___ আমার চাঁদ
____সাইয়্যেদাতুন নেছা আফনান
পর্ব:-০৫
আকলিমা বেগমের ডাকে চোখের পানি মুছে নিচে যায় মেহরা। আকলিমা বেগম মেহরাকে দেখেই বলে ওঠে,
– সুযোগ পাইলেই খালি রুমে যাও ক্যা? আহো আমার পা টিপ্পা দাও।
মেহরা মাথা নেড়ে আকলিমা বেগমের পাশে বসতে নিলেই আকলিমা বেগম বলে ওঠে,
– তুমি নিচে বহো, আমার পাশে না।
মেহরা অবাক চোখে তাকায়। মরিয়ম খাতুন আজ বাসায় নেই বলে সকাল থেকে এরকম আচরণ করছে।
আকলিমা বেগমের কথা অনুযায়ী নিচেই বসে মেহরা। আকলিমা বেগম কুটিল হেসে টিভি দেখায় মন দেয়।
———–
বাসস্ট্যান্ডে নেমে ফুলের দোকান খোঁজে তাহমিদ। প্রেয়সীর জন্য ফুল না নিলে হয়! হরেকরকম ফুল নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। পথগুলো যেন শেষই হয় না।
বাড়িতে এসে দরজায় কড়া নাড়ে। মেহরা উঠে দরজা খুলে দেয়। হঠাৎ তাহমিদকে সামনে দেখে হুঁ হুঁ করে কেঁদে দেয়। মেহরার হঠাৎ কান্না দেখে তাহমিদ ব্যকুল হয়ে ওঠে। ব্যাগ রেখে মেহরার গালে হাত দিয়ে বলে,
– আমার চাঁদ কাঁদছে কেন?
– তোমার সাথে তখন কথা হলো বললে না কেন?
– বললে কি আর সারপ্রাইজ থাকতো বোকা?
কথা বলার মাঝেই আকলিমা বেগম চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
– ফকিন্নির বেডি কোন নাগরের লগে কতা কস, তাড়াতাড়ি আয়,পা টিপ্পা দে।
তাহমিদ মেহরার দিকে এক পলক তাকিয়ে ভিতরে যায়, আকলিমা বেগম টিভির দিকে তাকিয়ে বলে,
– কে আইসিলো?
তাহমিদ মেহরাকে ইশারায় বলতে নিষেধ করে। মেহরা উত্তর দেয়,
– কেউ না।
– আহো, নিচে বইয়া পা টিপ্পা দাও।
তাহমিদ মেহরার জায়গায় গিয়ে বসে আকলিমা বেগমকে বলে,
– দাদি কোন পা টিপে দিবো?
আকলিমা বেগম ভুত দেখার মতো চমকে ওঠে, কাঁপাকান্ঠে বলে,
– দাদু তুমি! কহন আইলা?
– এইতো যখন আমার বউকে গালি দিয়েছিলে তখন।
আকলিমা বেগম দ্রুত প্রস্থান করেন। মেহরা তাহমিদের কাঁধের ব্যাগ নিতে চাইলে মেহরার হাতে ফুলের তোড়াটা দেয়। এতদিন পরে এতগুলো ফুল দেখে মেহরা অবাক হয়। পরম শান্তিতে হাত বুলায় ফুলগুলোতে, নাকে ঘ্রাণ নিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে ধন্যবাদ দেয়।
———–
মেহরা রান্নাঘরে এসেছে সেই বিকালে,এখনো বের হয় নি দেখে তাহমিদ নিজেই রান্নাঘরে যায়। মেহরা তাহমিদের পছন্দের খাবার রান্না করতে ব্যস্ত তখন। তাহমিদ কপাল চাপড়ে বলে,
– আসলাম বউয়ের জন্য, আর বউ রান্নাঘরে এসে বসে আছে।
– আর আমি বুঝি আরেকজনের জন্য রান্না করছি?
– আমার তো রান্না চাই না চাঁদ, আমার তো এই চাঁদকে প্রয়োজন।
– বিরক্ত করো না তো, রান্না প্রায় শেষ। তুমি রুমে যাও, আমি আধঘন্টায় আসছি। মা’কে ফোন করেছো?
– হুম করেছি, বিকেলেই রওনা দিয়েছে।
– যাও, যেয়ে রেস্ট নাও।
মেহরা বারবার যেতে বললেও তাহমিদ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। এরই মধ্যে আকলিমা বেগম কিচেনে আসে। মেহরাকে বলে,।
– নাতবউ, মাংস হয়েছে? বেশ ঘ্রাণ বের হয়েছে। একটু বাটিতে তুলে দাও তো।
মেহরা অন্য কাজ করছে বিধায় তাহমিদ মেহরাকে সেই কাজ করতে বলে নিজেই বাটি এনে মাংস তুলে দেয়। আকলিমা বেগম বাটি নিয়ে চলে যায়। তাহমিদ মেহরাকে বলে,
– মেহরা, তোমার বাবার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না?
– সে খবর তুমি নিয়ে কি করবে? তুমিই তো আসো নাই আমি কার সাথে যাবো?
– আচ্ছা, এবার নিয়ে যাবো।
– সত্যি?
– হুম।
মেহরার মন যেন আরো খুশি হয়ে যায়। কলিংবেলের শব্দে তাহমিদ দরজা খুলতে যায়। মরিয়ম খাতুন এসেছেন। তাহমিদকে দেখে জড়িয়ে ধরে। গালে চুমু এঁকে বলে,
– বাবা কেমন আছিস? এতদিন আসিস নি কেন?
– মা, তুমি তো সবই জানো,তবু জিজ্ঞেস করছে?
মরিয়ম খাতুন হাসেন। যতই জানুক, মা তো! তাহমিদ সবসময়ই সব বিষয়ে মরিয়ম খাতুনের থেকে পরামর্শ নেয়।
– মেহরা কোথায়?
– সে আর কই! রান্না করে।
– এই সন্ধ্যায় রান্নাঘরে কে যেতে বলেছে! আজ নাহয় বাইরে থেকে অর্ডার করতাম। এখন কষ্ট করতে কে বলেছে ওকে?
মেহরা রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে বলে,
– মা, লেবুর শরবত করে রেখেছি। এখন দিবো? নাকি ফ্রেশ হওয়ার পরে দিবো?
– তোমাকে এতকিছু কে করতে বলেছে?
– আহা মা! আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তো।
তাহমিদের ভালোই লাগছে বিষয়টা। কেন যেন ইচ্ছে করছে ঢাকার চাকরি,বাসা সব ছেড়ে গ্রামে চলে আসতে। মেহরার পছন্দেরও একটা বিষয় আছে। জানতে হবে।
———-
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মেহরা। তাহমিদ মেহরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– মেহরা, তোমার কোন পরিবেশ ভালো লাগে? গ্রামের নাকি ঢাকার?
– গ্রামের পরিবেশটাই ভালো লাগে, তুমি থাকলে পরিপূর্ণ হতো।
– মেহরা, আমি ঢাকায় একটা বাসা নিয়েছি, তোমার মনের মতো করে সাজাতে চেষ্টা করেছি। তুমি কি সেখানে যাবে নাকি আমি ঢাকার চাকরি ছেড়ে বাবার সাথে ব্যবসায় মন দেবো?
– তুমি ঢাকা থেকে চলে আসো। এখানেই ব্যবসায় মন দাও।
তাহমিদ মেহরার দিকে তাকিয়ে কপালে চুম্বন করে। অতি আনন্দে মেহরাকে কোলে তুলে নেয়।
———–
সকালে নাস্তার টেবিলে আহাদ খানের সাথে তাহমিদ কথা বলে,
– বাবা, ঢাকা থেকে চাকরিটা বাদ দিয়ে দেই? তোমার সাথে যদি ব্যবসায় হাত দেই তুমি কি রাজি হবে?
– মরিয়ম তোমার ছেলে কথা শুনেছো? এত কিছু সব কার জন্য করছি?
মরিয়ম বেগম তাহমিদকে বলে,
– বাবা, তুই যাবি না ঢাকায় সত্যি?
– হুম মা, মেহরাও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা এখানেই থাকবো।
সবার আনন্দ যেন উপচে পরছে। রিজাইন এবং মেহরাকে বাবার বাড়ি কিছুদিন ঘুরিয়ে নেয়ার জন্য ঢাকায় রওনা দেয়।
———
ঢাকায় এসে যেন মেহরার আনন্দের শেষ নেই। কতগুলো মাস পরে নিজের বাবা-মায়ের সাথে দেখা হবে! ছোট্ট মিয়ানও বড় হয়ে গিয়েছে। ভিডিও কলে কথা বলার সময় দেখেছে।
বাসার সামনে এসে কলিংবেল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দু’জন। মমতা বেগম দরজা খুলে মেয়েকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে পরে। আনন্দে চোখে অশ্রুরা ভীড় জমায়। ঝাপটে ধরে মেয়েকে। মেহরাও বহুদিন পরে মায়ের বুক পেয়ে যেন বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। কেঁদে দেয়। মাহিন খান হৈচৈ শুনে বাইরে এসে দেখে মেহরা এসেছে। দীর্ঘদিন পরে মেয়েকে দেখে ডাক দেয়,
– মেহরা,
বাবার কন্ঠ শুনে মেহরা বাবার বুকে আচড়ে পরে। মাহিন খানও এতদিন পরে মেয়েকে দেখে বুকে টেনে নেন। ছোট্ট মিয়ান তো মহা খুশি। তার আপা এসেছে। সাথে দুলাভাইও! এই আনন্দে সারা ঘরে দৌড়াচ্ছে।
রুমে এসে বোরকা খুলে ফ্রেশ হয় দু’জন। মমতা বেগম নাস্তা এনে দেয়। মেহরাও মমতা বেগমের সাথে কিচেনে যায়। টুকটাক সাহায্য করে রুমে আসে। তাহমিদ মিয়ানের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত।
———
আকাশের বুকে আবারও চাঁদ ওঠে। আবারও সেই বারান্দায় তাহমিদ-মেহরা দাঁড়িয়ে। তাহমিদ মেহরাকে বলে,
– তোমার চাওয়া-পাওয়া গুলো আমার কাছে অনেক দামী মেহরা। কিছু ইচ্ছে করলে সেটা আমাকে জানাবে। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।
– তাই নাকি? তাহলে তোমার চাঁদের পেটে আরো একজন চাঁদকে চাই!
তাহমিদ মেহরার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে মেহরা কি বলেছে বোঝার জন্য! যখন বুঝতে পারে তখন হেসে ফেলে।
———
ঢাকা থেকে এসেছে কয়েক মাস কেটে গিয়েছে। তাহমিদও ব্যবসায় মন দিয়েছে। মেহরাও পাক্কা গৃহিণী হয়ে গিয়েছে। এত কিছুর মধ্যেও পাল্টায় নি তাহমিদ-মেহরার ভালো বাসা।
পিরিয়ড মিস গিয়েছে আজ দুইমাস। মুখটাও ফুলে গিয়েছে। বমি পায় প্রায়ই। মেহরার আশংকা হয়। তাহমিদকে প্রেগ্ন্যাসি কিট আনতে হবে। তাহমিদ এনেও দিয়েছে তবে আলসেমিতে টেস্ট করা হয় নি।
————
– তাহমিদ বাসায় আসতে পারবে এক্ষুনি?
– কেন?
– আসতে পারবে কীনা বলো!
– মেহরা আমি তো ঢাকায় এসেছিলাম, গাড়িতে উঠেছি, সন্ধ্যায় চলে আসবো।
মেহরা ফোন কেটে দেয়। মরিয়ম খাতুনের রুমে আসে মেহরা। মরিয়ম খাতুনের কোলে মাথা রেখে বলে,
– মা, আপনার দাদুমনি আসবে ইনশাআল্লাহ।
মরিয়ম খাতুন চমকে ওঠে। ঠিক শুনেছে কীনা জানতে আবারও প্রশ্ন করে মেহরাকে। মেহরা হ্যাঁ বলতেই মরিয়ম বেগম চুমু আঁকেন মেহরার মুখে। জিজ্ঞেস করেন তাহমিদ জানে কীনা! মেহরা না বলতেই দু’জন মিলে ফিসফিসিয়ে বলেন কিছু একটা। মেহরা হেসে ফেলে।
চলবে,