আমার বোনু পর্ব-০৬

0
329

#আমার_বোনু
#Part_06
#Writer_NOVA

— কি হয়েছে বোনু?

অর্ণবের ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন শুনে হালকা কেঁপে উঠলো ঊষা। রাতের খাবার শেষ করে একসাথে ছয় ভাই-বোন কথা বলতে বসেছে। ঊষা একবার অরূপের দিকে তাকালো। অরূপ হাত নাড়িয়ে হেসে অনলের সাথে কথা বলছে। ঊষা অরূপকে বারবার গাড়িতে বলে দিয়েছিলো এসব কথা বাকি ভাইদের কানে না দিতে। কিন্তু ছেলেটা শুনেনি। আদিল চোখ কুঁচকে বোনের ভাবভঙ্গি খেয়াল করছিলো। ওর উত্তর না পেয়ে শান্ত গলায় বললো,

— বড় ভাই কিছু জিজ্ঞেস করেছে বোনু?

ঊষা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে আমতা আমতা আমতা উত্তর দিলো,
— হ্যাঁ, মেজো ভাইয়ু।

— তাহলে উত্তর দিচ্ছো না কেনো?

ঊষা মাথা নিচু করে ঠোঁট উল্টে বললো,
— কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছে তাই বুঝতে পারছি না।

ইশাত সোফায় পা তুলে বোনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
— আজকাল ভাইদের থেকে খুব কথা লুকাতে শিখে গেছিস তুই বোনু।

ঊষা স্থির চোখে ইশাতের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। কি উত্তর দিবে তা তার জানা নেই। সত্যি তো আজকাল সে ভাইদের থেকে কথা লুকায়। তার কেন জানি সব বিষয়ে ভাইদের জড়াতে ভালো লাগে না। তার চিন্তা হয় সারাদিন ভাইরা কাজে ব্যস্ত থাকে৷ এর মধ্যে তাকে নিয়ে টেনশন করলে কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না। আর এসব উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে বা কি লাভ? কিন্তু ভাইদের তো কাজের থেকে বোন সবার আগে। ঊষা মাথা উঠিয়ে ঈশানের দিকে তাকালো। অনেকখন ধরে ঈশানের কোন সাড়াশব্দ আসছে না। তাকাতে দেখলো ঈশান ওর দিকে গভীর ধ্যানে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে এখুনি মুখ খুলে ওকে বকবে।তবে তেমন কিছু হলো না। ঈশান জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে মেঝের দিকে নজর দিলো।

অরূপ অভিযোগের সুরে অর্ণবকে বললো,
— আমি ঠিক সময় না গেলে আজ তো ওরা বোনুর সাথে ঝামেলা পাকিয়ে ফেলতো।

অর্ণব তীক্ষ্ণ চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
— অরূপকে কেন এসব কথা বলতে বারণ করেছো তুমি? আমাদেরকে জানাতে মানা করার কারণ কি?

ঊষা ভাইয়ের চাহনি দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। সে আজকাল অল্পতে ভয় পেয়ে যায়। সবসময় মনে হয় এই বুঝি তার দ্বারা কোন ভুল হয়ে গেলো। যদিও সে ভুল করলে তার ভাইরা বকে না। সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে। তবে ইদানীং কি জানি হয়েছে তার। সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। ঈশান হালকা স্বরে ধমকে উঠলো,

— মুখে কি তালা লাগিয়ে রাখছিস? কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?

ঊষা ভাইয়ের আচমকা ধমকে জোরে চমকে উঠলো। সেই চমকানো আওয়াজ প্রতিটা ভাইয়ের চোখে পরলো। আদিল দ্বিগুণ জোরে ঈশানকে ধমক দিয়ে বললো,

— শান, যাস্ট শাট আপ। আমরা মজুদ থাকতেও তোর সাহস হয় কি করে বোনুর সাথে এভাবে কথা বলার? এখানে কথা বলার জন্য তোর বড় ভাই আছে, আমি আছি। বিষয়টা আমরা দেখবো। কথাটা আস্তে সুন্দর করে বলা যেতো,তুই জোরে কেন বলবি?

ঈশান নিজের রাগটাকে চেপে মাথা নিচু করে ফেললো। বড়দের সামনে উঁচু গলায় কারো সাথে কথা বলা বড়,মেজো দুই ভাইয়ের মধ্যে কারোরই পছন্দ নয়। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর অর্ণব,আদিল দুই ভাই মিলে বহু কষ্টে বাকি চার ভাই-বোনকে বড় করেছে। তাই এই দুজনের ওপর কথা বলার সাহস কারো নেই।এদের দুজনকে খুব মানে আর শ্রদ্ধাও করে।

ঈশান একবার বড় ভাইয়ের দিকে তাকালো। কিরকম শাতীল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চাহনিতে ঈশানের হৃৎপিণ্ডটা ধক করে উঠলো। আদিলের দিকে ফিরে মিনমিনে গলায় বললো,

— সরি মেজো ভাই। আসলে আমি রাগটা কন্ট্রোল করতে পারিনি।

অর্ণব শক্ত কন্ঠে বললো,
— রাগ কন্ট্রোল করতে শিখ। তোর থেকে ছোটরা শিখবে। তোদের থেকে অনলও শিখবে। বাচ্চাদের সামনে এমন কোন বিহেভ করবি না যাতে ওর মনে দাগ কাটে। ভয়ভীতি জন্মায়। বোনুর সাথে আমরা কথা বলছি। সেখানে তোর রাগ দেখানোর প্রশ্ন তো উঠেনি। বোনু কতটা ভয় পেয়ে চমকে উঠেছে তাতো দেখছিসই। এই কথাটা যেনো বারবার বলতে না হয়।

ঈশান একবার অনলের দিকে তাকালো। অনল ভয়ে অরূপের কোলে ঘাপটি মেরে জড়সড় হয়ে বসে আছে। পিটপিট চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে মুখ লুকালো অরূপের বুকে। অরূপ মাথায় হাত বুলিয়ে অনলকে বললো,

— চাচ্চু চলো আমি তোমাকে তোমার আম্মুর কাছে দিয়ে আসি।

অনল কথা বললো না। মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। অরূপ অনলকে কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। ইশাত স্বাভাবিক গলায় ঊষাকে বললো,

— তুই কি পুরো ঘটনা খুলে বলবি?

ঊষা আর কোন ঝামেলা চাইছে না। এখন না বললে ভাইদের মন-মেজাজ আরো খারাপ হতে পারে। তাই প্রথম থেকে সবকিছু খুলে বলতে লাগলো।

— ভাই, আপনি হঠাৎ আজ কলেজে?

তপুর কথায় আরান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। প্রশ্নটা যে তার পছন্দ হয়নি তা তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। কথার মধ্যে কিছু রাগ মিশ্রিত করে বললো,

— কেনো আসতে পারি না?

তপু জিহ্বায় কামড় দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,
— তা না ভাই। আপনি তো না বলে কখনো আসেন না। তাই জিজ্ঞেস করলাম।

আরান আগের থেকে রেগে উত্তর দিলো,
— আমাকে প্রশ্ন করার তুই কে?

তপু ভয়ার্ত চোখে বললো,
— কেউ না ভাই।

আরান এদিক সেদিক তাকিয়ে কাউকে খুজলো। তারপর তপুকে জিজ্ঞেস করলো,

— শামীম কোথায়?

তপুও সামনে পেছনে কিছু সময় চোখ বুলিয়ে বললো,
— আসে নাই মনে হয়।

— কালকে কি কাহিনী হইছে?

তপু আরানের কথায় অবাক হলো। কাল তো কোন ঝামেলা হয়নি। হলে তো তার জানার কথা। যদিও কলেজ ছুটির আগে সে চলে গেছে। তাই বিস্মিয় বজায় রেখে বললো,

— কই কিছু হয়নি তো ভাই?

আরান চোখ রাঙিয়ে বললো,
— কিছু না হলে কি আমি এমনি এমনি কলেজে আসি?

তপু পূর্বের থেকে কয়েকগুণ অবাক হয়ে বললো,
— কি ঘটনা ভাই?

আরান ঝাড়ি মেরে বললো,
— থাকিস কোন দুনিয়ায়? এতবড় ঘটনা ঘটে যায়। তাও তোদের হুশ থাকে না। এখন কি আমি তোকে কৈফিয়ত দিবো। শিকদার বাড়ির ছেলের থেকে তুই কৈফিয়ত চাস? সাহস তো দেখছি অনেক বাড়ছে।

তপু আবারো জিহ্বায় কামড় দিয়ে নিজের ভুল হয়েছে তা বুঝালো। আরান ওকে সাইড কাটিয়ে শার্টের কলার থেকে সানগ্লাসটা চোখ পরতে পরতে ভেতরে চলে গেলো। তপু মিনিট দুই দাড়িয়ে থেকে কাহিনি বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর আরানের পিছু দৌড় দিলো।

ছয় থেকে সাতটা ছেলে ঊষাকে ঘেরা দিয়ে রেখেছে। কলেজের ভেতর ঢোকার কিছু সময় পর এই বিপদে পরেছে সে। ঈশান ওকে কলেজের গেইট অব্দি এগিয়ে দিয়ে চলে গেছে। গতকাল থেকে ঊষার সাথে ঈশান একটু ভার হয়ে আছে। ভাইদের কাছ থেকে বকা খেয়ে সে ঊষার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। এরকম মাঝে মাঝে হয়। ঈশানের আবার গাল ফুলিয়ে রাখার অভ্যাস ছোট থেকেই। এতে ঊষা সুযোগ বুঝে মজাও নেয়।

তারিনের আসার খবর নেই। এই লেট লতিফা মেয়ের জন্য বেশিরভাগ সময় বিপদে পরে ঊষা। কে বলেছিলো গতকাল ভেজাল করতো। এখন এই ভেজালের রেশ কতদিন টানতে হয় কে জানে।ঊষা মনে মনে আরেকদফা ঝারলো তারিনকে। এই ছেলেগুলোকে ঊষা চিনে না। তাদের লিডার ছেলেটা তার অপরিচিত নয়। কলেজের ট্রাস্টি বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ আরাভ শিকদারের একমাত্র বেপরোয়া, একগুঁয়ে, জেদী ছেলে আরান শিকদার। আরানের সাথে রূপান্তিকে দেখে ঊষার ভীষণ রাগ হলো। এই মেয়েটার কি জানের ভয় নেই? গতকাল অরূপ সাবধান করার পরও আজ আরানকে নিয়ে এসেছে। ঊষার আজ ভয় করছে না। তবে অনেক বিরক্ত লাগছে। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রূপান্তি চোখ দুটো বিষন্ন করে মুখটা একটুখানি করে ফেললো। সবি ঢং আরকি। তারপর মন খারাপের ভান করে আরানকে বললো,

— ভাইয়া, এই মেয়েটা গতকাল তার ভাইকে দিয়ে শামীম ভাইকে মার খাইয়েছে। শামীম ভাইয়াকে তো গতকাল মেরেই ফেলতো। ভাইয়া কি ভয় পেয়েছে ভেবে দেখেন, রাতে তার জ্বর এসে পরছে।

আরান বাইকের ওপর ভাব নিয়ে বসে সিগারেট ফুঁকছিলো। তপু এবার পুরো বিষয় বুঝতে পেরে মাথা নাড়ালো। এতখন তার মাথা হ্যাং হয়ে ছিলো। এখন সব ক্লিয়ার। রূপান্তির কথায় সিগারেট দূরে ছুড়ে ফেলে ঊষার দিকে তাকালো। ঊষাকে দেখে তার মাথা খারাপ। এটা যে তার জাত শত্রু ঈশানের বোন। ঈশান আবার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার ছেলে। এবার ঈশানের কারণে ছাত্রলীগের সভাপতি পদটা আরান পায়নি। এতে ঈশানের প্রতি আরানের ভীষণ ক্ষোভ।অবশ্য দুজনের সাথে শত্রুতাটা বহু পুরনো। সেই কলেজ লাইফ থেকে। ঊষাকে দেখে ঈশানের রাগটা দপ করে জ্বলে উঠলো। ধীর পায়ে ঊষার সামনে গিয়ে বললো,

— সমস্যা কি?

ঊষা সবেমাত্র ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ঈশানের নাম্বারটাই ডায়াল করেছে। সামনে ওর নাম্বারটা ছিলো। আরানের ধমকে সে চমকালো না। তবে কোন কথাও বললো না। মোবাইলটা কানে দেওয়ার আগেই আরান সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো। চেচিয়ে বললো,

— এই মেয়ে তোমাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি? তুমি আমার কথার উত্তর না দিয়ে কোন সাহসে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত আছো? কাকে কল করছো তুমি? তোমার ঐ রাজনৈতিক নেতা ঈশান ভাইকে? আমার সামনে এতবড় স্পর্ধা তোমাকে কে দিয়েছে? উত্তর দিচ্ছো না কেনো? আরানের কথা না শোনার সাহস তুমি পেলে কোথায়?

ঊষা চুপ করে রইলো। তার ভেতর একটা চিনচিন রাগ উঠছে। সবাই পেয়েছে কি? গত কয়েকদিন ধরে সবাই তাকে ধমক দিয়ে বকে যাচ্ছে। সে কিছু বলে না বলে কি সবাই পার পেয়ে গেছে নাকি? রাগটা বাড়তে লাগলো। রাগের কারণে তার মনে কোন ভয় করছে না। ঊষা কথা না বলে হাত বাড়িয়ে তার মোবাইলটা আরানের হাত থেকে নিতে চাইলে আরান মোবাইল সরিয়ে ফেললো। রূপান্তি আগুনে ঘি ঢালার উদ্দেশ্য আরানকে বললো,

— দেখছেন ভাইয়া দেখছেন, কি বেয়াদব মেয়ে? কোন কথা তো বলছে না। আবার আপনার থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিতে চাইছে।

ঊষা হাত দুটো মুঠ করে রাগটা হজম করে নিলো। রূপান্তির দিকে রাগী চোখে তাকাতেই রূপান্তি বাঁকা হাসলো। যার মানে হলো, “এবার ঠেলা সামলাও। আরো লাগতে আসবে আমার সাথে?” কয়েক সেকেন্ড পর একটা চেঁচানোর আওয়াজ এলো।

— আরান, তুই শুধু কয়েকটা মিনিট কলেজে দেরী কর। আমি আসতেছি।

ঈশানের গলার স্বর পেয়ে আরান এদিক সেদিক তাকালো। তখন তার খেয়াল হলো ঊষা মোবাইলে কাউকে কল করছিলো। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে ঈশানের নাম জ্বলজ্বল করছে। আর ঈশান গত পাঁচ মিনিট ধরে লাইনে ছিলো। আসলে ঊষা কল করার সাথে সাথেই ঈশান কল রিসিভ করেছিলো। কিন্তু গতকালের থেকে গাল ফুলে থাকার কারণে কোন কথা বলেনি। কিন্তু কিছু সময় চুপ করে থাকার পর দেখলো অন্য ঘটনা। তাই এত সময় চুপ করে পুরো কাহিনি বোঝার চেষ্টা করলো। এবং আরানের কথা শুনে বুঝেও গেলো। মিনিট দুই পর আরানের কি জানি হলো। রেগে কল কেটে মোবাইলটা ঊষার দিকে এক প্রকার ছুড়ে মারলো। ভাগ্যিস ঊষা মোবাইলটা ক্যাচ ধরে ফেলেছে। নয়তো ওর নাক ফাটতো৷আরান ব্যস্ত হয়ে পরলো যাওয়ার জন্য। মনে হচ্ছে কোন জরুরি কাজ পরে গেছে, এখুনি যেতে হবে। সে কি ঈশানের ভয়ে পালাতে চাইছে নাকি সত্যি কোন কাজ পরে গেছে তা ঊষা বুঝলো না।আরান একবার ঊষার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,

— তোমাকে আর তোমার ভাইকে আমি পরে দেখে নিবো।

তারপর বাইক নিয়ে ছুট। তপু ও তার সাথের ছেলেগুলো কিছু বুঝলো না। বিস্ময় নিয়ে আরানের চলে যাওয়া দেখলো। রূপান্তি রাগে,জিদে মৃদুস্বরে চিৎকার করে উঠলো। প্রতিবার ঊষা বেঁচে যাচ্ছে। ঊষা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রূপান্তিকে ভেংচি কেটে চলে গেলো।

~~~ আমাদের কম-বেশি সবার মনে একটা আফসোস থাকে। তা হলো আমরা যা চাই তা পাই না। আর যা পাই তা চাই না। কিন্তু আমাদের একটা কথা মনে রাখা দরকার, “আল্লাহ যা করে তা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।”

#চলবে