আমার আছে জল পর্ব-০৫ এবং অন্তিম পর্ব

0
204

#আমার_আছে_জল
#পর্ব_৫ (অন্তিম পর্ব)
#আহানা_জেরিন

খুব সকাল সকাল চিত্রা চাদর মুড়ি দিয়ে বের হয়েছে। রাজিয়া বেগম তখনো ঘুমে বিভোর। চিত্রা দ্রুত পায়ে হাঁটছে। উদ্দেশ্য সামনের চায়ের দোকান। প্রতিদিন সকালে রনক এখানে এসে আড্ডা দেয় এই কথাটা চিত্রার অজানা নয়। আজও নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম হবেনা।

চিত্রা খানিক দূর হতে রনক কে ইশারায় ডাকে। রনক প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বুঝলো এটা চিত্রা। এই মেয়েটাও না শীতের মধ্যে রোজ বের হবেই। কথাটা বলেই রনক হাটা ধরে। রনক কে আসতে দেখে চিত্রা আরেকটু কাছে যায়। রনক একটু বিরক্ত হয়ে বলে, কিরে কি হইছে? চিত্রা বলতে যেয়েও থেমে যায়। শব্দগুলো কেমন ঠোঁটের কিনারায় এসেও যেন ঠাই পেলো না। রনক চিত্রার মাথায় হালকা চাপড় দিয়ে বলে, কি? বলবি? নাকি চলে যাবো?

– না না বলছি
– বল
– রনক ভাই
– বলবি তো নাকি?
চিত্রার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। চোখজোড়া বন্ধ করে এক নিশ্বাসে বলে ওঠে, আমাকে বিয়ে করবা তুমি?
রনক দুই কদম পিছিয়ে যায়। হঠাৎ কিছু একটা মনে করে চিত্রা মুখের সামনে এসে বলে, পাগল কি পুরোপুরি হয়েছিস?
চিত্রা চোখ খুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে। রনক আশেপাশে তাকিয়ে বলে, বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে আকাশের অবস্থা ভালো না তুই বাড়ি যা তো।

– আমি তোমাকে কিছু বলেছি
– শুনেছি
– রনক ভাই
– আবার কি
– আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

রনক ঘাড় দুই পাশে কাত করে দুই হাতের তালু ঘষতে ঘষতে বলে, ভালো কথা। দাওয়াত করতে এসেছিস? কষ্ট করতে গেলি কেন বিনা দাওয়াতে খাওয়ার অভ্যাস আমার আছে তো।

চিত্রা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। বিয়ের কথা শুনে একটুও চমকালো না? চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে, আমি তোমাকে ভালোবাসি রনক ভাই। তোমারে ছাড়া অন্যকাওরে বিয়ে করতে পারবো না। তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো তাই না? বলো?

রাগে রনকের কপালের রগ ফুলে ওঠে। চিত্রার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, কোনোদিন বলেছি তোকে ভালোবাসি? যত্তসব। এইজন্যই বাবা বলতো তোদের মতো ছোট জাতের সাথে যেন না মিশি। এখন বাবার কথার যথার্থতা বুঝতে পারছি।

চিত্রার কান্না থেমে যায়। মাথা তুলে রনকের দিকে তাকায়। একি সেই রনক ভাই যে সকলের অবহেলায় ছুড়ে দেওয়া সেদিনের সেই চিত্রার হাত ধরে এতোটা পথ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে? তবে কি আমিই ভুল? এত বড় ভুল কি করে করলাম। চিত্রা এক কদম করে পিছনে যেতে যেতে হঠাৎ দৌড়ে চলে যায়। রনকের মাথায় যেন কিছুই ঢুকলো না। তবে চিত্রার সাথে যে শুধু শুধুই প্রেমের নাম করে মজা করতো তা একদমই সত্যি। চিত্রার মতো সরল সোজা মেয়ের সাথে শুধু প্রেমের অভিনয়ই করা যায় বিয়ে না। আমার মতো পড়ালেখা জানা সভ্য ভদ্র ছেলে একটা মূর্খ কালো মেয়েকে কেনোই বা বিয়ে করতে যাবে। কথায় আছেনা বসতে দিলে শুইতে চায়।

রনকের সাথে চিত্রার এই কথোপকথন। এরই মধ্যে কেটে কেছে এগারোটা দিন। এই কয়দিন দুজনের একবারের জন্যও সাক্ষাত হয়নি। চিত্রা স্বইচ্ছায় নিজেকে রনকের কাছ হতে গুটিয়ে নিয়েছে। এমনকি বিয়েতেও রাজি হয়েছে। পড়শু তার বিয়ে। হবু শশুর বাড়ি থেকে কতকিছু চিত্রার জন্য পাঠিয়েছে। শাড়ি, চুড়ি, আলতা সব। তবুও চিত্রার মনে বিন্দুমাত্র শান্তির রেখা মিলে না। রাজিয়া বেগম এখন আর চিত্রাকে মারে না বকে না। চিত্রা যেন তার দুই চোখের মণি। মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে বাড়ির সমস্ত কাজ রাজিয়া বেগম নিজে হাতে করে। চিত্রা মাঝে মাঝে ভাবে বিয়েতে রাজি হয়ে একপ্রকার ভালোই হয়েছে মায়ের ভালোবাসা কি জিনিস অল্প হলেও বুঝতে পেরেছি।

তবে সেদিন আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটলো। চিত্রা কলসি ভর্তি করে পানি নিয়ে কলের পাড় হতে আসছিল। হঠাৎ দুটো ফুলে সজ্জিত গাড়ি তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেলো। চিত্রা খানিকটা ভড়কে গিয়ে ভাবে, এ পাড়ায় আবার কার বিয়ে হচ্ছে। চিত্রা আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যায়। গাড়ি তখন রনকদের বাড়ির সামনে থেমেছে। সদর দরজার সামনে অনেক মানুষ। চিত্রা আরেকটু এগিয়ে দেখলো,

পুঁতির কারুকাজ করা সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত একজন লম্বামতো ছেলে গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে লাল বেনারসি পরা মেয়েটাকে বের করলো। আশেপাশের মানুষজন এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে। চিত্রা মাথার কাপড়টা কপাল অব্দি টেনে লোকজনের ভিড়ে মিশে সামনে যায়। হঠাৎ বর বেশে থাকা ছেলেটার দিকে তার চোখ পরলো। এটাতো রনক ভাই। সঙ্গে সঙ্গে চিত্রার হাতে থাকা মাটির কলসিটা ধপ করে পরে যায়। ভিড় ঠেলে ছুটে গিয়ে সকলের সামনে রনককে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে চিত্রা।

রনকের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে ওঠে। চারপাশে মানুষের উৎসুক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বউ সাজে সজ্জিত মেয়েটি চিত্রার এক হাত ধরে টেনে দূরে সরিয়ে চিত্রার গালে সজোড়ে থাপ্পড় মারে। অশ্রুসিক্ত নয়নে সে একবার রনকের দিকে তাকায়। রনকের এই দৃষ্টি তার অজানা। চোখে মুখে কেমন ভয়ংকর রাগ লেপ্টে আছে। সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা মাটিতে লুটিয়ে পরে।

জ্ঞান ফিরলো রাত সাড়ে নয়টায়। চিত্রা চোখ পিটপিট করে তাকাতেই রাজিয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে কাছে এসে বলে, মা এখন ভালো লাগছে তো?
চিত্রা কথার উত্তর দেয় না। উল্টোদিক হয়ে শুয়ে থাকে। বিনা চিত্রার মাথার কাছে বসে বলে, আমি কিন্তু সবটা আগেই জানতাম। চিত্রা তাও উত্তর দেয় না। বিনা আবার বলে, যখন সে ভালো থাকতে পারে তখন তুমিও ভালো থাকার অধিকার রাখো। এই বিয়েটা করলে তুমিই সুখী হবে আমরা কেও তোমার সুখ কেড়ে নিবো না। চিত্রা ঘনঘন চোখের পলক ফেলে। মানুষের পরিবর্তন হবে এই চরম সত্যিটা মেনে নিতে কলিজা ছিড়ে গেলেও মেনে নিতেই হবে। যেই সময়টায় প্রচন্ড পরিমাণ হতাশার সাগরে হাবুডুবু খেতে হয় ঠিক সেই সময়েই মানুষ তার ভেতরকার কাঠিন্য রুপে খোলাসা হয়। আর সেই আগুনরঙা বিচ্ছুরণ রুপের আঁচে অপরপ্রান্তের মানুষটাকে প্রতিনিয়তো ঝলসাতে থাকে একদম পুরোপুরি ক্ষয় হওয়ার আগ পর্যন্ত।

দুইদিন কেটে গেলো। আজ বৃহস্পতিবার চিত্রার বিয়ে। চিত্রাদের বাড়ি ভর্তি মানুষ। বেশ বড়সড় করেই আয়োজন করা হচ্ছে। চিত্রার হবু স্বামী আকবর মন্ডল বিয়ের জন্য প্রায় বেশখানিক টাকা রাজিয়া বেগমের হাতে দিয়েছে। সেদিনের পর রনকের সাথে দ্বিতীয়বার আর দেখা হয়নি। চিত্রার বুক চিরে বোবা কান্নারা বেড়িয়ে আসে। যদি একপাক্ষিক ভালোবাসতাম তাহলে না হয় তোমার পরিবর্তন মেনে নেওয়া যেত। তোমার আচরণে কি বুঝাতে? বউ বউ বলে কি বুঝাতে রনক ভাই?
এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর আসে না।

সন্ধ্যে নেমেছে তখন। বড় আয়নার সামনে গিয়ে চিত্রা পেছন ফিরে বিনার দিকে তাকায়। বিনা হাসতে হাসতে বলে বোকা রে এটা এমনি। তুই বস আমি সব নিয়ে আসছি। চিত্রা মাথা নাড়িয়ে বসে পরে। বউ সাজার যে শখ তার ছিল আজ বুঝি পূরণ হচ্ছে। আজ তার বাবার কথা খুব করে মনে পরছে। তার মেয়ের বিসর্জন যে সে দেখতে পারলো না।

গাঢ় খয়েরী রঙের জামদানি শাড়ী পরানো হয়েছে চিত্রাকে। কোমর সমান চুলটা বেঁধে সেখানে শুভ্র বেলি ফুলের মালা দিয়ে লাগানো। টানাটানা চোখ দুটোতে গাঢ় কাজল দেওয়ায় তার ছলছল চোখ বাইরের কারো কাছেই স্পষ্ট হচ্ছে না।

চিত্রা টেবিলওয়ালা ঘরে থাকা বিশাল খাটের এককোনায় কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। একটু পরেই বরযাত্রী চলে আসবে। আর তাকে নিয়ে চলে যাবে। কথাটা ভেবেই তার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। ঘরে আরো একজন ছিল সে হলো বিনা। আয়নার সামনে বসে ইচ্ছেমতো সাজুগুজু করছে। পিয়াসের ডাকে বিনা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, থাক আসছি। বিনা চলে গেলো। চিত্রা আস্তে আস্তে উঠে দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজে বড় ঘরের পেছনের খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে পরে।

বাড়ির পেছন দিকটায় ছোট ছোট ঝোপ। এর মধ্যে দিয়েই চিত্রা দ্রুত পায়ে হাঁটছে আর ক্ষণে ক্ষণে পিছনে ফিরে দেখছে। ঝোপ পেরিয়ে রাস্তায় নামতেই রনক আর তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় চিত্রার। মেয়েটা রনকের হাত শক্ত করে ধরে আছে। চিত্রার এমন বেশভুসায় রনকের কপালে দু ভাজ পরলো। কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারলো না। চিত্রার গাল বেয়ে পানি থুতনিতে এসে মিলিয়ে যায়। চিত্রা রনকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সামনের দিকে দৌড়ে যেতে থাকে। রনক আগা মাথা কিছুই বুঝলো না। চিত্রা এতো রাতে এইভাবে বটতলার দিকে কেন গেলো। আর ও এভাবে হাসলো ও বা কেন?

সারারাত খুঁজাখুঁজির পরেও চিত্রার কোনো হদিস পাওয়া গেলো না। বরযাত্রী এসে লম্বা সময় অপেক্ষা করে রাজিয়া বেগমকে আচ্ছা মতো কথা শুনিয়ে চলে গেছে এবং যেই টাকা পয়সা বিয়েতে খরচ হয়েছে তা একদম হিসেব মতো দিতেও বলে গেছে। রাজিয়া বেগম মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। বিনা একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে। নাহ আপা রনক ভাইয়ের সাথে যায়নি কারণ কিছুক্ষণ আগেও তাকে বউ নিয়ে ঘুরতে দেখলাম। তাহলে আপা যাবে কোথায়। তার তো চেনা জানা তেমন কোনো আপন মানুষ নেই।

হঠাৎ কারো চিৎকারে বিনা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো রনকদের বাড়ির পেছনের বটতলার পুকুর পাড়ের দিকে। আওয়াজটা মূলত এখান থেকেই আসছে। বিনা তার মায়ের হাত ধরে ভীড় ঠেলে সামনে যায়।

ঠিক এরপরদিন সকালবেলা। বাইরে হালকা বৃষ্টি সাথে কনকনে ঠান্ডা বাতাস। রাজিয়া বেগম বারান্দায় একপাশে বসে আছে আর আবল তাবল বকতে বকতে জিনিসপত্র ছুড়ে মারছে। বিনা মা কে শান্ত করতে ব্যস্ত। হঠাৎ রনক ছুটে আসলো চিত্রাদের বাড়ি। ঠিক এমন সময় সাদা কাফনে মোড়ানো নিস্তেজ দেহটা ধরাধরি করে তার সামনে দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কয়েকজন লোক। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় লাশের ওপর থেকে কাপড়টা সরে যেতেই রনক আঁতকে ওঠে। এই মুখটা তার খুব চেনা । খুবই চেনা। কাল যদি তোমার ওমন প্রতিক্রিয়ার রহস্য উদঘাটনে তোমাকে একটিবার ডাক দিতাম তাহলে,,,, কথাটা শেষ করার আগেই লা’শবাহী খাটিয়াটা তার সামনে দিয়ে চলে গেলো।

আচমকা এক শীতল বাতাসের স্পর্শে রনকের সারা শরীর কেঁপে ওঠে। মনে হয় দূর হতে কেও কান্নাজড়িত কন্ঠে বলছে, আমার আরকিছু থাকুক বা না থাকুক এই চোখের কিনারায় এক কলস জল ঠিকই থাকে। সেই জল যে আজ ফুরিয়ে গেছে তাই আমিও ফুরিয়ে গেলাম।

(সমাপ্ত)