আমার আছে জল পর্ব-০৩

0
123

#আমার_আছে_জল
#পর্ব_৩
#আহানা_জেরিন

ভ্যান থেকে নেমেই চিত্রা পলকহীন চোখে ঊর্ধ্বদৃষ্টে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো সামনে অবস্থিথ প্রাচীর ঘেরা বিরাটকার বাড়িটার দিকে। আফজাল সাহেব দুইটা ব্যাগ এগিয়ে দেয় চিত্রার দিকে। চিত্রা হকচকিয়ে ব্যাগগুলো নেয়। আফজাল সাহেব মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে এগিয়ে যায়। ঘরে ঢুকবে এমন সময় এক বর্ষীয়সি মহিলা তেড়ে আসে। ঝাঁঝালো গলায় বলে,

– এই এই কে রে তোরা? এখানে কি চাস? ও লতা দেখ না কারা এরা বাড়িতে ঢুকলো কি করে?

আফজাল সাহেব কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকে। তার হাতে থাকা দই আর মিষ্টির প্যাকেট গুলো নিচে রাখতে রাখতে বলে,
– আ আ আমি বিনার বাবা আর ও হলো আমার মেয়ে চিত্রা।

মহিলাটি কপাল কুচকে তাকায়। মেকি হেসে বলে, ওহ নাত বউয়ের আত্মীয় তোরা। আয় আয় এখানে বস। বাড়ির সক্কলে তো শহরে গেছে। ও লতা গোয়াল ঘর থেকে মাদুর নিয়ে আয়।

চিত্রা অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে যায়। তার বুঝে আসে না নতুন বউয়ের বাবাকে কেও মাদুর পেতে বারান্দায় বসতে দেয় কিভাবে। তেমন কিছু বললো না সে চুপচাপ বসে পরে। তার বাবার মুখের দিকেও তাকানো যাচ্ছে না। লজ্জায় তার মুখখানা নুইয়ে পরেছে।

মহিলাটি পাশের উঁচু চকিতে বসে আড়চোখে আপাদমস্তক দেখছে চিত্রাকে। যা চিত্রার অজানা নয়। কিছুক্ষণ পর এক অল্প বয়স্কা মেয়ে এক বাটি সন্দেশ আর এক গ্লাস পানি এনে সামনে দেয়। আফজাল সাহেব আস্তে আস্তে মাথা তুলে বললো, –

– বলছি যে আম্মা আমার মেয়েটাকে যদি একটু
– আহ এসেছিস যখন দেখা তো পাবিই।

খানিক বাদে গাঢ় বেগুনি রঙের মোটা শাড়ি পরে বিনা মাথা নিচু করে আসলো। চিত্রার গভীর চোখ মূহুর্তেই চিকচিক করে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বিনাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায়া ভেঙে পরে চিত্রা। আফজাল সাহেবও চোখের পানি মুছতে বৃথা চেষ্টা করছে। এদিকে বিনার গা ঘিনঘিন করছে। তার ওতো দামি শাড়িতে চিত্রার হাত লেগে গেলো যে। বিনা চিত্রাকে সরিয়ে নিয়ে আফজাল সাহেবের কাছে যায়। চিত্রা প্রশন্নমুখ নিয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকে।

অনেকটা বিনার জোড়াজুড়িতেই আফজাল সাহেব দুপুরের খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য রাজি হলো। চিত্রা ভীষন খুশি হয়। গুটিগুটি পায়ে সে বাগানের দিকে যায়। সেখান থেকে একটা টকটকে জবা ফুল তুলে নেয়। মনে মনে ভাবে রনক ভাইকে দেওয়া যাবে। হঠাৎ কে যেন খপ করে হাত ধরে ফেলে। চিত্রা ভয়ে ভয়ে পেছনে ফিরতেই পিয়াস কে দেখতে পায়। চমকে ওঠে সে। সঙ্গে সঙ্গে হাতে থাকা জবা ফুলটা পরে যায়। পিয়াস অবাক হয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে লজ্জামিশ্রিত মুখ নিয়ে ফুলটা তুলে চিত্রার হাতে দিতেই বিনা চেঁচিয়ে ওঠে।

এমন চিৎকারে পিয়াস এবং চিত্রা উভয়ই হকচকিয়ে ওঠে। বিনা এগিয়ে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, আপনি ওরে ফুল দিচ্ছেন?

চিত্রা কিছু বলতে যাবে হঠাৎ করে বিনা চিত্রার গালে কষিয়ে থাপ্পড় মারে। চিত্রা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে গালে হাত দিয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকে।

তুই আমার জীবনটারে শেষ করতে আসছিস? বোনের সংসার ভাঙবি?

– আহ বিনা না জেনে বুঝে আপার সাথে এমন করছো কেন? ভুল করেছি আমি। আমি জানতাম না উনি বাসায় এসেছে।

– আপনি কিচ্ছুটি বলবেননা এখন।

আফজাল সাহেব এগিয়ে আসে। বিস্ময় মুখ নিয়ে বলে কি হইছে মা?

– কি হয়নি বলো বাবা। তোমার মেয়ের তো খুব বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে। তাই নিজের বোন জামাইয়ের দিকে হাত বাড়ায়।

– এইসব কি কথা!

বিনা পিয়াসের দিকে তাকিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে, জানেন আপনার সাথে আপার বিয়ে ভাঙার পরে আপা মন খারাপ করেছিল। আপা আপনাকে ভালোবাসে। আর আপনি ওরে ফুল তুলে দিচ্ছেন।
পিয়াস লজ্জায় মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলে, সামনে আব্বা আছে চুপ করো।

চিত্রার শরীর কেমন জমে গেছে। শুধু চোখজোড়া কথা বলে যাচ্ছে অনবরত। আফজাল সাহেব চিত্রাকে এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে বলে, আমার মেয়ে কিছু করেনি বাবা। ও ওমন ধরনের মেয়ে না বাবা। বিশ্বাস করো।

পিয়াস লজ্জায় মাথা তুলতে পারছেনা। এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই এই ধরনের। কেও কিছু বললে মাথা নিচু করে থাকবে। বিনা কঠোর ভাবে বলে, বাবা তুমি সারাজীবন তো ওর পক্ষ নিয়েই কথা বলে গেলে। তোমার যে আরেকটা মেয়ে আছে সে কথা তো ভুলেই যাও মাঝে মাঝে। এবার বুঝি মা কেন তোমার আদরের মেয়ের সাথে আমাকে মিশতে না করতো।

আফজাল সাহেব ভেজা চোখে বলে, আমাকে মাফ করে দে মা। আমার ভুল হয়েছে আমার মেয়েটারে নিয়ে এ বাড়িতে আসা। ও যে এই পৃথিবীর বাইরের লোক তা তো ভুলেই গেছিলাম।

ছোট্ট ভ্যান গাড়ি চলছে। মৃদু বাতাসের ঝাপটায় চিত্রার হুস আসে। পেছনে ফিরে বলে, বাবা আমি সত্যিই অপয়া তাইনা? আমার জন্য আজ ও বাড়ি থেকে এভাবে চলে আসতে হলো? তুমি বিশ্বাস করো আমি তেমন কিছু করিনি। বিনা শুধু শুধু ভুল বুঝলো।

কথাটা বলেই চিত্রা আবার আগের মতো অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। আফজাল সাহেব দুই হাত মাথায় দিয়ে নিচু হয়ে বসে আছে। তার কানে বিনার বলা প্রত্যেকটা কথা ঝনঝন করে বাজছে।

সন্ধ্যার দিকে তারা বাড়ি ফিরলো। চিত্রা এক দৌড়ে ঘরে চলে যায়। রাজিয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলে, কি গো চলে এলে যে? আমি তো ভাবলাম আজ বুঝি থাকবে। ভাত ও বসাইনি।

– ভাত খাবোনা রাজিয়া আমার পেট যে ভরে গেছে।
– উহহ আগে বলো বিনা কেমন আছে?
– ভালো। খুব ভালো।
রাজিয়া বেগমের মুখ খুশিতে চিকচিক করে ওঠে।

সূর্য ডুবেছে সেই কখন। অন্ধকারে ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। উত্তরের ঘরটাতে এখনো একটা মোমবাতি জ্বলছে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। চিত্রা জানালার পাশে বসে আছে। হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে চোখজ্বালা করছে তার। তবুও আরেকবার চোখ মুছে ফেলে। হঠাৎ কেমন একটা খচখচ শব্দে চিত্রা ভড়কে যায়। খাটের ওপর থেকে ওড়নাটা নিয়ে ভালো করে মাথায় পেচিয়ে নিয়ে জানালার একপাশে গিয়ে দাড়ায়। ভয়ে ভয়ে বলে, কে ওখানে?

– আমি রে আমি

চিত্রা ভয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলে, আ আমি কে?
– তুই কে সেটা আমি কি করে বলবো? তবে আমি ওপাশের বটতলার কাইল্লা ভুত।
– কিই ই ভু ভুত।
– আরে ভিতুর ডিম আমি রনক। একটু ঠাট্টা ও করতে দিবি না নাকি যত্তসব।

চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে জানালার কাছে আসে। ঠিক তখনি দুটো হাত জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে এসে চিত্রার হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। ধরা গলায় বলে, ভয় পেয়েছিস বউ?

চিত্রা হাত সরিয়ে নেয়। মোমবাতিটা হাতে নিয়ে আবার জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,

– আমি তোমার বউ হলাম কবে থেকে? পাগল হলে নাকি?
– হ্যাঁ কিছুটা।
– কি?
– বুঝিস না?
– না
– বুঝবি কেমনে মাথায় তো গোবর দিয়ে ভরা। কিছুদিন পর পঁচে সার হবে। পরে গাছ লাগাইস।

চিত্রা ভেঙচি কাটে। ফিসফিসিয়ে বলে, এতো রাতে এসেছো কি আমার মাথায় গাছ লাগাইতে?

– না রে ছাগল।
কথাটা বলেই রনক ছোট্ট পলিথিন থেকে দুইটা পেয়ারা বের করে এগিয়ে দেয় চিত্রার দিকে। চিত্রা পেয়ারা গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে একটাতে কামড় বসিয়ে বলে, কার বাড়ি থেকে চুরি করলে রনক ভাই? তাও আবার এতো রাতে?

রনক বিরক্ত হয়ে বলে, চুপ বলদি। খা এতো কথা বলিস কেন।

রাত তখন অনেক। কিন্তু আফজাল সাহেব অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুমাতে পারছে না। তার মাথায় প্রচন্ড পরিমাণে যন্ত্রণা করছে। হঠাৎ মাথাটা দু হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে ওঠে, আমার মেয়ে অপয়া না। আমার মেয়েকে মারিস না। মারিস না ওরে। মারিস না।

রাজিয়া বেগম হকচকিয়ে উঠে পরে। আফজাল সাহেবকে অনবরত ধাক্কা দেওয়ার পরেও থামছে না। একই কথা বারবার বলে যাচ্ছে। রাজিয়া বেগমের শরীর মুহূর্তেই ঘেমে যায়। তার মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। বহু কষ্টে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, চিত্রা তোর আব্বা জানি কেমন করছে।

চলবে,,,