আমার চাঁদ পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
333

___আমার চাঁদ

____সাইয়্যেদাতুন নেছা আফনান

পর্ব:-০৬

তাহমিদের বাড়ি ফিরতে প্রায় দশটা বাজে। সদর দরজার লাইট অফ দেখে চমকে ওঠে। কারেন্ট নেই তাই বলে কি আইপিএসও নেই! এমন তো হবার কথা না। বাসার ভিতরে ঢুকেও পুরো হলরুম অন্ধকার দেখে মরিয়ম খাতুনকে ডাক দেয়। সাড়া না পেয়ে মেহরাকে ডাকে। কারো সাড়া না পেয়ে ফোনের ফ্লাশ জ্বালতেই পুরো রুমের লাইট অন হয়ে যায়। হলরুমটাকে ডেকোরেশন করা হয়েছে। মেহরা বউ সাজে বসে আছে সোফায়। তাহমিদ ভাবে আজ কি কারো জন্মদিন! নাকি অন্য কোনো অনুষ্ঠান হওয়ার কথা! কিছুই মনে পরে না। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মরিয়ম খাতুনকে বলে,

– মা, আজ কীসের অনুষ্ঠান?

মেহরা অভিমানী কন্ঠে বলে,

– তুমি ভুলে গিয়েছো?

– আব… আমাদের বিবাহ বার্ষিকী তো আরো দু’মাস পরে। আর কি মনে রাখবো?

মেহরাসহ হলরুমের সবাই হেসে ওঠে। তাহমিদ তব্দা খেয়ে বলে ওঠে,

– এত গোল কেন খাওয়াচ্ছো আমাকে?বলে দিলেই তো হয়।

আকলিমা বেগম তাহমিদের কাছে যেয়ে বলে,

– তোমার বউ পোয়াতি, এইয়া কইবার লইগ্গ্যা এত ঢং! তোমার মায়ও বুইড়া বয়সে রান্দাবাড়ি খেলবার চাইতাসে।

মুখ ভেঙচে চলে যান তিনি। তাহমিদ যেন চমকে উঠেছে। তবে আকলিমা বেগমের পুরো কথা শুনে বলে,

– আপনার এই টক্কর দেয়া কথা বহুত বলেছেন, এবার ব্যবস্থা করতেছি। পাশেই বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে বাবাকে বলে আপনার সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

আকলিমা বেগম ফুসে উঠলেন। মেহরার দিকে এগিয়ে গিয়ে থাপ্পড় মারলেন গালে। আচমকা এমন কাজে হতবিহ্বল হয়ে পরে সবাই। তাহমিদ দৌড়ে গিয়ে মেহরাকে ধরে। মরিয়ম খাতুন ফোন হাতে নিয়ে ফোন দেয় আহাদ খানকে। আকলিমা বেগম বলে,

– এই ছেমড়ি যেই থেইকা বাড়ি আইছে হেই থেইকা সমস্যা শুরু। তুই আর তোর পেটেরটা দুইটাই মর।

আকলিমা বেগমের এমন কথা শুনে মেহরা কেঁদে দেয়। তাহমিদের চোখে আগুন। আকলিমা বেগম সেখানে না দাঁড়িয়ে চলে যান নিজ কক্ষে। আহাদ খান ফোন ধরতেই দ্রুত বাসায় আসতে বলেন মরিয়ম খাতুন। মেহরা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সদ্য জানা মা’কে যখন কেউ তার বাচ্চাকে নিয়ে কটুকথা বলে সে মায়ের ভিতরের অবস্থা সেই ভালো জানে।

———

সকাল থেকে যেই বাড়িতে খুশির আমেজ ছিল তা নিমিষেই মুছে গিয়েছে। আহাদ খান বাসায় এসে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে আকলিমা বেগমকে ডাকেন। সোফায় সবাই বসে। আহাদ খান বলেন,

– আম্মা। তোমার আসলে সমস্যা কি? তুমি কেন শান্তিতে থাকতে চাও না?

– আমার আবার সমস্যা কি হইবো? আমারে তোর বউ চোহে দেখতে পারে না হেইডা কইতে পারো না?

– কেন? মরিয়ম কখনো তোমার সাথে উচ্চবাক্য করেছে? উল্টো তুমি সবসময় মরিয়মকে তুচ্ছ করে কথা বলেছো। যখন আমার চাকরি ছিল না,এই চেয়ারম্যান হই নি তখন মরিয়মকে দিয়ে বাড়ির কাজের লোকের মতো ব্যবহার করো নি? ওর বাবার বাড়ির উপর জুলুম করেছো সেটাও মুখ বুজে সহ্য করেছে। ওর গায়ে হাতও তুলছো, আমি সব দেখেছি তবু চুপ ছিলাম। তুমি তোমার সীমা অতিক্রম করেছো। কিন্তু তুমি তো মা! তোমার সাথে খারাপ আচরণ করা যাবে না। তোমার জন্য আমি পাশের গ্রামে একটা বাড়ি বানিয়েছি সেখানে তুমি থাকবে একা। তোমার সব পূরণ করবো। কিন্তু তুমি আমাকে পাবে না।

– হ, করবিই তো, বউয়ের গোলাম।

আকলিমা বেগমের কথার প্রতিত্তোরে না দিয়ে সবাই নিজ রুমে চলে গেল। সিদ্ধান্ত হলো কাল সকালে আকলিমা বেগমকে সেই বাড়িতে রেখে আসা হবে।

———–

মেহরার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ হয়েছে। তবে চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। তাহমিদও ঘাটায় নি। মাথায় বিলি কেটে দিয়েছে, ভেবেছে ঘুমিয়ে পরেছে তাই তাহমিদও ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু মেহরার ঘুম আসে নি। ভয় এমন একটা রোগ যা মানুষকে মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে যায়। মেহরার মনেও ভয় ঢুকে গিয়েছে। শেষ রাতে সবে ঘুম চোখে হানা দিয়েছে মেহরার। বাজে স্বপ্নে চিৎকার দিয়ে ওঠে মেহরা। মেহরার চিৎকারে তাহমিদও জেগে ওঠে। মেহরাকে জড়িয়ে ধরতেই মেহরা কাঁদতে থাকে।

———-,

সকাল হতেই আকলিমা বেগমকে সেখানে নেয়ার জন্য ব্যাগ গাড়িতে উঠানো হয়। আকলিমা বেগম সবার থেকে বিদায় নিতে চেয়েছিল তবে কেউই তার সাথে দেখা করতে আসে নি। বাধ্য হয়ে একাই চলে যায়।

আহাদ খান বারান্দায় দাঁড়ানো ছিল। গাড়ি যেতেই চোখের অবাধ্য জলগুলো গড়িয়ে পরে। যতোই হোক! মায়ের জন্য অন্তর জ্বলবে এটাই স্বাভাবিক।

———

সকালে নাস্তার টেবিলে মেহরার ফোলা মুখ আর উষ্কখুষ্ক চেহারা বলে দেয় মেহরা কতটা অসুস্থ! আহাদ খান মেহরা এবং তাহমিদকে ঢাকা থেকে কিছুদিন ঘুরে আসতে বলে। এতে মেহরার মনও ভালো হবে আর এই আশঙ্কা থেকেও কিছুটা মুক্ত হবে।

——–

মেহরা ঢাকায় এসে অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে হরমোন বেড়ে যাওয়ায় যখন তখন এটা ওটা খেতে এবং হাবিজাবি করতে ভিষণ ভালোলাগে। যেমন মিয়ানের খেলনা নিয়ে মিয়ানের সাথে প্রায়ই ঝগড়া হয়, মেহরা কেঁদে ফেলে অল্পতেই। মেহরার এমন পাগলামি দেখে তাহমিদ অস্বাভাবিক হতে শুরু করে। এখন এটা ভালো লাগছে তো একটু পরে আর ভালো লাগবে না।

রাতের খাবার খেয়ে মাত্রই শুয়েছে তাহমিদ। মেহরা বসতে না বসতেই বমি করে দেয় তাহমিদের গায়ে। তাহমিদ করুণ চোখে তাকায় মেহরার দিকে। কষ্টে তাহমিদেরও কান্না আসে।

———*

একে একে নয়মাস পার হয় মেহরার। এই নয়মাসে তাহমিদকে জ্বালিয়ে মেরেছে মেহরা। বেচারা তাহমিদও চুপচাপ সহ্য করেছে।

তাহমিনার সাথে গল্প করছিলে মেহরা। ছাদে ওঠা নিষেধ করেছে তাহমিদ, তবুও আজ ইচ্ছে করছিলো মেহরার। তাহমিনাকে জোর করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আসার পর থেকেই মেহরার খারাপ লাগতে শুরু করে। তাহমিনা বলে নিচে যাওয়ার জন্য। মেহরার মুখ কালো হয়ে যাচ্ছিলো। তাহমিনা ভয় পেয়ে মরিয়ম খাতুনকে ডাকতে থাকে আর সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে।

নিচে এসে সোফায় বসে কাতরাতে থাকে মেহরা। তাহমিনা দৌড়ে মরিয়ম খাতুনকে ডেকে আনে। মেহরার এমন অবস্থা দেখে মরিয়ম খাতুন ভাবেন ডেলিভারির সময় হয়েছে।

——–

মেহরাকে হসপিটালে ভর্তি করেছে শুনে তাহমিদ দ্রুত হসপিটালে আসে। করিডোরে দাঁড়িয়ে মেহরার আর্তনাদ তাহমিদের অন্তর ভেদ করছিলো। তাহমিদের চোখে পানি চলে আসে।

দীর্ঘসময় পরে মেহরার জমজ সন্তান হয়। সবাই অবাক হয় দু’টো সন্তান দেখে সেই সাথে খুশিও। আহাদ খান তো দু’টো নাতিকেই কোলে নিয়ে বসে আছে। কাউকেই দিচ্ছে না।

————-

আজকাল তাহমিদকে দেখলে যে কেউ অবাক হবে। তিন পাগলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। ছেলে-মেয়ে দু’জন দুই মেরুর। মেহরার আহ্লাদীও বেড়েছে।

সব শেষে যখন রাত আসে আকাশের বুকে যখন চাঁদ হাসে তখন তাহমিদ মেহরাকে বলে, আকাশের চেয়েও আমার বুকের মাঝে তোমার জন্য ভালোবাসার সীমানা বেশী যেমনটা তুমি আকাশের চাঁদের চেয়েও আমার চাঁদ হিসেবে বেশী সুন্দর।

তাহমিদ-মেহরা যখন ভালোবাসায় সিক্ত তখনই কেঁদে ওঠে জমজ বাচ্চারা। তাহমিদের করুণ মুখ দেখে মেহরা বলে,

‘আরো চাঁদ চাই?’

সমাপ্তি।