আমার আছে জল পর্ব-০৪

0
133

#আমার_আছে_জল
#পর্ব_৪
#আহানা_জেরিন

চিত্রা তখন মাত্রই শুয়েছিল। মায়ের এমন চিৎকারে ধরফরিয়ে ওঠে দৌড়ে এ ঘরে আসতেই খাটের কোনার সাথে লেগে পরে যায়। মুহূর্তেই তার ঠোঁট কেটে দরদর করে রক্ত পরতে থাকে। তবে সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে অতিব্যস্ত হয়ে বাবার মাথার পাশে গিয়ে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আফজাল সাহেব ততক্ষণে চুপ হয়ে গেছে। চোখজোড়া তার পুরোপুরি বন্ধ। চিত্রা আফজাল সাহেবের নাকে হাত দেয় বুকের মধ্যে মাথা নিচু করে, হাত ধরে ঝাঁকাতে থাকে। অতঃপর করুণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়। রাজিয়া বেগম ভয়ার্ত মুখ নিয়ে বসে আছে।

পুরো ঘরে স্তব্ধ নিরবতা বিরাজ করছে। চিত্রা আস্তে আস্তে মায়ের হাত ধরে বলে, মা। রাজিয়া বেগম তাকায়। তার চোখে মুখে এখনো ভয় লেপ্টে আছে। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে, তোর লোকমান চাচা,,

চিত্রা পুরো কথাটা আর শুনলো না কারণ এতোটুকুতেই সে বুঝে গেছে। এক দৌড়ে সে লোকমান চাচার বাসায় যায়। প্রায় ১০ মিনিট পরে চিত্রা আর লোকমান হন্তদন্ত হয়ে আসে। আফজাল সাহেবের নাকে হাত দিয়েই সে দুই পা পিছিয়ে যায়। চিত্রা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে, চাচা বাবার কি হয়েছে? বাবা তো আর কথা বলেনা চাচা। লোকমান ছোট ছোট চোখ করে বলে, ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করছে মনে হচ্ছে। চিত্রা ধপাস করে বসে পরে। রাজিয়া বেগম তখনো নিশ্চুপ। লোকমান চিত্রার মাথায় হাত রেখে বলে, মৃ’ত্যু বলে কয়ে আসে না রে মা। নিজেকে শান্ত কর। তোর এই অবস্থা হলে তোর মা কে দেখবে কে?

আজকের সকালটা শুরু হলো বৃষ্টি দিয়ে। সেপ্টেমবর মাসের শেষের দিকে বলেই হয়তো এমন। বাইরে হালকা কুয়াশা আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আজ খুব সকাল সকাল রনকের ঘুম ভাঙে। ব্রাশ নিয়ে বের হয়ে সামনে হাটা ধরে। আচমকা চিত্রাদের বাড়ির দিকে চোখ যায়। আবছা আবছা কুয়াশার মধ্যেও সে স্পষ্টই বুঝতে পারলো একটা ভ্যান আর পাশে ছাতা নিয়ে কেও দাড়িয়ে বিনার সাথে কথা বলছে। রনক আস্তে আস্তে গিয়ে উঁকি দেয়। চিত্রা তখন বারান্দার খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। রনক হালকা হেসে বলে, কিরে কোথাও যাচ্ছিস নাকি। চিত্রা মুখ তুলে তাকায়। মিনমিনিয়ে বলে, হ্যাঁ তবে আমি না বাবা। রনক কিছু বলতে যাবে এমন সময় ঘর থেকে দুইজন লোক সাদা কাপড়ে মোড়ানো কাওকে নিয়ে বের হয়ে ভ্যানে তুললো। রনক সেদিকে পা বাড়াতেই চিত্রা ওর হাত ধরে ফেলে।

– ওদিকে কোথায় যাচ্ছো?
– কে ওটা
– বললাম না তোমাকে বাবা ঘুরতে যাচ্ছে। তোমার গিয়ে কাজ নেই।

রনক এক ঝাঁকিতে চিত্রার হাত ছেড়ে দেয়। মৃদু চিৎকার করে বলে ওঠে, চিত্রা!! মুহূর্তেই রনকের চোখে অশ্রুর কণা চিকচিক করছে। এইতো সেদিনও বাজারে দেখা হলো মানুষটার সাথে।

বিনার সাথের ছেলেটা সেই কখন থেকে দেখছিলাম ওকে সান্তনা দিতে দিতে ক্লান্ত। এটাই হয়তো পিয়াস।ছেলেটা ভ্যানে ওঠার আগমুহূর্ত পর্যন্ত বিনাকে শান্ত হতে বললো। অতঃপর লা’শবাহী ভ্যানটা চলে যায়। চিত্রা তখনো ওইভাবেই বসে আছে। হঠাৎ রাজিয়া বেগম ঘর থেকে বেড়িয়ে চিত্রার গায়ে লাথি দেয়। চিত্রা তাল সামলাতে না পেরে বসা থেকে ধপাস করে আমার পায়ের নিচে পরলো। রাজিয়া বেগম চিৎকার করে বলে, তোর জন্য হয়েছে সব। সব তোর জন্য। মানুষটারে তুই শান্তিতে বাঁচতে দিলি না। শেষ নিশ্বাস ফেলার সময়ও তোর মতো অপয়ার নাম নিয়েছে।

কথাটা বলেই রাজিয়া বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। রনক চিত্রাকে আস্তে আস্তে উঠিয়ে বলে, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে চাচাকে চিত্রা নিজে হাতে মেরেছে।

বিনা তেড়ে আসে আমার সামনে। কটমট চোখে বলে, সেই কখন থেকে দেখছি আপনি এখানে। আমার বাবা মা’রা গেছে আর আপনি কি তামাশা দেখতে এসেছেন? প্রতিবেশি যখন তখন প্রতিবেশির মতোই থাকবেন। আমাদের পরিবারের ব্যাপারে আপনাকে নাক গলাতে বলা হয় নাই। আর মা যা বলেছে তা পুরোটাও মিথ্যা না। যান এখান থেকে।

চিত্রা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। রনক বাঁকা হেসে বলে, ভালোই কথা শিখেছিস বিনা। কয়দিন আগেও তো বিছানায় হিসু করতিস। আজ ভালো ঘরে বিয়ে হয়ে সাহস বেরে গেছে তাই না। যেই বোনের জন্য আগে কলিজা কেটে দিয়ে দিতি আজ সেই বোনকেই এইসব বলছিস। লজ্জা থাকা উচিত।

কথাগুলো বলে রনক চলে যায়। বিনা পিতা হারানোর শোকে এতোটাই কাতর যে রনকের পরের কথাগুলো তার আর গায়ে লাগলো না। অন্যদিন হলে হয়তো এর কঠিন জবাব দিতো। তবে আজ তার কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই নেই।

চিত্রা বারান্দার একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। কালকে রাতে বাবার সেই চোখ, সেই চিৎকার সবকিছু তাকে প্রবলভাবে আষ্টেপৃষ্টে রেখেছে।

নভেম্বরের প্রায় শেষ। তবে শীতের রেশ মাত্রই শুরু। কনকনে ঠান্ডা। বাইরের অবস্থা আরো শোচনীয়। কুয়াশায় সামনের মানুষকেই স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। চিত্রা এই সকাল সকাল চাদর মুড়িয়ে বের হয়েছে। কলের একপাশে তার নিজের হাতে করা ছোট সবজির বাগান। মোটে কয়েকটা গাছ। লাউ গাছে থেকে ছোট একটা লাউ তুলে নিয়ে সে তড়িঘড়ি করে ঘরে যায়। বটি নিয়ে লাউ কুটতে বসে। আজ তার মা আসবে সব ভালো করে গুছিয়ে রাখতে হবে নইলে পিঠের ওপর দু ঘা পরবেই এতে কোনো সন্দেহ নেই।

আফজাল সাহেব মা’রা গেছেন আজ ২ মাস প্রায়। রাজিয়া বেগম এখন প্রায়ই তার ছোট মেয়ের শশুরবাড়ি যায়। যতদিন ইচ্ছা সে থাকতে পারবে এই অনুমতি তাকে আরো কিছুদিন আগেই দেওয়া হয়েছে। পিয়াস ছেলেটা চিত্রা এবং রাজিয়া বেগম উভয়কেই তাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছেন। তবে বিনা এতে দ্বিমত পোষণ করে। তার এক কথা চিত্রা এ বাড়িতে আসতে পারবে না। চিত্রা মনে মনে কষ্ট পেলেও আত্মসম্মানের দোহাই দিয়ে নিজেকে সংবরন করেছে।

রনকের ডাকে চিত্রার হুশ আসে। এক দৌড়ে বাইরে চলে আসে। রনক মৃদু ধমকে বলে, কতক্ষণ ধরে ডাকছি কোথায় ছিলি?

– ঘরেই তো।
– তোর মা কোথায়?
– বোনের বাড়ি গেছে।
– জানতাম আমি। তার এই একটাই কাজ। স্বামী নাই এখন শুধু টইটই করে ঘুরে বেড়াবে। বড় মেয়েটারে এইভাবে ঘরে রেখে কিভাবে থাকে বুঝিনা।
– আহ। তুমি আবার এসব নিয়ে কেন পরলে? তারা আর কতো করবে বলতো? বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তাদের দেওয়াতেই তো পেটে খাবার পরে নইলে তো কবেই,,

চিত্রা আর কথা শেষ করতে পারেনা। গলার স্বর কেমন ধরে আসছে। বাবার কথা যে তার আবার মনে পরলো। এখন আর তার কান্না আসে না। কান্নাগুলো কেমন দলাপাকিয়ে গেছে। এখন নিরব দীর্ঘশ্বাসই তার একমাত্র সঙ্গী। রনক সোয়েটারের পকেট থেকে ছোট একটা কাগজের ঠোঙা চিত্রার হাতে দেয়।

– এটাতে আবার কি আছে?
– চিতই পিঠা। একটু আগেই কিনে আনলাম। ঠান্ডা হওয়ার আগেই খেয়ে নিস কেমন।
– তুমিও না রনক ভাই

রনক হালকা হেসে চলে যায়। চিত্রা করুণ দৃষ্টিতে রনকের চলনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটা না থাকলে হয়তো চিত্রা নিজেকে এতোটা শান্ত রাখতে পারতো না। তোমারে অনেক ভালোবাসি রনক ভাই। আনমনে কথাটা বলেই চিত্রা মুচকি হাসে।

সন্ধ্যার দিকে দরজায় ঠকঠক আওয়াজে চিত্রার ঘুম ছুটে যায়। মাত্রই সে শুয়েছিল। ধরফরিয়ে উঠে দরজা খুলে দেয়। রাজিয়া বেগম কটমট চোখে একপলক তাকিয়ে চলে যায়। চিত্রা রান্নাঘর থেকে ভাতের পাতিল এনে রাখতেই রাজিয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলে, শুনছিস একটা ভালো খবর আছে। চিত্রা পেছন ফিরে বলে, কি মা?

– তোর ভালো একটা সম্বন্ধ এসেছে। ছেলের বিরাট ব্যবসা। বেশি ভাই বোনও নেই। একটা বড় বোন তাও বি’ধবা। আর শুধু বাপ মা। সুখের সংসার। শুধু একটা সমস্যা আছে।
– কি সমস্যা মা?
– তেমন কিছু না। ওই ছেলেটার আগের ঘরের একটা আট নয় বছরের মেয়ে আছে বউ অনেক আগেই মা’রা গেছে। বুঝলি কিছু?

চিত্রার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। মুখ ঘুরিয়ে বলে,
– আমি এই লোকরে বিয়ে করবোনা মা। আগে বিয়ে হয়েছিল আবার একটা মেয়েও আছে। তুমি বুঝতে পারছো না কতটা জঘন্য কাজ করতে যাচ্ছো?

– কিহ আমি জঘন্য কাজ করছি? দেখ চিত্রা তোর অনেক তালবাহানা শুনেছি। এই পাত্র আমি মোটেও হাত ছাড়া করবোনা। তোর নাই বাবা। সংসারের হাল ধরার মতো কোনো ভাইও নাই। তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি শান্তিতে ওই বাড়িতে থাকতে পারবো। আর কোনো চিন্তাই থাকবেনা।

চিত্রা চুপচাপ চলে আসে। বিছানার চাদর খামছে ধরে বসে থাকে। চোখ মুখ খিঁচে মৃদু শব্দে কান্না করতে থাকে। সারাজীবন মানুষের উপেক্ষার পাত্রীই ছিলাম। কিন্তু আর না। আমারো ভালো থাকার অধিকার আছে। আমি রনক ভাইকে ছাড়া অন্যকাওকে বিয়ে করতে পারবোনা। এই কথাটা মা কে কিভাবে বুঝাবো।

আচমকা এমন কথায় চিত্রার কান্না থেমে যায়।জানালার কাছে গিয়ে দাড়ায়। বাইরের তীব্র ঠান্ডা বাতাস চিত্রার শরীরে লাগতেই সারা গা শিউরে ওঠে। ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, আমাকে বাঁচাও রনক ভাই। তুমি ছাড়া আমারে কে বুঝে? আমি যে শুধু তোমার বউ হইতে চাই।

চলবে,,,