মনে মনে নুরবানু ওকে নিজের ছেলে বলেই ভাবে। আয়ানের কথা রাখতেই জোর করে শাড়িটা নিজের গায়ে জড়ালো। আয়নাতে চোখ পড়তেই নুরবানু নিজেকে দেখে অবাক হচ্ছে। মনে হচ্ছে ও যেন বিয়ের কনে। এমনসময় পরীবানু এসে বললো,
——এই শাড়িটাতে তোমাকে যে কি সুন্দর লাগছে! আসো তোমাকে সাজিয়ে দেই।
——তুমি সাজবে না। আজকাল তো বর আর বউয়ের মায়েরাও পার্লার থেকে সেজে আসে।
—–তুমি তো জানো আমি কখনও পার্লারে যাই না। আমার কথা বলছি কেন? তুমিও তো যাও না।
—–তুমি যা সুন্দর ভাবি তোমার পার্লার যাওয়া লাগে না। তোমার স্কীন এখনও মাখনের মতো।
—–তুমিও কম না। বকবক না করে আসো তোমাকে সাজিয়ে দেই। এখন তোমার কোমর ছাপানো চুল। ব্রাউনিস হওয়াতে একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। খোপা করবো নাকি বেনী করে দিবো?
—-আমি তো হেজাব পড়বো। খোঁপা করে দাও।
পরীবানু খোঁপা করে তাতে বেলীফুলের মালা জড়িয়ে দিলো। তারপর হেজাবটা ভালো করে পরিয়ে দিলো। মুখে হালকা পাউডার লাগিয়ে গালে একটু ব্লাশন লাগিয়ে দিলো। চোখ ভর্তি করে কাজল আর টকটকে লাল লিপস্টিক লাগিয়ে দিলো। আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো,
——ভাবি আমাকে এমনভাবে সাজালে দেখে মনে হচ্ছে আমি যেন বিয়ের কনে।
—–সবসময় তো সন্নাসিনীর মতো থাকো। আজ না হয় একটু সাজলে এতে তোমার তো কোনো ক্ষতি হবে না তাই না?
অগত্যা বাড়ির সবাই রাওয়া ক্লাবের দিকে রওয়ানা দিলো। জুলেখা নুরবানুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই সাজে কোনোদিন নুরবানুকে উনার দেখা হয়নি। বুকের ভিতরটা একটু মোচড় দিয়ে উঠলো। মেয়েটার প্রতি উনারা এতো কঠোর না হলেও পারতেন। তাহলে সারাজীবন মেয়েটাকে এমন বৈধব্যের বেশে জীবন কাটাতে হতো না। ছুটির দিন থাকায় গাড়ি রাওয়া ক্লাবে তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল। সবাই গুটি গুটি পায়ে বরের আসনের দিকে এগিয়ে চললো। কিন্তু নুরবানু বরের পাশে আগুন্তককে দেখে চমকে উঠলো। চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা মাথার ঘনচুলগুলো আধপাকা পরণে লালপাঞ্জাবী নুরবানুর চিনতে একটুও সমস্যা হয়নি। ওর পা,টা যেন আর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছে না। কে যেন ফেভিকল দিয়ে আটকে দিয়েছে। নুরবানুর দুচোখ বেয়ে কাজল ধোয়া পানি গড়িয়ে পড়ছে।

চলবে