আমার বোনু পর্ব-২+৩

0
438

#আমার_বোনু
#Part_02_03
#Writer_NOVA

মিনিট পচিশের মধ্যে অর্ণব দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। হন্তদন্ত হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে উচ্চস্বরে তার স্ত্রী-কে ডাকতে লাগলো,

— জিনিয়া, জিনিয়া!

জিনিয়া সবেমাত্র তার চার বছরের ছেলে অনল কে খাইয়ে এঁটো প্লেটটা কিচেনে রাখতে গিয়েছে। এর মধ্যে অর্ণবের কন্ঠ পেয়ে কিছুটা চমকে গেলো। সচারাচর এই সময় অর্ণব বাসায় আসে না। প্লেটটা বেসিনর ওপর রেখে হাতটা ওড়নায় মুছে সেদিকে রওনা দিলো। অনল তার বাবাকে পেয়ে “বাবা” বলেই কোলে চড়ে বসেছে। অর্ণব ছেলেকে কোলে নিয়ে সোফায় বসলো। জিনিয়া স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি হঠাৎ এই সময়ে?

অর্ণব জিনিয়ার কথার উত্তর দিলো না। তার ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— বাবা, তুমি তোমার রাণীর কাছে যাও। আব্বু এখন আম্মুর সাথে কথা বলবে।

অনল তার ফুপি উষাকে “রাণী” বলে সম্বোধন করে। এটা তার বাবা আর চার চাচা শিখিয়েছে তাকে।অনল বাধ্য ছেলের মতো বাবার কথায় মাথা নাড়িয়ে বললো,

— আচ্ছা বাবা।

তারপর দ্রুত বাবার কোল থেকে নেমে ঊষার রুমের দিকে ভো দৌড় দিলো। অর্ণব জিনিয়ার এক হাত ধরে টেনে তার পাশে বসালো। জিনিয়া এখন হতভম্ব হয়ে আছে। এই ছেলের মতিগতি সে এত বছর সংসার করেও বুঝে উঠতে পারেনা। কখন যে মনে কি ঘুরে তা একমাত্র সে জানে।জিনিয়া আবারো প্রশ্ন করলো,

— অনলের বাবা, কি হয়েছে বলো তো? ঘন্টা খানিক আগে ইশাত, ঊষাকে নিয়ে ফিরে এলো। এখন আবার তোমার আগমণ। বাসায় কোন অনুষ্ঠান হলে তো যুদ্ধ করেও তোমাকে দুপুরে খবর দিয়ে আনা যায় না। আজ হঠাৎ তুমি এই সময় বাসায়? আমার একটু খটকা লাগছে। আসলে বলো তো কি হয়েছে?

অর্ণব একবার জিনিয়ার মুখ পানে তাকালো। চোখ, মুখে মেয়েটার হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু অর্ণব বাইরের ঝামেলায় জিনিয়াকে কিংবা পরিবারের কোন মেয়েকে জড়াতে পছন্দ করে না। তাই এখনকার কাজ হলো প্রতিবারের মতো সন্তপর্ণে সবকিছু এড়িয়ে যাওয়া। অর্ণব জিনিয়ার কথার পিঠেই প্রশ্ন করে বসলো,

— আমাকে এই সময়ে দেখে কি তুমি খুশি হওনি?

জিনিয়া কপাল কুঁচকে কিছুটা বিরক্তিমাখা কন্ঠে ঝাঁঝালো উত্তর দিলো।

— কি যে বলো না তুমি! তোমাকে এই সময়ে দেখে কেন খুশি হবো না বলো তো?

— তাহলে এত প্রশ্ন করছো কেন?

— জানার জন্য।

— বাদ দাও তো। এখন আমি যে জন্য ডেকেছি তাই শুনো।

জিনিয়া নড়েচড়ে বসে বললো,
— হুম বলো।

— তোমার ভাই কোথায়?

অর্ণবের মুখে নিজের ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে জিনিয়ার মুখটা ঘন আঁধারে ঢেকে গেলো। অর্ণবের সুক্ষ্ণ চোখে তা কিন্তু এড়ালো না।

পরের দিন……

বিকেলের মিষ্টি রোদের আলোয় চারিদিকে ঝিলমিল করছে। সাথে ঝিরিঝিরি বাতাস যেনো পরিবেশটাকে আরো আকর্ষণীয় করে দিচ্ছে। আজ ঊষা কলেজ যাইনি।গতকাল যে কাহিনী ঘটলো তাতে আজ মন সায় দেয়নি কলেজ যেতে। বিশাল এক ঘুম দিয়ে একটু আগে উঠেছে। গতকাল যা হয়েছে তাতে সে কিছুটা আপসেট। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে এসবের প্রতিবাদ করতে। কিন্তু মনের গহীন কোণে কোথাও যেনো একটা ভয় কাজ করে। অথচ একটা মানুষ ছিলো যে সবসময় তাকে সাহস যুগাতো। একা একা নির্ভয়ে নিজেকে রক্ষা করতে শিখাতো। কিন্তু আজ সে লাপাত্তা। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের পানে তাকিয়ে বিরবির করে ঊষা বললো,

— কোথায় আপনি? আর কত অভিমান করে থাকবেন? আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি তো।দেখুন না আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই। চলে আসুন না প্লিজ। আমি আপনার সব কথা শুনবো।

চোখের কোণ বেয়ে টুপ করে একফোঁটা জল নিচে পরলো। ঊষার চোখ দুটো পানিতে ঝাপসা হয়ে গেছে।নিজের করা পাগলামিগুলোর জন্য এখন নিজের আফসোস হচ্ছে। ঐ যে কথায় আছে না কোন মানুষ থাকতে আমরা তার কদর বুঝি না। হারিয়ে গেলে খুঁজি। ঊষারও সেরকম দশা। চোখের পানি মুছে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। এখন একা থাকলে অনেক খারাপ লাগবে। তাই এখন কারো সাথে গল্প করবে।

ঊষা গিয়ে উঁকি দিলো মেজো ভাইয়ের রুমে। এই সময় তার মেজো ভাবী অথৈ জেগে থাকে। সব ভাই তাদের নিজস্ব কাজে গেছে। বড় ভাবী তার ছেলেকে নিয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে থাকে। তাই সেদিকে পা বাড়ালো না। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই অর্ণব আর মেজো ভাই আদিল বিয়ে করেছে। বাকি তিন ভাই এখনো অবিবাহিত। বড় ভাইয়ের এক ছেলে আর মেজো ভাইয়ের বউ অথৈ সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। অথৈ, জিনিয়া দুজন ঊষাকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে। অবশ্য ভালোবাসতেই হবে। নয়তো এই বাড়িতে তাদের থাকা হবে না।

অথৈ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আদিলের কিছু শার্ট ভাজ করছিলো। ঊষা ভেতরে ঢুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। অথৈ প্রথমে একটু ভয় পেলোও পরবর্তীতে বুঝতে পেরে ঊষার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,

— এই পাঁজি মেয়ে, এভাবে কেউ ধরে? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

ঊষা খিলখিল করে হেসে উঠলো। তার নিজের কোন বোন নেই তো কি হয়েছে? দুটো ভাবী যেনো তার নিজেরি বোন। ঊষা অথৈকে ছেড়ে সামনের খাটে আরাম করে বসে বললো,

— ভালো লাগছিলো না। তাই তোমার সাথে আড্ডা দিতে চলে এলাম।

অথৈ হাতের কাজ করতে করতে বললো,
— আমি একবার তোমার রুমে ঢুঁ মেরে এসেছি। কিন্তু তুমি নেই। তখুনি ভেবেছি তুমি ছাদে। আমার তো আবার এই অবস্থায় ছাদে যাওয়া কড়া নিষেধ। তাই রুমে এসে টুকটাক কাজে মনোযোগ দিলাম।

এরপর শুরু হলো ভাবী-ননদের যত গল্পসল্প। থাক আমরা আর তাদের গল্পে যোগ না দেই। তাহলে আবার বোর হয়ে যাবো।

রাতে…..

মির্জা বাড়ির একটা নিয়ম আছে। সেটা হলো সকাল ও রাতে একসাথে বসে খাবার খেতে হবে। যে যত ব্যস্ত থাকুক, যার যত কাজ থাকুক সব ফেলে একসাথে খাবার খেতে হবে। খাবারের টেবিলে সবাই গোল হয়ে বসে আছে। জিনিয়া আর কাজের মহিলা মালতী চাচী সবাইকে সার্ভ করে দিচ্ছে। আগে অবশ্য জিনিয়া আর অথৈ সার্ভের কাজটা করতো। কিন্তু অথৈ প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে সে ফুল রেস্টে আছে।

ইশাত বোল থেকে ঊষার প্লেটে ভাত বেড়ে দিলো। আদিল জগ থেকে পানির গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো। অরূপ কতগুলো তরকারির বাটি সামনে এগিয়ে দিলো। ঊষার পছন্দমতো যাতে যেকোনো একটা নিতে পারে। বোনের খাবারের তদারকি পাঁচ ভাই নিজে করবে। এক্ষেত্রে তারা অন্য কাউকে দায়িত্ব দিবে না। অর্ণব ভাতের প্লেট থেকে এক লোকমা খাবার তুলে ঊষার মুখের সামনে ধরলো। ঊষা চুপচাপ মুখে খাবার নিয়ে খেতে লাগলো। অরূপ চিংড়ি মাছের তরকারির বাটি থেকে বড় মাছটা ঊষার প্লেটে তুলে দিতেই ছোঁ মেরে সেটা ঈশান নিজের প্লেটে নিয়ে নিলো। সবাই চোখ রাঙিয়ে ঈশানের দিকে তাকাতেই ঈশান মাছে একটা বড়সড় কামড় বসিয়ে সামনের পাটি দাঁত দেখিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— বোনু এতবড় মাছ খেতে পারবে না। তাই আমি একটু কমিয়ে দিচ্ছি।

ঊষা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চিৎকার দিয়ে বললো,
— তোর কি আমার সাথে না লাগলে ভালো লাগে না?

ঈশান দাঁত দেখিয়ে আবারো হেসে বললো,
— নারে কালুর মা।

ঊষা “কালুর মা” ডাকটা শুনে আরো রেগে গেলো। আদিলকে বিচার দিয়ে বললো,

— মেজো ভাইয়ু ওকে কিছু বলো। ও সবসময় আমার সাথে কেন লাগে?

ঈশান ভেংচি কেটে বললো,
— এই তোর সাথে কোথায় লাগলাম? আমি তোর থেকে কতদূরে আছি দেখতো।আসলে তোকে সবাই এত আদর করে আমার সহ্য হয় না। কই আমিও তো ছোট আমাকে তো এত আদর করে না। সব তোর জন্য কেন?

ঈশানের কথার উত্তর ঊষা দেওয়ার আগে আদিল বলে উঠলো,

— শান, আবারো তুই বোনুর সাথে জোড়া দিচ্ছিস?তুই ভালো করে জানিস ওর এত আদর-যত্ন কেন? আমাদের দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র বোন। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন। তাই অতি আদরের হবে তো।

ঈশান খাবার মুখে দিয়ে চিবাতে চিবাতে ব্যঙ্গ সুরে বললো,
— হ্যাঁ এর জন্য তো কালুর মা গর্দভ হচ্ছে। কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না। লোকটাকে গতকাল ঠাটিয়ে এক চড় মারলে কি এত কাহিনি হতো?

অর্ণব ধমকে উঠলো,
— কি হচ্ছে এসব শান?

ঈশান চুপ হয়ে গেলো। ঊষার মাঝে মাঝে নিজের ওপর রাগ হয়। কেন সে নিজের সাথে কিংবা অন্যের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে না? তার ভাইরা তাকে ক্যারাটে শেখার প্রশিক্ষণে দিয়েছিলো। যাতে সে অন্তত সেল্ফ ডিপেন্ডড হতে পারে। দুই দিন গিয়ে ঊষা সে যে ফিরলো। তারপর তাকে আর কেউ জোর করেও নিতে পারেনি। ঊষা জানে ঈশান তাকে রাগিয়ে তার নিজের মধ্যে একটা জেদ সৃষ্টি করতে চাইছে। যে জিদে সে নিজেকে রক্ষা করতে শিখবে। কিন্তু ঊষার মধ্যে সেই স্পৃহা নেই। সে মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে লাগলো। এবার অর্ণবের থেকে আদিল প্লেট নিয়ে বোনের দিকে এক লোকমা খাবার এগিয়ে দিয়ে সবাইকে বললো,

— আমার বোনুকে রক্ষা করতে আমরা পাঁচ ভাই আছি। তাই কোনকিছু করার দরকার নেই। যেই বোনকে রক্ষা করতে তার পাঁচ ভাই আছে তার কি কোন ভয় থাকতে পারে?

ঊষার দিকে এগিয়ে দেওয়া আদিলের হাতের খাবার, ঊষার আগেই ইশাত মুখে নিয়ে দুষ্টামি হাসি দিয়ে আদিলের কথার সমর্থন জানিয়ে বললো,

— একদম না। জরিনার মা বলে কথা!

ঊষা চেচিয়ে উঠলো,
— তোমরা কি শুরু করছো ভাইয়ু😤? একজন আমার মাছ নিয়ে যাও। আরেকজন আমার মুখের সামনের খাবার নিয়ে যাও। কি শুরু করছো বলো তো?ভালো হয়ে যাও তোমরা।

সবাই একসাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। এটা রোজকার কাহিনি। ইশাত,ঈশানের কাজই বোনের সাথে লাগা। ঈশান অবশ্য বেশি লাগে। খাবার টেবিলে ওদের খুনশুটি লেগেই থাকবে। জিনিয়া, অথৈ চুপচাপ নিরব দর্শকের ভূমিকা রাখে। ভাই-বোনদের মধ্যে তারা কোন কথা বলে না। অনল ঘাপটি মেরে অথৈর কোলে বসে আছে। বড় চাচিকে তার ভীষণ পছন্দ। সবসময় এর সাথে থাকতে পছন্দ করে। শুধু খাবার আর ঘুম জিনিয়ার কাছে। বাকিসব কিছুতে অথৈ।

হাসি,ঠাট্টা, খুনসুটিতে সবাই খেতে লাগলো। জিনিয়ার বুক চিড়ে একটা বিষাদের নিঃশ্বাস বয়ে গেলো। কতদিন ধরে তার ছোট ভাইটাকে এক নজর দেখে না। ওর সাথেও এমন খুনসুটি ছিলো। পাঁচ ভাইদের তার বোনকে আদর করতে দেখলে তারও ভাইয়ের কথা মনে পরে। কোথায় যে রাগ করে নিরুদ্দেশ হলো! কেউ জানে না। জিনিয়া মনে মনে বললো,

— ভাই, তুই যেখানে থাকিস ভালো থাকিস।

~~~পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্কের একটি হলো ভাই-বোনের সম্পর্ক।

#চলবে

#আমার_বোনু
#Part_03
#Writer_NOVA

গাছের ডালে ঝিঁঝি পোকার ডাক। দূর থেকে মাঝে মাঝে নাম না জানা পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। সামনে তাকালে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ।ইরি ধানের মৌসুম চলছে।বিশাল এরিয়া জুড়ে রোপণ করা হয়েছে ধান। সবুজ ধানখেতের মধ্যে ঘাসফড়িং লাফাচ্ছে। বিকেলে যেনো এই পরিবেশটা আরো বেশি মোহনীয় হয়ে যায়। নিরিবিলি, নির্জন একটা ছোট গ্রাম। গ্রামের যেদিকে তাকায় সেদিকে সবুজ ধানের মাঠ। এ যেনো কবির কথিত ছায়াঢাকা, নিবিড়, সুজলা সুফলা, শান্তিপূর্ণ, এক গ্রাম।

দোচালা এক পাকা মেঝের ঘরের নাগ বারান্দার মধ্যে বেতের চেয়ারে বসে আছে আটাশর্ধো এক যুবক। হাতে তার ইংরেজি সাহিত্যের একটি উপন্যাসের বই। মনযোগ সহকারে উপন্যাসের পাতায় চোখ বুলাচ্ছে। উপন্যাসের নাম “কিস দ্যা গার্লস”।’কিস দা গার্লস’ এর লেখক- জেমস প্যাঁটারসন। অনুবাদ করেছেন, অনীশ দাস। মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মত একটি বই। এই গল্পে সিরিয়াল কিলার দুই জন। এক জন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে সুন্দরী,বুদ্ধিমতী মেয়েদের অপহরণ করছে ক্রমাগত ভাবে। সে মেয়েদের কাছে নিজেকে বিশ্বপ্রেমিক ক্যাসানোভা দাবী করে। সে মেয়েদেরকে বন্দী করে রাখে তার গোপন আস্থানাই সেখানেই তাদের উপর চলে বিভিন্ন অত্যাচার ও বিভিন্ন খামখেয়ালী পরীক্ষা নিরীক্ষা। অপরজন লস-এঞ্জেলসে বর্ণনাতীত নৃশংস খুন করে সৃষ্টি করছে আতংক। দুই জনই খুবই প্রতিভাবান এবং কৌশলী খুনি তাদের পতিটি খুন হল পারফেক্ট ক্রাইম। (তথ্যসূত্রেঃগুগোল)

যুবকটি খুব মনোযোগ দিয়ে উপন্যাস পড়ছে। তার অগোছালো কোঁকড়ানো চুলগুলো ভেজা। যা দেখে বোঝা যাচ্ছে সদ্য স্নান শেষ করেই বই নিয়ে বসেছে। চুলের কার্ণিশ বেয়ে টুপটাপ কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো বইয়ের পাতায়। তাতে যুবকের কপাল বিরক্তিতে ঈষৎ কুঁচকে এলো। কিন্তু তাতে তার পড়ার ব্যাঘাত ঘটালো না। চরম রোমাঞ্চকর ও টানটান উত্তেজনা কাজ করছে। এই বুঝি সব রহস্যের সমাধান হলো। কিন্তু তার আগেই তার হাফ পেন্টে থাকা মোবাইলটা ভাইব্রেট হতে লাগলো। একবার মন স্থির করেছিলো কলটা ধরবে না। অনরবত ভাইব্রেশনের কারণে তার পড়ার ডিস্টার্ব হচ্ছে। চোখ, মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে মোবাইলটা পেন্টের পকেট থেকে বের করলো। মোবাইল স্কিনে প্রিয় বন্ধুর নামটা দেখে মুহুর্তে বিরক্তি পালিয়ে মলিন মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো। রিসিভ করে কানের কাছে মোবাইল ধরতেই ঐপাশ থেকে তার বন্ধু বললো,

— কোথায় তুই?

যুবকটি বইয়ের পাতার কোণার দিকে ছোট ভাজ করে বইটা বন্ধ করলো। তারপর মুচকি হেসে বললো,

— আছি কোন এক নাম না জানা দেশে।

অপরপাশ থেকে ধমকের সুরে বললো,
— ঐসব কাব্যিক ভাষার ডায়লগ অন্য কোথাও দিস। আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে।

ছেলেটার ঠোঁটে এখনও হাসি বজায় আছে। সবাই তাকে হন্যি হয়ে খুঁজছে এতে যেনো সে একটা পৈশাচিক আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে। তবে তার মনটা আকুল হয়ে আছে যাকে তার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে পরে আছে সে তাকে খুঁজছে কিনা সেটা জানতে। সাময়িক সময়ের জন্য ভাবনার ঘোরে চলে গিয়েছিলো সে। কিন্তু তার বন্ধুর ঝাঁঝালো গলার কন্ঠ শুনে ভাবনায় ফিরে এলো।

— ইয়ার্কি করিস আমার সাথে? তোর কি সবকিছু ইয়ার্কি লাগছে? তুই এমন নিরুদ্দেশ কেন হয়েছিস?

ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো যুবকটি,
— মাঝে মাঝে নিজের গুরুত্ব বুঝাতে সবার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হয়।

— তার মানে তুইও এখন পাগলামি শুরু করেছিস?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— তুই আমার কন্টাক্ট নাম্বার কোথায় পেলি? এটা তো কারো কাছে নেই?

অপরপাশে থাকা ব্যক্তিটা যুবকের কথার উত্তর না দিয়ে জোর গলায় বললো,

— আগে তুই আমার কথার উত্তর দে।

যুবকটির মুখে আবারো হাসির ছটা। তবে এবারেরটা ভিন্ন। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে সে। তাদের কথার মাঝে ভেতর থেকে এক মধ্য বয়স্ক লোক এসে ছেলেটিকে বললো,

— ভাতিজা খেতে এসো।

যুবকটি কানে মোবাইল ধরে রেখেই তাকে ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো,

— আপনি যান, আমি আসছি।

লোকটা এক মিনিটও দাঁড়ালো না। যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই ভেতরে চলে গেলো। যুবকটির দৃষ্টি এখন সামনের ধান খেতের ওপর নিবদ্ধ। সবুজ খেতের মধ্যে ধানের ছরা এসেছে। সেখানে কিছু সাদা বকের আনাগোনা। আকাশে নাম না জানা কিছু পাখি তাদের নিজস্ব সুরে ডাকতে ডাকতে শা করে উড়ে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ছেলেটি। মোবাইল অপর পাশ থাকা তার বন্ধু একটানা “হ্যালো,হ্যালো” করেই যাচ্ছে। সেদিকে যুবকের ভ্রক্ষেপ নেই। সে তো সবুজ ধানখেতের বাতাসে দোল খাওয়া দেখছে। ইস, কি সুন্দর দৃশ্য!

নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে চারপাশ। মাঝে মাঝে সে নিস্তব্ধতা কাটিয়ে রাতজাগা পাখি ডেকে উঠছে। তাদের শব্দে মনে হচ্ছে আধারটাকে কেউ চিড়ে ফেলছে। রুমের লাইট বন্ধ। অন্ধকারের মধ্যে জানালা খুলে বাইরের দিকে মুখ করে নিস্তব্ধ পরিবেশ উপভোগ করছে ঊষা। একাকিত্বটাকে এভাবে উপভোগ করার আনন্দ অন্যরকম। এর মধ্যে থাকে ভিন্ন একটা ভালো লাগা। হঠাৎ করে বাতি জ্বলে উঠলো। ঊষা চোখ কুঁচকে পেছনে তাকালো। ঈশান দেয়ালে হেলান দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

ঊষা কিছুটা বিরক্তি গলায় প্রশ্ন করলো,
— কি হয়েছে ছোট ভাইয়ু?

ঈশান তীক্ষ্ণ চোখে একবার বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— কি হয়েছে তোর?

ঊষা নিজের মনোভাব লুকিয়ে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে প্রতিত্তোরে বললো,

— আমার আবার কি হবে?

— দেখ আমাকে এসব মনভুলানো কথা বলিস না কালুর মা। যা জিজ্ঞেস করেছি তার স্ট্রেইট উত্তর দে।

ঊষা নড়েচড়ে বসে উত্তর দিলো,
— আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।

এতটুকু উত্তর দিতে ঊষার আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো সে তার ভাইকে মিথ্যে বলছে। সে তো ভালো নেই। ভেতরটা যে একজনের জন্য কাঁদে। তবুও ভাইদের পেরেশানি না লাগার জন্য কি সুন্দর ঝটপট মিথ্যে উত্তর দিয়ে দিলো। মনে মনে এর জন্য নিজেকে ধিক্কার জানালো ঊষা।

ঊষাকে চুপ থাকতে দেখে পাশ থেকে অরূপ বলে উঠলো,

— দেখছিস শান, আমাদের বোনু আমাদের থেকে কথা লুকানো শিখে গেছে। তার মানে সে অনেক বড় হয়ে গেছে।

ঊষা একপাশ ঘুরে ছিলো বলে অরূপকে খেয়াল করেনি। অরূপের কন্ঠস্বর পেয়ে চমকে উঠে বললো,

— তুমি কখন এলে অরূপ ভাইয়ু?

অরূপ ধীর পায়ে রুমের ভেতরে ঢুকলো। ঊষার সামনে দাঁড়িয়ে ঊষাকে বললো,

— দেখছিস তো তোর ঠিক থাকার নমুনা। তুই ঠিক নেই বোনু। তুই ঠিক থাকলে আমাকে অবশ্যই খেয়াল করতি।

ঊষা নিষ্পলক চোখে অরূপের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ভাইগুলোর থেকে কিছু আড়াল করতে পারে না সে। তাকে এক পলক দেখেই পাঁচ ভাই বলে দিতে পারে তার কখন কি প্রয়োজন। সে ভালো আছে নাকি মন্দ আছে সবকিছু, সবকিছু বুঝতে পারে তারা। ঊষার থেকে আবারো উত্তর না পেয়ে অরূপ ঊষার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। এক হাত ঊষার গালে ছুঁয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে তোর বোনু? আমাকে বলবি না?

ব্যাস এতটুকুই যথেষ্ট। ঊষা অরূপের বুকে ঝাপিয়ে পরলো। হু হু করে কেঁদে উঠলো। বোনের কান্নার আওয়াজে ঈশানের বুকটা ধরফর করে উঠলো। দৌড়ে ঊষার পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো। ভয়ার্ত গলায় বললো,

— কি হয়েছে তোর বোনু? কোন ছেলে তোকে ডিস্টার্ব করেছে? কেউ কিছু বলেছে? কার এতবড় সাহস আমার বোনকে কাঁদায়? একবার শুধু তার নাম বল। জ্যন্ত কবর দিবো আমি তাকে। তুই শুধু একবার বল তোর সাথে কে অসভ্যতামি করেছে।

ঊষা কোন কথা বললো না। হু হু করে একটানা কেঁদে যাচ্ছে। অরূপ এক হাতে বোনের মাথায় দিয়ে চুপ করে বসে আছে। সে যেনো পাথর হয়ে গেছে। তবে তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ঊষার চোখের পানি তাকে বড্ড পোড়ায়। অবশ্য শুধু তাকে নয় পাঁচ ভাইকেই পোড়ায়। ঈশান চেচিয়ে বাকি তিন ভাইকে ডেকে উঠলো,

— বড় ভাইয়া, মেজো ভাইয়া, ইশাত!

ডাকতে দেরী তিন ভাইয়ের বোধহয় আসতে দেরী হলো না। হন্তদন্ত হয়ে রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে তিনজনই একসাথে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে শান?

ঈশান একবার সবার দিকে তাকিয়ে ঊষার দিকে আঙুল বাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

— বোনু কাঁদছে।

তাদের বোন কাঁদছে এটা যে কারো কাছে স্বাভাবিক বিষয়। একটা মানুষ কাদতেই পারে। এতে সমস্যা কি?কিন্তু পাঁচ ভাইয়ের কাছে এটা অস্বাভাবিক। তাদের বোনের চোখের পানি তাদের কাছে অনেক দামী। বোনকে এতটাই আদরে রাখে যে তার চোখের পানি কখনো আসতে দেয় না। বোনের চোখের পানি পরলে তাদের কলিজায় পানি থাকে না। তিন ভাই ভেতরে ঢুকে বোনকে ধরে ফ্লোরে বসে পরলো। আদিল চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞেস করলো,

— কে কি বলেছে বোনু? তুই কাঁদছিস কেনো?

ইশাত চোখ দুটো অগ্নিবর্ণ করে বললো,
— তোর চোখের পানির কারণ কে?

অর্ণব ঊষাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
— কি হয়েছে ভাইয়ুদের বল। নয়তো তাকে শাস্তি দিবো কি করে?

~~~যে এভাবে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু যে নিজ থেকে হারিয়ে যায় তাকে ততক্ষণ অব্দি খুজে পাওয়া যায় না, যতখন না সে নিজে ধরা দেয়।

#চলবে