আমার বোনু পর্ব-০৪

0
353

#আমার_বোনু
#Part_04
#Writer_NOVA

— আম্মু, ভাইয়ের কোন খোঁজ পেয়েছো?

জিনিয়ার কন্ঠে উৎকন্ঠা। এই বুঝি তার ভাইয়ের খবর মিললো। আপন বলতে তো তার মা জাকিয়া বেগম আর ছোট ভাই। বাবা বহু বছর আগে মারা গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজনরাও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তারপর থেকে জীবন যুদ্ধে তারা একাই সংগ্রাম করেছে। ছোট বয়সেই ভাই ব্যবসার হাল ধরেছে। সাথে জিনিয়াও সাহায্য করেছে। মোটামুটি ভালো একটা পজিশনে ব্যবসাটা নিয়ে এসেছে। সেই হাড়ভাঙা খাটুনির দিনগুলোর কথা মনে পরলে এখনো তার চোখে পানি ভীড়ে। বয়সে ভাই তার মাত্র দুই বছরের ছোট। একদম পিঠাপিঠি ভাই-বোন হওয়ায় দুজনের মধ্যে টম এন্ড জেরী যুদ্ধ লেগেই থাকতো। তবে তাদের মাঝে অনেক মিলও ছিলো। ভাই তার ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে পনেরো দিন ধরে নিরুদ্দেশ। বর্তমানে ব্যবসা লোক দিয়ে সামলাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন!

জিনিয়া আবারো তার মা-কে প্রশ্ন করলো,
— কি হলো কথা বলছো না কেনো? ভাইয়ের খোঁজ পেয়েছো? কোথায় ও?

জাকিয়া বেগম ঠোঁট চেপে কান্নার বেগ আটকে বললো,
— আমি জানি না।

মায়ের চেপে রাখা কান্নার আওয়াজটা জিনিয়ার কানে এসে ঠিকই বারি খেলো। চোখ দুটো তারও ভিজে উঠলো। তার ভাই ভীষণ অভিমানী ছেলে। জিনিয়ার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিলো যে তার ভাই অন্ততপক্ষে মায়ের সাথে যোগাযোগটা ঠিকই রেখেছে। কিন্তু তাও মিথ্যে প্রমাণিত হলো। ভিজে চোখের টলমল পানির ফোঁটাগুলো এবার অবাধ্য হয়ে ঝড়ে পরলো। মোবাইলের অপরপাশ থেকে তার মায়ের কান্নারত স্বরে ভেসে আসলো,

— এত অভিমান করলে কি চলে বল তো? ও তো এখন বড় হয়ে গেছে। এখনো যদি বাচ্চামো করে তাহলে আমার কি হবে? এই বুড়ো বয়সে আমি যাবোটা কোথায়? আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া ও যেখানে আছে সেখানেই যেনো ভালো থাকে। আর দ্রুত ফিরে আসে।

জিনিয়া মোবাইল কানে ধরে ধপ করে করে খাটে বসে পরলো। মা,মেয়ে দুজন কাঁদছে। অনল বাইরে থেকে ছুটে এসে মা-কে জড়িয়ে ধরে বললো,

— আম্মু, আমার গাড়ি কোথায়? আমার বড় গাড়িটা খুঁজে দেও না। আমি বড় চাচিআম্মুর সাথে খেলবো।

জিনিয়া কান্নাভেজা চোখে ছেলের দিকে তাকালো। ছেলে মায়ের চোখের পানি দেখে দ্রুত খাটে উঠে বড়দের মতো করে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,

— তোমার কি হইছে আম্মু? তুমি কাঁদছো কেন? তুমি না বলেছিলে ভালো ছেলে-মেয়েরা কান্না করে না।

ছেলের সান্ত্বনা বাক্য শুনে জিনিয়া আরো ভেঙে পরলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে জোরে কান্না করে উঠলো। অর্ণব ওয়াসরুমে গোসল করছিলো। জিনিয়ার কান্না শুনে টাওয়াল পেচিয়ে দ্রুত বের হয়ে এলো। জিনিয়াকে এই অবস্থায় দেখে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললো,

— না, এবার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

ভার্সিটি গেইট দিয়ে ঢুকেই ঊষা আশেপাশে তারিনকে খুঁজতে লাগলো।এই মেয়েটা সবসময় দেরী করে। এক নামকরা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াশোনা করে সে ও তারিন। ইশাত গেইটের বাইরে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যতখন অব্দি বোন ভেতরে না ঢুকবে ততক্ষণ সে এখান থেকে এক পাও নড়বে না। ঊষা পেছন দিকে ঘুরে ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— সেজো ভাইয়ু তুমি চলে যাও। তারিন চলে আসবে।

ইশাত ভ্রুকুটি কুঁচকে উত্তর দিলো,
— ঐসব সান্ত্বনার বাণী আমাকে শুনাতে হবে না। আমি এখান থেকে সরছি না। তুই আগে ভেতরে যা। তারপর আমি যাবো।

ঊষা বুঝতে পারলো ভাই তার নাছোড়বান্দা। একবার যা বলেছে তাই করবে। ইশাত একবার আড়চোখে বোনের দিকে তাকালো। গতকাল রাতে তো ভয় দেখিয়ে ফেলেছিলো। যদিও কান্নার কারণ বহুবার জিজ্ঞেস করার পরও পাঁচ ভাইয়ের এক ভাইকেও বলেনি। তখুনি এটাকে তারা সিরিয়াস ম্যাটার
হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাই আগের থেকে আরো কড়া নজরদারি রেখেছে বোনের ওপর। ঊষা ভেতরের দিকে চলে গেলো। ইশাত পকেট থেকে সানগ্লাস বের করে চোখে পরে নিলো। মনোযোগ তার মোবাইল দিকে।

একটা রিকশা এসে থামলো ইশাতের গাড়ির বিপরীত মুখে। তারিন রিকশা থেকে নেমেই জোরে এক চিৎকার দিলো।

— ইশাত বেবী!

তারিনের কন্ঠস্বর শুনে ইশাত বিস্ফারিত চোখে সামনে তাকালো। এই মেয়ের থেকে সে দশ হাত দূরত্ব বজায় রাখে। আসলে তারিন ইশাতকে অনেক পছন্দ করে। ছলেবলে কৌশলে তারিন তার মনের কথা ইশাতকে বুঝাতে চায়। কিন্তু ইশাত বুঝেও না বোঝার ভান করে। তার বাস্কেটবল ফাইনাল চ্যাম্পিয়নশিপের আগে সে এসবে জড়াবে না। কিন্তু এই তারিন ওকে পেলে আঠার মতো লেগে থাকে।

— ইশাত বেবী তুমি আসছো?

তারিনকে কেউ পাঁচ হাজার টাকা দিলেও এতটা খুশি হতো না। যতটা না ইশাতকে দেখে হয়েছে। ইশাত বিষম খেলো ওর কথায়। আশপাশ থেকে বেশ কিছু মেয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশাত দ্রুত কেটে পরতে চাইলে তারিন সামনে এসে দুই হাত মেলে পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললো,

— একদম পালাবে না।

ইশাত বুঝতে পারলো আজ তার তেরোটা বেজে যাবে। এদিক সেদিক তাকিয়ে ইশাত এই মেয়ের থেকে পালানোর পথ খুঁজতে লাগলো।

পড়ন্ত বিকেলের নিভন্ত আলোটা দেখতে বেশ লাগে তার কাছে। আজও সে ধানখেতের দোল খাওয়ার দৃশ্য দেখছে। তবে তার হাতে আজ উপন্যাসের বই নেই। বিশাল এক কফির মগ হাতে ধানখেতের আইলে দাঁড়িয়ে বাতাসের ছটা উপভোগ করছে। মুখটা মলিন। পরনে লাল রঙের টি-শার্ট আর গেরুয়া রঙের হাফ পেন্ট। গরমের মধ্যে এসব পরলেই তার শান্তি মেলে। হাতের কফিতে মৃদু চুমুক দিয়ে আইল দিয়ে হাঁটতে লাগলো। ডিপ টিউবওয়েল থেকে খেতে পানি দেওয়া হচ্ছে। সেদিকে গিয়ে পায়ের জুতা খুলে ঠান্ডা পানির নালায় পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেয়ে সারা শরীরে একটা শিরশির অনুভূতি অনুভব করলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর আবার কফিতে চুমুক দিলো।

— কি করো ভাতিজা?

আব্বাস চাচার কন্ঠ পেয়ে সামনের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে দৃষ্টি দিলো। লোকটা উৎসুক চোখে তার থেকে উত্তরের আশায় আছে। তা দেখে ছেলেটির ঠোঁট হালকা বাঁকিয়ে গেলো। ভালো করে তাকালে আব্বাস চাচা দেখতে পেতো ছেলেটা হাসছে। এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে আবারো কফির মগে চুমুক দিলো। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,

— কি সুন্দর পরিবেশ! তাই উপভোগ করছি।

আব্বাস চাচা ছেলেটির দিকে এখনো তাকিয়ে আছে। চেহারার মধ্যে তার বাবার প্রতিচ্ছবি। বেঁচে থাকতে তার বাবা আব্বাস চাচার অনেক উপকার করেছে।আব্বাস মিয়া অবশ্য অনেকবার এর কৃতজ্ঞতা জানাতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার বাবা রাজী হয়নি। এখন ছেলেটার বিপদে সঙ্গ দিতে পেরে কেন জানি মনের ভেতর শান্তি পায়। এই তো সপ্তাহ খানিক ধরে তার বাসায় আছে। ছেলেটার ব্যবহার মুগ্ধ করার মতো। খানিক সময়ের মধ্যে যে কারো সাথে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু এখন বেশিরভাগ সময় চুপ করে থাকে। কি জানি ভাবে মন দিয়ে। তার নিজের দুটো ছেলে আছে। তারা সুদূর প্রবাসে। তাই এই ছেলেকে পেয়ে সে ও তার স্ত্রী দুজনেরি মনে হচ্ছে নিজের ছেলে খুঁজে পেয়েছে। তাদের স্টাটাস আর এই ছেলের স্টাটাস আকাশ পাতাল তফাৎ। কিন্তু এর ব্যবহার, চাল-চলন দেখে মনে হয় তাদেরি কেউ।

— কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?

আব্বাস চাচার উসখুস মার্কা কথা শুনে ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে আময়িক হাসি দিলো।যার মানে হলো নিঃসন্দেহে সে কথা বলতে পারে। তাতে আব্বাস মিয়া কিছুটা সহজ হলো। সে ভেবেছিলো হুট করে কিভাবে কথাটা বলবে।

— অনেকদিন তো হলো বাসা ছেড়েছো। এবার বাসায় চলে যাও। না না তুমি আবার ভেবে না তোমাকে আমি তাড়িয়ে দিচ্ছি। তোমার মা মানে ভাবী অনেক টেনশন করছেন নিশ্চয়ই। তার এমনি বয়স হয়েছে। এই বয়সে এত টেনশন দিলে তার ক্ষতি হইবো। তাই বলছিলাম কি তুমি এখন বাসায় চলে যাও। পরে অনেক সময় নিয়ে সবাইকে নিয়ে এই গরীবের ঘরে চারটা ডাল-ভাত খেতে চলে এসো।

ছেলেটা কফি শেষ করে পা ভিজিয়ে রাখা পানির নালা থেকে মগটা ধুয়ে নিলো। তারপর স্বাভাবিক গলায় বললো,

— আমি মায়ের সব খবর রাখছি চাচা। শুধু মায়ের নয় আমি এখান থেকে সবার খবরই রাখছি।

আব্বাস চাচা কিছু বললো না। ছেলেটা সারা বছর থাকলেও তার সমস্যা নেই। খান বাড়ির ছেলে তার গরীব কুঠুরিতে থাকছে। এটা তো তার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। তাছাড়া খাবারের খরচটাও দু-একদিন পরপর ছেলেটি দিয়ে দিচ্ছে। আব্বাস মিয়া কথা বাড়ালো না। নিচুস্বরে বললো,

— তুমি কি এখন বাসায় যাবে?

ছেলেটা একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে উত্তর দিলো,
— না চাচা এখন যেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি বরং এই মগটা নিয়ে যান।

মগ নিয়ে আব্বাস চাচা বাড়ির পথ ধরলো। পেছন থেকে ছেলেটি ডাকলো। আব্বাস মিয়া পিছু ঘুরতেই ছেলেটি পকেট থেকে টাকা বের করে হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,

— এখন একটু হাটে যাবেন। সেখান থেকে ভালো দেখে একটা হাঁস কিনে নিয়ে আসবেন। আর চাচীকে বলবেন চালের ছিট রুটি বানাতে। রাতে হাঁসের গোশত দিয়ে ছিট রুটি খাবো।

আব্বাস মিয়া টাকা নিয়ে চলে গেলো। সে জানে টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানালেও কাজ হবে না। ছেলেটা তাহলে রাগ হয়ে যাবে। আব্বাস মিয়া যেতেই ছেলেটি আবারো প্রাকৃতিক পরিবেশে ডুব দিলো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো,

— জিবরান!

নিজের নাম শুনে ছেলেটি হতবাক। এই গ্রামে আব্বাস চাচা ছাড়া আর কেউ তার পরিচিত নয় যে তার নাম জানবে বা ডাকবে। বিস্মিত চোখে পেছনে ঘুরলো জিবরান।গলার স্বরটা তার প্রিয় বন্ধুর।যে গতকাল তাকে কল করেছিলো। চোখ ডলে ভালো করে তাকালো। না, এটা তার বন্ধুই। রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।জিবরানের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,

— আমাদের সবাইকে চিন্তায় ফেলে তুই এখানে হাঁসের গোশত আর ছিট রুটি খাওয়ার প্ল্যান করছিস? দাড়া তুই, খাওয়াচ্ছি তোকে হাঁসের গোশত আর ছিট রুটি!

~~~জীবনে গুরুত্ব ও দূরত্ব দুটোই অপরিহার্য।
একটা যেমন কাছে টানে, তেমনি আরেকটা দূরে ঠেলে দেয়। তবে এর সঠিক ব্যবহার যে করতে পারবে, সেই জীবনে সফল হতে পারবে।

#চলবে

অনেকেই বলছেন এই গল্প নাকি আগে পড়ছে😅। তাহলে আমি প্রতিদিন কি লিখি ভাই? আগের গল্পই লিখবো এতটা পাগল হইনি আমি। যেটা পড়ছেন সেটা বোনু সিজন ০১। ঐ সিজনের প্রতিটা চরিত্র নিয়ে এই গল্প। ঐ সিজনের সাথে এই গল্পের কোন মিল নেই, দুটোর কাহিনি ভিন্ন। একটা জিনিস মিল থাকবে সেটা হলো ভাই-বোনের ভালোবাসা।আরেকটা কথা আমি প্রতিদিনের পর্ব প্রতিদিন লিখি।