#আমার_আছে_জল
#পর্ব_২
#আহানা_জেরিন
রাজিয়া বেগম তড়িৎ গতিতে এসে চিত্রার ভাজ করা হাত ঝাঁকিয়ে বলে, গ্লাসটা ভাঙলি কিভাবে? জানিস ওটার দাম কতো?
চিত্রা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। রাজিয়া বেগম একবার রনকের দিকে তাকিয়ে চিত্রাকে বলে, এইসব চলছে তাহলে। আজ তোর বাবা আসুক।
চিত্রা ভয়ে চুপসে যায়। সে জানে বাবার এসব পছন্দ না। কিন্তু মা কি রনক ভাই কে চিনলো না?
রনক আলগোছে চুল ঠিক করে রাজিয়া বেগমের কাছাকাছি এসে বললো, আসসালামু আলাইকুম চাচি। আমাকে চিনতে পেরেছেন?
রাজিয়া বেগম সালামের উত্তর নিলো না। রাগে ফোস ফোস করতে থাকে। এমন সময় চিত্রার বাবা সামনে এসে বলে, রাজিয়া কি হয়েছে? মেয়েটাকে মারছো নাকি আবার? তুমি একটু,,,
রনক ভাই কে দেখে বাবা কথাটা শেষ করতে পারলো না। হালকা হেসে বললো, রনক বাইরে কেন তুই? যা ঘরে বস।
রনক বাঁকা হেসে বলে, এইতো চাচির সাথে কথা বলছিলাম।
রাজিয়া বেগম কপাল কুচঁকে দাড়িয়ে থাকে। এ তাহলে রনক! সেই কবে দেখেছি। ভুলেই গেছিলাম।
রাজিয়া বেগম চলে যায়। চিত্রা নিচু হয়ে ভাঙা গ্লাসের টুকরোগুলো একটা একটা করে বাটিতে রাখছে।
– তা কবে আসলে?
চিত্রার সহসা প্রশ্নে রনক হালকা হেসে বলে, কালকে বিকেলে। তোর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম কিন্তু পরে যখন শুনলাম বিনার বিয়ে হচ্ছে তখন আর এলাম না।
– ওহহ। মা তোমায় চিনতে পারেনি কিন্তু বাবা তোমাকে কিভাবে চিনলো?
– আফজাল চাচার সাথে কালকে বাজারে দেখা হয়েছিল।
কথাটা শেষ করে রনক হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকালো।
– থাক তাহলে আসি। ও হ্যাঁ বিকেলে বট গাছটার নিচে আসিস কিন্তু। কথা আছে।
রনক চলে যায়। চিত্রা অপলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, মানুষটা একদম পাল্টে গেছে।
বিকেলের দিকে চিত্রা মায়ের ঘরে উঁকি দিতেই দেখে দরজা খুলে ঘুমাচ্ছে। বাবা ও নেই। চিত্রা বুকে থুথু দিয়ে গুটিগুটি পায়ে বাইরে চলে আসে। উদ্দেশ্য বটতলা। এই বটগাছটার নিচে রনকের সাথে যে সে কত গল্প সল্প করেছে তার হিসেব কষতে কষতে যেতে থাকে।
রনক প্রায় পনেরো মিনিট ধরে বসে আছে। এদিকে চিত্রার আসার নাম গন্ধ নেই। রাগে তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। হঠাৎ চিত্রার আওয়াজ শোনাতে রনক পেছনে ফিরে যা দেখলো তাতে তার রাগ নিমেষেই উধাও হয়ে অট্টহাসিতে পরিণত হলো।
একটা কুকুরকে দেখে চিত্রা ঝোপের কোণায় লুকিয়ে আছে। আর চেচিয়ে চেচিয়ে রনক কে ডাকছে।
রনক সামনে যেতেই কুকুরটি চলে গেলো। চিত্রা ঝোপ থেকে বের হয়ে রনকের সামনে এসে বলে, পাগলের মতো হাসছো কেন?
– হাসবো না তো কি করবো? আজ বিয়ে দিলে কাল দাদি হবে সেই মেয়ে সামান্য কুকুর দেখে ভয়ে লুকিয়ে পরে। ছি ছি।
বিয়ের নাম শুনেই চিত্রার বুকের ভেতর কেমন ধক করে ওঠে। বটগাছটার নিচে বসে বলে, আসলেই আমার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে?
রনক চিত্রার পাশে বসতে বসতে বলে, শুধু কি বিয়ের বয়স সাথে চার পাঁচটা নাতি নাতনি পালার ও বয়স হয়েছে।
– আহ রনক ভাই মজা করো না তো।
– ঠিক আছে করবো না। তা যে জন্য তোকে ডেকেছি বিনার বিয়ে হলো কার সাথে।
বিনার নামটা উঠতেই চিত্রার মনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। মাথা নিচু করে ঘাসের মধ্যে আঙুল দিয়ে খোঁচাতে থাকে। রনক সামনে তাকিয়ে আবার বলে,
– আফজাল চাচা তোর বিয়ে না দিয়ে বিনার বিয়ে দিলো কেন এই বিষয়টাই আমি বুঝলাম না।
– আমাকে কে বিয়ে করবে রনক ভাই?
চিত্রার এহেন কথায় রনক থমকে যায়। সে জানে চিত্রা কালো হওয়ার কারনে তার বিয়ে হচ্ছে না। সবাই হয় সুন্দর মেয়ে চায় আর না হয় যৌতুক। এমন বাজে প্রশ্নের জন্য রনক মনে মনে লজ্জিত হয়। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি দেখবিনা?
– কি এনেছো?
রনক রঙিন কাগজে মোড়ানো ছোট একটা বাক্স বের করে চিত্রার হাতে দেয়।
– এতে কি আছে?
– কি আছে? খুলে দেখ।
চিত্রা বাক্সটা খুলে দেখে তাতে নীল রঙের এক মুঠো কাচেড় চুড়ি। অবাক হয়ে বলে, এটা আমার রনক ভাই?
– না তোর চাচাতো খালার মেয়ের জামাইয়ের দুই নাম্বার বউয়ের।
চিত্রা মুখ বাকিয়ে বলে, ভালো কথা তো জানো না।
– তা বলবো টা কি? তোকে যখন দিয়েছি তাহলে এটা তোরই। নে এবার পরে আমাকে দেখা।
চিত্রা মুচকি হেসে চুড়িটা নিয়ে পড়তে যেতেই রনক খপ করে ওর হাত ধরে ফেলে। চুড়িটা নিয়ে নিজেই পড়াতে থাকে। চিত্রা পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
সন্ধ্যা নেমেছে এই খানিকক্ষণ। রনক চিত্রাকে বাড়িতে পৌছে দিয়ে চলে যায়। চিত্রা ঘরে ঢুকতেই দেখে রাজিয়া বেগম হাতে বাঁশের মোটা কনচি নিয়ে চকির ওপর বসে আছে। তার রক্তবর্ণ চোখজোড়া চিত্রার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চিত্রার বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়ে যায়। রনক ভাইকে কতবার বললাম চলে যাই আসতেই দিলো না এখন কি হবে আমার? মনে মনে বলে ওঠা কথার প্রতিউত্তরে চিত্রা আল্লাহর নাম নিচ্ছে।
রাজিয়া বেগম চকি থেকে নেমে চোখ টানাটানা করে বললো, কোথায় গিয়েছিলি?
চিত্রা ভয়ে ভয়ে বললো, বট গাছ তলায়।
– আমাকে বলে যাসনি কেন?
– তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে মা আর আমি তো সবসময়ই যাই তাই আর বলিনি।
– তাহলে সন্ধ্যা হলো কি করে? বটতলায় সন্ধ্যা পর্যন্ত কার সাথে ছিলি?
চিত্রা আমতা আমতা করে বলে, র র নক ভা ই। ওমনি রাজিয়া বেগম বাঁশের কনচিটা খাড়া করে চিত্রার বাম হাতে আঘাত করতেই চিত্রা আল্লাহ গো বলে চেচিয়ে ওঠে। তাল সামলাতে না পেরে তার হাতে থাকা চুড়ির বাক্সটা দূরে গিয়ে পরতেই চুড়িগুলো ছিটকে বের হয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তবে চিত্রার সেইদিকে কোনো মনোযোগ নেই। তার হাত যেন মূহুর্তেই নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। ক্রমাগত হাত ঝাকাতে ঝাকাতে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে “মা আ আমি আর যাবো না মা আমায় আর মেরো না মা”।
চিত্রার হৃদয়বিদারক কন্ঠস্বরকে উপেক্ষা করে রাজিয়া বেগম চিত্রাকে মারার জন্য আবারো কনচিটা খাড়া করতেই চিত্রার বাবা হাত ধরে ফেলে। ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় তাকে। অশ্রুসজল চোখে বলে, কোনো মা তার মেয়ের সাথে এসব কিভাবে করতে পারে? তুমি তো মা নামের কলঙ্ক। আফজাল সাহেব আস্তে আস্তে মেয়েকে ঘরে নিয়ে যায়। চিত্রা তখনো ব্যথায় ছটফট করছে। আফজাল সাহেব মেয়ের দিকে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডান হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে বের হয়ে যায়।
বারান্দায় গিয়ে রাজিয়া বেগমের সামনাসামনি রক্তচক্ষু নিয়ে দাড়ায়। ঝাঝালো কন্ঠে বলে, আর যদি কোনোদিন দেখেছি আমার মেয়ের গায়ে তুমি একটা আঁচড় দিয়েছো সেইদিনই ওই হাত আমি কেটে দু ভাগ করে দেবো। আর সেইদিনই হবে এ বাড়িতে তোমার শেষ দিন।
কথাটা বলেই আফজাল সাহেব চলে যায়। রাজিয়া বেগম অপরাধীর ন্যায় ঠায় দাড়িয়ে থাকে। থমথমে মুখ নিয়ে পা টিপেটিপে চিত্রার ঘরে যায়। চিত্রা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরেছিল। এই সুযোগ। মেয়ের পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হাতের লাল টকটকে দাগটা দেখে রাজিয়া বেগমের কলিজা কেঁপে ওঠে। কোনোমতে চোখ মুছে দ্রুত পায়ে চলে যায়।
সকাল ১০ টার দিকে আফজাল সাহেব চিত্রার ঘরে ঢুকেই দেখে চিত্রা জানালার পাশে অন্যমনষ্ক হয়ে বসে ছিল। তখনো সে বাবার আগমন ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। আফজাল সাহেব মুচকি হেসে চিত্রার কাছে গিয়ে বলে, কিরে মা ব্যথা কমেছে?
চিত্রা হকচকিয়ে ওঠে। হালকা হেসে বলে, হ্যাঁ বাবা আর একটুও ব্যথা নেই।
আফজাল সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে একটা পলিথিনটা দিয়ে চলে যায়। চিত্রা পলিথিনটা খুলে দেখলো ভেতরে দুইটা আপেল আর ব্যথার টেবলেট। চিত্রা ঠোঁটের কোণের হাসিটা প্রশস্ত করে ফিসফিসিয়ে বলে, অনেক ভালোবাসি বাবা।
দুপুরের দিকে আফজাল সাহেব উঠোনে বসে ছিলেন। এমন সময় রাজিয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলে, কি গো কি ঠিক করলে?
– কি ঠিক করবো?
– আরে কাল রাতে তোমাকে বললাম না আজকে বিনার বিয়ের তিনদিন। ও বাসায় যেতে হবে নাকি?
আফজাল সাহেবের কপালে চিন্তার ভাজ পরে। মুখটা থমথমে করে বলে,
– যাবো যে কিছু তো নিতে হবে নাকি। ওতো টাকা পাবো কই? যা ছিল বিয়েতে তো সব শেষ করলাম। বিমল মাস্টারের থেকে যে ধার করবো তার ও উপায় নেই। স্কুল যে বন্ধ হয়ে গেলো।
– এখন কি হবে তাহলে? মান সম্মান যে এক্কেবারে শেষ হয়ে যাবে গো।
– আহ এতো হা হুতাশের কি আছে।
– তুমি এতোটা শান্ত কি করে বলোতো?
আফজাল সাহেব উঠে দাড়ায়। মুখ ঘুড়িয়ে বলে, লোকমানের থেকে ধার নেবো। তুমি চিত্রাকে তৈরি থাকতে বলো। ওকে সঙ্গে নিয়ে যাবো।
রাজিয়া বেগম কপাল কুচঁকে বলে, চিত্রা? ও কেন? ও তো,,
আফজাল সাহেব রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাতেই রাজিয়া বেগম আমতা আমতা করে আচ্ছা বলে চলে যায়। এদিকে মায়ের মুখে এ কথা শোনার পর থেকে চিত্রা খুশিতে লাফাচ্ছে। এই তিনদিন বিনাকে না দেখে যে তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল তারই বোধহয় আজ অবসান হবে।
পুরোনো কালচে কাঠের বাক্সটাতে অনেকটা সময় ধরে খোজাখুজি করেও বিনার শশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য একটাও ভালো জামা পেলো না। তার আনন্দে উপচে পরা মুখটা মূহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। এদিকে আরেক বিপত্তি সৃষ্টি হলো। চিত্রার ভালো জুতাটাও নেই। এবার তার সত্যি কান্না পাচ্ছে। অবশেষে অনেক চিন্তা ভাবনার পর বিনার বিয়ের সময় পরা লাল টকটকে থ্রী পিসটা আর বাসায় পরা সস্তা স্যান্ডেলটা পরেই বাবার সাথে সাগরেদ গ্রামের উদ্দেশ্য বের হলো।
চলবে,,,,