___আমার চাঁদ
_____সাইয়্যেদাতুন নেছা আফনান
পর্ব:-০৩
ফজরের আজান শুনে ঘুম ভাঙে মেহরার, দু’জনে একসাথে নামাজ পরে আবারও ঘুমিয়ে যায়, ঘুম ভাঙে দরজায় টোকা পরার আওয়াজে। তাহমিদ উঠে দরজা খুলে দেখে তাহমিদের দাদি দাঁড়ানো। তাহমিদকে দেখেই রাগি কন্ঠে বলে,
– তোর বউয়ের আক্কেল বলতে কিছু নাই? বাজে কয়টা? এহনো ঘুমায়?
– দাদি, সবে সাতটা বাজে। যাও তো বিরক্ত করো না।
– আপনারে বিরক্ত করতে আসিও নাই, আপনার বউরে তুলতে আইছি, হেয় আমার লগে যাওয়ার পরে আপনে ঘুমাইয়েন।
তাহমিদ বিরক্তিতে নাক মুখ কুঁচকে ফেলে। মরিয়ম খাতুনের রুমের দিকে পা বাড়ায়, এই অসাধ্য সাধণ একমাত্র সেই করতে পারবে। সামনে যেতেই ফুফুকে দেখে উঁকি দিতে, বুঝে ফেলে আসল কাহিনী।
তাহমিদের দাদি আকলিমা বেগম মেহরার মাথার কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে,
– এই যে নবাবের ঝি, ঘুম থেকে উঠুন।
হঠাৎ এমন চিৎকার শুনে লাফ দিয়ে ওঠে মেহরা। তাহমিদের দাদিকে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে দেয়। আকলিমা বেগম মেহরার মাথার কাপড় ফেলে চুল ধরতে লাগলেন। এরপরে জিজ্ঞেস করলেন,
– বাড়ি দিয়া সোনাদানা দেয় নাই কিছু?
এরই মধ্যে মরিয়ম খাতুন রুমে ঢোকেন। বলেন,
– আম্মা, সেসব দিয়ে আপনার কোনো কাজ আছে? ওর গহনা কি আপনাকে পরতে দিবে একবারও?
– পরতে না দিউক, আমার কি কম আছে যে ওরডা পরা লাগবে?
– তাহলে এই সাতসকালে এসে নতুন বউয়ের ঘুম ভেঙে এই প্রশ্ন কেন করছেন? আপনার ছেলেকে কি জাগিয়ে দিবো?
আকলিমা বেগম নড়েচড়ে ওঠেন, আহাদ খানের রাগ বেশী। বেশ ভয়ও পান তিনি। তবুও ভার গলায় বলেন,
– নতুন বউ এত ঘুমাইবে কেন?
– তো কি করবে? সাতসকালে উঠে ঘর ঝাড়ু দিবে? নাকি রান্না করবে? আপনাকে আপনার মেয়ে কি কানে দিয়েছে শুনি?!
আকলিমা বেগম মরিয়ম খাতুনের কাছে গিয়ে বলেন,
– গলাবাজি ধরে রেখেছো এখনো, রাখো ধরে, তবে দিন একদিন আমারো আসবে দেখে নিও।
– আমি বেঁচে থাকতে হবে না সেটাও জেনে নেন।
মরিয়ম খাতুনের দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যান আকলিমা বেগম। মরিয়ম খাতুন মেহরার দিকে এগিয়ে এসে বলেন,
– মা, কষ্ট পেও না। ঘুমাও তুমি, কাল অনেক ধকল গিয়েছে। সময় হলে আমি ডেকে নিবো। তাহমিদ এরপরে দরজা ভেঙে ফেললেও উঠবি না আমি ডাক না দেয়া অবধি।
মরিয়ম খাতুন চলে যেতেই তাহমিদ দরজা বন্ধ করে দেয়। সকাল বেলা সার্কাস দেখেই ঘুম শেষ। মেহরা জানতে চায় আকলিমা বেগম এত চড়া কেন? বিশেষ করে মায়ের উপর?
তাহমিদ বলে,
– সে বিশাল কাহিনী। একদিন মায়ের থেকে শুনে নিও। আমি যখন থাকবো না তখন মা তোমাকে প্রটেক্ট করবে। মায়ের থেকে কিছুই লুকাবে না। এই বাড়িতে দাদি আর ফুফু এই দু’জনের কথায় মা’কে না জানিয়ে কিছু করবে না।
মেহরা মাথা নাড়ে। মাথাটা ভিষণ ব্যথা করছে। এত সকালে আরো হুট করে ওঠায় এই ব্যথা। না ঘুমাতে পারলে এই ব্যথা সারাদিনেও কমবে না। মেহরা চোখ বুজে নেয়। তাহমিদ আলতো হাত বুলায় মাথায়।
মেহরা ঘুমিয়ে যেতেই তাহমিদ উঠে দাঁড়ায়। বাবার সাথে কথা বলা জরুরী। তাহমিদ জানে দাদি,ফুফু যতই অন্যায় করুক কখনোই বাবার কানে এসব দেয় না সে।
———
আহাদ খান বাসা থেকে বের হয়েছেন মাত্র, এরই মধ্যে ডাক দেয় তাহমিদ। সামনের বেঞ্চে বসে দু’জন। তাহমিদ খুলপ বলে গতকাল থেকে আজকের ঘটনা। এমন-কি মরিয়ম খাতুনের সাথে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদের কথাও জানায়। আহাদ খান দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। একদিকে মা-বোন অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষ। পুরুষদের জন্য এই সময়টা বেশ কঠিন।
আহাদ খান তাহমিদকে আশ্বস্ত করে রওনা দেন নিজের গন্তব্যে। তাহমিদও ঘরে চলে আসে। আজও টুকটাক ব্যস্ততা। যেহেতু কাল রিসিপশনের প্রোগ্রাম তাই আজই সেই ব্যস্ততার ধুম পরে গিয়েছে। তাহমিদ ওর ফুফুর রুমে আসে। তাহমিদকে দেখে আকলিমা বেগম বলেন,
– কি গো নাতি, আমার ঘরে আইছো কেন?
– আসছি ঠান্ডা মাথায় একটা কথা জানাতে।
– কি কথা?
– আপনার মেয়েরে নিতে আসতেছে আপনার মেয়ে জামাই।
– মানে?
– মানে হলো, ফুফুকে নিতে আসতেছে ফুফায়।
– ওই গোলামের পুতের বাড়ি আমি যাইতাম না, লাগলে তালাকের ব্যবস্থা করুম।
– তালাক দিয়া কই থাকবা?
– কেন্? আমার মাইয়া আমার বাড়ি থাকবে।
আকলিমা বেগমের কথায় হাসে তাহমিদ। বলে,
– ভুলে গেছো দাদি, দাদায় সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছেন। এ বাড়ি পুরোটা আমার বাবার, আমার বাবার যেহেতু আমি একটা ছেলে তাই এই বাড়ি আমার। আমার বাড়িতে তো তোমার মেয়েকে রাখবো না।
তাহমিদের কথায় ফুসে ওঠে আকলিমা বেগম। আহাদ খানকে চিৎকার দিয়ে ডাকেন। তাহমিদ চেয়ার টেনে বসে। বলে,
– চিৎকার করে লাভ নেই দাদি, আমার মায়ের সাথে আমার বউয়ের সাথে মিলে থাকতে পারলে এই বাড়িতে থাকতে দিবো নয়তো কি করতে পারি ভালোই বুঝতে পেরেছো?
তাহমিদ আবার বলে,
– যাও ফুফু, রান্না ঘরে মা একা কাজ করছেন, তাকে সাহায্য করো। তোমার ভারি শরীরকে একটু কষ্ট দিয়ে মাংস কমাও, নয়তো কসাইয়ের কাছে নিয়ে মাংস কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
———
মেহরার ঘুম ভাঙে সাড়ে দশটায়। পাশে তাহমিদকে ল্যাপটপে কাজ করতে দেখে বলে,
– তুমি ঘুমাও নি?
– নাহ, ঘুম আসে নি। অফিসের কিছু কাজ মেইল করেছে, সেগুলো করছি। তুমি ওঠো, নাস্তা করবে।
মেহরা ওয়াশরুমে যায়। তাহমিদ তাহমিনাকে ডেকে নাস্তা দিতে বলে।
নাস্তা খেয়ে বাইরে আসে মেহরা। কিচেনে উঁকি দিয়ে দেখে মরিয়ম খাতুন একা হাতেই সব করছেন। মেহরাও যায়। এরই মধ্যে তাহমিনা এসে মেহরাকে নিয়ে যায়। বাড়ির আশপাশ ঘুরিয়ে দেখায়। তাহমিদও যোগ দেয় ওদের সাথে। সব কাজিনমহল একসাথ হওয়ায় বিশাল লাইন হয়ে যায়। সবাই মিলে আড্ডায় ব্যস্ত হয়ে পরে।
——-
হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে কেটে যায় দিন। পরেরদিন সকাল সকাল উঠেই গোসল সেরে নেয় মেহরা। পার্লারের লোকেরা এসে সাজিয়ে দিয়ে যায়। তাহমিদ সেই সকালে বের হয়েছে এখন অবধি খবর নেই। মেহরার অস্বস্তি হচ্ছে এত মানুষের মধ্যে বসে থাকতে সাথে ভারি মেকআপ,ভারি লেহেঙ্গা সামলাতে।
তাহমিদ রুমে এসে দেখে মেহরাকে আকড়ে ধরে বসে আছে সবাই। তাহমিদ সবাইকে বলে,
– এখানে ওরকম ভাবে তোমরা বসে আছো কেন?
– বউ দেখি।
– বউ দেখা হয়েছে? তাহলে যাও, এবার আমি আমার বউ দেখবো।
তাহমিদের কথায় হাসির রোল পরে রুমে৷ সবাই উঠে চলে যেতেই মেহরা হাত-পা ছিটিয়ে শুয়ে পরে। মেহরাকে শুয়ে পরতে দেখে তাহমিদ বলে,
– এই বউ, ওঠো, আমি দেখবো না?
– বহুত দেখেছেন, এবার দেখতে চাইলে একদম নাক ফাটিয়ে দিব।
– তুমি পুরোই আনরোমান্টিক।
– দরকার নাই রোমান্টিকের।
ভেঙচি কাটে তাহমিদ। ওয়াশরুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে নিজেও রেডি হয়।
নিচ থেকে ডাক পরে মেহরার। মেহরার বাড়ির লোকজন এসেছে। মেহরার শরীরে যেন সব শক্তি ফিরে এসেছে। ভারি লেহেঙ্গা দু’হাতে উঠিয়ে দ্রুত পায়ে বের হয় রুম থেকে। মাহিন খান মেয়েকে দেখে গম্ভীরতা ভুলে জড়িয়ে ধরেন। মাত্র একটা দিনই কেমন যেন হাজার দিন মনে হয়েছে। সারা রাত ঘুম আসে নি। চোখ ঠেলে শুধু পানি পরেছে। মমতা বেগমও আগলে নেন মেয়েকে। মিয়ান তো বোনকে পেয়ে ছাড়তেই রাজি না। মেহরাও ছোট্ট মিয়ানকে বুকে আগলে নেয়। সোফায় বসে দুই ভাই-বোন গল্প করে। দু’দিনের জমানো সব গল্প দু’জনকে বলে।
মেহরাকে আজ কেউ বলবেই না এই মেয়ে ক্লান্ত। বাবার বাড়ি যাবে এই আনন্দেই মনেহয়। মরিয়ম খাতুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তাহমিনাকেও একদিন এভাবে বিদায় দিতে হবে। তার আদরের মেয়েটাও চলে যাবে তাদের রেখে।
চলবে,