আমার চাঁদ পর্ব-০৪

0
202

_____ আমার চাঁদ

_______সাইয়্যেদাতুন নেছা আফনান

পর্ব:-০৪

বিয়ের সব পর্ব শেষে তাহমিদের ঢাকা চলে যাওয়ার সময় চলে আসে। মেহরাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে তাই। মেহরা এবং তাহমিদ দু’জনেরই ভিষণ মন খারাপ। গত দিনগুলোতে দু’জন আরো ইমোশনাল হয়ে গিয়েছে। মেহরা তো রাত থেকেই কাঁদছে। তাহমিদেরও চোখ টলমল করে। তবুও যেতে হবে!

ব্যাগ নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে মরিয়ম খাতুনের হাত ধরে তাহমিদ বলে,

– মা, আমি জানি তুমি মেহরাকে প্রটেক্ট করবে, তবুও আবার বলছি, ও গ্রামীণ পরিবেশে অভ্যস্ত না, আরো দাদি,ফুফুদের বাজে ব্যবহার ও নিতে পারবে না। তুমি একটু খেয়াল রেখো।

মরিয়ম খাতুন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

– তুই খামোখা চিন্তা করছিস, আর যদি না পারে তখন আমি দরকার হলে ভিন্ন ব্যবস্থা করবো।

মেহরার চোখে পানি দেখে আকলিমা বেগম বললেন,

– এমন মরোইন্না কান্দা কান্দো কেন?

তাহমিদ তৎক্ষনাৎ আহাদ খানকে ডাক দেয়, আহাদ খানের নাম শুনে আকলিমা বেগম মেহরার কাছে গিয়ে বলে,

– নাতবউ,কেঁদো না। আমরা আছি না, তোমার জামাইকে বলো আহাদকে কেন ডাকছে?!

মেহরা হেসে ফেলে। এই বুড়িকে জব্দ করার উপায় পেয়ে গিয়েছে।

মেহরাকে বিদায় দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয় তাহমিদ।।

————–

তাহমিদ যাওয়ার পর থেকেই মেহরার সাথে সঙ্গী হয়ে আছে তাহমিনা। মন খারাপকে মেহরার সাথে মিশতে দিতে যেন সে নারাজ। মেহরাও বেশ ভালোই লাগছিলো তাহমিনার সঙ্গ। তবে তাহমিদের কথা মনে পরলেই চোখ ভেঙে কান্না আসে।

দুপুরের খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলো আর গল্প করছিলো আহান খানের সাথে। আকলিমা বেগমও চেয়ার টেনে বসে। আহাদ খান আকলিমা বেগমকে দেখে বলে,

– মা, কহিনুরের জামাই আসতেছে ওরে নিতে। বহুদিন হইলো যায় না শশুড়বাড়ি। ও এমন কেন করে? আপনি ওরে আবার সায় দিচ্ছেন না তো?

আকলিমা বেগম আমতা আমতা করে বললেন,

– জামাই আইতাসে কেন? আর কয়দিন পরে আইলেই তো হইতো।

– আপনার মাইয়ার পালাইয়া যাওনের সময় মনে ছিল না হের টাকা পয়সা দরকার? তখন ভালোবাসা টনটন করছিলো! তারে কইয়া দিও, ওট জামাই আইলে যেন হের লগে চইলা যায়। আমার মাথা যাতে গরম না করে। আর থাকতে মন চাইলে হের জমিতে ঘর উঠাইয়া থাকতে কও।

কথার মাঝে টেবিলে খাবার দেন মরিয়ম খাতুন। মেহরার প্লেটে মাছের মাথা দেয়ায় আকলিমা বেগম আঁতকে উঠে বলে,

– মরিয়ম এডা কি করলা? তোমার জামাই পাশে বওয়া ওর প্লেটে মাথা না দিয়া এই ছেমড়িরে দিলা কেন?

আহাদ খান বলে,

– কেন মা? আমার প্লেটে দেয়া লাগবে কেন? আর আপনার এতদিকে খেয়াল রাখতে কে বলে? আেনার দরকার হলে আপনি খান। মাছ তো আর একটা রাঁধে নাই, দরকার হলে বাকি মাথাগুলো আপনি খান৷ মেহরার সাথে এরূপ আচরণ আর করবেন না। ও আমার পুত্রবধূর চেয়ে মেয়ে বেশী। তাহমিনার ক্ষেত্রে যেমন আমি কঠোর তপমন মেহরার ক্ষেত্রেও।

আকলিমা বেগম চুপ হয়ে গেলেন। খাবার টেবিলে থমথমে পরিবেশ নিয়ে সবাই খাওয়া শেষ করে। মেহরা নিজ রুমে চলে আসে। তাহমিদকে ফোন দেয়।

– বউ, এখনো পৌঁছাতে পারি নি, যেই জ্যাম!

– খেয়েছো?

– হ্যাঁ, খাবার কিনে উঠেছিলাম বাসে। সেগুলোই খেলাম।

– সাবধানে যাও, যেয়ে ফোন দিও।

– এখনো মন খারাপ বউ?

– তোমার বুকে মাথা যেদিন আবার রাখবো সেদিন এই মন খারাপ কমবে।

– শীগ্রই এই দিন শেষ হবে বউ। আমার চাঁদের মন খারাপের কালো ছায়া শীগ্রই বিলীন করবো। চাঁদের মুখে উজ্জ্বলতাই মানায়,কালো ছায়া মানায় না বউ।

– চাঁদের উজ্জ্বলতা দেখার জন্য তাহমিদ নেই। তাহমিদ আসলেই কালে ছায়া দূর হয়ে যাবে।

কথা বলতে থাকে দু’জন। এরই মধ্যে ডাক পরে মেহরার। ফোন রেখে বাইরে এসে দেখে ফুফু চলে যাচ্ছে। আকলিমা বেগম মেয়েকে ধরে কাঁদছে। মানুষ যতই খারাপ হোক, নিজ সন্তানের বেলায় সবাই নমনীয়। মেহরা আকলিমা বেগমকে আগলে নেয়। সোফায় বসিয়ে পানি দেয়। বিভিন্ন কথা বলে মন খারাপের পর্দা সরিয়ে দেয়। মরিয়ম খাতুনও যোগ দেয় আড্ডায়। আজ যেন আকলিমা বেগমের সকল খারাপ অভ্যাস এবং ব্যবহার তাহমিদের ফুফু ব্যাগে করে নিয়ে গিয়েছে।

———–

তাহমিদ ঢাকায় পৌঁছে মেহরাকে ফোন দেয়। মেহরা আজকের আকলিমা বেগমের ভালো ব্যবহারের কথা জানায়। তাহমিদ অবাক হলেও মেহরাকে বলে,

– তবুও ওনার থেকে দূরে থাকবে। উনি সাপের মতো।

– এভাবে বলো না তাহমিদ।

– আচ্ছা বাদ দাও, আমি রান্না করবো।

– তুমি রান্না করতেও জানো?

– হুম জানি তো,

– বাহ্, তাহলে আর আমার রান্না করতে হবে না।

– তুমি তো বেশ খারাপ মেহরা, আমার দ্বারা রান্না করাবে?

– অবশ্যই, এখন রান্না করে খেতে পারলে তখন রান্না করে খাওয়াতে কেন পারবে না?

– শুধু বাড়ি এসে নেই৷ কড়ায় গন্ডায় সব কিছুর হিসেব নেব।

তাহমিদের বলার ধরনে মেহরা হেসে দেয়। তাহমিদ মোবাইলে কান পেতে শোনে সে হাসি। প্রেয়সীর এই হাসির জন্য সারাজীবন নিজেকে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।

———-

সকালে উঠে অফিসে যাওয়ার জন্য তাহমিদ রেডি হচ্ছিলে তখনই মেহরার ভিডিও কল আসে। ভিডিও কল রিসিভ করে আবারো রেডি হতে ব্যস্ত হয় তাহমিদ। মেহরা ব্যস্ত তাহমিদকে দেখে।

এভাবে প্রতি দিন একই নিয়মে কাটে। মেহরা এখন মরিয়ম খাতুনের সাথে প্রায়ই রান্না করে। আকলিমা বেগম এখন আর আগের মতো ভুল ধরে না। তবে মেহরাকে একা পেলে খোঁচাতেও দেরী করে না।

সব ব্যস্ততা এবং নিয়মের মাঝে কেটে যায় এক বছর। এই এক বছরের অনেক ছুটি পেয়েছে তাহমিদ,তবে আসে নি। এক বছরে টুকটাক করে অনেক কিছু করেছে। একটা ছোট বাসা নিয়ে সেখানে সব গোছগাছ করেছে। সংসারটা পরিপূর্ণ হতেই একদিন মেহরাকে না জানিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তখনই মেহরার ফোন আসে,

– আমার বউ কি করে?

– কি আর করবো? কাজ করছি।

– বউয়ের কি মন খারাপ?

– তাহমিদ তুমি বন্ধ পাওয়া স্বত্তেও কেন বাড়ি আসো না?

– তোনার জন্য সারপ্রাইজ রেডি করতে।

– তাহমিদ তুমি কি…..

– এই একদম ফাও কথা বলবে না, থাপ্পড় দিবো একদম।

– তাহলে বাড়িতে আসো না কেন?

– মেহরা, এই এক বছরে তোমার মুখ থেকে কি এই প্রশ্ন ব্যতীত ভিন্ন কোনো প্রশ্ন নেই? এ নিয়ে কতবার রাগারাগি করবে বলো?

– তাহমিদ তুমি জানো, আমি চাইলেই ঢাকায় চলে আসতে পারি একা, তবে সেটা খারাপ দেখায় তাই আসি না। এজন্য এটা ভেবো না আমহ আসবো না, আমি বাবাকে বলে শীগ্রই আসবো।

– আচ্ছা দেখা যাক।

ফোন কেটে দেয় তাহমিদ। মেহরা উদাস মনে আকাশের দিকে তাকায়। তাহমিদ আগের মতল তাকে সময় দিলেও কেন যে বাড়িতে আসে না সেটাই বোঝে না মেহরা। তাহমিদের কি আসতে ইচ্ছে করে না! নাকি ভিন্ন নারীতে মজেছে সে! চোখ ভার হয়ে আসে। বৃষ্টির ফোটার ন্যায় ঝরে পরে জল।

মেহরা জানেই না, এই জলটুকু জমিয়ে রাখলে ভালো হতো, দুঃখ স্পর্শ না করে সেই জলে সুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে পরতো।

চলবে,